Image description

গাজা যেন পরিণত হয়েছে ঐতিহাসিক কারবালার প্রান্তরে। ইসরায়েলি বাহিনী বিগত পৌনে দুই বছরে নিরবচ্ছিন্নভাবে হামলা চালিয়ে অঞ্চলটির পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ধ্বংস করে দিয়েছে। আর এখন অঞ্চলটিতে ত্রাণ প্রবেশ করতে না দিয়ে গাজাবাসী তৃষ্ণার্ত থাকতে বাধ্য করছে।

কারবালার প্রান্তরে ইমাম হুসাইন (রা.) ও তাঁর সঙ্গীদের জন্য পানি সংগ্রহ একটি অত্যন্ত কঠিন ও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় ছিল। আজ ঠিক একই পরিণতি বরণ করেছে গাজাবাসী। এজিদের বাহিনী ইমাম হুসাইনের শিবির অবরোধ করে ফোরাত নদীর পানি সরবরাহ যেমন বন্ধ করে দিয়েছিল, ঠিক একই কৌশলে গাজার পানি সরবরাহ ধ্বংস করে দিয়েছে ইসরায়েল। আর ইসরায়েল সৃষ্টি সেই কারবালার প্রান্তরে নির্মমভাবে প্রাণ হারাল দুই সহোদর ৯ বছরের কারাম আল-ঘুসাইন ও ১০ বছরের লানা ওরফে লুলু।

নয় বছর বয়সী কারাম আল-ঘুসাইন, তার ছোট্ট হাতে পাত্র নিয়ে যাচ্ছিল পরিবারের জন্য একটুখানি পানি সংগ্রহের আশায়। প্রায় পৌনে দুই বছর ধরে চলা ইসরায়েলি আগ্রাসনের কারণে তার বাড়িঘর ধূলিসাৎ। এখন আশ্রয় নিয়েছে স্থানীয় একটি স্কুলে। আর কয়েকটি গলি পেরিয়ে গেলেই কারাম পৌঁছে যেত, পানি সংগ্রহের সেই স্থানে। কিন্তু তার আগেই ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র এসে পড়ল ঠিক সেই স্থানে, যেখানে কারাম দাঁড়িয়েছিল।

দশ বছর বয়সী লুলু, যার আসল নাম ছিল লানা—সেও ছুটে এসেছিল তার ছোট ভাইকে সাহায্য করতে। মতোই কোমল হৃদয়ের অধিকারী এই মেয়েটির মুখ ছিল হাসিমাখা আর দয়ায় ভরা ছিল ছোট্ট মন। ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ভাইয়ের সঙ্গে বোনও চলে গেছে এই দুনিয়া ছেড়ে।

কারামের বাবা আশরাফ তাকে আদর করে ডাকতেন ‘আবু শরিক’ অর্থাৎ ‘আমার অংশীদার’ বলে। অভাবের সংসারেও ছেলের রিমোট কন্ট্রোল গাড়ির আবদার মেটাতে পারেননি মা হেবা। আজ সেই স্মৃতি তাঁর বুকে শেল হয়ে বিঁধছে।

বোমায় ছিন্নভিন্ন হওয়া কারাম ও লুলুর নিথর দেহ শেষবারের মতো দেখারও অনুমতি পাননি তাদের মা। তাঁর ভাই তাঁকে আগলে ধরেছিল, যাতে সে বীভৎস দৃশ্য দেখতে না পারে। কাঁদতে কাঁদতে হেবা বলেন, ‘এরপর আর কিছুই মনে নেই, যেন বাস্তবতার সঙ্গে আমার আর কোনো যোগসূত্র ছিল না।’

লুলু ভালোবাসত মুসাখান, মুরগি আর পেঁয়াজের সুস্বাদু ফিলিস্তিনি খাবার। কারামের স্বপ্ন ছিল শরমা খাওয়ার। তাদের ছোট্ট ছোট্ট ইচ্ছেগুলো যুদ্ধ কেড়ে নিয়েছে। গত মার্চ থেকে চলা নির্মম অবরোধে গাজায় পানি এখন সোনার চেয়েও দামি, আর সেই পানির খোঁজে যাওয়াও যেন সাক্ষাৎ মৃত্যুর হাতছানি।

হেবা ভেবেছিলেন, খাবার খোঁজার চেয়ে পানি আনতে পাঠানো হয়তো নিরাপদ হবে। তাদের আশ্রয় নেওয়া স্কুল থেকে কয়েক পা দূরেই ছিল সেই পানি বিতরণের স্থান। কারাম ঘণ্টার পর ঘণ্টা লাইনে দাঁড়িয়ে থাকত, কখনো খালি হাতে ফিরত, কখনো ২০ লিটারের ভারী পানির পাত্র নিয়ে আসত। এতটুকু ক্লান্তি বা বিরক্তি দেখা যেত না তার ছোট্ট মুখটিতে।

সেদিন পানির স্টেশনে ভিড় ছিল কম। কারাম যখন লাইনের একদম সামনে, ঠিক তখনই লুলু এসে তার পাশে দাঁড়াল। সাহায্য করতে চেয়েছিল ভাইকে। আর ঠিক সেই মুহূর্তেই আকাশ থেকে মৃত্যুদূত হয়ে নেমে এল ইসরায়েলি ক্ষেপণাস্ত্র।

প্রত্যক্ষদর্শী আলী আবু জায়েদ জানান, ‘প্রতিটি শিশুর হাতে ছিল পানির বালতি, রক্তাক্ত অবস্থায় তারা সেখানেই পড়ে ছিল। তাদের ছোট দেহগুলো যেন ঝাঁজরা হয়ে গিয়েছিল। বাতাসে শুধু বারুদের গন্ধ।’ অ্যাম্বুলেন্সের পৌঁছাতে দেরি হওয়ায় গাধার গাড়িতে করেই আহত ও নিহতদের নেওয়া হচ্ছিল হাসপাতালের দিকে।

আশরাফ যখন বিস্ফোরণের শব্দ শুনে ছুটে যান ঘটনাস্থলে, দেখতে পান—তাদের পানির পাত্রগুলো দুমড়ে-মুচড়ে পড়ে আছে, রক্তে ভেজা সবকিছু। হাসপাতালে গিয়ে শনাক্ত করলেন দুই সন্তানের নিথর দেহ। কান্না দমিয়ে আশরাফ বলার চেষ্টা করলেন, ‘তাদের ওভাবে দেখে মনে হচ্ছিল যেন আমার হৃৎপিণ্ডে কেউ ছুরি মারছে।’

হেবা পাগলের মতো খুঁজেছিলেন তাঁর দুই সন্তানকে, ভেবেছিলেন হয়তো তারা আশ্রয়ে ফিরে গেছে। এর আগেও দুটি বোমা হামলায় বেঁচে গিয়েছিল কারাম ও লুলু। কিন্তু তৃতীয়বার আর পারল না। কেউ সাহস করে হেবাকে তাদের মৃত্যুর খবরটি জানাতে পারেনি। অবশেষে আল-আওদা হাসপাতালে গিয়ে তিনি জানতে পারেন, দুই সন্তানের নিথর দেহ পড়ে আছে স্বামীর পাশে।

ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী দাবি করেছে, ‘এক জঙ্গিকে লক্ষ্য করে চালানো অভিযানে ত্রুটির’ কারণে এই মর্মান্তিক ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আশরাফ এই দাবি মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘তাদের অত্যাধুনিক প্রযুক্তি, তারা জানে তাদের ক্ষেপণাস্ত্র কোথায় পড়বে। এটা কীভাবে ভুল হতে পারে? একটা ভুল আমার দুটি নিষ্পাপ জীবন কেড়ে নিল?’

কবর দেওয়ার মতো সামান্য অর্থও নেই আশরাফ-হেবা দম্পতির। তাই হেবার বাবার কবরের পাশেই চিরনিদ্রায় শায়িত করা হয়েছে কারাম ও লুলুকে। তাদের ১৮ মাস বয়সী ছোট বোন ঘিনা এখন অপুষ্টি, চর্মরোগ ও পানিশূন্যতায় ভুগছে। গাজার হাজার হাজার শিশুর মতোই, যাদের কাছে খাবার, পানি ও ওষুধ প্রায় দুর্লভ হয়ে উঠেছে। ইসরায়েলি বাহিনী যেভাবে পানিকে অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করেছে, তাতে গাজা হয়ে উঠেছে আরেক ঐতিহাসিক কারবালা।

হেবা বলেন, ‘আমরা ক্ষুধার্ত অবস্থায় ঘুমাই, ক্ষুধার্ত অবস্থাতেই জেগে উঠি। তেষ্টা তো লেগেই থাকে সব সময়। লবণাক্ত পানি পরিশোধন কেন্দ্রগুলো তেমন চলে না। সারা বিশ্ব এটা দেখছে, তবু সবাই চোখ বন্ধ করে রেখেছে।’

ইউনিসেফ আগেই সতর্ক করেছে, গাজার পানি সরবরাহ ব্যবস্থা ভেঙে পড়ায় শিশুরা তৃষ্ণায় মারা যাওয়ার ঝুঁকিতে রয়েছে। গাজায় বেঁচে থাকাই এখন প্রতিরোধের অপর নাম, আর সেই প্রতিরোধ প্রায়শই ডেকে আনে নির্মম মৃত্যু।

এর আগে, মধ্য গাজায় একটি পানি সংগ্রহ কেন্দ্রে ইসরায়েলি হামলায় অন্তত ১০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়, যাদের মধ্যে ছয়জনই ছিল শিশু।

তথ্যসূত্র: দ্য গার্ডিয়ান