নির্ঘুম এক রাত
19 April 2014, Saturday
চিকিৎসকের পরামর্শ- রাত জাগবেন না, তাড়াতাড়ি ঘুমিয়ে পড়বেন। ইদানীং হৃদযন্ত্রের বেয়াড়াপনার কারণেই তার এহেন নির্দয় হুকুম। নির্দয় বললাম এ জন্য যে, গত পঞ্চাশ বছর ধরে রাত্রি জাগরণের যে বদভ্যাসটি চমৎকারভাবে গড়ে উঠেছে, চিকিৎসকের হুকুমে তা কি রাতারাতি বদলানো সম্ভব?
সাংবাদিকতা এমন এক অদ্ভুত পেশা, না চাইলেও আবেগ-উত্তেজনা প্রতি মুহূর্তের সঙ্গী হয়েই থাকে। সমকালের বার্তাকক্ষ থেকে কখনও কখনও রাত ১টায়ও টেলিফোন আসে, কখনও দেশি-বিদেশি টেলিভিশন চ্যানেলে চোখ রাখতে রাখতে আধো ঘুম-আধো জাগরণের প্রহেলিকায় আচ্ছন্ন থাকি। বৃহস্পতিবার রাতেও তার ব্যত্যয় ঘটেনি।
রাত পৌনে ১টার দিকে সমকালের যুগ্ম সম্পাদক বাবুর সঙ্গে কথা শেষ করে ঘুমিয়ে পড়তে না পড়তেই এলো প্রধান প্রতিবেদক লোটন একরামের টেলিফোন। লোটন জানাল, রিজওয়ানা হাসানের স্বামীকে অক্ষত অবস্থায় পাওয়া গেছে। তিনি এখন ধানমণ্ডি থানায়। আমার সিদ্ধান্ত কী হবে লোটন জানে। বললাম, বাবু, পরশসহ অন্যদের তাড়াতাড়ি অফিসে আসতে বলো। আমি বেরোচ্ছি। 'বিশেষ নগর সংস্করণ' বের করতে হবে।
সুনসান রাত। মাঝেমধ্যে দু'একটা ট্রাক ও প্রাইভেটকার নৈঃশব্দ্য ভেঙে ছুটে চলেছে। উত্তরা থেকে তেজগাঁওয়ে সমকালে আসতে বড়জোর কুড়ি মিনিট লাগল। একে একে বাবু, লোটন, চিফ ক্রাইম রিপোর্টার পরশ, ডিজিএম (সার্কুলেশন) অমিত, গ্রাফিক ডিজাইনার মেহেদী এলো। হঠাৎই আবার ব্যস্ত হয়ে পড়ল বার্তাকক্ষ। রিপোর্টার আতাউর ততক্ষণে ধানমণ্ডি থানায়। সমকালের নগর সংস্করণ ছাপা বন্ধ।
আবু বকর সিদ্দিককে উদ্ধারের সর্বশেষ সংবাদসহ সমকালের বিশেষ নগর সংস্করণের প্রস্তুতি চলছে। প্রেস ম্যানেজার মিজান যখন সমকালের 'বিশেষ নগর সংস্করণে'র কপি নিয়ে এলো, তখন ঘড়ির কাঁটা রাত ৪টা স্পর্শ করেছে। নিশি জাগরণের কোনো ক্লান্তিই কারও চোখে-মুখে নেই। সকলেই উৎফুল্ল।
এ পেশায় এমন কিছু কিছু পাগল মানুষ রয়েছেন, যারা জীবন-সংসারের জরুরি প্রয়োজনের প্রতিও দৃকপাত করেন না। প্রিয়জনের ভালোবাসার বন্ধনও অবলীলায় অগ্রাহ্য করেন। কেউ কেউ বলেন, আমিও নাকি ওদেরই দলে।
আবু বকর সিদ্দিকের অপহরণের ঘটনাটি আমাদের ব্যথিত ও ক্ষুব্ধ করেছে। আমরা কি এভাবেই তিমিরে তলিয়ে যাব? যেভাবে ক'দিন আগে অতল জলে হারিয়ে গেছে আমাদেরই চারটি মেধাবী সন্তান। কোন সূচকে আমরা কতখানি এগিয়েছি তার পরিসংখ্যান প্রচারে যারা ব্যস্ত, তাদের কাছে সাধারণ মানুষ এ প্রশ্ন করতেই পারেন_ গুম ও গুপ্তহত্যাসহ নৃশংসতা, সহিংসতার সূচকে আমরা বহু দেশকেই অতিক্রম করেছি, এ কথা স্বীকারে দ্বিধা কেন?
২০১০-১৪ সালের মার্চ পর্যন্ত ২৬৮ জন অপহৃত হয়েছেন। ফিরে এসেছেন মাত্র ২৪ জন। লাশ উদ্ধার হয়েছে ৪৩ জনের। নিখোঁজের খাতায় ১৮৭ জন। আবু বকর সিদ্দিকের নামটিও হয়তো এই নিখোঁজের তালিকায় স্থান পেত। কেন স্থান পেল না? তার সম্ভাব্য কারণের কথা বলেছেন রিজওয়ানা স্বয়ং। তিনি বৃহস্পতিবার রাতে ধানমণ্ডি থানায় সাংবাদিকদের বলেছেন, তার স্বামী প্রাণ নিয়ে ফিরে আসার বড় কারণ গণমাধ্যমের চাপ। নাগরিক সমাজের সম্মিলিত শক্ত অবস্থান। আবু বকরকে উদ্ধারে প্রধানমন্ত্রীর সুস্পষ্ট নির্দেশের কথাও তিনি কৃতজ্ঞতার সঙ্গে স্মরণ করলেন।
একই কথা তিনি গতকাল রাতে তার ধানমণ্ডি সেন্ট্রাল রোডের বাসায় আমাকেও বলেছেন। আমি বললাম, পরিবেশ রক্ষার আন্দোলনের প্রথম সারির এই নেত্রীর স্পষ্টবাদিতা ও সাহসিকতা অন্যদের থেকে তাকে আলাদা করেছে। আমার এই মন্তব্যে তিনি ঈষৎ বিব্রত হলেন বলে মনে হলো। বললেন, সামাজিক আন্দোলনে গণমাধ্যম আমাদের সহায়ক শক্তি। তার স্বামীর অপহরণের ঘটনায় গণমাধ্যমের সাহসী ভূমিকায় তিনি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে বললেন, আমাদের অভিন্ন শত্রুদের একসঙ্গে মোকাবেলা করতে হবে। আবু বকর অপহরণ হলো।
জনমত ও গণমাধ্যমের চাপে অশুভ চক্র তাকে ছেড়ে দিল_ এভাবে সহজ হিসাব করার কোনো সুযোগ নেই। তারা ফণা উদ্যত করেছে, আমাদের সাবধান থাকতে হবে। রিজওয়ানা ও তার স্বামী আবু বকর সিদ্দিককে দেখে ক্ষাণিকটা চিন্তামুক্ত মনে হলেও তাদের চোখেমুখে উৎকণ্ঠার স্পষ্ট ছায়া লক্ষ্য করলাম। তাদের বললাম, ভয় পাবেন না, আমরা সবাই আপনাদের পাশে আছি।
উৎসঃ সমকাল
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন