স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। এ বিষয়ে রোগীরা কী করতে পারেন। এসব রোগ প্রতিরোধ ও চিকিৎসার জন্য রোগীদের করণীয় কী? এসব বিষয়ে লিখিত প্রশ্নের উত্তরে সাপ্তাহিক-এর সঙ্গে নিজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেছেন ঢাকাস্থ শের-ই-বাংলা নগর ন্যাশনাল ইনস্টিটিউট অব নিউরো সায়েন্সেস ও হাসপাতালের ক্লিনিক্যাল নিউরোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. এম. এস জহিরুল হক চৌধুরী।
সাক্ষাৎকার নিয়েছেন সুইটি আক্তার,
ছবি তুলেছেন কাজী তাইফুর
সাপ্তাহিক : স্ট্রোক কী ধরনের অসুখ?
ডা. এম. এস. জহিরুল হক চৌধুরী : স্ট্রোক মস্তিষ্কের একটি রোগ যাতে রক্তনালির জটিলতার কারণে হঠাৎ করে মস্তিষ্কের একাংশের কার্যকারিতা হারায়। মনে রাখতে হবে স্ট্রোক হার্টের কোনো রোগ নয়।
সাপ্তাহিক : স্ট্রোকের লক্ষণসমূহ কী কী?
ডা. এম. এস. জহিরুল হক চৌধুরী :
১. হঠাৎ করে শরীরের একাংশ অবশ বা দুর্বল হয়ে যাওয়া।
২. মাথাব্যথা ও বমি হওয়া।
৩. হঠাৎ অজ্ঞান হওয়া।
৪. কথা জড়িয়ে যাওয়া, বা একেবারেই কথা বলতে না পারা।
সাপ্তাহিক : স্ট্রোক হলে তাৎক্ষণিক কী করণীয় ?
জহিরুল হক চৌধুরী : কোনো রোগীর উপরের লক্ষণসমূহ দেখা দিলে বুঝতে হবে তার স্ট্রোক হয়েছে। এ ক্ষেত্রে আতঙ্কিত না হয়ে জরুরি ভিত্তিতে ডাক্তারের পরামর্শ নেয়া উচিত। প্রয়োজনে নিকটস্থ হাসপাতালের জরুরি বিভাগে নেয়া উচিত। সম্ভব হলে মস্তিষ্কের CT Scan করে স্ট্রোকের ধরন বুঝতে হবে। মনে রাখতে হবে স্ট্রোক দুই ধরনের হয়। মস্তিষ্কে রক্ত চলাচল ব্যাহত হওয়ার জন্য (Ischemic Stroke) অথবা মস্তিস্কে রক্তক্ষরণের জন্য (Hemorrhagic Stroke) এবং যার চিকিৎসা পদ্ধতিও ভিন্নতর।
জরুরি চিকিৎসা : অজ্ঞান রোগীর ক্ষেত্রে-
১. শ্বাসনালি, শ্বাসপ্রশ্বাস ও রক্ত সঞ্চালন নিয়মিত রাখা। ২. রোগীকে একদিকে কাত করে, বালিশ ছাড়া মাথা নিচু করে শোয়াতে হবে। ৩. চোখের যতœ নিতে হবে। ৪. মূত্রথলির যতœ (প্রয়োজনে ক্যাথেটার দিতে হবে)।
৫. খাবারের ব্যবস্থা করতে হবে।
স্ট্রোকের সব রোগী হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন হয় না। তবে মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ, খিঁচুনি, রোগী অজ্ঞান হলে, অথবা স্ট্রোকের সঙ্গে অন্যান্য রোগ যেমন- উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি থাকলে হাসপাতালে ভর্তির প্রয়োজন। চিকিৎসার প্রধান উদ্দেশ্য মৃত্যুর ঝুঁকি কমানো, কর্মক্ষমতা ফিরিয়ে আনা এবং পরবর্তীতে যেন স্ট্রোক না হয় তার ব্যবস্থা করা (Secondary Stroke Prevention)।
সাপ্তাহিক : প্যারালাইসিস হলে বা মুখ বেঁকে গেলে কী করা যায় ?
জহিরুল হক চৌধুরী : বিশেষজ্ঞ ডাক্তারের পরামর্শ মোতাবেক চিকিৎসা এবং ফিজিওথেরাপি করতে হবে।
সাপ্তাহিক : বাংলাদেশে স্ট্রোকের হার কত ? কত শতাংশ মানুষ এর ঝুঁকির মধ্যে আছে ?
জহিরুল হক চৌধুরী : আমাদের দেশে স্ট্রোকের হার প্রতি হাজারে ৫-১২ জন হয়। প্রায় ৫ শতাংশ মানুষ ঝুঁকির মধ্যে আছে।
সাপ্তাহিক : স্ট্রোক প্রতিরোধের উপায়সমূহ ?
জহিরুল হক চৌধুরী : স্ট্রোক অনেকাংশেই প্রতিরোধযোগ্য। স্ট্রোক প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন সচেতনতা। যেমন- রক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ, ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণ, ধূমপান পরিহার করা, রক্তের চর্বি নিয়ন্ত্রণ, শারীরিক ব্যায়াম নিয়মিত করা, ওজন ঠিক রাখা, প্রতিদিন পর্যাপ্ত পরিমাণ শাকসবজি, সতেজ ফলমূল খাওয়া।
সাপ্তাহিক : কত শতাংশ রোগী সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয়?
জহিরুল হক চৌধুরী : চিকিৎসা করলে ৩০ শতাংশ সম্পূর্ণরূপে সুস্থ হয় আর ৩০ শতাংশ পক্ষাঘাতগ্রস্ত থাকে।
বয়স : সাধারণত স্ট্রোক চল্লিশোর্ধ্ব রয়স্ক মানুষের বেশি হয়। তবে অল্প বয়সেও স্ট্রোক হতে পারে।
কারণ : স্ট্রোকের বিভিন্ন কারণ থাকলেও নিম্নোক্ত বেশিরভাগ স্ট্রোক হয়ে থাকে।
ডায়াবেটিস, উচ্চ রক্তচাপ, রক্তে অতিরিক্ত চর্বি/কোলেস্টেরল, ধূমপান।
এছাড়া বিভিন্ন জন্মগত ত্রুটির কারণেও স্ট্রোক হতে পারে।
সাপ্তাহিক : স্ট্রোকের সঙ্গে নিউরোর সম্পর্ক কী?
জহিরুল হক চৌধুরী : স্ট্রোক ও নিউরো ওতপ্রোতভাবে জড়িত। কারণ স্ট্রোক মস্তিষ্কে হয়ে থাকে তা বিভিন্ন কারণে ও ধরনের হতে পারে কিন্তু স্ট্রোক মস্তিস্ক অর্থাৎ ব্রেইনের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট। কিন্তু নিউরো শব্দটির ব্যাপকতা অনেক। ব্রেইন ও স্পাইনাল কর্ড (স্নায়ু বস্তু) সেন্ট্রাল নার্ভাস সিস্টেম এবং সারা শরীরে স্নায়বিক সংযোগ পেরিফেরাল নার্ভস সিস্টেম এর সঙ্গে যুক্ত। তাই নিউরো একটি বৃহৎ ব্যাপার। স্ট্রোক তার একটি অংশ।
সাপ্তাহিক : রোগীদের নিয়ে আপনার অভিজ্ঞতা?
জহিরুল হক চৌধুরী : রোগীদের নিয়ে অভিজ্ঞতা বলতে গেলে অনেক সময় প্রয়োজন শুধু এই বিষয়েই ঘণ্টার পর ঘণ্টা বলা যাবে। যেহেতু আমার ক্ষুদ্র জীবনে অনেক রোগী দেখার অভিজ্ঞতা আছে। তবে মূল বিষয় হলো কোনো রোগী যখন সেবা নিয়ে ভালো জীবনযাপন করে অথবা সুস্থ হয় তখন অনেক ভালো অনুভব করি। আবার অনেক কষ্ট করে রোগ নির্ণয়ের পর যখন দেখি রোগটির পরিপূর্ণ চিকিৎসা নেই তখন খুব খারাপ লাগে।
সাপ্তাহিক : কী কী ধরনের রোগ নিয়ে রোগীরা আপনার কাছে ্ আসে?
জহিরুল হক চৌধুরী : সাধারণত নিউরোলজিক্যাল সমস্যার রোগীরাই বেশি আসে। তা ছাড়া মেডিসিন, সাইকিয়েট্রি, অর্থোপেডিকসের রোগীও এসে থাকে। কিছু রোগী আসে যারা হয়তো অন্য বিভাগের চিকিৎসকদের দেখিয়েছেন এখন তার নিউরোলজি সংক্রান্ত সমস্যা হচ্ছে সেসব বিষয়ে আমার অভিমত নেয়ার জন্য আসেন। মোটকথা সব ধরনের রোগীই আসে তবে নিউরোলজির রোগীই বেশি আসে।
সাপ্তাহিক : নারী ও পুরুষ রোগীদের মধ্যে আপনি কাদের বেশি প্রাধান্য দেন?
জহিরুল হক চৌধুরী : দেখুন নারী-পুরুষ শব্দটি চিকিৎসকদের কাছে কখনো আলাদা নয়। আমরা চিকিৎসা করি রোগীর। একটি প্রবাদ আছে Doctors Have no Sex. চিকিৎসক লিঙ্গবৈষম্য করতে পারে না। আর প্রাধান্য অবশ্যই রোগ ও রোগীর আস্থা অনুযায়ী দিয়ে থাকি, আছিও। কিছু কিছু ক্ষেত্রে সম্পূর্ণরূপে মানা সম্ভব হয় না সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে। তবে অবশ্যই জরুরি রোগী এবং বৃদ্ধ, অনেক ক্ষেত্রে মহিলাদের প্রাধান্য দেওয়া হয়ে থাকে।
সাপ্তাহিক : কোন কোন রোগের চিকিৎসা আপনি করে থাকেন?
জহিরুল হক চৌধুরী : স্ট্রোক, প্যারালাইসিস, মাথাব্যথা, খিঁচুনি।
সাপ্তাহিক : আমরা বুঝব কীভাবে এই রোগে আক্রান্ত হয়েছি এবং কীভাবে প্রতিরোধ করব?
জহিরুল হক চৌধুরী : নিউরো অর্থাৎ স্নায়ুরোগ আক্রান্ত হওয়ার অনেক লক্ষণ আছে তার মধ্যে অন্যতম হলো মাথ্যব্যথা, চোখে-মুখে ব্যথা, মাথা ঘুরানো, অজ্ঞান হয়ে যাওয়া, খিঁচুনি হওয়া, ভুলে যাওয়া, দুর্বলতা, চলাফেরা বা মুভমেন্ট করতে অসুবিধা হওয়া, কথা বলতে অসুবিধা হওয়া, চোখের পাতা পড়ে যাওয়া, ডবল দেখা, কানে শুনতে অসুবিধা হওয়া, প্রস্রাব আটকে যাওয়া, ঘুমের সমস্যা হওয়া ইত্যাদি সব রকমভাবেই নিউরোলজিক্যাল সমস্যা শুরু হতে পারে। এসব লক্ষণ দেখা গেলে আপনি চিন্তা করতে পারেন।
প্রতিরোধ বলতে কিছু কিছু রোগ যেমন স্ট্রোক প্রতিরোধ করা যায় রক্তচাপ ও ডায়াবেটিস নিয়ন্ত্রণে ও খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তনের মাধ্যমে। অবশ্য ধূমপান ও তামাক পাতা বাদ দেয়াসহ ব্যায়াম এবং শরীর চর্চার মাধ্যমে দুশ্চিন্তামুক্ত একটি জীবনযাপন করতে হবে।
সাপ্তাহিক : আমাদের লাইফ স্টাইল ও খাদ্যাভ্যাসে কোনো পরিবর্তন আনতে হবে কিনাÑ এ সম্পর্কে কিছু বলবেন?
জহিরুল হক চৌধুরী : অবশ্যই খাদ্যাভ্যাসে ও লাইফ স্টাইলে পরিবর্তন আনতে হবে যদি স্ট্রোকের ঝুকি কমাতে চান। ধূমপান পরিহার করতে হবে। চর্বি জাতীয় খাবার এবং রেড মিট অর্থাৎ গরুর মাংস, খাসির মাংস ইত্যাদি কম খেতে হবে। প্রতিদিন অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করতে হবে।
সাপ্তাহিক : রোগীরা ডাক্তারদের নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করে আপনি এ সম্পর্কে কী বলবেন?
জহিরুল হক চৌধুরী : এটি একটি আপেক্ষিক বিষয়। কোনো কোনো রোগী বিরূপ মন্তব্য করলেও অধিকাংশ রোগী চিকিৎসককে এখনও শ্রদ্ধা করেন এবং ভালোবাসেন। মন্তব্যগুলো যদি গঠনমূলক হয় তাহলে আমি অবশ্যই তার মধ্যে নিজেকে সংশোধনের চেষ্টা করি। কেউ কেউ অহেতুক মন্তব্য করে যার কোনো ভিত্তি নেই। যেগুলো আমলে নিলে সামনে এগুনো যাবে না।
সাপ্তাহিক : রোগীদের থেকে আপনি কী ধরনের আচরণ আশা করেন?
জহিরুল হক চৌধুরী : আমরা রোগীদের সেবার মানসিকতা হৃদয়ে ধারণ করি। আমরা সেবাদাতা রোগীরা সেবা গ্রহীতা। তাদের মধ্যে উদ্বেগ, উৎকণ্ঠা থাকতে পারে। আমরা আশা করি রোগীরা ধৈর্য সহকারে চিকিৎসকের ওপর আস্থা রাখবেন।
সাপ্তাহিক : এই রোগের চিকিৎসা অনেক ব্যয়বহুল। গরিব রোগী বাঁচাবে কীভাবেÑ এর উপায় কী?
জহিরুল হক চৌধুরী : সব রোগে চিকিৎসা ব্যয়বহুল নয়। কিছু কিছু নিউরোলজির চিকিৎসা ব্যয়বহুল তবে পরীক্ষা যেমন সিটি স্ক্যান, এমআরআই ইত্যাদি খরচ বেশি। সরকারকে এসব পরীক্ষা পর্যায়ে চালু করতে হবে এবং জেলা পর্যায়ে নিউরোলজিস্ট পদায়ন করতে হবে তাহলে হয়তো গরিব রোগী নিজ এলাকাতে সহজে চিকিৎসা পেতে পারেন।
সাপ্তাহিক : এই হাসপাতালে আপনার কাজের অভিজ্ঞতা কেমন?
জহিরুল হক চৌধুরী : নিনস একটি বিশেষায়িত দেশের নিউরোলজির সর্বোচ্চ সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠান হিসেবে পরিচিতি হয়েছে। এই প্রতিষ্ঠানে কাজ করতে পেরে নিজেকে সৌভাগ্যবান মনে করি। এখানে রোগীর চাপ অনেক বেশি, তারপরও আমরা চেষ্টা করি মানুষকে ভালো সেবা প্রদান করার জন্য।
সাপ্তাহিক : স্ট্রোক এবং হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে পার্থক্য কী?
জহিরুল হক চৌধুরী : স্ট্রোক ও হার্ট অ্যাটাকের মধ্যে বড় তফাৎ হলো স্ট্রোক মস্তিষ্কে হয়; হার্ট অ্যাটাক হার্টে হয়। কারণগুলো যেমন উচ্চ রক্তচাপ, ডায়াবেটিস ইত্যাদি যদিও দুটোর মধ্যে মিল রয়েছে। এর পার্থক্য একজন চিকিৎসক সহজেই কিছু শারীরিক পরীক্ষার মাধ্যমে নিরূপণ করতে পারেন।
Bookmark and Share প্রিন্ট প্রিভিও | পিছনে
সাক্ষাৎকার
‘প্রতিদিন আমাদের অন্তত ৩০ মিনিট হাঁটার অভ্যাস করতে হবে’-ডা. এম. এস. জহিরুল হক চৌধুরী
shaptahik.com
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন