Image description

চারজনের একটি দল বছরের পর বছর ওড়িশায় বসবাস করে আসছেন। তারাও আজ শত শত মুসলিমের সঙ্গে আতঙ্কে নিজেদের ঘরবাড়ি ছাড়ছেন। আনন্দের কোনো উপলক্ষ নয়, বরং চরম চাপ ও ভয়ভীতির কারণে তারা বাড়ি ছাড়ছেন। ওড়িশার নায়াগড়ের ওদাগাঁও থানার পক্ষ থেকে তাদেরকে ৭২ ঘণ্টার মধ্যে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেয়া হয়েছে বলে অভিযোগ। সোমবারই ওই সময়সীমা শেষ হয়েছে। চারজনেরই শেকড় মুর্শিদাবাদের ডোমকল মহকুমার জলঙ্গির সাগরপাড়া গ্রাম পঞ্চায়েতে। বহু বছর ধরে তারা মোটরবাইকে করে মশারি, লেপ, কম্বল ইত্যাদি বিক্রি করেন। এ খবর দিয়েছে অনলাইন দ্য টেলিগ্রাফ ইন্ডিয়া।

এতে আরও বলা হয়, বৃহস্পতিবার ওদাগাঁও থানায় যখন তারা হাজির হন, পুলিশকর্মীরা তাদের আধার ও ভোটার কার্ড দেখানোর পরও শহর ছাড়ার নির্দেশ দেয়। শুধু বাংলা ভাষায় কথা বলার কারণে একাধিকবার তাদের ‘রোহিঙ্গা’ ও ‘বাংলাদেশি’ বলে গালি দেয়া হয়। সোমবার সন্ধ্যার মধ্যে বাসে করে ভুবনেশ্বর যাওয়ার কথা তাদের। সেখান থেকে ট্রেনে হাওড়া যাওয়ার পরিকল্পনা ছিল। কিন্তু তারা জানেন না তড়িঘড়ি করে ফেলে যাওয়া ঘরোয়া জিনিসপত্র কিংবা বিক্রি না হওয়া মালপত্রের কী হবে। এই গ্রুপে সবচেয়ে কমবয়সী সাহেব শেখ (৩২) বলেন, আমাদের কনফার্ম টিকিট নেই। তার চেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে স্টক। বাড়ির মালিককেও পুলিশ চাপ দিয়ে আমাদের নোটিশ দিতে বাধ্য করেছে। প্রায় ২ লাখ টাকার মাল আমাদের কাছে আছে। ৩০ কিলোমিটার দূরে এক জায়গা পেয়েছি মাল রাখার জন্য। যদি কোনোভাবে কিছু মাল অল্প দামে হলেও বেচে দিতে পারি, তাহলেই বাড়ি ফিরব।

তিনি জানান, তিনি তার বাবা, চাচা- যারা দু’জনেই প্রবীণ এবং আরেক আত্মীয়কে নিয়ে ভাড়া বাড়িতে থাকেন। সাহেব বলেন, আমি প্রথম বাবার সঙ্গে এখানে এসেছিলাম ১৫ বছর আগে। বাবা-চাচা তো আরও বহু বছর ধরে আসছেন। ওনারা মাঝেমধ্যে বলেন, নায়াগড় আর কোরাপুট আমরা মুর্শিদাবাদের চেয়ে বেশি চিনি। অথচ আমাদেরই বলা হলো অনুপ্রবেশকারী!
এই অপমান তাদের আর্থিক ক্ষতির চেয়েও বেশি কষ্ট দিচ্ছে। তাদের একজন আবদুস সালাম (৩৮) বলেন, আমাদের ১২০ বছরেরও বেশি পুরনো জমির কাগজ আছে। তা সত্ত্বেও কেন আমাকে আমার ভারতীয় পরিচয় প্রমাণ করতে হবে? এই বছর জুড়ে ওড়িশায় বাংলাভাষী মুসলিম ফেরিওয়ালা ও শ্রমিকদের পুলিশি হয়রানি ও জনতার হামলার শিকার হতে দেখা গেছে বারবার। ২৪ নভেম্বর গঞ্জাম জেলায় মুর্শিদাবাদের ২৪ বছর বয়সী শীতবস্ত্র বিক্রেতা রাহুল ইসলামকে ‘বাংলাদেশি’ বলে মারধর করা হয়। কারণ তিনি ‘জয় শ্রীরাম’ ধ্বনি দিতে অস্বীকার করেছিলেন। সেই জায়গা সাহেবদের থাকার জায়গা থেকে মাত্র ৩০ কিলোমিটার দূরে।

গত বৃহস্পতিবার দুপুরে পুলিশের দুটি গাড়ি এসে তাদের দরজায় দাঁড়ায়। তখন ঘরে একাই ছিলেন সাহেব। তিনি বলেন, তারা বলল আমরা নাকি রোহিঙ্গা, বেআইনিভাবে থাকছি। পরিচয়পত্র চাইলে আমি আধার আর ভোটার কার্ড দেখাই। তিনি তাতেও সন্তুষ্ট হননি। বাড়িওয়ালাকে ডেকে আমাদের সবাইকে বিকেল ৫টার মধ্যে থানায় হাজির হতে বলেন। থানায় গিয়ে আবারও তাদের ‘বাংলাদেশি ও রোহিঙ্গা’ বলে অপমান করা হয়। কাগজপত্রের নকল নিয়ে সই করিয়ে নেয়ার পর ৭২ ঘণ্টার আলটিমেটাম দেয়া হয় বলে অভিযোগ।

আবদুস সালাম বলেন, তাদের ওড়িয়া বাড়িওয়ালা একজন ভাল মানুষ। ওনার বিরুদ্ধে আমাদের কোনো অভিযোগ নেই। পুলিশ তাকে ভয় দেখিয়ে আমাদের ভাড়া রাখতে নিষেধ করেছে। তারা বলেন, যারা তাদের হেনস্তা করছে, তারা একটি হিন্দুত্ববাদী সংগঠনের কর্মী। বাজারে ও অন্যান্য জায়গায় তাদের দেখেছি। তারা থানাতেও ছিল। চারজন মিলে প্রতিদিন খরচ বাদে প্রায় ১২০০ রুপি সঞ্চয় করতেন, যার বেশিরভাগই বাড়িতে পাঠানো হতো।
মাইগ্রান্ট লেবার ইউনিটি ফোরাম ইতিমধ্যে ওড়িশা পুলিশকে লিখিত অভিযোগ পাঠিয়েছে। নায়াগড়ের এসপিকে ফোনে পাওয়া যায়নি। মেসেজেরও কোনো জবাব মেলেনি। পরে এসপি অফিস থেকে এক ব্যক্তি ফোন করে জানান, থানার কাছে খোঁজ নিচ্ছি।

গঞ্জামে আক্রান্ত রাহুল ইসলাম এখন মুর্শিদাবাদের নিজের বাড়িতে শারীরিক যন্ত্রণা নিয়ে সেরে উঠছেন। কিন্তু মানসিক আঘাত কাটেনি। ২৪ নভেম্বর এক যুবক প্রথমে তার স্কুটি থামায়। সে ফোনে অন্যদের ডেকে বলে, ‘একটা বাংলাদেশি ধরেছি’। মুহূর্তেই ১৫ জনের দল আমাকে ঘিরে ধরে- বলেন রাহুল। মব তাকে ‘জয় শ্রীরাম’ না বললে জীবন্ত পুড়িয়ে মারার হুমকি দেয়। রাহুল বলেন, একজন বাইকের ট্যাংক থেকে পেট্রল বোতলে ভরে এনে দেখাল। বলল এখনই আগুন ধরিয়ে দেবে। এই দৃশ্য ভুলতে পারছি না। তার মালিক মাইনুল সরকারও মুর্শিদাবাদে ফিরে এসেছেন। তিনি বলেন, ওড়িশায় পুলিশকে জানালেও কোনো সাহায্য পাননি।

মাইনুল বলেন, রাহুল ছাড়াও আমার আরও দু’জন কর্মীকে হেনস্তা করা হয়। কিন্তু রাহুল তো মরেই যাচ্ছিল। সব মাল গঞ্জামে আমার ভাড়া বাড়িতেই পড়ে আছে। অনির্দিষ্টকালের জন্য সেখানে থাকা সম্ভব নয়।