Image description
 

ডোনাল্ড ট্রাম্প দ্বিতীয় বার ক্ষমতায় আসার পর থেকেই লাতিন আমেরিকা অর্থনৈতিক এবং সামরিক জবরদস্তির একটি মাইনফিল্ডে পরিণত হয়েছে।

 

এমন সময় লাতিন আমেরিকার কিছু নেতা ট্রাম্পের বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিবাদ জানালেও, কেউ কেউ তার নীতিতে রাজি হতে বাধ্য হয়েছেন। আবার কেউ কেউ ‘পসম’ খেলেছেন অর্থাৎ মরার মতো ভান ধরেছেন, মানে যাকে মারার মতো কিছুই নেই।

 
 

ট্রাম্প প্রশাসনের এমন ‘আমাদের গোলার্ধ’ হিসেবের মার্কিন হস্তক্ষেপবাদ দৃষ্টিভঙ্গি থেকে রেহাই পাচ্ছে না লাতিনের কোনো দেশই।

আর্জেন্টিনার সান মার্টিন বিশ্ববিদ্যালয়ের আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের অধ্যাপক আলেজান্দ্রো ফ্রেঙ্কেল বলেছেন, ‘ লাতিন আমেরিকার প্রতিটি দেশের সঙ্গেই মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের একটি অসম অবস্থান তৈরি হয়েছে। আর এটিই তাদের এখনকার মৌলিক অবস্থান।’

এখানে কিছু সারসংক্ষেপ এবং বিভিন্ন প্রতিক্রিয়া তুলে ধরা হয়েছে।

ট্রাম্প যা চান

ওয়াশিংটনের ইন্টার-আমেরিকান ডায়ালগ থিঙ্ক ট্যাঙ্কের বিশ্লেষক মাইকেল শিফটার এএফপি সংবাদ সংস্থাকে বলেন, ট্রাম্পের এখন চরম পর্যায়ের আদর্শগত মিত্র, আর্জেন্টিনার জাভিয়ের মাইলি- ‘ট্রাম্প যা করেন এবং যা চান’ তিনি তাই করেন।’

দীর্ঘদিন ধরে অসুস্থ অর্থনীতিকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টায় মাইলির একজন শক্তিশালী সমর্থকের খুবই প্রয়োজন ছিল। আর এ কারণেই মাইলি ট্রাম্পের একজন সোচ্চার চিয়ারলিডার হয়ে উঠেছেন, অন্যদিকে মার্কিন প্রশাসন আর্জেন্টিনাকে তাদের বাজারে অগ্রাধিকারমূলক প্রবেশাধিকার প্রদান করেছে।

ট্রাম্প পারস্পরিক চুক্তির ভিত্তিতে আর্জেন্টিনার গরুর মাংস আমদানির ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা তুলে নিয়েছেন, যা দেশটিতে প্রাণ সঞ্চারকারী কয়েক বিলিয়ন ডলারের সরবরাহ করেছে।

ট্রাম্প শিবিরের এমন আরেক সদস্য হচ্ছেন এল সালভাদরের প্রেসিডেন্ট নায়েব বুকেলে। ট্রাম্প প্রশাসনের দ্বিতীয় মেয়াদে শত শত অভিবাসীকে বহিষ্কার করা হলে, তার দেশই তাদের প্রথম গ্রহণ করেছিল।

বিভিন্ন মানবাধিকার গোষ্ঠীগুলি জানিয়েছে, প্রাথমিক পর্যায়ে মার্কিন অভিবাসী পুরুষদের ওপর নির্যাতন চালানো হয়েছিল, তবে বুকেলে কিছু ছাড় দিয়ে ট্রাম্পের হৃদয় জিতেছিলেন, যার ফলে তিনি ২০০,০০০ এরও বেশি সালভাদোরানকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে বসবাস ও কাজ করার সুযোগ তৈরি করতে পেরেছেন। এর ফলে তার দেশও অত্যন্ত প্রয়োজনীয় ডলার রেমিট্যান্স পেয়েছিল।

একইভাবে, ইকুয়েডরের রাষ্ট্রপতি ড্যানিয়েল নোবোয়া নির্বাসিত অভিবাসীদের গ্রহণ করতে সম্মত হন। আর এর পাশাপাশি ক্যারিবিয়ান ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ট্রাম্পের সামরিক মোতায়েন এবং মাদক চোরাচালানকারী নৌকাগুলোতে বোমা হামলারও প্রশংসা করেন। তবে এর মাধ্যমে, নোবোয়া তার নিজের গ্যাং-এর বিরুদ্ধে লড়াই করতে মার্কিনিদের সহযোগিতা পেয়েছিলেন।

অভদ্র এবং অজ্ঞ

অন্যদিকে কলম্বিয়ার বামপন্থী নেতা গুস্তাভো পেট্রো ট্রাম্পের সাথে প্রকাশ্যে বিরোধিতায় জড়িয়েছেন, তাকে ‘অভদ্র এবং অজ্ঞ’ বলে অভিহিত করেছেন। এমনকি তাকে অ্যাডলফ হিটলারের সাথেও তুলনা করেছেন।

পেট্রো বরাবরই ট্রাম্প প্রশাসনের অভিবাসী নীতি এবং মাদক পাচারকারী নৌকাগুলোতে হামলার বিরোধীতা করেছেন। এছাড়ও নৌকাগুলো হামালায় ৮০ জনেরও বেশি লোকের ‘বিচারবহির্ভূত মৃত্যুদণ্ডে’র নিন্দা করেছেন।

পেট্রো চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড অবকাঠামোতে যোগ দিয়ে, কলম্বিয়াকে বেইজিংয়ের আরো কাছাকাছি নিয়ে এসেছেন। অন্যদিকে ট্রাম্প প্রশাসন পেট্রোর বিরুদ্ধে মাদক পাচারের অভিযোগ এনেছে এর পাশাপাশি নিষেধাজ্ঞা আরোপের মাধ্যমে তাদের প্রতিক্রিয়া জানিয়েছে।

তবে, মাদক পাচারের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে মিত্রদের তালিকা থেকে ট্রাম্প বোগোটাকে বাদ দেওয়ায় দেশটি কঠোর শাস্তি থেকে রক্ষা পেয়েছে। ধারণা করা হয়, ওয়াশিংটনের ২০২৬ সালের নির্বাচনে ডানপন্থীদের প্রত্যাবর্তনের সম্ভাবনায় ট্রাম্প এমনটি করেছেন।

ব্রাজিলের বামপন্থী লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভাও ট্রাম্পের সাথে লড়াই করেছেন।

সাও পাওলোর গেটুলিও ভার্গাস ফাউন্ডেশনের আন্তর্জাতিক সম্পর্কের অধ্যাপক অলিভার স্টুয়েঙ্কেল বলেন, লুলা দা সিলভা আরো বেশি ‘বাস্তববাদী এবং দৃঢ়চেতা’ ।

লুলা তার ডানপন্থী মিত্র জাইর বলসোনারোর বিরুদ্ধে অভ্যুত্থানের বিচার করেছেন। আর এর প্রতিশোধ হিসেবে ব্রাজিলের উপর শাস্তিমূলক আমদানি শুল্ক আরোপের করেছে যুক্তরাষ্ট্র। তবে এই হস্তক্ষেপেরও নিন্দা করেছেন লুলা।

স্টুয়েঙ্কেল বলেছিলেন, পঁচিশ বছর আগে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান বাণিজ্যিক অংশীদার ছিল ব্রাজিল, যার কারণে তাদেরকে উল্লেখযোগ্য ছাড় দিতে হত যুক্তরাষ্ট্রকে। কিন্তু ‘ব্রাজিল এখন মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপের সম্মিলিত রপ্তানির চেয়ে বেশি রপ্তানি করে চীনে।’

নীরব কূটনীতি

মেক্সিকোর রাষ্ট্রপতি ক্লডিয়া শেইনবাউমের কাছে খুব কমই বিকল্প ছিল। তার দেশ ৮০ শতাংশেরও বেশি রপ্তানি করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের কাছে, তাই তিনি একটি বাণিজ্য চুক্তি পুনর্বিবেচনা করছেন।

মেক্সিকোর মাদক চক্র এবং অভিবাসন সম্পর্কে ট্রাম্প প্রায়ই কঠোর বক্তব্য দেন। এর জবাবে শাইনবাউম ‘নীরব কূটনীতি’ ব্যবহার করেছেন। বিশ্লেষকদের মতে শাইনবাউম ‘বন্ধ দরজার পিছনে সমস্যাগুলি সমাধান করে।’

এমনকি, ট্রাম্পের সবচেয়ে খারাপ শুল্ক ক্রোধ থেকে রক্ষা পেতে শাইনবাউম, তাদের গোয়েন্দা তথ্য ভাগাভাগিসহ, মাদক আটক এবং কার্টেল নেতাদের গ্রেপ্তার বৃদ্ধি করেছেন।

তবে ট্রাম্প যখন মেক্সিকোর মাদকের জায়গাগুলিতে সামরিক হামলার কথা বলেছেন, তখন শাইনবাউম তার দৃঢ় বিরোধীতা করে বলেছেন, মেক্সিকোর মধ্যে কোনো ‘অধীনতা’ থাকতে পারে না।

পানামার রাষ্ট্রপতি হোসে রাউল মুলিনোও ট্রাম্পের কড়া চাপে চীনের বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ থেকে তার দেশকে প্রত্যাহার করে নিয়েছিলেন।

এছাড়াও তিনি পানামা খালের উপর অবস্থিত হংকং-ভিত্তিক একটি জোট মালিকানাধীন বন্দর বিক্রিরও অনুমতি দিয়েছিলেন, কেননা ট্রাম্প হুমকি দিয়েছিলেন যে যুক্তরাষ্ট্র বন্দরটি দখল নিবে ।

কোনো উস্কানি নেই, তারপরও

ভেনিজুয়েলাও রয়েছে ট্রাম্প বিরোধে শিবিরের শ্রেণীতে। তারা আশঙ্কা করছে, ক্যারিবিয়ান অঞ্চলে বৃহৎ পরিসরে মার্কিন নৌবাহিনী মোতায়েনের অন্যতম লক্ষ্য হচ্ছে রাষ্ট্রপতি নিকোলাস মাদুরোকে ক্ষমতাচ্যুত করা।

তবে চাপের মুখে কারাকাস, আমেরিকার বন্দীদের মুক্তি দিতে রাজি হয়েছে। অনেক কারণেই ওয়াশিংটন শেভরনকে ভেনেজুয়েলায় তার কার্যক্রম চালিয়ে যাওয়ার অনুমতি দিয়েছে। তবে এখন আমেরিকার সামরিক শক্তিবৃদ্ধির মুখে ভেনেজুয়েলা তার সমর প্রস্তুতিমূলক অবস্থানে চলে গেছে।

ওয়াশিংটন-ভিত্তিক সেন্টার ফর ইকোনমিক অ্যান্ড পলিসি রিসার্চের একজন সিনিয়র রিসার্চ ফেলো এবং ইকুয়েডরের প্রাক্তন পররাষ্ট্রমন্ত্রী গুইলাম লং বলেছেন, ভেনেজুয়েলা ‘যুক্তরাষ্ট্রকে উত্তেজিত না করার জন্য আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে।’