বাংলা অঞ্চলে ইসলাম ধর্মের বিস্তার কীভাবে ঘটল, তা নিয়ে পরস্পরবিরোধী কয়েকটি জনপ্রিয় তত্ত্ব চালু আছে উনিশ শতকের শেষ দিক থেকেই। বিশ শতকের শেষ দিকে দৃশ্যপটে রিচার্ড ম্যাক্সওয়েল ইটনের আগমন সব বদলে দিল। পুরনো সব ধারণাকে সরল অথচ প্রায় অকাট্য তথ্যপ্রমাণ ও যুক্তিকে খারিজ করে দিয়ে ইটন আনলেন একদম নতুন ব্যাখ্যা। ১৯৯৩ সালে প্রকাশিত রাইজ অব ইসলাম অ্যান্ড দ্য বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার (১২০৪-১৭৬০) বাংলার ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে একটা যুগান্তর এনেছে, যদিও এটিই তার একমাত্র গুরুত্বপূর্ণ কাজ নয়। ভারতবর্ষের ইতিহাস নিয়ে রিচার্ড ইটনের অন্যান্য গ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ইন্ডিয়া’স ইসলামিক ট্র্যাডিশনস ৭১১-১৭৫০, অ্যাসেজ অন ইসলাম অ্যান্ড ইন্ডিয়ান হিস্টরি।
ইতিহাস সমিতির ৫০ বছর পূর্তির আয়োজনে আরো কয়েকজন বিশ্বখ্যাত ইতিহাসবিদের সঙ্গে ইটনও এসেছিলেন বাংলাদেশে। তিনি এ বছরই ৮ ডিসেম্বর ৭৬ বছর পূর্ণ করলেন। ইতিহাস সমিতির অনুষ্ঠান ছাড়াও বক্তৃতা দিয়েছেন বেশ কয়টি জায়গায়। সবখানেই পাঠ করেছেন নতুন প্রবন্ধ। এ বয়সেও সমান সক্রিয় ইটন ঘুরতে গিয়েছিলেন সুন্দরবনেও।
সেন্ট্রাল উইমেন্স ইউনিভার্সিটিতে তার বক্তৃতার পর চায়ের বিরতিতে এই ব্যস্ত সূচির মধ্যেও একটি সাক্ষাতের সময় ঠিক করা গেল। পারভীন আপা বন্দোবস্ত করে দিলেন, পরদিন সকালবেলা নাশতার ফাঁকে যতটুকু পারা যায় তার সঙ্গে কথা বলে নেয়া যাবে। তার কাজগুলো পড়তে পড়তে নানা সময়ে যে প্রশ্নগুলো জেগেছিল, তা নিয়ে কিছু আলাপ করতে আর বিশেষত ব্যক্তিগত মুগ্ধতার প্রকাশ ঘটাতে জোনায়েদ সাকির সঙ্গে হাজির হলাম ড. পারভীন হাসানের বাড়িতে, সেখানেই উঠেছিলেন ইটন। আলাপটুকু হলো সকালের খাবারের মাঝেই, কিছুক্ষণ পরই তাকে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিতে যেতে হবে।
অনুমিত কারণেই প্রথম প্রশ্নটা ছিল: কীভাবে এই অনুসন্ধানের শুরু? উত্তরে ইটন যা বললেন, তার জন্য ঠিক প্রস্তুত ছিলাম না।
‘আমি আসলে দক্ষিণ এশিয়া নিয়ে আগ্রহী ছিলাম না। এর শুরুটা অনেক আগে, ১৯৬৩ সালে। আমি তখন খুবই তরুণ, আমি ইরানে ছিলাম। সেখানে আমি ফার্সি শিখেছিলাম। গবেষণায় এখনো ফার্সি ভাষাই সবচেয়ে কার্যকরভাবে ব্যবহার করতে পারি। আমি সেখানে দুই বছর ছিলাম। তার পর একটা সফরে বের হলাম। আমি ইরান থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম পাকিস্তান, বেলুচিস্তান, করাচি ও ভারতে একেবারে কলকাতা পর্যন্ত এলাম। এর পর আমি আফগানিস্তান হয়ে ইরানে ফেরত গেলাম। আমি তখন সত্যিই আগ্রহী হয়ে উঠলাম ইরান আর ভারতের যোগ-সম্পর্ক নিয়ে। বিশেষ করে দেখলাম অতিকায় সব স্থাপত্য, ভারত আর পাকিস্তান উভয় দেশেই... আমি তখনো পূর্ব পাকিস্তানে আসিনি, এটা তো তখন পূর্ব পাকিস্তানই ছিল। আমার আগ্রহ
লেখকের সঙ্গে রিচার্ড ইটন
লেখকের সঙ্গে রিচার্ড ইটন
জন্মাল দীর্ঘ একটা সময়জুড়ে ইরান-ভারতের সম্পর্ক নিয়ে— এ দুটি সভ্যতার অভিবাসন, মানুষের স্থানান্তর, প্রযুক্তি, ধ্যান-ধারণা, ধর্ম, শাসনের ধরন, রাজনীতি — অর্থাত্ ইরান ও ভারতের একটা দীর্ঘ ইতিহাস আছে পারস্পরিক লেনদেনের, এর সঙ্গে ধর্ম একটা অংশ মাত্র... ইরান থেকে আসা যে পারসি চাকা পাঞ্জাবে কৃষিকাজের বিস্তার ঘটিয়ে জাট জনগোষ্ঠীকে ইসলাম ধর্মের আওতায় নিয়ে এসেছিল, তা আমি তখনো দেখেছি পাঞ্জাবে। এখনো তা আছে ঝিলম, সুতলেজের পাঞ্জাবি গ্রামগুলোয়। আমি দেখেছি... তো আমি আগ্রহী হয়ে উঠলাম, কারণ আমি তখন ছিলাম খুবই অল্পবয়সী আর আমি দক্ষিণ এশিয়াকে দেখলাম পারসিক সংস্কৃতির চশমার ভেতর দিয়ে... ষাটের দশকে অনেকেই এখানে এসেছিলেন যোগশাস্ত্র শিখতে (হাসি), সংস্কৃত পড়তে বা হিন্দু ধর্ম সম্পর্কে আগ্রহী হয়ে। কিন্তু ভারতের সঙ্গে আমার পরিচয়ের সূচনা ইরানের মাধ্যমে, আমি যেহেতু এসেছিলাম ইরান থেকে এবং আমি ভাবলাম ইসলাম যদি এখানে ইরান থেকেই আসে, তাহলে কেন তা পশ্চিম বাংলাকে এড়িয়ে গেল এবং কীভাবে পূর্ব বাংলায় পৌঁছল। বুঝতেই পারছেন, এটি একটি বিরাট প্রশ্ন এবং কেউ এর উত্তর দেয়নি, কেউই এ প্রশ্নটা তোলেওনি। তো এভাবেই এ মানচিত্রের জটিলতাতেই আমি অনুসন্ধানের সূচনা করলাম।’
ধর্মান্তরকরণ বিষয়ে ইটনের নিজস্ব একটা মত আছে। ভারতীয় উপমহাদেশে ধর্মান্তরকরণ বলতে একটি বৃহত্ ধর্ম ত্যাগ করে অন্য একটি ধর্ম গ্রহণের ঘটনা বড় আকারে ঘটেনি, এমনটাই ইটনের সিদ্ধান্ত। যেমন— হিন্দু ধর্ম, ইসলাম ধর্ম ও খ্রিস্ট ধর্ম— এ তিন ধর্মের যে বিস্তার ভারতে ঘটেছে, তার মাঝে ব্যক্তিগত পর্যায়ে কিছু ধর্মান্তরের উদাহরণ থাকলেও ইটন দেখিয়েছেন, এ তিন ধর্মেরই অধিকাংশ অনুসারী এসেছে কোনো বৃহত্ ধর্মের কাঠামোর সঙ্গে ইতোপূর্বে যুক্ত নয়— এমন স্থানীয় জনগোষ্ঠী থেকে। এ স্থানীয় জনগোষ্ঠী নানা ধরনের লৌকিক ধর্মাচরণের সঙ্গে যুক্ত থাকলেও নগরায়ণ ও রাষ্ট্র এবং সাম্রাজ্যের বিকাশের ফল হিসেবে যে বিশ্বধর্মগুলোকে আমরা দেখি, সেগুলোর সঙ্গে সম্পর্কিত ছিল না। বরং তাদের এর আগের ধর্মাচরণ অনেকাংশেই সম্প্রদায় বা গোষ্ঠীর সঙ্গেই সম্পর্কিত এবং তার মাঝেই সীমিত। কিন্তু তারা যখন সাম্রাজ্যের বিস্তারের কারণে কোনো বৃহত্ রাষ্ট্র কাঠামোর সঙ্গে যুক্ত হয়ে পড়েন, যুক্ত হন উচ্চফলনশীল কৃষি, খাজনা, নগরায়ণ, আনুগত্য প্রভৃতি নতুন শর্তের সঙ্গে, সেই অনুযায়ী ধর্ম আর সংস্কৃতির রূপান্তর ঘটে। ফলে ভারতে এটি এক পুরনো ধর্ম থেকে আরেক ধর্মে ধর্মান্তর নয় ততটা, বরং সংস্কৃতির রূপান্তর এবং নিজস্বতা নিয়েই কোনো না কোনো বিশ্বধর্ম ও সভ্যতার অঙ্গীভূত হওয়ার প্রক্রিয়া। প্রক্রিয়াটি নিয়ে ইটন অন্তত তিনটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ করেছেন। একটি পাঞ্জাবে আধা মরুপ্রবণ অঞ্চলে যাযাবর জাট জনগোষ্ঠীর ইসলাম ধর্মের সঙ্গে যুক্ত হওয়া নিয়ে (দ্য পলিটিক্যাল অ্যান্ড রিলিজিয়াস অথরিটি অব দ্য শ্রাইন অব বাবা ফরিদ), যেখানে পারসি চাকা নামের ইরান থেকে আসা সেচের একটি নতুন প্রযুক্তি কৃষিকাজকে আধা মরুপ্রবণ এলাকায় সম্ভব করে তুলেছিল। ইটন দেখিয়েছেন, সুফি খানকাগুলো সেখানে ইসলামী সংস্কৃতি বিস্তারের একটা কেন্দ্র হিসেবে কাজ করেছে। তিনি আরেকটি কাজ করেছিলেন ভারতের নাগা জনগোষ্ঠীর খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ নিয়ে (কম্পারেটিভ হিস্টরি অ্যাজ ওয়ার্ল্ড হিস্টরি: রিলিজিয়াস কনভার্সন ইন মডার্ন ইন্ডিয়া)। কীভাবে ঔপনিবেশিক শাসনের অবসানের পরই নাগা জনগোষ্ঠীর খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণ সম্পূর্ণ হতে পারল, তা নিয়ে আলোচনায় ইটন আরেকটি নতুন বিষয় দেখিয়েছেন। নাগাদের লৌকিক ধর্মে এর আগে যেখানে সর্বোচ্চ দেবতার গুরুত্ব ছিল কম, তার ওপর মনোযোগও ছিল কম। বরং প্রাত্যহিক চাহিদা ও স্বার্থের সঙ্গে সম্পর্কিত দেবদেবীরাই বেশি গুরুত্বপূর্ণ ছিল। ঔপনিবেশিক আমলে তাদের অঞ্চল যখন প্রথম পরাক্রান্ত বিদেশীদের দ্বারা দখলীকৃত হয়, অঙ্গীভূত হয়, নতুন রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক বাস্তবতায় উচ্চাঙ্গের দেবতারা নতুন করে বাড়তি মনোযোগ পান। কেননা স্থানীয় সীমিত দায়িত্ব পালন করা দেবতা আর নতুন সৃষ্টি হওয়া চাহিদাগুলো সামলাতে সচেষ্ট থাকলেন না। তাই দরকার পড়ল সার্বভৌম নতুন শক্তির ধারণার। ইটন তাই এ চিন্তার সঙ্গে খুবই একমত যে, ধর্মপ্রচারকরা কী কী নতুন বাণী নিয়ে আসছেন সেটা নয়, বরং ওই জনগোষ্ঠী কী নতুন অভিজ্ঞতার ভেতর দিয়ে যাচ্ছে, তার নিরিখেই ধর্মান্তরের বিষয়টাকে বোঝা যাবে।
কিন্তু কুকি জনগোষ্ঠীর খ্রিস্টানত্বের ধরন নিয়ে তার সিদ্ধান্তটি পরিচয়ের রাজনীতির আন্তর্জাতিকীকরণের যুগে একটা সমস্যা কি সৃষ্টি করে? কেননা কুকিদের নিয়ে তার পূর্বোক্ত নিবন্ধের শেষে তিনি বলেছেন, ‘তিনি আর তার নিকট পূর্বপুরুষরা আত্মসচেতন এটাকে আদিবাসী নাগা ধর্মে রূপান্তর করেছেন, যেমনটা ইউরোপীয়রা আরো আগে এটাকে বানিয়েছিল ইউরোপীয় আদিবাসী ধর্ম।’ খ্রিস্ট ধর্ম গ্রহণের প্রয়োজন নাগাদের এ কারণেই ছিল যে, ‘নাগাদের খ্রিস্টান পরিচয় তাদের হিন্দু, মুসলিম বা ভারতীয় সমতলের অন্য সব জাতি থেকে আলাদাভাবে চিহ্নিত করে। এ পরিচয় তাদের ভারতীয় প্রজাতন্ত্রের সঙ্গে আত্তীকরণের বিরুদ্ধে চলমান প্রতিরোধের জন্য প্রয়োজন ছিল।’
এ খ্রিস্টানত্ব কি শেষ পর্যন্ত আদিবাসী বা লোকায়ত খ্রিস্টানত্বই থেকে যাবে এই বিশ্বায়নের যুগে, নাকি কোনো বৈশ্বিক মানদণ্ড খুঁজতে গিয়ে নতুন সামাজিক সংঘাত সৃষ্টি করতে পারে, যেমনটা করছে বাংলাদেশসহ আরো বহু মুসলমান দেশেও ইসলামের আত্মপরিচয়ের সন্ধান? বাংলাদেশে তো লোকায়ত ইসলাম প্রতিদিন ক্ষয়িষ্ণু হয়ে আন্তর্জাতিক একটা রূপ খুঁজছে, বিশ্বায়নের এই নতুন প্রতিক্রিয়া নিয়ে প্রশ্ন করা হলে ইটন বললেন, ‘আমার তো মনে হয়, এটা আজ সব ধর্মের জন্য সত্য। পৃথিবীর সব জায়গাতেই এটা ঘটছে। বিশ্বায়ন একটা ভূমিকা রাখছে মানুষ নিজেদের কীভাবে উপলব্ধি করে, সেই বোধের জায়গাটায়। বিশ্বায়ন মানে অঞ্চলগুলোর মাঝে ঘনীভূত আন্তঃযোগাযোগ। আর এই ক্রমবর্ধমান আন্তঃযোগাযোগ একই সঙ্গে অসমও। কেননা এটা প্রায়ই অভিজাত অংশের ওপর বৃহত্তর অভিঘাত ফেলে: সেই মানুষেরা যারা বহুজাতিক, অঞ্চল-অতিক্রমী শক্তিকাঠামোর সঙ্গে প্রত্যক্ষভাবে যুক্ত— অন্যরা যারা এ রকম বহুজাতিক সংস্কৃতির সঙ্গে ততটা যুক্ত নয়, এটা প্রায়ই এই দুই শ্রেণীর মাঝে একটা টানাপড়েন সৃষ্টি করে। এটা সামাজিক শ্রেণীর প্রশ্ন। আমরা এ সমস্যা মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেও দেখছি, যেখানে অভিজাত অংশ তথ্যপ্রযুক্তির মাধ্যমে বাকি দুনিয়ার সঙ্গে যুক্ত, আর অনভিজাত অংশ পেছনে থেকে যাচ্ছে। এটাই আমরা দেখেছি সাম্প্রতিক নির্বাচনে ডোনাল্ড ট্রাম্পের উত্থানে। ফলে এটা কেবল বাংলাদেশেই অথবা ইসলামেই সীমিত না। আমার ধারণা, এটা সর্বত্র ঘটছে। দুনিয়া যখন আরো বেশি দৃঢ় আন্তঃযোগাযোগের মাঝে আসে, কিছু উপাদান এর বাইরে পড়ে যায়, তা থেকে বাতিল হয়ে যায়। আর তাদের মাঝে আবেদন তৈরি করে প্রথাগত কর্তৃত্বের ধরনগুলো। আমেরিকায় আমরা যেটাকে বলি বাইবেল-বেল্ট। বাইবেল বেল্ট হলো, আমেরিকার সেই অঞ্চলগুলো, যেটা কেন্দ্রের সঙ্গে... কী বলা যায় এটাকে... তুলনামূলকভাবে কেন্দ্রের সঙ্গে অসংযুক্ত। তো ঐতিহ্যগত ধর্ম সে স্থানগুলোর ওপর তুলনামূলকভাবে বেশি কর্তৃত্ব করে অন্য এলাকার চেয়ে। আমার মনে হয়... আমি একুশ শতকের বাংলাদেশ নিয়ে খুব বেশি পর্যবেক্ষণ করিনি। ফলে আমি নিশ্চয়তা দিয়ে কিছু বলছি না, কিন্তু আমার মনে হয়, বাকি দুনিয়ার সঙ্গে কিছু সাদৃশ্য আছে। মধ্যপ্রাচ্য, পশ্চিম ইউরোপে এ ধরনের টানাপড়েন আমরা দেখছি বিশ্বায়িত শ্রেণীগুলোর সঙ্গে অসম্পর্কিত শ্রেণীগুলোর।’
সুফিদের হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের ধর্মান্তরে ভূমিকা বিষয়ে আপনার মতামত খুব কম মানুষই গ্রহণ করে। এটা কি একদম অসম্ভব যে সুফিরা খ্রিস্ট ধর্ম প্রচারকদের মতো স্থানীয় প্রাক-কৃষি জনগোষ্ঠীকে কৃষিজীবীতে রূপান্তরের মধ্য দিয়ে কিংবা কৃষিজীবীতে রূপান্তর না করেই ইসলামের বিস্তার ঘটিয়ে থাকতে পারেন?
“এটা খুবই মজার একটা প্রশ্ন। কোনো সন্দেহ নেই যে, অনেক অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুফির আবির্ভাব ঘটেছিল বাংলার ইতিহাসে। এ নিয়ে আমার একটা অধ্যায়ই আছে, ‘আরলি সুফিস অব দ্য ডেলটা’, এরাই প্রথম আশরাফ শ্রেণী গঠন করেছিল, তারা এসেছিল বাইরে থেকে। তাদের খুব গুরুত্বপূর্ণ সব অনুসারী দলও গড়ে উঠেছিল, বিশেষ করে উত্তর-পশ্চিম বাংলায়। পূর্বদিকে শাহজালাল। ...আদিতম পারসিক সূত্র অনুযায়ী তিনি এখানে এসেছিলেন একদল অনুসারী নিয়ে। তাকে নিয়ে ভিন্ন ভিন্ন প্রজন্ম ভিন্ন ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। আঠারো বা আমার ধারণা সতেরো শতকের ব্যাখ্যাগুলোর দিকে তাকালে আমরা জানতে পারব, তিনি বাংলায় এসেছিলেন কিছু কাদামাটি নিয়ে। তার প্রতি আদেশ ছিল— দুনিয়া ভ্রমণ করতে থাকো যতক্ষণ না হুবহু একই ধরনের মাটি মেলে। তিনি সিলেটে এলেন। এখানে একই মাটি মিলল। এ গল্পের কয়েকটি সংস্করণ রয়েছে। একটা অনুযায়ী এ মাটি তাকে দিয়েছিলেন মধ্য এশিয়ার তুর্কমেনিস্তানে তার নিজের শায়খ, তার নিজের পীর। এভাবে বাংলার মাটি আর ইসলামের খাঁটিত্বের মাঝে একটা সম্পর্ক আমরা পাই... এটা কিন্তু পরবর্তীকালের একটি ব্যাখ্যা। আমরা শাহজালালের ক্ষেত্রে একজন প্রত্যক্ষদর্শীর সাক্ষ্য পাই, তিনি শাহজালালকে দেখেছেন। তিনি মাটি বা কাদা এসবের কথা কিছু বলেননি। তিনি খুব বিখ্যাত সুফি ছিলেন, ইবনে বতুতা মধ্যপ্রাচ্যের কোথাও তার নাম শুনেছিলেন। কিন্তু পুরনো সূত্রগুলোয় এ গল্প নেই। তো বাংলায় সন্দেহাতীতভাবেই অনেক গুরুত্বপূর্ণ সব সুফি ছিলেন। কিন্তু বিপুল জনগোষ্ঠীকে ইসলাম ধর্মে আসার বিষয়ে আমরা কোনো সমকালীন নিদর্শন পাই না, যেখানে সুফিরা এই ধর্মান্তরে আগ্রহ দেখিয়েছেন বা কোনো ভূমিকা রেখেছিলেন। এ অধ্যায়ে আমরা আরো যে সুফিদের পাই, তারা ইসলাম প্রচারে ভূমিকা রাখেননি।”
তারা মিশনারিদের মতো কোনো ভূমিকাও রাখেননি?
‘না। মিশনারি শব্দটাই বিভ্রান্তিকর। আমার মনে হয়, মিশনারি শব্দটা উনিশ শতকের একটি প্রটেস্ট্যান্ট খ্রিস্টান পরিভাষা। পশ্চিমা অনেক পণ্ডিত বাংলার ইতিহাস না বুঝেই এ শব্দটা ব্যবহার করেছিলেন। তারা স্রেফ খ্রিস্টান মিশনারিদের ধারণাটা গ্রহণ করেছিলেন এবং এটাকেই পেছনের সেই সময়ে আরোপ করেছিলেন। আমি মনে করি, কাজটি দুর্ভাগ্যজনক। কেননা কোনো সাক্ষ্যপ্রমাণ নেই যে, বাংলার আদি সুফিরা ইসলাম প্রচারে সক্রিয় ছিলেন। আমি এমন কোনো কিছু পাইনি। আমি জানি, বহু মানুষ তা বিশ্বাস করে। এটি একটা পরিহাস যে, পাকিস্তান-ভারত-বাংলাদেশে ইতিহাস গ্রন্থের খুব কম যে কয়টি বিষয়ে সবাই একমত, তার একটা এই যে, সুফিরা হিন্দুদের মুসলমান বানিয়েছিলেন। এটা বোধগম্য, কেননা যদি বারবার পুনরাবৃত্তি করা হতে থাকে, সবাই এটা বারবার, বারবার এবং বারবার বলতে থাকে... সবাই এটা গ্রহণও করে ফেলে। আপনাকে অবশ্যই মূল ফার্সি মালমসলাগুলো দেখতে হবে।’
ইসলামের সাম্যবাদী ভাবাদর্শ কি কোনো ভূমিকা রাখেনি? কেননা হিন্দু ধর্মের বর্ণাশ্রম প্রথা তো একটা নির্যাতন হিসেবেই নিম্নজাতির মানুষেরা নিত?
‘কিন্তু সমস্যা হলো, যতই পূর্বদিকে আমরা আসি, ব্রাহ্মণ জনগোষ্ঠীর সংখ্যা তো কমতে থাকে। পূর্ব বাংলায় ব্রাহ্মণরা তো ছিল না প্রায়। যদি আদি সংস্কৃত পাঠগুলো আমরা দেখি, খ্রিস্টপূর্ব চতুর্থ শতকের সূত্রগুলোয় ব্রাহ্মণরা... করতোয়া নদীর পূর্বে গেলে তাদের বিশেষ শুদ্ধিকরণের প্রক্রিয়ায় আসতে হবে। কেননা এটা ছিল অশুদ্ধ ভূমি। কাজেই ব্রাহ্মণদের এখানে কোনো ভিত্তি ছিল না। তাহলে নিপীড়ন আসবে কোথা থেকে যদি ব্রাহ্মণরা অনুপস্থিত থাকে? আমার বইয়ের প্রথম অধ্যায়েই একটি মানচিত্র আছে। এখানে ছোট ছোট কিছু ব্রাহ্মণ্য জনগোষ্ঠীর উল্লেখ আমরা পাই। পাই লালমাইয়ে বৌদ্ধ, মহাস্থানে তুলনামূলক বড় বৌদ্ধ বসতির সন্ধান। কিন্তু আরো পশ্চিমে জনবসতিগুলো অনেক বড়। আমি যেটা বলতে চাই, প্রক্রিয়াটা শুরু হয়েছিল অনেক আগেই। কিন্তু পশ্চিমবঙ্গে এটা যতটা আসন গেড়েছিল, পূর্ববঙ্গে তা হয়নি। যা-ই হোক, পূর্ববঙ্গে আমরা উচ্চশ্রেণীর নির্যাতনের লিখিত নিদর্শন পাই না। ব্রাহ্মণ্যতন্ত্রই যদি নির্যাতনের কারণ হয়, এটা যদি সত্যি হয়, তাহলে পশ্চিমবঙ্গে যেখানে অনেক বেশি ব্রাহ্মণ ছিল, সেখানেই ইসলামের অনেক বেশি প্রাধান্যশীল ধর্ম হওয়ার কথা ছিল।’
সুফিরা যদি কৃষিজীবী জনগোষ্ঠীতে রূপান্তরে ভূমিকা পালন করে থাকেন?
‘যারা ইসলাম প্রচার করলেন, সেই একই ব্যক্তিরাই কৃষিকাজেরও প্রবর্তন করলেন, এ কথাটি বারবার শুনতে পাওয়া যাবে। কেন এটা ঘটল? আমি বারবার কৃষিকাজের সঙ্গে সুফিদের সম্পর্কের এ গল্প বাংলায় শুনতে পেলাম। ভারতের আর কোথাও এটা ঘটেনি। আমি এদের বলি জাঙ্গল পাইওনিয়ার... এই মুসলিম অগ্রদূতরা ঢাকায় মোগল সুবাদারের কাছ থেকে জমি বন্দোবস্ত নিয়েছিলেন। তারা মানুষকে অরণ্য সাফ করার এবং স্থানীয় আদিবাসীদের শ্রমিক হিসেবে ব্যবহার এবং কৃষিকাজ করার অনুমতি দিতেন। এ অগ্রদূতদেরই মৃত্যুর পরে তাদের কবরগুলো তীর্থস্থানে রূপান্তরিত হয়। তারা সুফি হিসেবে স্মরিত হতে থাকেন। তারা যদিও ভারতের বিখ্যাত সব তরিকা যেমন— নকশাবন্দি, চিশতি বা ফেরদৌসিয়ার সঙ্গে যুক্ত না। এটা কীভাবে হয়? এ সমস্যা সমাধানে প্রস্তাব হলো, যে মানুষগুলো এই কৃষিকাজ পত্তন করেছিলেন, তাদেরকেই উত্তরকালে মহান সুফি হিসেবে ভাবা হয়।’
পাঠকের জন্য এখানে টীকা আবশ্যক। ইটন অন্য ধরনের যে সুফিরা ইহজাগতিক কার্যাবলির সঙ্গে যুক্ত ছিলেন না, ধর্মচর্চাতেই নিরত থাকতেন, সমকালীন সূত্র থেকে তাদের কথাও বলেছেন। এদের ধর্মনিষ্ঠার কথাও সমকালীন সূত্রেই মেলে। কিন্তু অরণ্য আবাদ করে কৃষিভূমিতে রূপান্তর করার সঙ্গে সম্পর্কিত সুফিদের বিষয়ে পরবর্তীকালের সূত্রগুলোতেই কেবল তাদের আধ্যাত্মিক পরিচয় পাওয়া যায়। এখানেই এমনকি হজরত শাহজালালের মতো কৃষিপত্তনকারীদের সঙ্গে নূর কুতুব ই আলমের মতো দরবেশের পার্থক্য করেন ইটন। প্রথমজনের আধ্যাত্মিকতার কাহিনী পরবর্তীকালের সূত্রগুলোয় মেলে, দ্বিতীয়জনের আধ্যাত্মিকতার কথা সমকালীন সূত্রগুলোয়ও পাওয়া যায়।
অন্যদিকে ইটন দেখিয়েছেন, অরণ্যকে কৃষিভূমি করার এ প্রক্রিয়ায় বাংলায় কেবল ইসলাম ধর্মের বিস্তারই ঘটেনি। বহু ক্ষেত্রেই বন্দোবস্তকারীর পরিচয়ের সূত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠী হিন্দু ধর্মের মাঝেও আত্তীকৃত হয়েছে। মোগলরা প্রতিটি বন্দোবস্ত চুক্তির সঙ্গে মসজিদ কিংবা মন্দির বানানোর শর্ত যুক্ত করে দিত। লক্ষ্য ছিল— কৃষিসভ্যতা, রাষ্ট্র ব্যবস্থা এবং আনুগত্যের ধারণার সঙ্গে সম্পর্কহীন এ আদিবাসী জনগোষ্ঠীকে কোনো একটি বৃহত্ ধর্মের আওতায় আনার মধ্য দিয়ে রাষ্ট্রেরও কর্তৃত্বে নিয়ে আসা। সকালের এ আলাপেও ইটন তারই পুনরাবৃত্তি করেন:
‘আমি এই জমির বন্দোবস্তের দলিলগুলো দেখেছি। নোয়াখালী, সিলেট এবং অন্য সব জায়গায়— সর্বত্রই একই শর্তে জমি দেয়া হয়েছে। এভাবেই ইসলাম ও হিন্দু ধর্মের বিস্তার ঘটেছে। আইন ই আকবরীতে দেখা যাবে বলা হচ্ছে, পূর্ব বাংলার মানুষ হিন্দুও না, মুসলমানও না। উল্লেখ মিলবে যে, একটা গ্রাম যদি মুসলমান কারো দ্বারা পত্তন হয়ে থাকে, সেটা মুসলমান গ্রামে পরিণত হয়। যদি বৈষ্ণব কারো দ্বারা পত্তন হয়, তো সেটা পরিণত হয় বৈষ্ণব হিন্দু গ্রামে।’
এ প্রক্রিয়ায় ইসলাম ধর্মের বিকাশ বেশি ঘটেছে সঙ্গত কারণেই। মধ্য এশিয়ায় মোঙ্গল উপদ্রব কৃষির যে বিনাশ ঘটিয়েছে, নগরগুলো ধ্বংস করেছে, সেই কারণেই মুসলমানদের মাঝেই এ পত্তনীকারদের সংখ্যা বেশি ছিল। মধ্য এশিয়া থেকে উদ্বাস্তু হয়ে আসা এসব মানুষ এখানে অরণ্য আবাদের কাজ করেছেন। ইটন তার গ্রন্থে দেখিয়েছেন, জনগোষ্ঠীর এই ধরন ১৯৪৭ সাল পর্যন্ত অটুট ছিল।
এভাবে ইটন ইসলামের সাম্য দেখে দলে দলে অত্যাচারিত মানুষ ধর্মান্তরিত হয়েছিল কিংবা রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতার কারণে ইসলাম গ্রহণ করেছিল, এই উভয় ব্যাখ্যাকেই নাকচ করে দেন। কেননা দিল্লির রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতা থেকে অনেক দূরে পূর্ব বাংলায় ইসলামের বিস্তার হয়েছিল বেশি, বাংলার পরিপ্রেক্ষিতেও দীর্ঘকাল ক্ষমতার কেন্দ্র থাকা গৌড়, পাণ্ডুয়ার তুলনায় বরিশাল, ময়মনসিংহ নোয়াখালীর মতো দূরাঞ্চলে। একই কারণে তরবারির জোরে বা বলপ্রয়োগে ইসলামের প্রবর্তনে ধারণাও তিনি বাতিল করেন। কেননা বলপ্রয়োগও ক্ষমতার কেন্দ্রেই বেশি সম্ভব দূরপ্রান্তগুলোর তুলনায়। অন্যদিকে ইটন প্রমাণ করলেন, এই নতুন কৃষি বসতিগুলোয় এমনকি হিন্দু ধর্মেরও বিস্তৃতি ঘটেছে। নতুন নতুন জনগোষ্ঠী ইসলাম ও হিন্দু এই উভয় ধর্মের আওতায় আসছে।
ভারতবর্ষের ইতিহাসের অন্যতম বিতর্কিত প্রসঙ্গ মুসলমান শাসকদের কথিত ৬০০ কিংবা ৬ হাজার মন্দির ভাঙার আলোচনা। বিশেষ করে বাবরি মসজিদকে কেন্দ্র করে সাম্প্রদায়িক উত্তেজনা প্রবল হয় ১৯৯০ সালে। এ পরিপ্রেক্ষিতে ইটন তার ‘টেম্পল ডিসেক্রেশন অ্যান্ড দি ইন্দো মুসলিম স্টেটস’ প্রবন্ধে দেখান, মন্দির ভাঙার এ ইতিহাসের দুটো বিশিষ্ট দিক রয়েছে। প্রথমত. ফার্সি ও ভারতীয় উত্স থেকে ৮০টি মন্দির মুসলমানদের হাতে বিনষ্টের তালিকা পাওয়া গেছে। অভিযোগকৃত মন্দিরের তুলনায় এ সংখ্যা অস্বাভাবিক কম।
কিন্তু দ্বিতীয় বিষয়টিই বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সেটি হলো, মন্দির ভাঙার সংস্কৃতিটি মুসলমানরা প্রবর্তন করেনি, বরং আশ্চর্য হলেও সত্যি যে, এটি প্রাক-মুসলমান ভারতীয় একটি প্রথা, মুসলমানরা এ ঐতিহ্যটি কেবল বজায় রেখেছে। যেকোনো পরাজিত রাজ্যের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট রাজকীয় মন্দির ভাঙা/অবমানিত করা/তার ইষ্ট দেবতাকে তুলে নিজের মন্দিরে স্থাপন করা একটি সুপ্রাচীন ভারতীয় প্রথা। এর মধ্য দিয়ে বিজয়ী পক্ষ পরাজিত পক্ষের ওপর রাজনৈতিক কর্তৃত্বকে প্রতীকীভাবেও সুনিশ্চিত করে। ভারতীয় যুদ্ধ ও রাজনীতিবিদ্যায় এর তাত্পর্য অপরিসীম।
রাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্কিত নয়, এমন বহু মন্দিরও সব নগর কিংবা রাজ্যেই ছিল। কিন্তু এই অরাজনৈতিক ও নিছক ধর্মীয় পীঠস্থানগুলো যুদ্ধের এ আগ্রাসন থেকে সাধারণত সুরক্ষা পেত। আমাদের আধুনিক অর্থে এ চর্চাটি ক্ষতিকর কিংবা আগ্রাসী মনে হলেও প্রাচীন ভারতে এটি খুবই স্বাভাবিক আচরণীয় একটি প্রথা ছিল, যার উত্তরাধিকার মুসলমানরাও বহন করেছে। এভাবে ইটন মনে করেন, মুসলমান শাসকরা একটা ক্ষতিকর প্রথার ধারাবাহিকতা রক্ষা করার মধ্য দিয়েও ভারতীয় ঐতিহ্যের মাঝে নিজেদের আত্তীকরণেরই নিদর্শন রেখেছেন।
কিন্তু নির্বিচারে এই মন্দির ভাঙার তত্ত্বের জন্ম কোথায়?
“এ ব্যাখ্যার জন্ম দিয়েছে আংশিকভাবে ব্রিটিশ ও ইউরোপীয় ওরিয়েন্টালিস্টরা। ইউরোপীয়দের মনে এ চিত্রটি ছিল যে, ইসলাম হলো একটা সহিংসতার ধর্ম, তরবারির ধর্ম। বহু ব্রিটিশ ইতিহাসবিদ ধারণাটি ব্যবহার করেছেন। পুরোটা না হলেও উপনিবেশিক আমলে চিন্তাটি ছিল। উপনিবেশিক প্রভাবের আরেকটি দিক দেখা যাক— আদমশুমারি। আদমশুমারিতে জনগোষ্ঠীকে হিন্দু বা মুসলিম হিসেবে ভাগ করা হতো। তোমাকে হয় হিন্দু বা মুসলমান হতে হবে। বাছাই করতে হবে। এই সম্প্রদায়ের বা সেই সম্প্রদায়ের। এ আদমশুমারিও একটা বিভাজনের উত্স হলো প্রতি ১০ বছর পর পর। উনিশ শতক এ বিভাজনকে তীব্রতর করল। মন্দির ধ্বংসের এ কাহিনীগুলোর সূত্রপাত তখনই। হিন্দু মধ্যবিত্তও এটা আনন্দের সঙ্গেই গ্রহণ করল। আমি যেটা করলাম তা হলো, আদি উত্কীর্ণ লিপি, ফার্সি দলিলপত্রগুলোর কাছে গেলাম, দেখলাম এগুলোই হলো প্রমাণ। দেখতে পেলাম, যে মন্দিরগুলো ধ্বংস হয়েছে, সেগুলো রাষ্ট্রদেবতার মন্দির। গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, হিন্দুরা রাজনৈতিক কারণেই মন্দির ধ্বংস এবং অবমাননা করেছে মুসলমানদের আগেই। মুসলিমরা কেবল এ প্রথাটাকেই অনুসরণ করেছে।’
সাব-অলটার্ন বা নিম্নবর্গের ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসচর্চার অন্যতম প্রভাব সৃষ্টিকারী ধারা। এ ধারার প্রাথমিক প্রতিশ্রুতির প্রতি ইটনের সমর্থন থাকলেও নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকারীরা তাদের আদি অবস্থান ধরে রাখতে পারেননি, এমনটাই ইটনের মত। ‘রিইমেজিং দি আদারনেস: এ পোস্টমর্টেম ফর দ্য পোস্টমডার্ন ইন ইন্ডিয়া’ নামের আলোচিত নিবন্ধটির কথা মনে করিয়ে দিতেই ইটন বললেন,
‘আশি আর নব্বইয়ের দশকে নিম্নবর্গের ইতিহাসবিদরা ছিলেন খুবই কাজের, তারা দারুণ সব উদ্যোগ নিয়েছিলেন। যাদের কথা ইতিহাসে শোনা যায়নি। নারী, চর্মকার, কৃষক— যাদের কথা ইতিহাসে লেখা হয়নি। কেননা অধিকাংশ ইতিহাস লেখা হয়েছে অভিজাত অংশের হাতে। শাহীদ আমিন, রনজিত্ গুহ, সুমিত সরকার... এর পর এটা লুণ্ঠিত হলো, হাই-থিওরি আর ডিসকোর্সের মানুষদের হাতে। এটা পুরো আন্দোলনকে থামিয়ে দিল। এ নিয়ে কেউ কথা বলেনি। কাজেই আমার প্রবন্ধটি চিহ্নিত করার চেষ্টা করল নিম্নবর্গের আদি আন্দোলনের কী হলো। আমার অনেক শত্রু তৈরি হলো এ কারণে। কেননা আমি দুজন মানুষের নাম একসঙ্গে লিখেছিলাম— নিকোলাস ডির্কস আর রুডিয়ার্ড কিপলিং। সাব-অলটার্ন ইতিহাস ভারতীয় ইতিহাসকে তিন ভাগে বিভক্ত করেছিল— প্রাক-ঔপনিবেশিক, ঔপনিবেশিক আর উত্তর ঔপনিবেশিক। এর সত্যিকার মানে হলো, সব ইতিহাসের কেন্দ্র হলো ঔপনিবেশিক সময়। এটা সময় সম্পর্কে উনিশ শতকের ওরিয়েন্টালিস্ট ভাবনাকেই পুনরুজ্জীবিত করল। এ প্রবন্ধটি দুবার প্রত্যাখ্যাত হয়েছিল। এটাই একমাত্র প্রবন্ধ, যেটার এই অভিজ্ঞতা আছে। এটা একটা পরিহাস। এটা শুরু হয়েছিল নিম্নবর্গকে ভাষা দেয়ার কথা বলে। কিন্তু মানুষ আসলে শুনতে চায় না। এ প্রবন্ধের শুরুতে আমি নিকোলাস ডির্কসের লেখাকে ঠিক ১০০ বছর আগের রুডিয়ার্ড কিপলিংয়ের সঙ্গে তুলনা করেছি। কিপলিং হলেন সাম্রাজ্যবাদীদের প্রতিভূ: পশ্চিম হলো পশ্চিম আর পুব হলো পুব, তারা কখনো মিলবে না একসঙ্গে। নিকোলাসেরও একই রকম একটা যুক্তি আছে যে, পুবের প্রতিষ্ঠানগুলো যেমন— বর্ণপ্রথা ইউরোপ কর্তৃক উদ্ভাবিত। এ তত্ত্ব সবকিছুর কর্তাসত্তা ইউরোপীদের হাতেই তুলে দেয়। আবার তাদের যুক্তির সারাংশ হলো, ইউরোপ আর ভারত দুটো পৃথক দুনিয়ায় বাস করে। এটি একটি ওরিয়েন্টালিস্ট ভাবনা। এটি একটা পরিহাস যে, পরবর্তীকালের নিম্নবর্গীয়রা একই ভাবনা দিয়ে শেষ করলেন। এমনকি ইতিহাসবিদরা স্থানীয় পর্যায়ের মালমসলা খুঁজলেন না। ১৯৯০ নাগাদ নিম্নবর্গের আন্দোলনে যখন পূর্ণ জোয়ার, তারা এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় আসাও বন্ধ করলেন। কেন আসতে হবে এখানে! শুধু যা করতে হবে সেটা হলো, লন্ডনে গিয়ে মহাফেজখানা ঘাঁটা এবং ডিসকোর্স অনুসরণ করা। আমার মনে হয়, বিশেষজ্ঞকে অবশ্যই মাঠে যেতে হবে এবং আসল উত্সগুলো পাঠ করতে হবে আদি ভাষাতেই। এ মানুষগুলো মাঠে যাওয়া বন্ধ করল। এমন একটা সময় গেছে, আমেরিকানরা এমনকি দক্ষিণ এশিয়ায় আসাও বন্ধ করেছে, কেননা ডিসকোর্স তৈরি হতো ইউরোপে।’
সমকালীন ভারত নিয়ে কিছু প্রশ্ন জেগেছিল। ইতিহাসের জ্ঞান আমাদের কতটুকু কাজে আসে! সমকালীন ভারতে অটল বিহারী বাজপেয়ী ও নরেন্দ্র মোদির আমলে আমরা দেখেছি ইতিহাস নতুন করে লেখার পাঁয়তারা। সম্মিলিতভাবেই একে প্রতিহত করার চেষ্টা করেছেন ইতিহাসবিদরা। দিল্লি হিস্টরিয়ান গ্রুপ নামে ইতিহাসবিদদের একটি সংকলনে দেখা যাবে ইরফান হাবীবের এই মত: ‘ভারতে সাম্প্রদায়িকতাবাদী অজস্র। কিন্তু সাম্প্রদায়িক ইতিহাসবিদ পাওয়া যাবে না।’ ইতিহাসবিদদের এই সচেতনতা সত্ত্বেও সমাজে, রাষ্ট্রে সাম্প্রদায়িকতার ব্যবহার তো কমছে না! কিন্তু এ বিষয়ে ইটনের মত শোনার আগেই ইতিহাসবিদ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক আকসাদ আলম চলে এলেন, রিচার্ড ইটনকে তারই সঙ্গে তক্ষুণি রওনা হতে হয় জাহাঙ্গীরনগরের রাস্তায়।
বণিকবার্তা
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন