গেল সপ্তাহে সরকারের তিন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী তিনটি বাণী দিয়েছেন। সামাজিক-অসামাজিক সব মাধ্যমে বাণীগুলোর কাটাছেঁড়া হয়েছে অনেক। সময়ের অভাবে মন্ত্রী মহোদয়রা তাঁদের বাণীগুলোর ব্যাখ্যা দিতে পারেননি। রস+আলো নিজ দায়িত্বে সেগুলো বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করল। লিখেছেন আসফিদুল হক
আমরা বিদেশে জ্ঞান রপ্তানি করব: শিক্ষামন্ত্রী
মূল বাণী: উচ্চশিক্ষায় গবেষণা খাতে বরাদ্দ বাড়িয়েছে সরকার। এ জন্য আগের তুলনায় অনেক গবেষণা হচ্ছে, জ্ঞান সমৃদ্ধ হচ্ছে। ফলে খুব দ্রুতই সেই জ্ঞান আমরা বিদেশে রপ্তানি করব, প্রযুক্তি রপ্তানি করব।
নুরুল ইসলাম নাহিদ, শিক্ষামন্ত্রী
রাজধানীর পলাশীতে ব্যানবেইস কার্যালয়ে এক কর্মশালায় (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, ৫ মার্চ ২০১৮)
বাণীর ব্যাখ্যা: শস্য-শ্যামলা, সুজলা-সুফলা এবং জ্ঞানে টলটলা আমাদের এই বাংলাদেশ। যে জ্ঞান আমরা পকেটের চিপায়-চাপায় রাখি, তা অন্যান্য দেশে মাইক্রোস্কোপ দিয়েও খুঁজে পাওয়া যায় না। কীভাবে একটা আস্ত ব্যাংকের টাকা দিনে-দুপুরে উধাও করে ফেলা যায়, গুনে গুনে ঘুষ খাওয়া যায়, আবার ঘুষ খেয়ে ধরা খেলেও পিছলে বের হওয়া যায়, কীভাবে খুনের মামলার আসামি হয়েও হাসপাতালে বিলাসী জীবন যাপন করা যায়, কাজ না করেই বিভিন্ন প্রকল্পের টাকা উঠিয়ে নেওয়া যায়—এ ধরনের জ্ঞান আমাদের অসীম। এই জ্ঞানভান্ডারে সাম্প্রতিক সময়ে যুক্ত হয়েছে প্রশ্ন ফাঁসসংক্রান্ত জ্ঞান। সর্বশক্তি দিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়েও শিক্ষা মন্ত্রণালয় মূল প্রশ্ন ফাঁসকারীদের ধরতে পারছে না। উল্টো প্রশ্ন ফাঁসকারীরা প্রতিনিয়ত শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে রীতিমতো শিক্ষা দিয়ে প্রশ্ন ফাঁস করে যাচ্ছে। জীবন থেকে নেওয়া এসব অনুপ্রেরণামূলক ঘটনাই শিক্ষামন্ত্রীকে উৎসাহিত করেছে, অনুপ্রাণিত করেছে বিদেশে জ্ঞান রপ্তানি করার জন্য। দেরিতে হলেও শিক্ষামন্ত্রীর মাথায় এ রকম একটা জবরদস্ত আইডিয়া আসায় আমরা তাঁকে ‘রপ্তানিযোগ্য’ ধন্যবাদ জানাই। তাঁর এই আইডিয়ার কারণে অচিরেই হয়তো আমরা দেখব রপ্তানিযোগ্য পোশাক এবং চিংড়ির মতো জ্ঞানও কার্টনে ভরে বিদেশে রপ্তানি হচ্ছে। ওয়ালমার্টের মতো বিখ্যাত চেইন শপগুলো তখন অন্যান্য পণ্য বাদ দিয়ে শুধু আমাদের জ্ঞানের কার্টন দিয়েই শেলফ ভরে ফেলবে। তবে টাকার মতো জ্ঞানও কিন্তু অবৈধ পথে পাচার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা আছে! তাই দেরি না করে এখন থেকেই ‘জ্ঞান মন্ত্রণালয়’ নামক একটি আলাদা মন্ত্রণালয় করে বিষয়টি নিয়ে আলাদাভাবে গবেষণা করার জোর দাবি রাখে।
ছুরি ছিল বলে ধরা পড়েনি: অর্থমন্ত্রী
মূল বাণী: ছুরি লুকিয়ে রাখা যায় বলে আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে রামদা হলে দেখা যেত, আগেই হামলা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো।
আবুল মাল আবদুল মুহিত, অর্থমন্ত্রী
লেখক-অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে (সূত্র: সারাবাংলা ডটনেট, ৫ মার্চ ২০১৮)
বাণীর ব্যাখ্যা: পুলিশের সামনে ছুরি নিয়ে অধ্যাপক মুহম্মদ জাফর ইকবালের ওপর হামলা প্রসঙ্গে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে সবার অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছেন, ‘ছুরি লুকিয়ে রাখা যায় বলে আগে থেকে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। তবে রামদা হলে দেখা যেত, আগেই হামলা প্রতিরোধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হতো।’ মন্ত্রী মহোদয়ের এ কথা শুনে আমরা চমকে উঠে ভেবেছি, আরে তাই তো, বিষয়টা যে আমাদের কারও মাথায়ই আসেনি! ছুরির বদলে রামদা নিয়ে এলে হামলাকারী খুব সহজেই ধরা পড়ে যেত। কারণ, রামদার আকার ছুরির তুলনায় অনেক গুণ বড়, ফলে সেটা লুকিয়ে রাখা অসম্ভব। হামলাকারী অনেক বুদ্ধিমান, তাই সে ছুরি নিয়ে এসেছিল হামলা করতে। তবে আমাদের অর্থমন্ত্রীও কিন্তু কম বুদ্ধিমান নন। এ রকম বুদ্ধি আমরা দেখেছি এরকুল পোয়ারো, শার্লক হোমস বা ফেলুদার মধ্যে। তাই আমরা আশা করি, অবসর নেওয়ার পর অর্থমন্ত্রীর কাছ থেকে একটি জমজমাট,
রহস্যে ঘেরা গোয়েন্দা কাহিনি পাব, যেখানে আততায়ীরা পুলিশকে বোকা বানানোর জন্য সাগরেদের হাতে রামদা তুলে দেবে এবং নিজে ছুরি নিয়ে ঘুরবে। তবে ছুরি নিয়ে ঘুরলেও সে মানুষ খুন করবে না, বরং ব্যাংক থেকে মাত্র চার হাজার কোটি টাকা নিয়ে ভাগবে। এখন দেখার বিষয় হচ্ছে, গল্পে অর্থমন্ত্রীর তৈরি করা গোয়েন্দা চরিত্রটি কি টাকা উদ্ধার করতে পারবে, নাকি পারবে না? আগামী কোনো এক বইমেলায় হয়তো আমরা এসব প্রশ্নের উত্তর পাব।
যত দিন পৃথিবী থাকবে তত দিন মশা থাকবে: স্বাস্থ্যমন্ত্রী
মূল বাণী: যত দিন পৃথিবী থাকবে, তত দিন মশাও থাকবে। কামড়ও থাকবে। তবে এবার মশার কামড় থেকে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগের কোনো আশঙ্কা নেই।
মোহাম্মদ নাসিম, স্বাস্থ্যমন্ত্রী
সচিবালয়ে চিকুনগুনিয়া ও ডেঙ্গু রোগের প্রাদুর্ভাব প্রতিরোধে গৃহীত ব্যবস্থা ও রোগ দমনে ভবিষ্যৎ করণীয় সম্পর্কিত এক সভায় (সূত্র: বাংলা ট্রিবিউন, ৮ মার্চ ২০১৮)
বাণীর ব্যাখ্যা: অনেক কাল আগের কথা। শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায় তখন খুব ডাল খেতে ভালোবাসতেন। প্রচুর পেঁয়াজ, রসুন, শুকনো মরিচ ও টমেটো দিয়ে বাগাড় দেওয়া ঘন ডাল না হলে তিনি খেয়ে মজা পেতেন না। একবার হয়েছে কী, মজা করে ঘন ডাল খেতে গিয়ে শরৎবাবু দেখেন, ডালের ওপর তেলাপোকা ভাসছে। সেটা দেখে তিনি ঘেন্নায় কিলবিলিয়ে উঠলেন। কিন্তু স্ত্রীর ভয়ে তেমন কিছু বলতেও পারলেন না। শুধু মিনমিনিয়ে বললেন, ‘অতিকায় হস্তী লোপ পাইয়াছে কিন্তু তেলাপোকা টিকিয়া আছে।’ শরৎবাবুর কপাল ভালো, তিনি স্মার্টফোনের যুগ পর্যন্ত টেকেননি। তাহলে তাঁকে ডালের ওপর তেলাপোকার বদলে নিত্য মশা খেতে হতো এবং ফেসবুকে স্ট্যাটাস দিয়ে বলতে হতো, ‘অতিকায় তেলাপোকা লোপ পাইয়াছে, কিন্তু মশা টিকিয়া আছে! টিকিয়া থাকিবে আজীবন।’ তবে এই চিরন্তন সত্যটুকু শরৎবাবু না বলে যেতে পারলেও আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী কিন্তু ঠিকই বলে দিয়েছেন। আমরাও স্বাস্থ্যমন্ত্রীর সঙ্গে একমত। কারণ, সৃষ্টির শুরু থেকে আমরা মশা মেরে আসছি, কিন্তু তাদের নির্বংশ করা যায়নি, ভবিষ্যতেও যাবে না। এই সত্যটুকু মেনে নিয়ে আমরা এখন থেকে আর মশাদের পেছনে সময় নষ্ট করব না। সিটি করপোরেশনগুলোরও উচিত মশা নিধনে কোটি কোটি টাকার ওষুধ ছিটানো বন্ধ করা। কারণ, এসব ওষুধ পানির সঙ্গে মিশে দিনকে দিন পানি বিষাক্ত করে তুলছে। এর ফলে আমরা যখন চিকুনগুনিয়া, ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে পানির জন্য হাহাকার করব, তখন আমাদের পান করতে হবে মশার ওষুধ মেশানো বিষাক্ত পানি। তাই এখন থেকেই মশা নিধনের সব পথ বন্ধ করে ঘরে বসে মশার অত্যাচার সহ্য করার দক্ষতা বাড়ানো আমাদের কর্তব্য। কারণ, একদিন আমরাও হারিয়ে যাব, কিন্তু টিকে থাকবে মশারাই।
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন