সভ্য সন্তানই পারে জাতিকে সভ্য করতে
04 April 2018, Wednesday
দার্শনিক নেপোলিয়ন বলেছিলেন ‘আমাকে একটি শিক্ষিত মা দাও, আমি একটি শিক্ষিত জাতি উপহার দেবো।’ আজ থেকে একশ’ বছর আগে ফরাসি সম্রাট থাকাকালীন অবস্থায় এই বিখ্যাত উক্তিটি করেছিলেন তিনি।
নেপোলিয়নকে কার্যত বলা হয় ফ্রান্সের ত্রাণকর্তা। তার মধ্যে সাম্রাজ্যবাদী মনোভাব থাকলেও ফ্রান্সকে তিনি বদলে দিয়েছিলেন। শিক্ষার হার বাড়াতে তার ভূমিকা ছিল অনবদ্য। কিন্তু বর্তমান সময়ে বিশ্বব্যাপী শিক্ষায় উন্নয়ন হলেও মানুষের মনুষ্যত্বের বিকাশ ঘটেনি। আজ নেপোলিয়ন যদি বেঁচে থাকতেন, হয়তো বলতেন, ‘আমাকে একটি সভ্য সন্তান দাও, আমি একটি সভ্য জাতি উপহার দেবো।’
আমাদের দেশে কোনো ঘটনা ঘটলেই সেটি নিয়ে অনেক মাতামাতি হয়, প্রতিবাদ হয়, নিন্দার ঝড় বয়ে যায় অনলাইন কিংবা অফলাইনে। টক শো টেবিলের ইস্যু বাড়ে। তেমনি গত বছর দেশের এক প্রভাবশালী ব্যবসায়ীর পুত্রসহ পাঁচজনের বিরুদ্ধে যৌন-নিপীড়নের অভিযোগ করেন বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুজন ছাত্রী। মামলাও হয়েছে থানায়। ব্যাপারটি নিয়ে অনেক আলোচনা-সমালোচনাও হয়েছিল। সবাই যৌন-নিপীড়নে অভিযুক্ত যুবকদের সমালোচনা কিংবা ঘৃণা দিয়ে ধুয়ে দিচ্ছে। এরপরেও কিন্তু এমন ঘটনা ঘটেই যাচ্ছে। কোনো সমাধানই হচ্ছে না।
‘পাপীকে নয়, পাপকে ঘৃণা কর’—বহুল প্রচলিত একটি বাংলা প্রবাদ। কিন্তু আমরা এই প্রবাদটির সদ্ব্যবহার কখনোই করার চর্চা করি না। তাই যৌন নিপীড়ককে নয়, যৌন নিপীড়নকেই ঘৃণা করতে হবে। যৌন নিপীড়নই তৈরি করে যৌন নিপীড়ককে। এই ধারা থেকে বের হয়ে আসতে পারলে কিছুটা হলেও সামাজিক অনাচারের মতো এসব অপরাধ কমবে।
যৌন নিপীড়নের ঘটনা কিন্তু আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারতের চেয়ে আমাদের দেশে অনেক কম। তাই এটি প্রতিরোধ করাও সহজ; যদি সবাই নিজের মন থেকে সচেতন ও বিশুদ্ধ থাকি। বিশ্বায়নের এই যুগে যৌন নিপীড়ন একটি বৈশ্বিক সমস্যা। পৃথিবীর সব দেশেই কমবেশি ঘটছে এই নিকৃষ্ট ঘটনাটি।
পরিসংখ্যান বলে, বিশ্বে সবচেয়ে বেশি যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটে আমেরিকাতে। দেশটিতে যৌন নিপীড়নের শিকার নারীর পরিসংখ্যান ৯১%। আরেকটি সমীক্ষা অনুযায়ী ছয়জন নারীর মধ্যে নিপীড়নের শিকার হয় একজন। এই সমীক্ষায় দ্বিতয়ি দক্ষিণ আফ্রিকা, চতুর্থ ভারত, পঞ্চম ব্রিটেন, ষষ্ঠ জার্মানি, সপ্তম ফ্রান্স, অষ্টম কানাডা, নবম শ্রীলঙ্কা এবং দশম অবস্থানে আছে ইথিওপিয়া।
তালিকায় চার নম্বরে থাকা ভারতের ন্যাশনাল ক্রাইম রেকর্ড ব্যুরো অনুযায়ী ২০১২ সালে ভারতে ধর্ষণের অভিযোগ জমা পড়ে ২৪ হাজার ৯২৩টি। দেশটিতে ধর্ষণের শিকার হওয়া ১০০ জন নারীর মধ্যে ৯৮ জনই আত্মহত্যা করেন। প্রতি ২২ মিনিটে ভারতে একটি করে ধর্ষণের অভিযোগ দায়ের হয়। পরিসংখ্যানেই বোঝা যায় এই সমস্যাটি কতটা ভয়াবহতা ধারণ করেছে সারা বিশ্বে।
এবার আসা যাকে আমাদের দেশের যৌন হয়রানির পরিসংখ্যানে। আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) বাংলাদেশের মানবাধিকার পরিস্থিতি ও পর্যালোচনামূলক প্রতিবেদনের তথ্যানুযায়ী ২০১৬ সালে ৭২৪ জন নারী যৌন নিপীড়নের শিকার হয়। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসহ বিভিন্ন কর্মস্থলে যৌন নির্যাতন ও বখাটের উত্ত্যক্তকরণের শিকার হন ২৪৪ জন। ২০১৫ সালে সারা দেশে ৮৪৬ নারী-শিশু যৌন নিপীড়নের শিকার হন। এর ঠিক আগের বছর ২০১৪ সালে ৭০৭ জন ধর্ষণের শিকার হন। তবে পরিসংখ্যানের বাইরেও অনেক ঘটনা ঘটে, যা প্রকাশ্যে আসে না। চক্ষুলজ্জার ভয়ে অনেকেই মুখ বুজে যৌন নির্যাতন সহ্য করে যান।
প্রতিক্রিয়াশীল অবস্থানে থাকা আমাদের দেশের পরিসংখ্যান কিন্তু বাড়া-কমা করছে। সমাজে প্রতিনিয়ত পরিবর্তন ঘটছে। সংযোজন-বিয়োজনের কারণে এ রকম অস্থিরতা বিরাজ করছে সমাজে। ফলে অপরাধের মাত্রা বাড়ছেই। বিচারবহির্ভূত আইনব্যবস্থা, পুরুষদের মানসিকতার পরিবর্তন না হওয়া, পশ্চিমা সংস্কৃতি ও বিশ্বায়নের ক্ষতিকর প্রভাব যতদিন না বন্ধ হবে, ততদিন যৌন নিপীড়নের মতো অপরাধের প্রবণতা বাড়তেই থাকবে।
নেপোলিয়নের সময় নারী শিক্ষার অভাব ছিল। সভ্যতার বিকাশ না ঘটলেও এতটা অসভ্য ছিল না। তাই তিনি নারী শিক্ষার ওপর জোর দিয়েছিলেন। কিন্তু বর্তমানে বিশ্বের মতো আমাদের দেশেও নারী শিক্ষার হার বাড়ছে। কিন্তু মায়েরা শিক্ষিত হলেও সন্তানদের মধ্যে সভ্যতার যথেষ্ট অভাব রয়েছে। তবে সব ক্ষেত্রেই এই যুক্তি প্রযোজ্য নাও হতে পারে। রাজধানীর বনানীতে যারা যৌন নিপীড়নের ঘটনা ঘটিয়েছে তাদের মায়েরা নিশ্চয়ই অশিক্ষিত নন। তারাও তো সমাজে সমাদৃত, উচ্চ রুচির শৃঙ্খলে আবর্তিত। তবে কেন এই ঘটনা? কারণ তার মায়েরা শিক্ষিত হলেও তাদের সন্তানদেরকে সভ্য করতে অক্ষম। তারা নিশ্চয়ই সন্তানদের শেখাননি একটি নারীকে কীভাবে সম্মান দিতে হয়, নারীর মধ্যে মায়ের প্রতিচ্ছবি আবিষ্কার করার কলা-কৌশলটাও রপ্ত করতে শেখাননি, একজন নারীর মধ্যে কীভাবে নিজের অস্তিত্ব বিলিয়ে দিতে হয়, তাও শেখাননি।
তাহলে তো শিক্ষিত মা কামনার পাশাপাশি সভ্য সন্তান কামনা করাই যেতে পারে। অবশ্য এর জন্য দরকার পরিকল্পনা। তা স্বল্পমেয়াদিও হতে পারে আবার দীর্ঘমেয়াদিও হতে পারে। এ জন্য যার যার অবস্থানে থেকে বৈশ্বিক এই অপরাধ দমনে কাজ করতে হবে। রাষ্ট্রকেও এগিয়ে আসতে হবে।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন