মাদ্রাসার ছেলেরা বাংলাদেশ চেনে না : সৈয়দ হাসান ইমাম
21 December 2016, Wednesday
সৈয়দ হাসান ইমাম। একজন অভিনেতা, আবৃত্তিকার, স্বৈরাচার ও সাম্প্রদায়িকতাবিরোধী গণতান্ত্রিক আন্দোলনের অগ্রণী ব্যক্তিত্ব। নাটক সিনেমায় অভিনয়ের পাশাপাশি পরিচালনাও করেছেন তিনি।
১৯৭১ সালে ফেব্রুয়ারি মাসে হাসান ইমামকে আহ্বায়ক করে গঠিত হয় শিল্পীদের প্রতিবাদী সংগঠন বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ। যারা বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে পাকিস্তান বেতার ও টেলিভিশন অনুষ্ঠান বর্জন করেন। গণআন্দোলনের চাপে পাকিস্তানি সরকার ৮ মার্চ বেতার ও টেলিভিশনের দায়িত্ব বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজের হাতে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়। ২৫ মার্চের পর হাসান ইমাম মুজিবনগরে চলে যান এবং মুক্তিযুদ্ধে যোগ দিয়ে স্বাধীনবাংলা বেতার কেন্দ্রের নাট্য বিভাগের প্রধানের দায়িত্বে নিযুক্ত হন।
সৈয়দ হাসান ইমাম মুজিবনগর স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে সালেহ আহমেদ নামে বাংলা সংবাদ পাঠ করতেন। হাসান ইমাম ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত সংবাদ পাঠ এবং নাট্য বিভাগের দায়িত্বভার বহন করেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় জহির রায়হানকে সভাপতি ও হাসান ইমামকে সাধারণ সম্পাদক করে মুজিবনগরে চলচ্চিত্র শিল্পী ও কলাকুশলী সমিতি গঠন করা হয়। যাদের উদ্যোগে মুক্তিযুদ্ধের চলচ্চিত্র দলিল ‘লেট দেয়ার বি লাইট’ নির্মিত হয়।
মুক্তিযুদ্ধের পর বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি প্রতিষ্ঠায় হাসান ইমাম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন। সম্প্রতি রাইজিংবিডির মুখোমুখি হয়েছিলেন সৈয়দ হাসান ইমাম। এ আলাপচারিতার চুম্বক অংশ নিয়ে সাজানো হয়েছে এই সাক্ষাৎকার।
রাইজিংবিডি : দেশের শ্রেষ্ট সন্তানদের মধ্যে আপনি একজন। স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর আপনার অনুভূতি জানতে চাই।
সৈয়দ হাসান ইমাম : আমার মিশ্র অনুভুতি। স্বাধীনতার পর অনেক কিছু আমরা অর্জন করেছি। স্বাধীনতার আগে আমাদের যে অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক, রাজনৈতিক অধিকার থেকে আমরা এখন অনেক উন্নত। এজন্য অবশ্যই ভালো লাগছে।
রাইজিংবিডি : যে কারণে আপনারা স্বাধীনতা চেয়েছিলেন, স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর তা কতটা বাস্তবায়িত হয়ছে বলে মনে করছেন?
সৈয়দ হাসান ইমাম : মুক্তিযুদ্ধের যেসব চেতনা তার সব এখনো বাস্তবায়িত হয়নি। স্বাধীনতার চারটি মূল নীতি ছিল। যেমন- গণতন্ত্র, সমাজতন্ত্র, ধর্ম নিরোপেক্ষতা, বাঙ্গালি জাতীয়তাবাদ। জাতীয়তাবাদ হয়তো কিছুটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। গণতন্ত্র অনেকটা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে, তবে কিছু বাকি আছে। আমাদের ধর্ম নিরোপেক্ষতা আর সমাজতন্ত্র এই দুটি স্তম্ভ ছিল। সমবন্টন অর্থনীতি যে জন্য মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েছিল। তা এখনো পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি। আমাদের জীবদ্দশায় এগুলো পূরণ হবে কি না, তা দেখে যেতে পারব কি না তা জানি না। এগুলো পুরণ না হওয়া পর্যন্ত সম্পূর্ণভাবে সফল হয়েছি বলতে পারব না।
অর্থনৈতিক বৈষম্য দূর করা, সমাজতন্ত্র আর ধর্ম নিরোপেক্ষতা এই দুইটি বিষয়ে এখনো আমরা সফল হতে পারিনি। ধর্ম নিরোপেক্ষতা যদিও খাতায় কলমে ছিল। এরশাদ সাহেব এসে রাষ্ট্রীয় ধর্ম ইসলাম করে দিয়েছেন। রাষ্ট্রের কোনো ধর্ম থাকে না। ইসলাম ধর্ম যদি রাষ্ট্রের হয় তাহলে আমাদের ইসলামের যে আইনগুলো আছে তা রাষ্ট্র পালন করছে? রাষ্ট্র কি রোজা রাখতে পারবে? রাষ্ট্র কি হজ্জ্ব যেতে পারবে? ধর্ম তো মানুষের জন্য হয়েছে। রাজনৈতিক কারণে এটাকে রাষ্ট্র ধর্ম করা হয়েছে। রাষ্ট্র ধর্মের পৃষ্ঠপোষকতা করতে পারে। সেখানে আমাদের বক্তব্য ছিল সব ধর্মকে রাষ্ট্র পৃষ্ঠপোষকতা করবে। অথবা নিরোপেক্ষতা থাকবে না। যে যার মতো ধর্ম পালন করবেন।
এখন স্বাধীনভাবে ধর্ম পালন করতে গেলেও যারা অপশক্তি আছেন তারা গিয়ে মন্দির ভেঙ্গে দিচ্ছে। এগুলো তো কথা ছিল না। আর ইসলাম ধর্ম যেভাবে প্রচার করা হয়েছিল আর এখনকার যারা ইসলাম ধর্ম প্রচার করছেন তারা ইসলামের নাম করে রাজনীতি করছেন। তারা তো নিজেরাও সঠিক ধর্ম পালন করছেন না। ইসলাম ধর্ম সহনশীল ধর্ম। এখন যারা ধর্ম প্রচার করছেন তারা নতুন করে মুসলমান বানাচ্ছে না বরং যারা মুসলমান তাদেরকেই হত্যা করছে। এসব কারণে মুক্তিযুদ্ধের সকল উদ্দেশ্য আদায় করতে পেরেছি তা বলা যাবে না।
রাইজিংবিডি : স্বাধীনতার ৪৫ বছর পর দেশ কি এখন কলঙ্কমুক্ত হয়েছে বলে মনে করেন?
সৈয়দ হাসান ইমাম : যুদ্ধাপরাধীর বিচারের জন্য আমরা আন্দোলন করেছি। এখন যুদ্ধাপরাধীর বিচার হচ্ছে, এগুলো ইতিবাচক। আর নেতিবাচক হলো- এখন সন্ত্রাসী কর্মকান্ড হচ্ছে। মৌলবাদী শক্তির উত্থান হচ্ছে। এ দুটো জিনিস আমাদের ক্ষতি করছে।
দেশ কলঙ্কমুক্ত হবে যখন এ ধরনের ঘটনা নতুন প্রজন্মকে প্রভাবিত করবে না। যুদ্ধাপরাধীর বিচার করছি ঠিকই কিন্তু নতুন প্রজন্ম বিভ্রান্ত হচ্ছে। এটার কারণ শিক্ষা ব্যবস্থা এক ধরনের হতে হবে। মুক্তিযুদ্ধের আগে থেকেই আমাদের দাবি ছিল যে শিক্ষা ব্যবস্থা এক ধরনের হতে হবে যদি আমরা এক ধরনের নাগরিক চাই। তা আমরা করতে পারিনি। এখনো তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থা চালু আছে। ইংরেজি, বাংলা ও আরবি। এই তিন ধরনের শিক্ষা ব্যবস্থায় তিন ধরনের মানুষ তৈরি হচ্ছে। ইংরেজি মাধ্যমের ছেলেরা বাংলাদেশে চেনেই না। আবার মাদ্রাসার ছেলেরাও বাংলাদেশ চেনে না। এই কারণে এ প্রজন্ম ভুল পথে যাচ্ছে। শিক্ষা ও সংস্কৃতি মানুষের মনো জগতের পরিবর্তন আনতে পারে। রাজনীতি তখনই সফল, যখন সোনার মানুষ পায়।
রাইজিংবিডি : আমাদের স্বাধীনতা ও ইতিহাস নতুন প্রজন্ম কতটা সঠিকভাবে জানতে পারছে বলে মনে করেন?
সৈয়দ হাসান ইমাম : রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে মিথ্যে ও অপপ্রচার করা হয়েছিল কারণ যে সরকারের সঙ্গে জামাত অন্তর্ভূক্ত থাকবে সেখানে কখনই মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস সঠিকভাবে পৌঁছাবে না। নিজের কলঙ্কের কথা কি কেউ প্রচার করে? এখন জামাতমুক্ত সরকার ক্ষমতায় আছে তারা অনেকটাই সঠিকভাবে প্রচার করছেন। কিন্তু মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বিষয়গুলো বিশেষ করে সামাজিক ন্যায় বিচারের বিষয়টা এখনো প্রায় কিছুই করা হয়নি। নিজেদের জাতীয়তাবাদে বিশ্বাসী থাকব এবং অপরের জাতীয়তাবাদে শ্রদ্ধাশীল থাকব। এটাই হওয়া উচিৎ।
রাইজিংবিডি : দেশের বিভিন্ন আন্দোলনে আপনারা অংশ নিয়েছিলেন। রাষ্ট্র আপনাদের সঠিক মূল্যায়ন করতে পেরেছে কি?
সৈয়দ হাসান ইমাম : মূল্যায়ন পাওয়ার জন্য আমরা যুদ্ধ করিনি। যখন মুক্তিযুদ্ধ করেছি তখন আমরা কি ভেবেছিলাম যে, আমাদের মূল্যায়ন করা হবে? এটা তো ঠিক না। আমরা সাধারণ জনগনের সঙ্গে সম্পৃক্ত থেকে যুদ্ধ করেছি। গ্রামে-গঞ্জে যারা যুদ্ধ করে জীবন দিয়েছেন বা নারীরা তাদের সম্ভম হারিয়েছেন, তাদের মূল্যায়ন সমষ্টিগতভাবে হওয়া উচিত। তবে আমরা যারা এখন সুবিধাভোগী শ্রেণী বাংলাদেশে তাদের অনেকের মুল্যায়ন হয়েছে।
এই সরকার একটা বিষয় ভালো করেছে যে, বিদেশ থেকে যারা আমাদের সহায়তা করেছেন তাদের সন্মান করেছেন। তাদেরকে পুরস্কৃত করেছেন।
যেমন রাজাকারদের খুঁজে খুঁজে তালিকা করে বিচার করছে তেমনই যারা দেশের হয়ে যুদ্ধ করেছেন তাদের তালিকা করা প্রয়োজন। এবং তাদের সন্মান করা উচিৎ।
রাইজিংবিডি : আপনার জীবনের কোনো স্মরনীয় ঘটনা সর্ম্পকে জানতে চাই। যা আজও আপনাকে নাড়া দেয়।
সৈয়দ হাসান ইমাম : আন্দোলনে আমাদের বহু মানুষ সহায়তা করেছেন। এখনো অনেক মানুষ আমাদের ভালোবাসেন। যেমন- আমি দুটো স্মৃতি কখনো ভুলতে পারব না্। এ দুটো স্মৃতি খুব ভালো লাগে। একটি- আমি একবার চিতলমারিতে মিটিংয়ে ভাষণ দিচ্ছিলাম। সেখানে ভাষণ দিয়ে ঢাকায় চলে আসি। মাস খানেক পর একবৃদ্ধ হিন্দু লোক ঢাকায় আমার অফিসে আসেন। এসে আমাকে বলেন- ‘আপনার ভাষণ সেদিন আমি শুনেছিলাম। এ রকম ভাষণ ৪৭ সালে কেউ দিলে দেশটা ভাগ হতো না।’ এত বড় সন্মান আমাকে আর কেউ দেয়নি।
দ্বিতীয়- কয়েক বছর আগের কথা। আমি বিজয় সরণীতে জ্যামে আটকে ছিলাম। তখন আমার পাশে একটা গাড়ি এসে থামে। এক ভদ্রলোক গাড়ি থেকে নেমে আমার গাড়ির দরজায় নক করে। দরজাটা খুলতেই সেই ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে আমার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করল। এবং বলল- ‘আমার বহুদিনের ইচ্ছে ছিল আপনার পায়ে হাত দিয়ে সালাম করব।’ এ কথা বলে নিজের গাড়ি করে চলে যান। এর থেকে বড় সন্মান আর কি হতে পারে? আমি স্বাধীনতা পদক, একুশে পদক পেয়েছি। কিন্তু সাধারণ মানুষের যে ভালোবাসা পেয়েছি, এরচেয়ে বড় আর কিছুই হতে পারে না।
রাইজিংবিডি : রাইজিংবিডিকে সময় দেয়ার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।
সৈয়দ হাসান ইমাম : রাইজিংবিডিকেও ধন্যবাদ।
রাইজিংবিডি
http://www.risingbd.com/%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%8D%E0%A6%B0%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%B0-%E0%A6%9B%E0%A7%87%E0%A6%B2%E0%A7%87%E0%A6%B0%E0%A6%BE-%E0%A6%AC%E0%A6%BE%E0%A6%82%E0%A6%B2%E0%A6%BE%E0%A6%A6%E0%A7%87%E0%A6%B6-%E0%A6%9A%E0%A7%87%E0%A6%A8%E0%A7%87-%E0%A6%A8%E0%A6%BE--%E0%A6%B8%E0%A7%88%E0%A6%AF%E0%A6%BC%E0%A6%A6-%E0%A6%B9%E0%A6%BE%E0%A6%B8%E0%A6%BE%E0%A6%A8-%E0%A6%87%E0%A6%AE%E0%A6%BE%E0%A6%AE/218603
পাঠক মন্তব্য
Back in school, I'm doing so much leganinr.
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন