'আমি কাঁদতে চাই। অঝোরে কাঁদতে চাই। নিঃশব্দে কাঁদতে চাই। চিৎকার করে পৃথিবী কাঁপিয়ে কাঁদতে চাই। বুকভরে জমে থাকা বেদনার গুরুভার বহন করার শক্তি চাই।'
এই আর্তনাদ আমাদের প্রিয়জন ট্রান্সকমের কর্ণধার, প্রথম আলোর প্রাণপুরুষ লতিফুর রহমানের হতে পারে। 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে'তে ২০ বছরের প্রাণবন্ত নাতি ফারাজ আইয়াজ হোসেনকে হারিয়েছেন তিনি। এ ক্রন্দন ১৮ বছরের কিশোরী তারুশি জৈনের বাবা সঞ্জিব জৈনের হতে পারে। এ ক্রন্দন হতে পারে ৪৫ বছরের ইশরাত আখন্দের স্বজনদের। এ ক্রন্দন বাংলাদেশের ১৭ কোটি মানুষের। রহমান ভাইকে বলব, পুরো সমকাল পরিবার আপনার সমব্যথী।
সে রাতে অবিশ্বাস্য, অভাবনীয়, অভূতপূর্ব এক নির্মম অভিজ্ঞতার গুরুভার বহন করতে হয়েছে সংবাদকর্মীদের। সাংবাদিকতা প্রতিদিনের চ্যালেঞ্জ। 'ব্ল্যাক ফ্রাইডে'র চ্যালেঞ্জের চরিত্র ও ক্যানভাস ছিল বিশাল। গুলশানের এক প্রান্তে জনপ্রিয় রেস্তোরাঁ 'হলি আর্টিসান বেকারি'। চমৎকার সব বেকারিসামগ্রীর জন্যই এ রেস্তোরাঁ ভোজনরসিকদের দারুণ পছন্দ। রাত পৌনে ৯টার দিকে রেস্তোরাঁটি ঘিরে আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী, অগণিত সংবাদকর্মী, উৎসুক মানুষ। ভেতরে মৃত্যুভয়ে ভীত ৪০ জনের মতো দেশি-বিদেশি, নানা বয়সের ভীতসন্ত্রস্ত লোক। তাদের সামনে পাঁচ সশস্ত্র নরপশু। মাঝেমধ্যে গুলি, বোমার তীব্র শব্দ।
এরই পাশাপাশি অন্য এক দৃশ্যপট সংবাদপত্র ও টেলিভিশন চ্যানেলে। ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে চলেছে গুলশানে- সাংবাদিকতার ভাষায় 'ডেভেলপিং স্টোরি'। সমকালের অপরাধ বিভাগের পাঁচ প্রতিবেদক, চার আলোকচিত্রী ঘটনাস্থল থেকে বার্তাকক্ষে সংবাদ ও ছবি পাঠাচ্ছেন। তাদের পাঠানো ও নানা সূত্রে পাওয়া সংবাদ নিয়ে গলদঘর্ম ডেস্ক। বার্তা ব্যবস্থাপনায় যুক্ত শীর্ষ সাংবাদিক থেকে শুরু করে রিপোর্টিং, ডেস্ক, সম্পাদনা, কম্পিউটার, গ্রাফিকস বিভাগে শশব্যস্ততা। ঘাড়ের ওপর সার্কুলেশন ম্যানেজার। ক'টি সংস্করণ বেরোবে? রাত ১টার মধ্যে প্রথম সংস্করণ চাই-ই। এদিন তিনটি সংস্করণ প্রকাশ করে সমকাল গুলশানের সর্বশেষ পরিস্থিতি অবহিত করেছে পাঠকদের। ভয়ঙ্কর সংবাদের মুখোমুখি দাঁড়িয়ে এই যে বিনিদ্র রজনী যাপন, এ তো সারাজীবনের বিরল এক অভিজ্ঞতা। আমার প্রতি ডাক্তারের কঠিন সতর্কবার্তা ছিল- রাত ১০টার মধ্যে ঘুমিয়ে পড়বেন, কোনো টেনশন নয়, এমনকি উচ্চকণ্ঠে কথাও নয়। সে রাতে আমার মনে হয়েছে, যা খুশি বলুন ডাক্তার। কোনো কিছুই মানব না। তাই তরুণ সহকর্মীদের সঙ্গে বার্তাকক্ষে একসঙ্গেই বিনিদ্র রজনী যাপন করেছি।
'ব্ল্যাক ফ্রাইডে' রাতে শুধু গণমাধ্যমের বার্তাকক্ষ নয়, জেগেছিল সারাদেশের কোটি মানুষ। আরেকজন জেগেছিলেন, তিনি আমাদের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। গুলশানে ভয়ঙ্কর ঘটনা ঘটে চলেছে। প্রধানমন্ত্রী কীভাবে নিশ্চিন্ত থাকবেন, কীভাবে ঘুমাবেন। সারারাত গভীর উৎকণ্ঠায় জেগে থেকে প্রধানমন্ত্রী তিন বাহিনী প্রধান, পুলিশ, র্যাব, বিজিবিপ্রধানের সঙ্গে গণভবনে দীর্ঘ বৈঠক করেছেন। যোগাযোগ রেখেছেন সিনিয়র মন্ত্রী ও দলীয় শীর্ষ নেতাদের সঙ্গে, একই সঙ্গে চোখ গুলশানে। বাংলাদেশের বিস্ময়কর অগ্রযাত্রা ব্যাহত করতে দেশি-বিদেশি চক্রান্তের ব্যাপারে সদাসতর্ক প্রধানমন্ত্রী একেবারে ঠাণ্ডা মাথায় পুরো পরিস্থিতির ওপর নজর রেখেছেন। বাংলাদেশের এই কঠিন সময়ে বিশ্বনেতৃবৃন্দ, বিশেষ করে আমাদের অকৃত্রিম, পরীক্ষিত বন্ধু ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি বাংলাদেশের পাশে থাকার যে আশ্বাস দিয়েছেন, তাতে প্রধানমন্ত্রীর মনোবল আরও বেড়েছে বলেই বিশ্বাস।
আমরা সবাই লক্ষ্য করেছি, শনিবার রাতে প্রধানমন্ত্রী জাতির উদ্দেশে যে ভাষণ দিয়েছেন, তা তার জীবনের সংক্ষিপ্ততম ভাষণ। নিষ্ঠুর শোকাবহ বাস্তবতার সামনে দাঁড়িয়ে একজন প্রধানমন্ত্রী, যার চোখেমুখে বেদনার সুস্পষ্ট ছাপ। ভাষণে তিনি প্রয়োজনের অতিরিক্ত একটি বাক্য- এমনকি একটি শব্দও ব্যবহার করেননি।
গুলশান ট্র্যাজেডি বাংলাদেশকে যে কঠিন সত্যের মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে, তা বেশ খোলামেলা করে স্মরণ করিয়ে দিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ বাংলাদেশের বন্ধুপ্রতিম বড় বড় দেশ। যেসব চ্যালেঞ্জ এখন বাংলাদেশকে মোকাবেলা করতে হবে, তা-ও জানিয়ে দিয়েছেন তারা। পাশাপাশি এ সংকট উত্তরণে সর্বাত্মক সমর্থন ও সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছেন। গত রাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা একই বার্তা দিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে।
অন্যের প্রশংসায় পঞ্চমুখ নন, বরং কৃপণ বলে সাংবাদিকদের দুর্নাম কম নয়। তবে 'অপারেশন থান্ডারবোল্ট'-এর পরিকল্পনা ও রূপায়ণে তিন বাহিনী, পুলিশ, র্যাব ও বিজিবি যে দক্ষতা ও প্রত্যুৎপন্নমতিতার পরিচয় দিয়েছে, তা নিয়ে তাদের মনে দ্বিধা কম।
অবশ্য এ ব্যাপারে প্রেস ক্লাবে দু-একজন বন্ধু আমার সঙ্গে কিঞ্চিৎ দ্বিমত প্রকাশ করে বলেছেন, জঙ্গিদের বিরুদ্ধে অভিযানে বিলম্ব হয়েছে। আগে হলে হয়তো এত প্রাণনাশ হতো না। তাদের বক্তব্যের সঙ্গে একমত হওয়ার কোনো যুক্তিই আমি খুঁজে পাইনি। এ ব্যাপারে 'অপারেশন থান্ডারবোল্টে'র সঙ্গে যারা যুক্ত, তাদের একজন দায়িত্বশীল সেনা কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলেছি। তিনি বলেছেন, এ ধরনের 'হোস্টেজ সিচুয়েশনে' মাথা গরম করে অপারেশন চালালে বড় ধরনের প্রাণহানির ঝুঁকিই বেশি। তিনি জানান, গত ২ জানুয়ারি সন্ধ্যায় আফ্রিকার একটি ক্ষুদ্র রাষ্ট্র বুরকিনা ফাসোর রাজধানী ওয়াগাদোগোতে কাপাচিনো রেস্তোরাঁয় বিদেশিসহ অনেককেই জিম্মি করে আল মুরাবিতুন নামে এক জঙ্গিগোষ্ঠী। পুরো রাত অপেক্ষা করে কমান্ডো হামলা চালানো হয় পরদিন সকালে। অপারেশনে তিন জঙ্গি ও ৩০ জিম্মি নিহত হয়। দায়িত্বশীল অন্য এক সূত্র বলছে, সরকার চেয়েছিল জীবিত অবস্থায় সকল জিম্মিকে উদ্ধার করতে। তারা তথ্য নেওয়ার চেষ্টা করেছিল, রেস্টুরেন্টের ভেতরে আসল চিত্র কী। একটি জীবিত মানুষের প্রাণও অভিযানকারীদের কাছে মূল্যবান বলে বিবেচিত হয়। শনিবার সকালে কমান্ডো অভিযানের কিছুক্ষণ আগে দুই বিদেশি নাগরিকসহ তিনজন রেস্টুরেন্ট থেকে কৌশলে বেরিয়ে আসতে পারেন। এর পর আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী তাদের কাছে তথ্য পায়, বন্দুকধারীরা সব বিদেশিকে হত্যা করেছে। অধিকাংশকেই হত্যা করেছে রেস্টুরেন্টে হামলা চালানোর ৩০ মিনিটের মধ্যে। এর পরই সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের নির্দেশে দ্রুত কমান্ডো অভিযান চালানো হয়।
'ব্ল্যাক ফ্রাইডে'তে আমরা দু'জন বিজ্ঞ, কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তাকে হারিয়েছি। তারা হলেন- পুলিশের গোয়েন্দা শাখার সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল করিম ও বনানী থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) সালাহউদ্দিন খান। বনানী থানার ওসির সঙ্গে আমার ব্যক্তিগত পরিচয় ছিল। একজন বিচক্ষণ, সজ্জন পুলিশ কর্মকর্তা হিসেবেই তাকে আমি চিনতাম। বেশ কয়েক মাস আগে বনানী থানায় গিয়েছিলাম। আপাদমস্তক এই ভদ্রলোক অনেকটা বিস্ময় প্রকাশ করে বললেন, স্যার, আপনি কেন ডাকলেন না। হুকুম করলেই সমকালে আমি হাজির হতাম। তার সহকর্মীরা আমাকে জানালেন, ওসি সাহেব এ রকমই বিনয়ী মানুষ। তিনি যে কতটা কর্তব্যনিষ্ঠ পুলিশ কর্মকর্তা, জীবন দিয়ে তার প্রমাণ রেখে গেলেন। ঘটনাস্থল গুলশান হলেও তিনি গুরুতর ঘটনার কথা জেনে সেখানে ছুটে গিয়েছিলেন। এ দুই পুলিশ কর্মকর্তার প্রাণদান সহকর্মীদের জন্যও প্রেরণার উৎস হতে পারে।
নারকীয় হত্যাকাণ্ডে জড়িত পাঁচ জঙ্গির ছবি গতকাল সমকালসহ সব পত্রিকায় ছাপা হয়েছে। টগবগে তরুণ তারা। ধনাঢ্য পরিবারের সন্তান। নামিদামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে তারা শিক্ষা নিয়েছে। তাদের একজন নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির মতো নামিদামি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করছিল। এ ক্ষেত্রে নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটির ট্র্যাক রেকর্ড মোটেই ভালো নয়। শাহবাগের গণজাগরণ মঞ্চের কর্মী ও ব্লগার স্থপতি রাজীব হায়দার হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার সন্দেহে এই বিশ্ববিদ্যালয়ের পাঁচ ছাত্রকে ২০১৩ সালের ১ ও ২ মার্চ গোয়েন্দা পুলিশ গ্রেফতার করেছিল
বেশ কিছুদিন থেকে গভীর এক দুশ্চিন্তা আমাকে আচ্ছন্ন করছিল। বড় কোনো বিপদ কি রুদ্রমূর্তি হয়ে আমাদের সামনে দাঁড়াচ্ছে? ভয়ঙ্কর বাস্তবতার মুখোমুখি হচ্ছি আমরা? সহকর্মীদের আমার এ উৎকণ্ঠার কথা জানিয়েছি। সর্বশেষ গণভবনে এক ইফতার মাহফিলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আরেফিন ভাইকে আমার দুশ্চিন্তার কথা জানালে তিনিও বললেন, এক ধরনের অশনিসংকেত তিনিও যেন শুনতে পাচ্ছেন। দেশকাঁপানো এই ভয়ঙ্কর ঘটনাটি ঘটল তিন দিন পরই।
যারা হন্তারক, তারা সন্ত্রাসী না জঙ্গি, তারা হরকাতুল জিহাদ না আইএস? এসব প্রশ্ন এখন 'পাত্রাধার তৈল না তৈলাধার পাত্রে'র মতোই মনে হয়। গুলশানের হত্যাকাণ্ডের সঙ্গে আইএসের অপারেশনের অমিল কম। এ প্রসঙ্গে গত রাতে ঢাকায় নিযুক্ত ভারতের প্রাক্তন হাইকমিশনার বীণা সিক্রি বিবিসিকে বলেছেন, তারা যে আন্তর্জাতিক কোনো গোষ্ঠীর হাতে র?্যাডিকালাইজড হয়নি, সেটা কীভাবে নিশ্চিত হওয়া যাবে? তিনি বলেছেন, 'বুঝলাম, এরা সবাই বাংলাদেশি। কিন্তু তাদের এ পথে এনেছে কে, র?্যাডিকালাইজ করেছে কে? তারা উচ্চশিক্ষিত, ধনী ঘরের ছেলে। কেউ মাদ্রাসার ছাত্র নয়। মনে রাখতে হবে, তাদের এ পথে নিয়ে আসতে আইএস বা আল কায়দাকে কিন্তু বাংলাদেশে আসতে হবে না, ইন্টারনেটই তার জন্য যথেষ্ট।
আমার একান্ত প্রিয়জন কবি হেলাল হাফিজের সাড়াজাগানো এক কবিতার মর্মার্থ- যৌবনই যুদ্ধে যাবার প্রকৃষ্ট সময়। কবিকে বলব, জীবনে এমন সময়ও আসে- যৌবন বিগত যার, তার প্রতিও যুদ্ধে যাবার ডাক আসে। সে যুদ্ধ প্রতিক্রিয়াশীল, স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের হাত থেকে প্রিয় মাতৃভূমিকে রক্ষার যুদ্ধ।
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন