লন্ডনে অবস্থানরত এক অকালকুষ্মাণ্ড বিকারগ্রস্ত রাজনীতিকের নিয়মিত বিষোদ্গার ইদানিং প্রচারমাধ্যমের সরস উপাদান হয়ে দাঁড়িয়েছে। তারেক রহমান নামের এই ব্যক্তিটি গত কিছুদিন যাবৎ একের পর এক যেসব বক্তব্য দিয়ে চলেছেন, তাতে তিনি যে দলটির নেতা সেই দলের মুখ এবং মান রাখা দায় রাখা হয়ে পড়েছে। সর্বশেষে তিনি বললেন, শেখ মুজিবকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে বিচার করা হবে।
শেখ মুজিব ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ তো পাকিস্তানের দৃষ্টিতে। তিনি পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশের জন্য স্বাধীনতা এনেছেন। পাকিস্তানিরা তাঁকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ হিসেবে আগরতলা মামলার প্রধান আসামি করেছিল, সামরিক আদালতে বঙ্গবন্ধুসমেত ৩৫ জনের বিচার হয়েছিল। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে পাকিস্তানি সামরিক কর্মকর্তা থেকে শুরু করে তৎকালীন পাকিস্তানি রাজনীতিক কিংবা শাসকদের যত মন্তব্য এ যাবৎ প্রকাশিত হয়েছে, সেগুলোর প্রায় সবক‘টাতেই শেখ মুজিবকে ‘রাষ্ট্রদ্রোহী’ বলা হয়েছে।
তারেক রহমান তার সাম্প্রতিক বক্তব্যে ওই পাকিস্তানি সামরিক জান্তারই প্রতিধ্বনি করলেন। এ মন্তব্য বাংলাদেশে বিএনপির রাজনীতির জন্য যে কী পরিমাণ ক্ষতি করে ফেলল, তা ওই বাচাল যুবকের পক্ষে অনুধাবন করাও সম্ভব নয়। বিএনপিতে যাঁরা রাজনীতি করেন, কিংবা রাজনৈতিক পরিমণ্ডলের সঙ্গে সম্পর্কিত, তাঁরা কিছুটা নিশ্চয়ই অনুভব করবেন যে, লন্ডনে বসে তারেক জিয়া দলের অস্তিত্বের জন্য কী মারাত্মক ক্ষতিসাধন করে চলেছেন। তিনি যখনই মুখ খুলছেন, তখনই তাঁরা বিব্রত হচ্ছেন, শঙ্কিত এবং হতাশ হচ্ছেন।
লন্ডনে তিনি যা যা বলেছেন, যা যা বলছেন, তার পিতা জীবদ্দশায় সে রকম একটি বাক্যও উচ্চারণ করেননি। জিয়া যত অপকর্মই করুন, কথায় কিংবা ভাষায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে সামান্যতম অসৌজন্যমূলক শব্দ মৃত্যুর পূর্ব পর্যন্ত কখনও উচ্চারণ করেননি। তার মা বেগম খালেদা জিয়া বাংলাদেশে সোয়া দুইবার প্রধানমন্ত্রী হয়েছেন। অসংখ্য জনসভায় তিনি বক্তৃতা করে আওয়ামী লীগকে তুলোধুনো করেছেন, বঙ্গবন্ধুকন্যাকে তিনি নানাভাবে সমালোচনা করেছেন, অনেক সময় অনেক অরাজনৈতিক, অকর্ষিত, অশোভন বাক্যাবলী প্রয়োগও করেছেন। বঙ্গবন্ধু সম্পর্কেও মাঝেমধ্যে কটূক্তি করেছেন বলে মনে পড়ে। তবে বেগম জিয়া বঙ্গবন্ধুকে চূড়ান্ত অপমান করেছেন ১৫ আগস্ট ‘মিথ্যা’ জন্মদিন পালন করে।
আর তাদের অর্বাচীন পুত্র বল্গাহীনভাবে এমন একজনকে কদর্য ভাষায় আক্রমণ করে চলেছেন যিনি আর কেউ নন, স্বয়ং বাংলাদেশের মহানায়ক জাতির জনক শেখ মুজিবুর রহমান। তারেক জিয়া গত কিছুদিন ধরে তার দলের সর্বনাশ কীভাবে করে চলেছেন সেটা বিশ্লেষণ করলে দেখা যাবে–
তারেক রহমান দলের নীতির পথে হাঁটেননি
তারেক রহমান দলের নীতির পথে হাঁটেননি
১. তিনি প্রকাশ্যে মুক্তিযুদ্ধবিরোধী বক্তব্য দিয়ে একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধকে জামায়াতি এবং পাকিস্তানি কায়দায় ব্যাখ্যা করছেন;
২. বিএনপির নীতি হচ্ছে বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার প্রশ্নে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আপাতত খুব বেশি বিতর্কিত না করে স্বাধীনতা-পরবর্তী আওয়ামী লীগের ভূমিকা, বিশেষ করে, বাকশাল প্রতিষ্ঠার বিষয়টিকে কঠোরভাবে সমালোচনা করা। কিন্তু তারেক রহমান দলের নীতির পথে হাঁটেননি, এটি বিএনপির নীতি নির্ধারকদের প্রচণ্ডডভাবে বিব্রত করছে;
৩. তারেক জিয়া প্রকাশ্যে বাংলাদেশের মহান সংবিধানকে অত্যন্ত অবলীলায় উপেক্ষা এবং প্রত্যাখ্যান করেছেন। শুধু তাই নয়, তিনি ইচ্ছাকৃতভাবে বিভিন্ন সময় এমন মন্তব্য করেছেন, যার মোকাবিলা করতে গিয়ে বিএনপির রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ বেশ বিব্রতকর অবস্থায় পড়েছেন। এর ফলে দলের গণসংযোগ প্রয়াস বিঘ্নিত এবং প্রশ্নবিদ্ধ হয়েছে;
৪. তিনি বিভিন্ন সময় তার বক্তব্য এবং ভূমিকা দ্বারা দলের নীতি ও কার্যক্রমের সম্পূর্ণ বিপরীত অবস্থানে চলে গেছেন, যা দলকে বিব্রত ও বিভ্রান্ত করেছে;
৫. অর্থপাচার থেকে শুরু করে দেশে বিভিন্ন সময় লুণ্ঠন ও নৈরাজ্য সৃষ্টি, রাজনীতির ক্ষেত্রে পরিপক্ব ও পরীক্ষিত নেতৃবৃন্দকে অসম্মান, একুশে আগস্ট বোমা হামলা ও দশ ট্রাক অস্ত্র চোরাচালানির সঙ্গে সম্পৃক্তি, স্বাধীনতাবিরোধী শক্তিসমূহের প্রতি অবিচল আনুগত্য, বাংলাদেশ-বিরোধী আন্তর্জাতিক পক্ষশক্তির কাছে নিঃশর্ত আত্মসমর্পণের যে নীতি ও কর্মপদ্ধতি তারেক রহমান নিষ্ঠার সঙ্গে বহন করে চলেছেন– বিএনপির নীতি ও আদর্শের সঙ্গে এর অসঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও কেউ প্রতিবাদী হতে পারছেন না।
তারেক রহমান এখন যে কাজটি করে চলেছেন, তাতে তিনি সংবিধানের ৭ (ক)-এর ১ এবং ২ উপবিধি অনুযায়ী সরাসরি রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগে অভিযুক্ত হতে পারেন। শুধু তা-ই নয়, তার দল যদি তার অবস্থান অনুমোদন, সমর্থন বা অনুসমর্থন করে, তাহলে দলের ওপরও একই ধরনের শাস্তি প্রযোজ্য হবে। আর সেই শাস্তি ‘প্রচলিত আইনে অন্যান্য অপরাধের জন্য নির্ধারিত দণ্ডের মধ্যে সর্বোচ্চ দণ্ড।’ জিয়াতনয় হঠকারিতা, অবিমৃষ্যকারিতা এবং নির্বুদ্ধিতা দ্বারা তার দলকে মহাবিপদের মধ্যে ফেলে দিয়েছেন।
দুই.
ইতোমধ্যে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত বাংলাদেশের বিশাল জনগোষ্ঠীর জন্য বিশালতর সুসংবাদ হল– একাত্তরের তিন নিকৃষ্ট ঘাতকের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনাল এবং সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের যুগান্তকারী রায়। ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রাণদণ্ড দেওয়া হয়েছে মতিউর রহমান নিজামী, মীর কাশেম আলীকে। আর সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে কামারুজ্জামানের আবেদন খারিজ হয়ে গেছে। অর্থাৎ, একাত্তরে মানবতাবিরোধী অপরাধের দায়ে এখন ফাঁসির কাঠে কামারুজ্জামানকে ঝুলতেই হবে। ট্রাইব্যুনালের কাজ এবং দেশের সর্বোচ্চ আদালত যদি একই ধরনের দ্রুততার সঙ্গে অগ্রসর হয়, তাহলে আমরা অন্তত এই ভেবে আশ্বস্ত বোধ করব যে, একাত্তরের সেই সব দুর্বৃত্ত, যারা এতদিন সারা দেশে বছরের পর বছর আস্ফালন করে বেরিয়েছে, এখন তাদের সেই স্পর্ধার কড়া জবাব দিচ্ছেন মাননীয় প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনা।
স্বাধীনতার পর এই চার দশক সমগ্র জাতি রুদ্ধশ্বাসে অপেক্ষা করেছে। এরই মধ্যে অনেক মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যু ঘটেছে। অনেক পিতাহারা সন্তানের, স্বামীহারা স্ত্রীর, বোনহারা ভাইয়ের চোখের জল শুকিয়েছে। ঘাতক খুনিদের অনুচরেরা বলে বেরিয়েছে, যুদ্ধাপরাধের বিচার মানে জাতিকে বিভক্ত করা; সামনে তাকাতে হবে, পেছনে নয়, ইত্যাদি।
কী আজব কথা! স্বাধীনতার শত্রুদের, যারা মুক্তিযুদ্ধে বিশ্বাস করে না– ৩০ লাখ মানুষের রক্ত, তিন লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানির ঘটনা যারা আড়াল করে, তথাকথিত একসঙ্গে কাজ করার হাস্যকর ধ্বনি তোলে– মুক্তিযোদ্ধারা কি তাদের সে আবদার মেনে নেবে? নতুন প্রজন্ম কি মেনে নেবে তাদের? স্বজনহারানো, ইজ্জতহারানো নারী-পুরুষ– কেউ কি সেটা মানবে? তারা কি সুকান্তের ভাষায় বলবে না–
আদিম হিংস্র মানবকিতার যদি আমি কেউ হই
স্বজনহারানো শ্মশানে তোদের চিতা আমি তুলবই।
প্রধানমন্ত্রী বলেছেন যুদ্ধাপরাধী সকলেরই বিচার হবে এবং এই সরকার সব রায় কার্যকর করবে। আমরা সেটাই চাই। বাংলাদেশের মাটি কখনও-ই স্বাধীনতাবিরোধীদের সেবাদাস হতে পারে না। গত চার দশকে যে কাজ কেউ করেনি শেখ হাসিনার সরকার সেটাই করেছে, জাতির জনকের সপরিবারে হত্যাকাণ্ডের মূল হোতাদের অনেককে ফাঁসি দেওয়া হয়েছে, একাত্তরের ঘাতকদের বিচার করা হচ্ছে, শাস্তি দেওয়া হচ্ছে। গোলাম আযম, আবদুল আলীমরা কারাগারের অন্তরালে থেকেই মৃত্যুবরণ করেছে, একাত্তরের ঘাতকদের এক এক করে খুঁজে বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে। এ জাতির জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে?
ঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, জাতির জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে
ঘাতকদের বিচারের কাঠগড়ায় দাঁড় করানো হচ্ছে, জাতির জন্য এর চেয়ে বড় প্রাপ্তি আর কী হতে পারে
স্বাধীনতার এবং মুক্তিযুদ্ধের দুশমনরা গত চারটি দশক ধরে কম চেষ্টা করেনি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস মুছে ফেলার জন্য। শেষ পর্যন্ত কি পেরেছে? পারেনি। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা অক্ষুণ্ন রাখার জন্য, স্বাধীনতার শত্রুদের চূড়ান্ত শাস্তিবিধানের জন্য একজন শেখ হাসিনার দরকার ছিল, যিনি জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক চাপের কাছে সামান্যতম নতিস্বীকার না করে, প্রলোভন-প্ররোচনা কিংবা ভীতির কাছে আত্মসমর্পণ না করে জাতির কাছে প্রদত্ত প্রতিশ্রুতি রক্ষা করে যাচ্ছেন।
আজ একটি কথা তো প্রমাণিত হচ্ছে, কিছু মানুষকে কিছু সময়ের জন্য বিভ্রান্ত করা যায়, কিন্তু সব মানুষকে চিরকালের জন্য করা যায় না। প্রয়োজন মানুষকে এক সময় একেক জনকে উপহার দেয় যিনি সব স্বার্থ ও ক্ষুদ্রতার ঊর্দ্ধে উঠে ইতিহাসের দাবি পূরণ করে যান।
তিন.
এখন আমার সুস্পষ্ট প্রত্যাশা–
১. জামাত-শিবিরের রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হোক;
২. ইসলামী ব্যাংক, ইবনে সিনা, রাবেতাসমেত স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রত্যক্ষ বা পরোক্ষ মদদে সৃষ্ট সকল প্রতিষ্ঠান সরকারের নিয়ন্ত্রণে আনা হোক;
৩. মুক্তিযুদ্ধ-বিরোধীদের রাজনৈতিক এবং সাংবিধানিক অধিকার হরণ করা হোক বাহাত্তরের সংবিধানের আলোকে;
৪. মানবতাবিরোধী অপরাধে দন্ডপ্রাপ্ত কোনো আসামি যেন কোনো অবস্থাতেই সামান্যতম রেয়াত না পায়, তার ব্যবস্থা করা হোক;
৫. ধর্মান্ধতামুক্ত আধুনিক শিক্ষাব্যবস্থা চালু করা হোক সর্বস্তরে।
অতঃপর আমরা ‘জয় বাংলা’ ধ্বনিটি নির্দ্বিধায় নিঃসঙ্কোচে উচ্চারণ করতে চাই।
(বিডিনিউজ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন