Image description

মোনরো ডকট্রিনের সময় থেকেই যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকাকে নিজের নিরাপত্তা বলয়ের অংশ হিসেবে দেখে আসছে। আজকের বিশ্বে সেই আগ্রহ নতুন রূপ নিয়েছে—লিথিয়াম, বাণিজ্য, অভিবাসন সংকট আর চীনের ক্রমবর্ধমান উপস্থিতি। ফলে এই অঞ্চল এখন যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষাক্ষেত্র।

 
বিশ্ব মানচিত্রে যুক্তরাষ্ট্রের ঠিক নিচেই লাতিন আমেরিকা। মেক্সিকো থেকে শুরু করে একদম দক্ষিণে চিলি আর আর্জেন্টিনা পর্যন্ত বিস্তৃত এই অঞ্চল। দশকের পর দশক ধরে ওয়াশিংটনের নীতি-নির্ধারকরা এই অঞ্চলকে নিজেদের ‘ব্যাকইয়ার্ড’ বা বাড়ির পেছনের উঠোন হিসেবে গণ্য করে এসেছেন।

 

 

স্নায়ুযুদ্ধের সময় এই ‘উঠোন’ যাতে সোভিয়েত ইউনিয়নের দখলে না যায়, সেজন্য সিআইএ থেকে শুরু করে মার্কিন মেরিনরা ছিল সদা তৎপর। কিন্তু বার্লিন দেওয়াল ধসে পড়ার তিন দশক পর, আজকের পৃথিবীতে কেন আবারও লাতিন আমেরিকা মার্কিন পররাষ্ট্রনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে উঠে এল?

 

 

আজকের বাস্তবতা ভিন্ন। এখন আর কেবল কমিউনিজম ঠেকানো নয়, বরং এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ফেন্টানাইল ও কোকেনের মতো মাদকের ভয়াবহতা, সীমান্তে আছড়ে পড়া অভিবাসীদের অনিয়ন্ত্রিত স্রোত। সবচেয়ে বড় আতঙ্ক, চীনের নীরব কিন্তু আগ্রাসী অর্থনৈতিক উপস্থিতি।

 

 

আমাজনের গহিন অরণ্য থেকে আন্দিজ পর্বতের লিথিয়াম খনি—সবখানেই এখন পরাশক্তিদের দাবার ঘুঁটি চালনা চলছে। যুক্তরাষ্ট্রের কাছে লাতিন আমেরিকা এখন কেবল প্রতিবেশী নয়, অস্তিত্ব ও প্রভাব বজায় রাখার এক অগ্নিপরীক্ষা।

 

 

মোনরো ডকট্রিন থেকে স্নায়ুযুদ্ধ: আধিপত্যের ঐতিহাসিক ভিত্তি

 

 

লাতিন আমেরিকার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্যের ঐতিহাসিক ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপিত হয়েছিল ১৮২৩ সালে। তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জেমস মোনরো ঘোষণা করেছিলেন বিখ্যাত ‘মোনরো ডকট্রিন’। এই নীতির সারকথা ছিল—‘আমেরিকা কেবল আমেরিকানদের জন্য’। অর্থাৎ, পশ্চিম গোলার্ধে ইউরোপীয় কোনো শক্তি নাক গলাতে পারবে না। যদিও শুরুতে এটি ছিল ইউরোপীয় উপনিবেশবাদ ঠেকানোর কৌশল, কিন্তু বিংশ শতাব্দীতে এসে পরিণত হয় মার্কিন হস্তক্ষেপের লাইসেন্সে।

 

 

মার্কিন ভাষাবিদ ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক নোয়াম চমস্কি তাঁর বিভিন্ন লেখায় বারবার উল্লেখ করেছেন, যুক্তরাষ্ট্র লাতিন আমেরিকাকে কখনোই স্বাধীন সত্তা হিসেবে দেখেনি, বরং দেখেছে তাদের সম্পদের ভাণ্ডার এবং নিরাপত্তার বাফার জোন হিসেবে। চমস্কির মতে, স্নায়ুযুদ্ধের সময় ‘কমিউনিজম প্রতিরোধ’-এর ধুয়া তুলে যুক্তরাষ্ট্র গুয়াতেমালা (১৯৫৪), ব্রাজিল (১৯৬৪) এবং চিলির (১৯৭৩) মতো দেশে গণতান্ত্রিকভাবে নির্বাচিত সরকারকে উৎখাত করে সামরিক একনায়কদের বসিয়েছে।

 

মোনরো ডকট্রিন নিয়ে ১৮৫৬ সালে ভিক্টর গিলামের ব্যঙ্গচিত্র। ছবি: সংগৃহীতমোনরো ডকট্রিন নিয়ে ১৮৫৬ সালে ভিক্টর গিলামের ব্যঙ্গচিত্র। ছবি: সংগৃহীত

 

চিলির সালভাদর আলেন্দেকে সরিয়ে পিনোশেকে ক্ষমতায় বসানোর নেপথ্যে হেনরি কিসিঞ্জারের ভূমিকা আজ আর গোপন কোনো বিষয় নয়। এই ঐতিহাসিক হস্তক্ষেপগুলো লাতিন আমেরিকার জনমানসে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি স্থায়ী অবিশ্বাস তৈরি করেছে।

 

 

তবু ইতিহাস সাক্ষী দেয় ওয়াশিংটন কোনোভাবেই নিজের ঘরের কাছে অন্য কোনো পরাশক্তির ঘাঁটি মেনে নেয়নি—সেটা ১৯৬২ সালের কিউবার মিসাইল ক্রাইসিসই হোক আর আজকের ভেনেজুয়েলায় রুশ বোমারু বিমানের উপস্থিতিই হোক।

 

 

ভূ-রাজনৈতিক সমীকরণ: ঘরের কাছে শত্রু ও মিত্র

 

 

ভূ-রাজনীতির ভাষায় নৈকট্য বা প্রক্সিমিটি বড় ফ্যাক্টর। যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তার প্রথম ধাপই হলো তার দক্ষিণ সীমান্তের সুরক্ষা। টেক্সাস বা অ্যারিজোনার সীমান্ত দিয়ে কেবল অভিবাসীই আসে না, আসে মাদক ও নিরাপত্তার ঝুঁকি। মেক্সিকো ও মধ্য আমেরিকার দেশগুলোর স্থিতিশীলতা সরাসরি যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তার সঙ্গে জড়িত। ২০২৩ সালে আটলান্টিক কাউন্সিলকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মার্কিন সাউদার্ন কমান্ড বা সাউথকম-এর প্রধান জেনারেল লরা রিচার্ডসন বলেন, ‘এই অঞ্চল আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ, কারণ এখানে আমাদের শত্রুরা আমাদের ঘরের দরজায় কড়া নাড়ছে।’

 

 

এই ‘শত্রু’র তালিকায় সবার ওপরে এখন চীনের নাম। গত দুই দশকে লাতিন আমেরিকায় চীনের উত্থান যুক্তরাষ্ট্রের জন্য দুঃস্বপ্নের মতো। বেইজিংয়ের ‘বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ (বিআরআই)-এর মাধ্যমে চীন সেখানে বন্দর, রাস্তা, বাঁধ এবং বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণে বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করছে। পানামা খালের মতো কৌশলগত জলপথের নিয়ন্ত্রণ বা পেরুর চাঙ্কাই বন্দরে চীনের মেগা প্রজেক্ট—এসবই যুক্তরাষ্ট্রের ঘুম হারাম করার জন্য যথেষ্ট। মার্কিন পররাষ্ট্রনীতি বিষয়ক ম্যাগাজিন ‘ফরেইন পলিসি’-র এক বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, লাতিন আমেরিকায় চীনের উপস্থিতি কেবল বাণিজ্য নয়। চিন এমন এক ‘ডুয়েল-ইউজ’ বা দ্বৈত ব্যবহারের অবকাঠামো তৈরি করছে, যা ভবিষ্যতে সামরিক কাজেও ব্যবহৃত হতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র ভয় পাচ্ছে, যদি তারা এখনই সতর্ক না হয় তবে তাদের প্রভাববলয় হাতছাড়া হয়ে যাবে।

 

চিলির স্বেরশাসক আউগুস্তো পিনোশে ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের করমর্দন। ছবি: সংগৃহীতচিলির স্বেরশাসক আউগুস্তো পিনোশে ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী হেনরি কিসিঞ্জারের করমর্দন। ছবি: সংগৃহীত

 

এছাড়া মাদক পাচার বা নার্কোটিকস কন্ট্রোল যুক্তরাষ্ট্রের আরেকমাথাব্যথা। কলম্বিয়া, পেরু ও বলিভিয়া থেকে কোকেন এবং মেক্সিকো থেকে ফেন্টানাইল যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশ করে প্রতি বছর হাজার হাজার আমেরিকানের মৃত্যু ঘটাচ্ছে। এই ড্রাগ কার্টেলগুলোকে নিয়ন্ত্রণ করতে হলে উৎস দেশগুলোতে মার্কিন গোয়েন্দা ও সামরিক উপস্থিতি জরুরি। তাই কলম্বিয়ার সঙ্গে ‘প্ল্যান কলম্বিয়া’ বা মেক্সিকোর সঙ্গে ‘মেরিদা ইনিশিয়েটিভ’-এর মতো সামরিক ও নিরাপত্তা সহযোগিতা যুক্তরাষ্ট্রের স্বার্থেই প্রয়োজন।

 

 

অর্থনীতির চাকা ও ‘সাদা সোনা’র তৃষ্ণা

 

 

লাতিন আমেরিকা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য কেবল নিরাপত্তাবলয় নয়, বিশাল বাজার ও সম্পদের খনিও বটে। নাফটাবা পরবর্তী সময়ে ইউএসএমসিএ চুক্তির মাধ্যমে উত্তর আমেরিকার সাপ্লাই চেইন একে অপরের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। অটোমোবাইল থেকে শুরু করে ইলেকট্রনিক্স—অনেক পণ্যের ‘ইন্টারমিডিয়েট গুডস’ বা মধ্যবর্তী যন্ত্রাংশ তৈরি হয় মেক্সিকোতে, যা পরে যুক্তরাষ্ট্রে সংযোজন করা হয়।

 

 

তবে বর্তমান সময়ে অর্থনৈতিক স্বার্থের কেন্দ্রবিন্দুতে চলে এসেছে জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ। ভেনেজুয়েলায় বিশ্বের বৃহত্তম তেলের মজুদ রয়েছে। রাজনৈতিক বৈরিতা সত্ত্বেও ইউক্রেন যুদ্ধের পর বিশ্ববাজারে তেলের দাম স্থিতিশীল রাখতে যুক্তরাষ্ট্রকে ভেনেজুয়েলার দিকে তাকাতে হয়েছে।

 

 

কিন্তু তার চেয়েও বড় আগ্রহের বিষয় হলো লিথিয়াম। ইলেকট্রিক গাড়ি ও সবুজ জ্বালানির যুগে লিথিয়ামকে বলা হচ্ছে ‘সাদা সোনা’। আর বিশ্বের প্রায় ৬০ শতাংশ লিথিয়াম মজুদ রয়েছে আর্জেন্টিনা, বলিভিয়া ও চিলির সীমান্তে। এই তিন এলাকাকে বলা হয় ‘লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গেল’।

 

 

জেনারেল লরা রিচার্ডসন কংগ্রেসনাল শুনানিতে বলেছিলেন, ‘এই লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গেল আমাদের প্রযুক্তির ভবিষ্যতের জন্য অপরিহার্য ও আমাদের নিশ্চিত করতে হবে যে আমাদের প্রতিপক্ষরা যেন এই সম্পদ কুক্ষিগত করতে না পারে।’ চীনের কোম্পানিগুলো ইতিমধ্যে এই খনিগুলোতে বড় বিনিয়োগ করেছে, যা যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক অস্তিত্বের সংকট তৈরি করেছে। এ ছাড়া গায়ানার উপকূলে আবিষ্কৃত বিশাল তেলের মজুদও এখন এক্সনমোবিলের মতো মার্কিন জায়ান্টদের আকর্ষণের কেন্দ্রবিন্দু।

 

 

অন্যদিকে অভিবাসন ও রেমিট্যান্সের বিষয়ও অর্থনৈতিক সমীকরণের অংশ। যুক্তরাষ্ট্রের কৃষি, নির্মাণ ও সেবা খাতে লাতিন অভিবাসীরা সস্তা শ্রমের যোগান দেয়। আবার যুক্তরাষ্ট্র থেকে পাঠানো রেমিট্যান্স এল সালভাদর, গুয়াতেমালা বা হন্ডুরাসের জিডিপির এক বিশাল অংশ। এই অর্থনৈতিক আন্তঃনির্ভরশীলতা এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, এক পক্ষকে বাদ দিয়ে অন্য পক্ষের চলা অসম্ভব।

 

 

গণতন্ত্র বনাম কর্তৃত্ববাদ: আদর্শিক রশি টানাটানি

 

 

যুক্তরাষ্ট্রের লাতিন আমেরিকা নীতির বড় অংশ জুড়ে রয়েছে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের প্রশ্ন। যদিও সমালোচকরা একে প্রায়ই দ্বিচারিতা বলে থাকেন। ওয়াশিংটন দীর্ঘদিন ধরে কিউবা, ভেনেজুয়েলা ও নিকারাগুয়াকে ‘ট্রয়কা অফ টায়রেনি’ বা স্বৈরাচারের ত্রয়ী হিসেবে চিহ্নিত করে আসছে। এই দেশগুলোতে বামপন্থী ও আমেরিকা-বিরোধী সরকার ক্ষমতায় থাকায় যুক্তরাষ্ট্র নিষেধাজ্ঞা, কূটনৈতিক চাপ এবং বিরোধী দলকে সমর্থনের মাধ্যমে তাদের কোণঠাসা করে রাখতে চায়।

 

 

তবে গত কয়েক বছরে লাতিন আমেরিকায় রাজনীতির হাওয়া বদল হয়েছে, যাকে বলা হচ্ছে ‘পিঙ্ক টাইড’ বা গোলাপি জোয়ার। মেক্সিকো, কলম্বিয়া, ব্রাজিল, চিলিসহ অধিকাংশ দেশে বামপন্থী বা মধ্য-বাম সরকার ক্ষমতায় এসেছে। কলম্বিয়ার গুস্তাভো পেত্রো বা ব্রাজিলের লুলার মতো নেতারা যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক রাখলেও, তারা চীনের সঙ্গেও সমানতালে ব্যবসা করছেন এবং ইউক্রেন ইস্যুতে যুক্তরাষ্ট্রের অন্ধ অনুকরণ করতে নারাজ।

 

 

এই আদর্শিক পরিবর্তন যুক্তরাষ্ট্রের জন্য এক নতুন চ্যালেঞ্জ। ‘দ্য ইকোনমিস্ট’-এর ২০২৩ সালের এক প্রতিবেদনে দাবি করা হয়েছে, লাতিন আমেরিকার নতুন বামপন্থীরা আগের মতো কট্টর আমেরিকা-বিরোধী না হলেও, তারা অনেক বেশি বাস্তববাদী এবং ‘নন-এলাইন্ড’ বা জোটনিরপেক্ষ থাকতে পছন্দ করেন। যুক্তরাষ্ট্রকে এখন গণতন্ত্রের দোহাই দিয়ে নয়, বরং অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে এদের সঙ্গে কাজ করতে হচ্ছে।

 

 

সমাজ ও সংস্কৃতির মেলবন্ধন: যখন পররাষ্ট্রনীতিই ঘরোয়া রাজনীতি

 

 

যুক্তরাষ্ট্রের লাতিন আমেরিকা নীতিকে কেবল পররাষ্ট্রনীতি ভাবলে ভুল হবে; এটি এখন পুরোদস্তুর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতির বিষয়। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে লাতিনো বা হিস্পানিক জনসংখ্যা দ্রুত বাড়ছে। পিউ রিসার্চ সেন্টারের তথ্যমতে, যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার প্রায় ১৯ শতাংশই লাতিনো। ফ্লোরিডা, টেক্সাস, অ্যারিজোনা বা ক্যালিফোর্নিয়ার মতো সুইং স্টেটগুলোতে লাতিনো ভোটাররা নির্বাচনের ফলাফল নির্ধারণে বড় ভূমিকা রাখেন। কিউবান-আমেরিকান বা ভেনেজুয়েলিয়া-আমেরিকানরা চায় তাদের দেশের স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে যুক্তরাষ্ট্র কঠোর হোক। আবার মেক্সিকান-আমেরিকানরা চায় অভিবাসন নীতি সহজ হোক।

 

চায়না-সেলাক ফোরামের উদ্বোধনী মঞ্চে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার শীর্ষ নেতারা। ছবি: সংগৃহীতচায়না-সেলাক ফোরামের উদ্বোধনী মঞ্চে চিনা প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের সঙ্গে লাতিন আমেরিকার শীর্ষ নেতারা। ছবি: সংগৃহীত

 

ফলে হোয়াইট হাউসে বাইডেন বা ট্রাম্প যিনিই থাকুন না কেনো লাতিন আমেরিকা নীতি ঠিক করার সময় মিয়ামি বা লস অ্যাঞ্জেলেসের ভোটারদের কথা মাথায় রাখতে হয়। স্প্যানিশ ভাষা, মিডিয়া, খাদ্যাভ্যাস ও পপ কালচার মার্কিন সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে ঢুকে গেছে। এই সাংস্কৃতিক নৈকট্য বা ‘সফট পাওয়ার’ যুক্তরাষ্ট্রের জন্য যেমন সুযোগ, তেমনি অভিবাসন নীতির ক্ষেত্রে জটিল রাজনৈতিক মারপ্যাঁচ তৈরি করেছে।

 

 

সংকটের চক্র ও মার্কিন সম্পৃক্ততা

 

 

লাতিন আমেরিকায় যখনই কোনো সংকট তৈরি হয়, তার ঢেউ সরাসরি আছড়ে পড়ে যুক্তরাষ্ট্রের উপকূলে। হাইতিতে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও গ্যাং ভায়োলেন্স বাড়লে ফ্লোরিডার উপকূলে শরণার্থীদের নৌকা ভিড়তে শুরু করে। মধ্য আমেরিকার ‘নর্দার্ন ট্রায়াঙ্গেল’ (এল সালভাদর, গুয়াতেমালা, হন্ডুরাস)-এ খরা বা হ্যারিকেনের মতো জলবায়ু বিপর্যয় দেখা দিলে টেক্সাস সীমান্তে হাজার হাজার মানুষের কাফেলা বা ক্যারাভান জড়ো হয়।

 

 

মাদক কার্টেলগুলোর সহিংসতা মেক্সিকোর পর্যটন শহরগুলো ছাড়িয়ে যুক্তরাষ্ট্রের রাস্তায়ও ছড়িয়ে পড়ে। ইকুয়েডরের মতো শান্ত দেশে হঠাৎ করে অপরাধ বেড়ে যাওয়া বা রাজনৈতিক হত্যাকাণ্ডের ঘটনা যুক্তরাষ্ট্রকে বিচলিত করে, কারণ অস্থিতিশীলতা মানেই অভিবাসন এবং অবৈধ ব্যবসার রমরমা। তাই সংকট মোকাবিলার স্বার্থেই যুক্তরাষ্ট্রকে এই অঞ্চলে পুলিশিং বা সহায়কের ভূমিকা পালন করতে চায়। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক জেমস বসওয়ার্থ তাঁর ল্যাটিন আমেরিকা রিস্ক রিপোর্টে উল্লেখ করেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র চাইলেও লাতিন আমেরিকার সমস্যাগুলো থেকে মুখ ফিরিয়ে থাকতে পারবে না, কারণ ভূগোল তাদের ভাগ্যকে এক সুতোয় বেঁধে দিয়েছে।’

 

 

তবে ভিন্ন যুক্তিও আছে। লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের এই অতি-আগ্রহকে অনেক বিশ্লেষকই নিছক ‘নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ’ হিসেবে দেখেন না, বরং দেখেন রাজনৈতিক হস্তক্ষেপের নতুন কৌশল বা ‘ইমপেরিয়ালিস্ট টুল’ হিসেবে। সমালোচকদের মতে, অভিবাসন সংকট, মাদক পাচার কিংবা জলবায়ু বিপর্যয়ের মতো মানবিক ইস্যুগুলোকে ওয়াশিংটন মূলত ঢাল হিসেবে ব্যবহার করছে। বিশ্বজুড়েই যুদ্ধ বা প্রাকৃতিক দুর্যোগের কারণে প্রতিবেশী দেশে অভিবাসনের ঘটনা ঘটে। কিন্তু এই অজুহাতে অন্য কোনো দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি বা সরকার ব্যবস্থায় সরাসরি নাক গলানোর নজির একমাত্র যুক্তরাষ্ট্রেরই বেশি। তারা সীমান্তে দেয়াল তোলার পাশাপাশি উৎস দেশগুলোর নীতি নির্ধারণেও ছড়ি ঘোরাতে চায়।

 

 

অন্যদিকে, ‘ওয়ার অন ড্রাগস’ বা মাদকবিরোধী যুদ্ধের নামে মেক্সিকো, কলম্বিয়া কিংবা ভেনেজুয়েলায় মার্কিন সামরিক ও গোয়েন্দা তৎপরতা নিয়েও রয়েছে বিস্তর বিতর্ক। নোয়াম চমস্কিসহ অনেক তাত্ত্বিকের মতে, মাদকের সমস্যা আসলে যুক্তরাষ্ট্রের নিজস্ব সামাজিক ও স্বাস্থ্যগত সংকট। মার্কিন সমাজে মাদকের বিপুল চাহিদা বা ‘ডিমান্ড’ যতদিন থাকবে, ততদিন কেবল জোগান বন্ধ করে লাভ নেই। অথচ ওয়াশিংটন নিজের ঘরের এই সামাজিক অবক্ষয় না মিটিয়ে, ‘সাপ্লাই চেইন’ ধ্বংসের দোহাই দিয়ে লাতিন দেশগুলোর ওপর নিজেদের সামরিক ও রাজনৈতিক এজেন্ডা চাপিয়ে দিচ্ছে। ভেনেজুয়েলার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ বা মেক্সিকোর রাজনীতিতে চাপ প্রয়োগের নেপথ্যে মাদকের চেয়ে ভূ-রাজনৈতিক নিয়ন্ত্রণ বজায় রাখার আকাঙ্ক্ষাই প্রবল।

 

 

কৌশল ও হাতিয়ার: গাজর ও লাঠির নীতি

 

 

যুক্তরাষ্ট্র তার স্বার্থ হাসিলের জন্য লাতিন আমেরিকায় ‘ক্যারট অ্যান্ড স্টিক’ বা গাজর ও লাঠির নীতি ব্যবহার করে। গণতন্ত্র উন্নয়ন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যের বিভিন্ন প্রজেক্টে ফান্ডিং করার জন্য রয়েছে ইউএসএইড। এর মাধ্যমে তৈরি হয় যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি সহানুভূতিশীল সুশীল সমাজ। সামরিক সহযোগিতার মাধ্যমে পেন্টাগন লাতিন আমেরিকার সামরিক অফিসারদের প্রশিক্ষণ দেয়, যা দীর্ঘমেয়াদে মার্কিন প্রভাব বজায় রাখতে সাহায্য করে।

 

 

অন্যদিকে, অবাধ্য দেশগুলোর জন্য রয়েছে নিষেধাজ্ঞার খড়গ। ভেনেজুয়েলার তেল সেক্টর বা কিউবার অর্থনীতির ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে তাদের দুর্বল করে রাখা যুক্তরাষ্ট্রের পুরনো কৌশল। কূটনৈতিক চাপ প্রয়োগ করে অর্গানাইজেশন অফ আমেরিকান স্টেটস (ওএএস)-এর মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্র তার এজেন্ডা বাস্তবায়ন করতে চায়। তবে স্নায়ুযুদ্ধের সময়ের মতো সিআইএ-র গোপন ক্যু বা সামরিক অভিযান এখন কমে এলেও, সাইবার নিরাপত্তা ও ইন্টেলিজেন্স শেয়ারিংয়ের মাধ্যমে গোপন সহযোগিতা ঠিকই বজায় আছে।

 

 

সীমাবদ্ধতা ও চ্যালেঞ্জ

 

 

এত কিছুর পরেও লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের প্রভাব আগের মতো নেই। এর প্রধান কারণ চীন। বেইজিং কোনো রাজনৈতিক শর্ত বা মানবাধিকারের প্রশ্ন ছাড়াই ঋণ দেয় এবং অবকাঠামো বানিয়ে দেয়। যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক কূটনীতিক ও উইলসন সেন্টারের ফেলো বেঞ্জামিন গেডান ফরেইন পলিসি ম্যাগাজিনে লিখেছেন, ‘যুক্তরাষ্ট্র যখন লাতিন আমেরিকাকে দুর্নীতি বা গণতন্ত্র নিয়ে লেকচার দেয়, চীন তখন চেক বই নিয়ে হাজির হয়। ক্ষুধা পেটে নীতিবাক্য শোনার চেয়ে চেক বই নেওয়া অনেক সহজ।’

 

 

এছাড়া অতীতে যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক হস্তক্ষেপ ও ক্যু সমর্থনের ইতিহাস লাতিন আমেরিকার মানুষের মনে গভীর ক্ষত তৈরি করেছে। আজও মেক্সিকো বা চিলির মানুষ যুক্তরাষ্ট্রের ‘সাম্রাজ্যবাদী’ আচরণ ভোলেনি। এই আস্থার সংকট বা ‘ট্রাস্ট ডেফিসিট’ কাটানো যুক্তরাষ্ট্রের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। তার ওপর যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অভিবাসন নিয়ে বিভক্তি ও সংরক্ষণবাদী বাণিজ্য নীতি লাতিন আমেরিকার সঙ্গে সম্পর্ক গভীর করার পথে বাধা হয়ে দাঁড়াচ্ছে।

 

 

অনেক সমালোচকই মনে করেন, আগামী দিনগুলোতে লাতিন আমেরিকা হতে যাচ্ছে পরাশক্তিদের দ্বন্দ্বের নতুন ফ্রন্টলাইন। চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের ঠান্ডা লড়াই এই অঞ্চলের লিথিয়াম খনি, ৫জি নেটওয়ার্ক ও বন্দরের দখল নিয়ে আরও তীব্র হবে। ‘দ্য ডিপ্লোম্যাট’ ম্যাগাজিনের বিশ্লেষণে বলা হয়েছে, আগামী দশকে ‘লিথিয়াম ডিপ্লোম্যাসি’ এই অঞ্চলের রাজনীতির মোড় ঘুরিয়ে দিতে পারে। যারা ব্যাটারি তৈরির কাঁচামাল নিয়ন্ত্রণ করবে, তারাই একুশ শতকের প্রযুক্তি নিয়ন্ত্রণ করবে।

 

 

অভিবাসন নীতির পরিবর্তনও বড় বিষয় হয়ে দাঁড়াবে। যুক্তরাষ্ট্রকে বুঝতে হবে যে দেয়াল তুলে অভিবাসন ঠেকানো যাবে না, বরং উৎস দেশগুলোর অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হবে। যুক্তরাষ্ট্র কি তার হারানো গৌরব ফিরে পাবে? তা নির্ভর করছে ওয়াশিংটন কি তাদের ‘ব্যাকইয়ার্ড’ মানসিকতা থেকে বেরিয়ে এসে লাতিন আমেরিকাকে সমান অংশীদার হিসেবে সম্মান জানাতে পারবে কি না তার ওপর।

 

 

লাতিন আমেরিকায় যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ ভূগোল, অর্থনীতি ও নিরাপত্তার এক অবিচ্ছেদ্য বন্ধন। মোনরো ডকট্রিনের সেই পুরনো দিনের মতো একচ্ছত্র আধিপত্য হয়তো আর সম্ভব নয়, কারণ চীন এখন এক বড় খেলোয়াড়। কিন্তু লিথিয়াম ট্রায়াঙ্গেল থেকে টেক্সাস সীমান্ত—যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় স্বার্থের শিকড় এই অঞ্চলের মাটির অনেক গভীরে প্রোথিত। চমস্কির ভাষায় বলতে গেলে, ‘আধিপত্যের ধরন হয়তো বদলেছে, কিন্তু নিয়ন্ত্রণের আকাঙ্ক্ষা বদলায়নি।’

 

 

তথ্যসূত্র: আল-জাজিরা, বিবিসি, দ্য ডিপ্লোম্যাট, পলিটিকো, প্রজেক্ট সিন্ডিকেট এবং আটলান্টিক কাউন্সিল।