জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন (কপ৩০) আসর তপ্ত হয়ে উঠেছে। চড়ছে বিতর্কের পারদ। ব্রাজিলের বেলেম শহরে চলমান সম্মেলনে গতকাল বৃহস্পতিবারের আলোচনার কেন্দ্রবিন্দু ছিল জলবায়ু অর্থ, ন্যায্য রূপান্তর, অভিযোজন ও গ্লোবাল স্টকটেক (জিএসটি)। তিন দিনের আলোচনার পর কিছু বিষয় স্পষ্ট হয়েছে। জলবায়ু অর্থায়ন, অভিযোজন তহবিল ও ন্যায্য রূপান্তর– এই তিন ইস্যু ঘিরেই নির্ধারিত হবে সম্মেলনের সাফল্য-ব্যর্থতা।
আফ্রিকান গ্রুপ ও লাইক মাইন্ডেড ডেভেলপিং কান্ট্রিজ (এলএমডিসি) উন্নত দেশগুলোর কাছ থেকে নির্দিষ্ট দায়বদ্ধতা ও নিশ্চয়তাপূর্ণ অর্থায়নের দাবি জানায়। লাতিন আমেরিকার জোট (এআইএলএসি) আন্তর্জাতিক ন্যায়বিচার আদালতের সাম্প্রতিক মতামত উল্লেখ করে জানায়, জলবায়ু সহযোগিতা এখন আর সদিচ্ছার বিষয় নয়, এটি আইনি বাধ্যবাধকতা।
তবে অভিযোজন তহবিলের জেন্ডার সমতা ও স্থানীয় নেতৃত্বের উদ্যোগের প্রশংসা এলেও অর্থের ঘাটতি বড় বাধা। আফ্রিকান গ্রুপ ও ছোট দ্বীপরাষ্ট্রগুলোর জোট (এওসিস) বলেছে, স্বীকৃত প্রতিষ্ঠানগুলোর পারস্পরিক স্বীকৃতি ও সরাসরি অর্থপ্রবাহ নিশ্চিত না হলে তহবিল কার্যকর হবে না। আফ্রিকান ও আরব দেশগুলো অভিযোজন তহবিলে অনুদান না বাড়ানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। অন্যদিকে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও সুইজারল্যান্ড স্বচ্ছতা আর নিরাপত্তার বিষয়টিতে জোর দিয়েছে।
প্রশমন কর্মসূচি (মিটিগেশন ওয়ার্ক প্রোগ্রাম) নিয়েও মতবিরোধ দেখা দিয়েছে। ক্ষুদ্র দ্বীপরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস লক্ষ্য ধরে রাখার আহ্বান জানালেও ভারত ও আরব দেশগুলো বলেছে, এটি যেন উন্নয়নশীল দেশের ওপর নতুন চাপ না হয়।
গতকালের সবচেয়ে উত্তপ্ত অধিবেশন ছিল ন্যায্য রূপান্তর নিয়ে তিন ঘণ্টার আলোচনা। ইউরোপ, প্রশান্ত মহাসাগরীয় দ্বীপ দেশ ও তরুণ সংগঠনগুলো জীবাশ্ম জ্বালানির ভর্তুকি তুলে দিয়ে নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসারে জোর দেয়। অন্যদিকে আরব ও এলএমডিসি দেশগুলো জানায়, উন্নয়ন ও জ্বালানি নিরাপত্তার জন্য জীবাশ্ম জ্বালানি এখনও অপরিহার্য।
বাংলাদেশের প্রতিনিধি যুবনেট গ্লোবালের নির্বাহী সমন্বয়ক সোহানুর রহমান বলেন, ন্যায্য রূপান্তর মানে শুধু শক্তি পরিবর্তন নয়। এটি সামাজিক, অর্থনৈতিক ও প্রজন্মগত ন্যায়বিচারের প্রশ্ন। মানুষকে লাভ নয়, কেন্দ্রে রাখতে হবে।
ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, নিউজিল্যান্ড, উরুগুয়ে ও পরিবেশ সচেতন গোষ্ঠীগুলোর প্রতিনিধিরা বলেছে, সব মানুষের জন্য পরিচ্ছন্ন, সাশ্রয়ী ও নির্ভরযোগ্য জ্বালানির প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করতে হবে। নবায়নযোগ্য শক্তির প্রসার, পরিষ্কার রান্নার জ্বালানি, জ্বালানি নিরাপত্তা ও জীবাশ্ম জ্বালানি পরিত্যাগের সামাজিক-অর্থনৈতিক সুফলও আলোচনার অংশ হওয়া দরকার।
এদিকে কপ৩০-এর ‘এডুকেশন ডে’তে বিশ্বজুড়ে তরুণরা অভিযোজন নিয়ে ‘গ্লোবাল ইয়ুথ কল টু অ্যাকশন অন অ্যাডাপটেশন’ ঘোষণা করেছে। এতে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিকল্পনা (এনডিসি) ও জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনায় (ন্যাপ) তরুণদের অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানানো হয়।
গ্লোবাল সেন্টার অন অ্যাডাপটেশন (জিসিএ) জানায়, ৯০টির বেশি দেশের তরুণরা এই ঘোষণায় অংশ নিয়েছে। তারা অভিযোজন তহবিল বাড়ানো, স্থানীয় জ্ঞান সংযোজন, সবুজ কর্মসংস্থান ও প্রযুক্তিতে বিনিয়োগ বাড়ানোর সুপারিশ করেছে। তরুণদের বার্তা স্পষ্ট– অভিযোজন সফল হবে
না, যদি তরুণদের নেতৃত্ব ও টেকসই বিনিয়োগ নিশ্চিত না হয়।
একই দিনে আলোচনায় উঠে আসে ১ দশমিক ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা সীমার প্রশ্ন। যুক্তরাজ্য, ইইউ ও দ্বীপরাষ্ট্রগুলো কার্বন নির্গমন হ্রাসকে এই লক্ষ্যের সঙ্গে যুক্ত করার আহ্বান জানায়। তবে লাতিন আমেরিকার দেশগুলো জানায়, এই লক্ষ্য রাখতে হলে অর্থায়নের প্রতিশ্রুতিও স্পষ্ট করতে হবে। আলোচনায় কোনো ঐকমত্য না হওয়ায় বৈঠক স্থগিত করা হয়েছে।
ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়ছে, বিশ্ব এখনও বিপর্যয়কর ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রা বাড়ার পথে এগোচ্ছে। দেশগুলোর জলবায়ু প্রতিশ্রুতি যথেষ্ট শক্তিশালী নয়। অথচ জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে নিঃসরণ রেকর্ড উচ্চতায় পৌঁছেছে।
ব্রাজিলে অনুষ্ঠিতব্য জাতিসংঘের জলবায়ু সম্মেলন কপ৩০-এর জন্য দেশগুলোর নতুন নিঃসরণ হ্রাস পরিকল্পনাগুলোও যথেষ্ট নয় বলে জানিয়েছে ক্লাইমেট অ্যাকশন ট্র্যাকার। তাদের হিসাব অনুযায়ী, শতাব্দীর শেষে পৃথিবীর তাপমাত্রা শিল্পপূর্ব সময়ের চেয়ে প্রায় ২ দশমিক ৬ ডিগ্রি বেড়ে যাবে, যা গত বছরের মতোই রয়ে গেছে।
গতকাল বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছে, জলবায়ু সংকটই এখন স্বাস্থ্য সংকট। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন সরাসরি মানুষের স্বাস্থ্যের ওপর পড়ছে। তাই এখন সময় এসেছে জলবায়ু সম্মেলনগুলোতে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাস্থ্য নিয়ে আলোচনা শুরু করার। ডব্লিউএইচও প্রধান টেড্রোস আধানম গেব্রিয়াসুস বেলেমে কপ৩০ সম্মেলনে অংশ নেন। সেখানে তিনি জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক আলোচনায় স্বাস্থ্যকে আরও গুরুত্ব দেওয়ার আহ্বান জানান।