ব্রাজিলের অ্যামাজন অঞ্চলের নিস্তব্ধ এক বন্দর শহর বেলেমে এখন জমজমাট পরিবেশ। জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ৩০) উপলক্ষ্যে বিশ্বের নানা প্রান্ত থেকে প্রায় ৫০ হাজার মানুষ সমবেত হয়েছেন এখানে। অথচ শহরটির হোটেল সক্ষমতা মাত্র ১৮ হাজার কক্ষের। ফলে শুরু হয়েছে থাকা-খাওয়ার হাহাকার। এই সংকট সামাল দিতে দুটি বিশাল ক্রুজ জাহাজকে ভাসমান হোটেলে রূপান্তর করেছে ব্রাজিল সরকার। এখন বেলেমের উপকূলে নোঙর করা এই জাহাজগুলোই হয়ে উঠেছে কপ৩০-এর অতিথিদের অস্থায়ী আশ্রয়স্থল।
এদিকে জলবায়ু সংকটকে স্বাস্থ্য সংকট বলে মন্তব্য করেছে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও)। সম্মেলন চলাকালীন বুধবার সংস্থাটি বলছে, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। প্রসঙ্গত, সোমবার থেকে শুরু হয়েছে এবারের কপ৩০ সম্মেলন। চলবে আগামী ২১ নভেম্বর পর্যন্ত। এএফপি, ফ্রান্স ২৪।
কোস্টা ডায়াডেমা এবং এমএসসি সিভিউ
বেলেমের উত্তর উপকূলে নতুন উদ্বোধিত ওতেইরো ক্রুজ টার্মিনালে নোঙর করেছে জাহাজ দুটি- কোস্টা ডায়াডেমা এবং এমএসসি সিভিউ। পুরোনো এক পণ্যবাহী ডক পুনর্গঠন করে তৈরি করা হয়েছে এই বিশেষ টার্মিনালটি। যা নির্মিত হয়েছে মাত্র পাঁচ মাসে। বন্দরের দৈর্ঘ্য এখন প্রায় ৭১৬ মিটার। আগে ছিল ২১৬ মিটার। যেখানে যাত্রী ও ক্রুদের জন্য রয়েছে আলাদা রিসেপশন এলাকা, আধুনিক সাইনেজ, মানচিত্র, দ্বিভাষিক কর্মী ও ২৪ ঘণ্টা পরিবহণ সেবা। দুটি ক্রুজ মিলিয়ে বেলেম শহরের হোটেল ব্যবস্থাপনায় প্রায় ৪০০০ অতিরিক্ত কক্ষ যোগ করেছে। ইউরোপ থেকে আনা এই দুটি জাহাজে একসঙ্গে ১০,০০০ জনেরও বেশি মানুষ থাকার ব্যবস্থা রয়েছে।
অক্টোবরের শেষের দিকে ইউরোপ থেকে যাত্রা শুরু করে ৩ নভেম্বর বেলেমে এসে পৌঁছায় জাহাজ দুটি। বেলেম শহরে প্রায় ১৪ লাখ মানুষ বাস করে। ফলে সম্মেলনের এত অতিথি সামলানোও শহর প্রশাসনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়ায়। এই অবস্থায় ক্রুজ জাহাজগুলোই হয়ে উঠেছে আশ্রয়ের ভরসা। অতিথিরা এখান থেকে সম্মেলন ভেন্যু, বিমানবন্দর ও শহরের নির্দিষ্ট জায়গায় বিনামূল্যে যাতায়াতের সুযোগ পাবেন। ব্রাজিলের প্রেসিডেন্টের চিফ অব স্টাফ রুই কস্তা বলেন, ‘এই জাহাজগুলো অতিথিদের জন্য নিরাপদ ও নিশ্চিত আবাসনের ব্যবস্থা করেছে। যারা কাজের জন্য বা শুধুমাত্র অংশগ্রহণের উদ্দেশ্যে বেলেমে এসেছেন।’
ব্যয়বহুল আয়োজন ও সমালোচনা
এই আয়োজনের জন্য বন্দরটিকে সাজাতে হয়েছে নতুনভাবে। ওতেইরোতে ক্রুজ জাহাজ নোঙরের উপযোগী অবকাঠামো তৈরি করতে ব্যয় হয়েছে প্রায় ৪ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার। স্থানীয় প্রশাসনের মতে, এটি কেবল সম্মেলনের জন্য নয়, বেলেম শহরের দীর্ঘদিনের অবকাঠামোগত ঘাটতি পূরণেরও একটি সুযোগ। বন্দরের সঙ্গে নতুন সেতু নির্মাণ, রাস্তা সংস্কার এবং যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে স্থানীয় বাসিন্দারাও সন্তুষ্ট। কিন্তু পরিবেশবাদীরা এই পুরো ব্যবস্থাপনাকে এক ধরনের বিদ্রূপের চোখে দেখছেন। তারা বলছেন, জলবায়ু রক্ষার উদ্দেশ্যে আয়োজিত সম্মেলনের অতিথিরা যে দুটি ডিজেলচালিত ক্রুজ জাহাজে অবস্থান করছেন, সেগুলোই আবার বিপুল পরিমাণে জ্বালানি পুড়িয়ে কার্বন নির্গমন করছে এবং নদীর পানি দূষিত করছে। এই ক্রুজ জাহাজগুলো বিপুল পরিমাণে জ্বালানি খরচ করে। যার ফলে তাদের কার্বন নিঃসরণও অনেক বেশি। কোস্টা ডায়াডেমা জাহাজটি প্রতি ঘণ্টায় প্রায় ১৩৫ লিটার ডিজেল খরচ করে। যেখানে এই সম্মেলনের মূল লক্ষ্যই হচ্ছে বিশ্বব্যাপী জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর নির্ভরতা কমানো, সেখানে এমন উচ্চ-নিঃসরণ জাহাজকে আবাসন হিসাবে ব্যবহার করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন পরিবেশবিদ ও সচেতন নাগরিকরা। এদিকে সমালোচকদের মন্তব্যে কিছুটা বিরক্ত হয়ে ব্রাজিলের প্রেসিডেন্ট লুইজ ইনাসিও লুলা দা সিলভা হেসে বলেন, ‘প্রয়োজনে প্রতিনিধি দল আকাশের নিচেই ঘুমোতে পারতেন। পরিবর্তে অনেকেই ঘুমোচ্ছেন পানির ওপর ভাসমান এই জাহাজে।’
অতিথিদের অভিজ্ঞতা
তবে সব অতিথি সন্তুষ্ট নন। কেউ কেউ অভিযোগ করছেন, কেবিনগুলো ছোট। অনেকেই বলছেন, সম্মেলনের স্থান থেকে ২০ কিলোমিটার দূরত্বের জন্য দীর্ঘপথ পাড়ি দিতে হয়। আবার অনেকে এই অদ্ভুত অভিজ্ঞতাকেই দেখছেন জীবনের স্মৃতি হিসাবে। দক্ষিণ আফ্রিকার শহর লেসোথোর বন বিভাগের কর্মকর্তা বেরেং মকেতে বলেন, ‘সাধারণত আমরা কনফারেন্সে হোটেল বা অ্যাপার্টমেন্টে থাকি। কিন্তু এবার অভিজ্ঞতাটা একেবারে ভিন্ন। যা হয়তো সারাজীবন মনে থাকবে।’
সম্মেলনের আগে থেকেই বেলেমে আবাসিক সংকট নিয়ে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়। আয়োজকরা বাধ্য হয়ে অতিথিদের জন্য ব্যক্তিগত বাড়ি, বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুলে থাকার ব্যবস্থা করেন। এরপর আসে এই ক্রুজ জাহাজের ধারণা। তবে আয়োজনের কমতি না থাকলেও রয়েছে প্রশ্ন- জলবায়ু সম্মেলনের অতিথিদের জন্য ডিজেলচালিত বিশাল জাহাজ ব্যবহার কতটা টেকসই সমাধান? কিন্তু আপাতত এটাই বেলেমের একমাত্র ভরসা।