দেশের নাট্যান্দোলনের অন্যতম সংগঠক ও খ্যাতিমান অভিনেতা আলী যাকের। তবে তার সবচেয়ে বড় পরিচয় হলো তিনি একজন মুক্তিযোদ্ধা।।একাত্তরে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের শব্দ সৈনিক ছিলেন। সাংস্কৃতিক বোধ ও চেতনার মধ্য দিয়ে মানুষকে যুথবদ্ধ করেছেন মুক্তি সংগ্রামে, স্বাধীনতার লড়াইয়ে। বিজয়ের দিন সামনে রেখে তিনি কথা বলেছেন পূর্বপশ্চিমের সঙ্গে। জানিয়েছেন, কোন প্রেরণায় মুক্তিযুদ্ধে জড়িয়েছিলেন। বলেছেন, দেশকে নিয়ে প্রত্যাশা-প্রাপ্তির কথা।
পূর্বপশ্চিম: মুক্তিযুদ্ধের সময় সাংস্কৃতিক লড়াইটা কেমন ছিলো?
আলী যাকের: স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ছিলো আমাদের সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। এর মাধ্যমে মানুষকে আমরা জানাতাম- আমরা একটা যুদ্ধে আছি, একটার পর একটা সেক্টরে পাকিস্তান পরাজিত হচ্ছে, আমরা বিজয়ী হচ্ছি। এতে মানুষ যেমন প্রতিনিয়ত দেশের অবস্থা জানতে পারতেন, সেরকম বহির্বিশ্বও জানতে পারতো বাঙালির যুদ্ধগাঁথা। যুদ্ধ চলছে, পাকিস্তান আমাদের সঙ্গে অন্যায় আচরণ করছে আর বাংলাদেশের মানুষ কিভাবে তাদের বিরুদ্ধে ঘুরে দাঁড়িয়েছে- সব জানতো বিশ্ববাসী। বহির্বিশ্বে যারা বাংলাদেশের পক্ষে কথা বলেছেন, তাদের কথাও আমরা সেখানে নিয়মিত প্রচার করতাম, তাতে দেশবাসী আশায় বুক বাঁধতো। বিশ্বের সঙ্গে একটা যোগসূত্র তৈরি করেছিল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র। কেবল হাতিয়ারে যুদ্ধ-জয় সম্ভব ছিল না, যদি না এই প্রচার মাধ্যমটি সাথে থাকতো।
পূর্বপশ্চিম: স্বাধীনতার চেতনা, কতটা উপস্থাপিত হায়েছে আমাদের মঞ্চনাটকে?
আলী যাকের: পরাধীন দেশে কখনো স্বাধীন সংস্কৃতি চর্চা সম্ভব নয়। স্বাধীনতার পরে স্বাধীনতার যে চেতনা, যে উল্লাস, যে আনন্দ, যে উচ্ছ্বাস, যে উত্তেজনা- এগুলো নিয়েই আমরা যারা মঞ্চ নাটক করতে চেয়েছিলাম, শুরু করেছি। এর ফলে এটা এত দূরে গিয়েছে এবং আরো যাবে। এখন ঢাকা শহরে যে কোনো সন্ধ্যায় টিকেট কেটে কমপক্ষে দু থেকে তিনটি নাটক দেখা যায়। এ অবস্থা আগে ছিলো না, স্বাধীন দেশ বলেই সম্ভব হয়েছে। অনেক ভালো ভালো দল যারা স্বাধীনতার পর মুক্তিযুদ্ধের মন্ত্র বুকে নিয়ে নাটক করতে শুরু করেছে, যেমন- ‘নাগরীক নাট্যদল’, ‘ঢাকা থিয়েটার’, ‘আরণ্যক’। এ সমস্ত দল অনুপ্রেরণা পেয়েছে মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ থেকে, চেতনা থেকে, মূল্যবোধ থেকে।
পূর্বপশ্চিম : প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ নিয়ে বিখ্যাত সব চলচ্চিত্র নির্মান হয়েছে। আমাদের স্বাধীনতা সেখানে কতটা উজ্জ্বল?
আলী যাকের: মুক্তিযুদ্ধের উপর ভিত্তি করে ভালো নাটক যে দু-একটা হয়নি, তা না। সৈয়দ শামসুল হকের ‘পায়ের আওয়াজ পাওয়া যায়’- এটি বিশাল একটি অবদান। প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব সারা বিশ্বে ছিলো। বিভিন্ন জায়গার জনগোষ্ঠী এটাকে নিয়ে একেকভাবে ভেবেছে, এর প্রভাব ভিন্ন যায়গায়, ভিন্ন মানুষকে ভিন্ন ভিন্নভাবে স্পর্শ করেছে। ফ্রান্সে যারা মুক্তির পক্ষে ছিলো জার্মানীর বিরুদ্ধে তারা যেভাবে ভেবেছে, জার্মানীর যারা নাৎসীবাদের বিরুদ্ধে ছিলো তারা ভেবেছে আরেকভাবে। আমাদের দেশে একাত্তর সালে চলচ্চিত্র কিংবা নাটক প্রতিষ্ঠিত ছিলো না। তখন বিষয়গুলো চিন্তা চেতনার মধ্যেই ছিলো। আমাদের সৌভাগ্য আমরা মাত্র ন’মাসেই যুদ্ধ শেষ করতে পেরেছি। কিন্তু মাত্র ন’মাসের যুদ্ধ থেকে কিছু নিয়ে বড় মাপের কিছু করা সম্ভব ছিলো না।
পূর্বপশ্চিম : ‘বহুব্রীহি’ নাটকে পাখিকে ‘তুই রাজাকার’ বলতে শেখান। নাটকটি প্রচারের সময় কোন বাঁধা এসেছিল কি?
আলী যাকের: তখন কোনো বাঁধার সন্মুক্ষীন হইনি, কিন্তু পরে বিএনপি সরকার ক্ষমতায় এলে হয়েছি। বিএনপির সে সময়ের তথ্যমন্ত্রী ছিলেন নাজমুল হুদা।তিনি নাটকটি বেশ পছন্দ করতেন। উনি ‘বহুব্রীহি’ নাটকের পুরো টিমটাকে দাওয়াত করলেন, আমরা গেলাম। উনি ভীষণ খুশি হলেন, যত্ন করে খাওয়ালেন। ওই সময় উনি আমাদের ‘বহুব্রীহি’ নাটকটি বাংলাদেশ টেলিভিশনে আবার প্রচার করতে বলেন। আবার প্রচার শুরু হলো কিন্তু তখন আর ওনার পছন্দ হলো না। তিনি বললেন, ‘তুই রাজাকার’-এটা কী? এ ধরণের সংলাপ তো প্রচার করা যাবে না।
পূর্বপশ্চিম : একজন মুক্তিযোদ্ধা হয়েও রাজাকার চরিত্রে অভিনয় করেছেন?
আলী যাকের: আমার দূর্ভাগ্য। আমার চেহারা খারাপ বলে হয়তো এ চরিত্রে আমাকে বেশী ডাকে। যেহেতু ওদের আমি দেখতে পারি না, তাই যতটা বদভাবে ওদের উপস্থাপন করা যায়, তাই করেছি।
পূর্বপশ্চিম : ব্যক্তিগত উদ্যেগে স্বাধীনতার ২৫ বছর পর আপনারা ক’জন মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতি ট্রাস্ট গঠন করেন। এ প্রসঙ্গে বলুন।
আলী যাকের: আমরা ৮ জন মিলে তখন ভাবলাম, কবে মরে যাবো তার তো ঠিক নেই, আমাদের পরবর্তী প্রজন্ম কিছুই জানবে না? এটা তো হতে পারে না। আমি তখন ভাবলাম বিভিন্ন জায়গায় যে বদ্ধভূমিগুলো আছে, সেখানে একটা স্ট্র্যাকচার করা যায়। কিন্তু সেটাতে অনেক খরচ। তখন আমাদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়ার ট্রাস্টি ড: সারোয়ার আলী বললেন আমরা একটা ছোট্ট আকারে জাদুঘর করি, সেখানে যদি তরুণরা আসে, আমরা যদি তাদের এখানে আনতে পারি তবে মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে তারা জানতে পারবে। শুরু করতে আমাদের অসুবিধা হয়নি, সেগুনবাগিচায় ছোট্ট একটা বাড়ি ভাড়া করে শুরু করলাম। সাড়া পেলাম অভূতপূর্ব। সেখানে বঙ্গবন্ধুর পাইপ, জামা-কাপড় মাননীয় প্রধানমন্ত্রী নিজে আমাদের দিয়েছেন। এমন কোনো সেক্টর কমান্ডার, মুক্তিযোদ্ধা বা তাদের পরিবার নেই যারা তাদের ব্যবহৃত জিনিষ দেননি।
পূর্বপশ্চিম : তরুণ প্রজন্মের দেশ প্রেম নিয়ে আপনি কতটা আশাবাদী?
আলী যাকের: আমার দুজন তরুণ সন্তান আছে ফলে তরুণ প্রজন্মের দেশ প্রেম নিয়ে আমার কোনো রকম সন্দেহ নেই। আমি নিশ্চিত যে তারা এ দেশকে অন্য পথে চলে যেতে দিবে না।
পূর্বপশ্চিম: বিজয়ের ৪৫ বছর পূর্তিতে দেশের প্রতি প্রত্যাশা কী?
আলী যাকের: দেশ ঠিক পথেই আছে। দেশের কাছে আমি কিছু চাইনি, কোনোদিনও না। অনেকে বলে দেশ স্বাধীন করে কী পেলাম? আমি দেখি এরকমভাবে যে, রাস্তা দিয়ে আমার মা যাচ্ছেন, তিনি কিছু দুষ্কৃতিকারী দ্বারা আক্রান্ত হলেন, আমি গিয়ে নিজে আহত হলাম কিন্তু মাকে বাঁচালাম, তারপর মায়ের কাছে সেটার পাওনা চাইবো? যুদ্ধ শেষ, আবার পাওনা কিসের? নিজের মাকেই তো বাঁচিয়েছি।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন