বঙ্গবন্ধুর সময়ের আওয়ামী লীগ আর বঙ্গবন্ধুর হত্যা পরবর্তীকালের যে আওয়ামী লীগকে আমরা দেখছি, সে জায়গাটিতে বিচার-বিশ্লেষণের অবকাশ রয়েছে। বঙ্গবন্ধুর সময়ের আওয়ামী লীগ একটা দেশ স্বাধীন করার আওয়ামী লীগ, দেশকে শত্রুমুক্ত করার আওয়ামী লীগ। একটা দেশের মানুষ, যারা কোনোদিন নিজেরা অস্ত্র হাতে তুলে নেয়নি, শক্তিশালী পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার সাহস দেখিয়েছিল আওয়ামী লীগ এবং এদেশের মানুষÑ দৈনিক আমাদের অর্থনীতিকে দেওয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এমন মন্তব্য করেন বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ, গবেষক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক অধ্যাপক ড. আবুল বারকাত।
তিনি বলেন, বঙ্গবন্ধু হত্যার পরবর্তী কালটা আমি যেভাবে দেখি তা হচ্ছেÑ প্রথমে অর্থনীতি দুর্বৃত্তায়িত হয়েছে। অর্থনৈতিক দুর্বৃত্তায়ন একটা পর্যায়ে এসে রাজনীতিকেও দুর্বৃত্তায়িত করেছে। একটি দেশের অর্থনীতি যখন দুর্বৃত্তায়িত হয়, রাজনীতি দুর্বৃত্তায়িত হয় তখন মুক্তি ও স্বাধীনতার যে মূল চেতনা সেই চেতনা আর টিকে থাকার কথা নয়। সেটিই ঘটেছে এখানে। এর মাঝখান দিয়ে দেশের মোট জাতীয় উৎপাদন বেড়েছে কিন্তু বৈষম্যও ক্রমাগতভাবে বেড়েছে। এসব হচ্ছে সেইসব ফাঁকফোকর যেসব ফাঁকফোকর দিয়ে এদেশে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি ঢুকেছে। ১৯৭২ সালের সংবিধানে পরিষ্কারভাবে চারটি স্তম্ভের কথা বলা ছিলÑ বাঙালি জাতীয়তাবাদ, গণতন্ত্র, ধর্মনিরপেক্ষতা ও সমাজতন্ত্র। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর প্রাথমিকভাবে যে কাজটি করা হয়েছে তা হলো অসাম্প্রদায়িকতাটা সংবিধান থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে। ধীরে ধীরে ইসলামকে রাষ্ট্রধর্ম করা হয়েছে। অসাম্প্রদায়িকতা আমাদের একটা বড় ভিত্তি ছিল, যে ভিত্তির উপর দাঁড়িয়ে আমরা মুক্তিযুদ্ধও করেছিলাম। সেই ভিত্তিটা যখন থেকে সরিয়ে দেওয়া হয় তখন রাষ্ট্র আর অসাম্প্রদায়িক থাকে না। কারণ রাষ্ট্রের ধর্ম করা হয়েছে ইসলামকে।
তিনি আরও বলেন, পঁচাত্তর পরবর্তী ৪০ বছরে, আমি আগেই বলেছিÑ একটি দেশের অর্থনীতি যখন দুর্বৃত্তায়িত হয়, রাজনীতি যখন দুর্বৃত্তায়িত হয় তখন সামগ্রিকভাবে একটা আর্থ-রাজনৈতিকভাবে রাষ্ট্রীয় সরকার কাঠামোটাই অন্য জায়গায় চলে যায়। যদি ধরেও নিই বাংলাদেশ সমাজতন্ত্র করেনি, সমাজতন্ত্রের বিপরীতে গিয়ে যে একটা আর্থ-রাজনৈতিক রীতি, অর্থাৎ যাকে পুঁজিবাদ বলা হয় সেটা করেছে, সেই প্রপার পুঁজিবাদও এখানে হয়নি। এখানে যেটা ঘটেছে সেটা হচ্ছেÑ পরজীবীবৃত্তি, লুটেরা, অন্যের সম্পদ জোর করে দখল করা ইত্যাদি। এটা কিন্তু প্রকৃত পুঁজিবাদ নয়। অর্থাৎ পরজীবী নামের একটা গোষ্ঠী যারা নিজেরা কোনো সম্পদ সৃষ্টি করেন না, অন্যদের সৃষ্ট সম্পদ জবর দখল করেন, লুণ্ঠন করেন তারা আপারহ্যান্ড। এটা একটা ত্রিভূজের মতো বলতে পারেন। ত্রিভূজের মাথায় রয়েছেন তারা, তলার বাহুতে রয়েছে রাষ্ট্র ও সরকার, অন্যদিকে রাজনীতি। তার মানে পরজীবীদের অধীনস্থ হয়ে গেছে আমাদের রাষ্ট্র, সমাজ ও রাজনীতি।
আবুল বারকাত বলেন, একটা ত্রিভূজের কথা আমি আগেই বলেছি। রাষ্ট্র কীভাবে চলে। পরজীবী, সরকার ও রাজনীতি। আরেকটি ত্রিভূজ এখানে তৈরি হয়েছে, সেই ত্রিভূজের মাথায় আছে জামায়াতে ইসলাম। এই ত্রিভূজের বামদিকে রয়েছে ১৩২টি জঙ্গি সংগঠন। ডানদিকে রয়েছে মৌলবাদের অর্থনীতি। তার সঙ্গে ২৩১টি এনজিও, বেসরকারি সংস্থা ট্রাস্ট ফাউন্ডেশন। অতএব এটা কোনো দুর্বল সত্তা নয়, কঠিন সত্তা। যদি মূলধারার অর্থনীতিতে মৌলবাদ ও জঙ্গিবাদ থেকে থাকে তাহলে মূলধারার সরকারের মধ্যেও মৌলবাদের সরকার রয়েছে। তাহলে মূলধারার রাষ্ট্র, রাষ্ট্রের অনেক অঙ্গপ্রত্যঙ্গ সেই মূলধারার রাষ্ট্রের অঙ্গপ্রত্যঙ্গের মধ্যেও মৌলবাদ, জঙ্গিবাদ ও ধর্মভিত্তি রয়েছে। সে রকম একটা সমাজ কাঠামোর মধ্যে আমরা বাস করছি। সেই কাঠামোর মধ্যে সবকিছুই যে খারাপ হচ্ছে তা নয়, ভালো অনেক কাজও হচ্ছে।
তিনি বলেন, ভালো কাজের মধ্যে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলা যায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার তো হচ্ছে। এটা তো বাংলাদেশের মানুষ কল্পনাও করেননি, সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর মতো ব্যক্তির ফাঁসি হতে পারে। সেটা হয়েছে। একদিকে সেটা হচ্ছে আরেকদিকে ধর্মভিত্তিক রাজনীতিও চলছে। সেখানে জামায়াতে ইসলামী একটা নাম। বাংলাদেশের একটি অর্থনীতি রয়েছে। সেই অর্থনীতিতে মৌলবাদের অর্থনীতি রয়েছে। মূল যে অর্থনীতিটা আছে সেই অর্থনীতির মধ্যে আরেকটি অর্থনীতি। মূলধারার যে অর্থনীতি তার মধ্যে আরেকটি অর্থনীতি। যে অর্থনীতি ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনৈতিক গোষ্ঠীর স্বার্থরক্ষার অর্থনীতি। পঁচাত্তর, ছিয়াত্তর কিংবা সাতাত্তর সালে ধীরে ধীরে এই অর্থনীতি তৈরি হয়েছে। এখন কিন্তু তারা খুব একটা ছোট নেই। দেশে তাদের নয়টি বড় সেক্টরে বিনিয়োগ রয়েছে।
তিনি আরও বলেন, প্রথমে সেক্টর হচ্ছে আর্থিক প্রতিষ্ঠানÑ যার মধ্যে বীমা, লিজিং কোম্পানি, দ্বিতীয় বড় সেক্টর হচ্ছেÑ বিভিন্ন ধরনের যানবাহন, সেটা রিকশা থেকে শুরু করে সমুদ্রগামী জাহাজও রয়েছে। তৃতীয় হচ্ছেÑ ঔষধ কোম্পানি থেকে শুরু করে ডায়াগনস্টিক, হাসাপাতাল ইত্যাদি। শিক্ষা। প্রাক-প্রাইমারি মাদ্রাসা থেকে শুরু করে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত। মিডিয়া আইটিও তাদের হাতে রয়েছে। আবাসন ব্যবসা রয়েছে। মুদি দোকান থেকে রিটেইল, হোলসেল সবই তাদের রয়েছে এবং ২৩১টি এনজিও রয়েছে। এই অর্থনীতিটা মূলধারার অর্থনীতি যেভাবে চলে সেভাবে চলে না, অন্যভাবে চলে। সেই অর্থনীতিতে আমার গত বছরের হিসাবÑ একটা ইন্ডাস্ট্রিতে বছরে একটা প্রফিট হয়, প্রফিট থেকে সব খরচ বাদ দিলে নীট প্রফিট হয়, এই অর্থনীতিতে গত বছরে নীট মুনাফা প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা। বিগত ৩৫-৪০ বছর যোগ করলে প্রায় ২ লাখ কোটি টাকার উপরে।
যেহেতু মূলধারার অর্থনীতির মধ্যে আরেকটি অর্থনীতি তৈরি হয়েছে, মূলধারার অর্থনীতির বাৎসরিক প্রবৃদ্ধি যেখানে ৫-৬ শতাংশ হারে বাড়ে সেখানে মৌলবাদের অর্থনীতি বাড়ে ১০ শতাংশ হারে। কারণ তাদের অর্থনীতিটা আইডলজিভাবে মোটিভেটেড। তারা তাদের ৩ হাজার কোটির টাকার নীট প্রফিটের ২০ শতাংশ ৬০০ কোটি টাকা রাজনৈতিক কর্মকা-ে ব্যয় করে। এখন তারা কী চায়? ধর্মকে বর্ম বা ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে রাষ্ট্রক্ষমতাটাই দখল করতে চায় তারা (জামায়াত)। এটাই হচ্ছে তাদের মূল লক্ষ্য।
বিশিষ্ট এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ হঠাৎ করেই ঘটেনি। দীর্ঘ একটা সংগ্রামের ফলই হচ্ছে সশ্রস্ত্র মুক্তিযুদ্ধ। আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া একটা যুদ্ধ ছিল একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ, যে যুদ্ধটা আমরা আমাদের মুক্তির ও স্বাধীনতার জন্য করেছিলাম। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান একাত্তরের ঐতিহাসিক ৭ মার্চের ভাষণে সবার কাছে খুব স্পষ্ট করেছিলেন যে, ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সেই ভাষণে তিনি একথাও বলেছিলেন, ‘আমি প্রধানমন্ত্রিত্ব চাই না, এদেশের মানুষের অধিকার চাই’। মুক্তি, স্বাধীনতা, অধিকার ও মানুষÑ এ কথাগুলোই ছিল ওই ভাষণের মূল কথা। সেই মুক্তির চেতনায় আমরা মুক্তিযুদ্ধ করেছিলাম।
তিনি আরও বলেন, আমি নিজেও একজন সশস্ত্র মুক্তিযোদ্ধা। আমার মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করার কারণ ছিল দুটো। প্রথম হচ্ছেÑ শোষণমুক্ত, বৈষম্যহীন একটি সমাজ-রাষ্ট্র আমরা চেয়েছিলাম। দ্বিতীয়ত হচ্ছেÑ অসাম্প্রদায়িক মানস কাঠামো। অর্থাৎ সেক্যুলার একটা মাইন্ডসেট। এই দুটো জিনিস আমরা চেয়েছিলাম। আজকে পঁয়তাল্লিশ বছর পর যদি জিজ্ঞেস করা হয়Ñ মুক্তিযুদ্ধের যে মূল চেতনা অর্থাৎ বৈষম্যহীন, শোষণ-ক্ষুধামুক্ত, সমতাভিত্তিক একটি দেশ, বাংলাদেশের অর্থনীতি, রাষ্ট্র-সমাজ ও অসাম্প্রদায়িক মানস কাঠামো কতটুকু অর্জিত হয়েছে? আমি মনে করি, স্বাধীনতা বলতে যা বোঝায়, সেটা যদি একটা ভূখ- হয়, একটি নিজস্ব জাতি রাষ্ট্রের পতাকা হয়, একটা জাতীয় সংগীত হয় তাহলে এসব আমরা পেয়েছি। মুক্তির কথা যদি বলা হয়, তাহলে বলবÑ আমরা মুক্ত হইনি। মুক্ত না হওয়ার মাত্রা কতটুকু সেটা নিয়ে আপাতত নাই বলি।
অধ্যাপক আবুল বারকাত বলেন, ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে। এই হত্যাকা- দেশিয় ও আন্তর্জাতিক ষড়যন্ত্রের ফল। ওই ষড়যন্ত্র হয়েছে মুক্তিযুদ্ধের যে দ্্ুই চেতনা তা এখানে বাস্তবায়িত করতে না দেওয়া। অর্থাৎ এই দেশটি যেন শোষণমুক্ত বৈষম্যহীন একটি দেশ না হয়, এই দেশে অসাম্প্রদায়িকতা যেন না থাকে। উল্টো সাম্প্রদায়িকতা যেন পরিপুষ্ট হয়। সেই দুটি বিষয় এখানে বাস্তবায়িত করার জন্যই বঙ্গবন্ধুর মতো একজন মহান নেতাকে হত্যা করেছে আন্তর্জাতিক চক্র এদেশিয় দোসরদের সহযোগিতায়। এই মানুষটিকে হারানো আমাদের কতটা ক্ষতি হয়েছে, কতটা ক্ষত সৃষ্টি করেছে তা আমাদের উপলব্ধিরও বাইরে। একটা জাতির স্বপ্নকে যে মানুষটি জীবনের মায়া ত্যাগ করে পূরণে সংগ্রাম করল, স্বাধীনতা এনে দিলেন, তাকে কিনা আমরাই হত্যা করেছি।আস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন