শুধু দেশের ভেতরে নয়, আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও সাম্প্রতিক বাংলাদেশের যে দুটি বিষয়ে ব্যাপকভাবে আলোচিত হচ্ছে- একটি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং দ্বিতীয়টি জঙ্গী মৌলবাদের নবউত্থান। ’৭১-এর গণহত্যা, মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ ও যুদ্ধাপরাধের সঙ্গে যারা যুক্ত ছিল তাদের অপরাধের প্রধান প্রণোদনা ছিল মওদুদীবাদ, যা ইসলামের নামে হত্যা, ধর্ষণ ও নির্যাতনসহ যাবতীয় সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডকে বৈধতা দেয়। জঙ্গী মৌলবাদী সন্ত্রাসীরা বাংলাদেশসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে হত্যা ও নির্যাতনসহ সন্ত্রাসের যে তাণ্ডব চালাচ্ছে তারও প্রধান প্রণোদনা হচ্ছে মওদুদীবাদ বা ওহাবিবাদ। বাংলাদেশের নিজামী, মুজাহিদ, সাঈদী আর মধ্যপ্রাচ্যের বোগদাদী, লাদেন ও মোল্লা উমররা একই আদর্শের অনুসারী, একই নৌকার যাত্রী- সবার লক্ষ্য শরিয়াভিত্তিক ইসলামী রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা, যেখানে ভিন্নধর্ম, ভিন্নমত ও ভিন্ন জীবনধারার অনুসারীদের কোন স্থান নেই।
পঁচিশ বছর আগে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার এবং জামায়াত-শিবির চক্রের মৌলবাদী ও সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের দাবিতে যে অভূতপূর্ব নাগরিক আন্দোলনের সূচনা হয়েছিল তা বিজয়ের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা পঁচিশ বছর আগে জাহানারা ইমামকে কথা দিয়েছিলেন ক্ষমতায় এলে তিনি যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করবেন। ১৯৯৬ সালে সংখ্যালঘু সরকার হওয়ার কারণে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে না পারলেও তিনি ২০০৯ সালে বিপুল সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে সরকার গঠন করে দীর্ঘ প্রত্যাশিত বিচার শুরু করেছেন। গত সাড়ে ছয় বছরে অর্ধশতাধিক যুদ্ধাপরাধীর বিচার ও শাস্তি হয়েছে এবং ছয় জনের মৃত্যুদণ্ডও কার্যকর হয়েছে। একইভাবে জঙ্গী দমনেও শেখ হাসিনার সরকার অনেক দেশের তুলনায় অধিকতর সাফল্য প্রদর্শন করেছেন। গত এক দশকে অর্ধশতাধিক জঙ্গী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছে এবং বিচারে এক ডজনেরও বেশি জঙ্গীর ফাঁসি হয়েছে।
এই দুই ক্ষেত্রে সাফল্যের জন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের সঙ্গে জড়িতরা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবিদার, তবে সবচেয়ে বেশি প্রশংসা পাবেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা, হাজারো প্রতিকূলতার ভেতর যিনি অসম্ভবকে সম্ভব করেছেন। উদ্বেগের বিষয় হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধের অবিস্মরণীয় বিজয়ের পর আমরা যেমন সে বিজয়কে ধরে রাখতে পারিনি, একইভাবে যুদ্ধাপরাধের বিচার এবং জঙ্গীনির্মূলে যে সব বাধা ও সমস্যা প্রত্যক্ষ করছি তাতে আশঙ্কা হয়- আমরা কি আরেকবার ’৭৫-এর ভয়ঙ্কর অন্ধকারের দিকে এগিয়ে যাচ্ছি?
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘ্নিত ও বিলম্বিত করার জন্য জামায়াত হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে আমেরিকা ও ইউরোপের পাশাপাশি দেশের অভ্যন্তরেও লবিস্ট নিয়োগ করেছে। বিএনপি যে মরণ আলিঙ্গনে জামায়াতকে জড়িয়ে ধরেছে দলটির জীবদ্দশায় মুক্ত হওয়ার কোন সম্ভাবনা নেই। হালে দেখছি, আওয়ামী লীগেও জামায়াতের অনুপ্রবেশ ঘটছে। প্রশাসন, বিচার বিভাগ, বিভিন্ন বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জামায়াতের অগুনতি আন্ডা-বাচ্চা ছড়িয়ে রয়েছে। যার ফলে জামায়াত ও ঘাতক সংগঠনসমূহের বিচারের একটি সামান্য সংশোধনীর জন্য আমাদের অপেক্ষা তিন বছর হতে চলেছে।
গুলশানের হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় জঙ্গী হামলাকারীদের দু’জন কথিত কাফের হত্যায় উজ্জীবিত হয়েছিল পীস টেলিভিশনে ভারতের জাকির নায়েকের ওয়াজ শুনে। সন্ত্রাসী ওয়াজে জামায়াতের দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর ধূর্ত সংস্করণ জাকির নায়েক। বাংলাদেশের জঙ্গীরা তার ওয়াজ শুনে জিহাদে উদ্বুদ্ধ হচ্ছে জেনে সরকার পীস টেলিভিশন বন্ধ করেছে বটে, কিন্তু ইউটিউবে জাকির নায়েকের শত শত ভিন্নধর্ম বিদ্বেষী জিহাদী বয়ান অবারিত রয়েছে। এলিফ্যান্ট রোডের কাঁটাবন মসজিদের নিচে বইয়ের দোকানে জাকির নায়েকের চটি বই দেদার বিক্রি হচ্ছে। একইভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধে আমৃত্যু কারাদণ্ডপ্রাপ্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী ওরফে দেইল্যা রাজাকারের ওয়াজও হাটে-গঞ্জে দুর্লভ নয়। দূরপাল্লার বাসে, গ্রামের ওয়াজ মাহফিলে সাঈদীর ওয়াজের সিডি এন্তার শোনা যায়। এ ক্ষেত্রে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও বিচার বিভাগ উটপাখি নীতি অবলম্বন করে বালিতে মাথা গুঁজে বসে আছে।
ভারতে জাকির নায়েকের পীস টেলিভিশন বন্ধের পর তার এনজিও ‘ইসলামিক রিসার্চ ফাউন্ডেশন’- এর কার্যক্রমও বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। বাংলাদেশে জামায়াতের গণহত্যাকারীদের মৃত্যুদণ্ড দেয়ার পর পাকিস্তান যেভাবে মাতম করেছে ভারতে জাকির নায়েকের এনজিও বন্ধের পর একইভাবে ‘ইসলাম গেল’ বলে হাফিজ সাঈদেরা মাতম করছেন। পাকিস্তানে জামায়াতে ইসলামী, ‘জইশে মোহাম্মদ’, ‘তেহরিক-এ তালেবান’ সবাই একে জাতিসংঘের মানবাধিকার সনদের লঙ্ঘন বলে বিলাপ করছে, যেন জামায়াতীরা এটি খুব মান্য করে। আমার ‘জিহাদের প্রতিকৃতি’ প্রামাণ্যচিত্রে দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর এক ওয়াজের বয়ান হচ্ছেÑ খ্রীস্টান ও ইহুদিদের জাতিসংঘের মুখে লাথি মেরে মুসলমানদের জাতিসংঘ কায়েম করতে হবে। বলাবাহুল্য, সে জাতিসংঘের খলিফা হবেন আল কায়দার মোল্লা উমর, নয়তো আইএস-এর আবু বকর আল বোগদাদী। জাতিসংঘ সম্পর্কে জাকিরের বক্তব্যও সাঈদীর মতো।
বাংলাদেশে সাঈদীকে গণহত্যার জন্য সাজা দেয়া হলেও তার ওয়াজ যেমন বন্ধ হয়নি, একইভাবে জঙ্গীবাদে উদ্বুদ্ধকরণের জন্য পীস টেলিভিশন নিষিদ্ধ হলেও জাকির নায়েকের ওয়াজ বন্ধ হয়নি। যার ফলে জঙ্গী উৎপাদনও অব্যাহত রয়েছে। আইনশৃঙ্খলা বাহিনী গত ছয় মাসে দফায় দফায় জঙ্গীদের আস্তানা খুঁজে বের করে ডজন তিনেক জঙ্গীকে ঘায়েল করলেও জঙ্গীরা নব নব রূপে আবির্ভূত হচ্ছে। গত সপ্তায় ঢাকার দক্ষিণখানের আশকোনায় আত্মঘাতী মহিলা জঙ্গীও আমরা দেখেছি। এরপর আফগানিস্তান ও পাকিস্তানের মতো আত্মঘাতী শিশু জঙ্গীর দেখা পেলে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই, কারণ জঙ্গী উৎপাদনের কারখানা পুরোদমে চালু আছে। সেখানে লে-অফের কোন সম্ভাবনা দেখছি না।
গত ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবসের আলোচনা সভায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা আবারও বলেছেন, ‘যুদ্ধাপরাধীদের বিচারে কেউ বাধা সৃষ্টি করতে পারবে না।...যুদ্ধাপরাধীর বিচার চলছে, এ বিচার চলতেই থাকবে। কারণ, এ বিচার শেষ হবার নয়। কাজেই যারা দেশে গণহত্যা চালিয়েছে, বুদ্ধিজীবীদের হত্যা করেছে; তাদের কেউ রক্ষা করতে পারবে না। কারণ, এটা ন্যায়ের পথ। যেটা ন্যায় ও সত্য, তার জয় সবসময় হয়, সবসময় হবে।’
সেদিন মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের পরিবারের সদস্যদের উদ্দেশ করে প্রধানমন্ত্রী আরও বলেছেন, ‘পাক হানাদার বাহিনী এদেশের পথ-ঘাট চিনত না। কারা এদের পথ-ঘাট, বাড়ি-ঘর চিনিয়ে দিয়ে এত গণহত্যা চালাতে সাহায্য করেছিল, তা সবারই জানা। তিনি বলেন, আমাদের মধ্যে কিছু বেইমানের জন্ম না হলে, এদেশীয় আলবদর-আলশামস সৃষ্টি না হলে কোনভাবেই দেশের এত বুদ্ধিজীবীকে হত্যা করা সম্ভব হতো না। আলবদর-আলশামসরাই তালিকা তৈরি করে বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে গিয়ে হত্যা করতে সাহায্য করেছে।’ (জনকণ্ঠ, ১৫ ডিসেম্বর ২০১৬)
দেশে ও বিদেশে যাবতীয় বাধা অগ্রাহ্য করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেভাবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চলমান রেখেছেন- শুধু তিরিশ লাখ শহীদ পরিবার নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী গোটা জাতি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ থাকবে। তাঁর শত আন্তরিকতা সত্ত্বেও আমরা যখন দেখি বিভিন্ন অজুহাতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বিঘিœতকরণের প্রচেষ্টা চলছে তখন এটা মনে হওয়া খুবই স্বাভাবিক যে ’৭১-এর রাজাকার, আলবদর, আলশামস আর শান্তি কমিটির লোকজন সর্বত্র এখনও সক্রিয়। প্রথমে দুটি ট্রাইব্যুনালের একটি বন্ধ করে করে দেয়া হলো, তারপর বলা হলো অবশিষ্ট ট্রাইব্যুনালকে বর্তমান ভবন ছেড়ে চলে যেতে হবে। ২০০৯ সালে বর্তমান ভবনে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের ট্রাইব্যুনাল স্থাপনের জন্য আমাদের কী পরিমাণ দৌড়ঝাঁপ করতে হয়েছে- সবই রেকর্ডে আছে। ট্রাইব্যুনাল সরানোর উদ্যোগকে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের ষড়যন্ত্র হিসেবে আখ্যায়িত করে গত ২৭ আগস্ট (২০১৬) এক সংবাদ সম্মেলনে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি, মুক্তিযোদ্ধা সংসদ, মহিলা পরিষদ, মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি সংরক্ষণ কেন্দ্র, প্রজন্ম ’৭১, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর, সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম, বাংলাদেশ ইতিহাস সম্মিলনী ও জাতীয় প্রেসক্লাবের নেতৃবৃন্দ এক সংবাদ সম্মেলনে প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ করে বলেছেন-
‘আমরা আশা করেছিলাম আপনি প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার আরও গতিশীল হবে, কারণ এটি নিছক ’৭১-এর গণহত্যা ও যুদ্ধাপরাধের বিচার নয়, ৩০ লাখ শহীদের প্রতি গোটা জাতির দায়বদ্ধতাও বটে। আপনি এই বিচারকার্যকে কতটা গুরুত্বহীন মনে করেন তার সর্বশেষ উদাহরণ হচ্ছে ৩১ অক্টোবরের ভেতর পুরনো হাইকোর্ট ভবন থেকে ‘আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল’ সরিয়ে নেয়ার নোটিস। সুপ্রীমকার্টের স্থান সংকুলানের জন্য আরও বহু জায়গা আছে, যেখানে ভবন সম্প্রসারিত হতে পারে। ট্রাইব্যুনালে মামলার সংখ্যা যত বাড়ছে ’৭১-এর গণহত্যার ভয়াবহতা নতুন নতুন মাত্রায় দেশবাসীসহ বিশ্ববাসীর সামনে উন্মোচিত হচ্ছে। যখন ট্রাইব্যুনালের সক্ষমতা ও সচলতা আরও বৃদ্ধি প্রয়োজন তখন আপনার নতুন সিদ্ধান্ত কার্যকর হলে ’৭১-এর গণহত্যাকারীরা যেমন উল্লসিত হবে একইভাবে মুক্তিযুদ্ধের শহীদ পরিবার ও ভুক্তভোগীদের চার দশকেরও অধিক সময়ের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আরও বৃদ্ধি করবে।
‘বর্তমান আইসিটি ভবনের সঙ্গে মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন জড়িয়ে গেছে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নুরেমবার্গের যে ভবনে নাৎসী যুদ্ধাপরাধীদের প্রথম বিচার হয়েছিল সেই ‘প্যালেস অব জাস্টিস’ পরে জাদুঘরে রূপান্তরিত হয়েছে, যা উত্তর প্রজন্মকে স্মরণ করিয়ে দিচ্ছে নাৎসীদের নৃশংসতার কথা। গণহত্যার বিচারের অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ভবিষ্যতের গণহত্যা নিরুৎসাহিত করার পাশাপাশি গণহত্যাকে জাদুঘরের বিষয়ে পরিণত করা। এই উদ্দেশ্যেই মাননীয় প্রধানমন্ত্রীকে ২০০৯ সালে লেখা চিঠিতে আমরা বলেছিলাম এই ভবনকে ভবিষ্যতে আমরা ’৭১-এর গণহত্যা এবং বিচারের জাদুঘর ও আর্কাইভ হিসেবে দেখতে চাই।
‘আপনার প্রতি আমাদের সনির্বন্ধ অনুরোধ, যুদ্ধাপরাধীদের চলমান বিচার এবং এই বিচারিক ভবন কেন্দ্র করে ৩০ লাখ শহীদ পরিবার এবং বিচারবঞ্চিত সমগ্র জাতির আশা, অনুভূতি ও স্বপ্ন পদদলিত করবেন না।’
এরপর আইনমন্ত্রী আমাদের বলেছেন, এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে গণরায়ের কারণে। জনগণ না চাইলে ট্রাইব্যুনাল সরানো হবে না। আইনমন্ত্রীর কথায় আমরা আশ্বস্ত হয়েছিলাম, কিন্তু বিধি বাম। গত ২৪ ডিসেম্বর প্রধান বিচারপতি সিনহা আবারও বলেছেন, ৩১ ডিসেম্বরের ভেতর ট্রাইব্যুনাল সরাতে হবে। তিরিশ লাখ শহীদ পরিবারসহ যুদ্ধাপরাধীদের বিচারপ্রার্থী সর্বস্তরের জনগণ জানেন বর্তমান ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল উৎখাতের অর্থ হচ্ছে ’৭১-এর গণহত্যাকারী ও মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধীদের বিচার চিরদিনের জন্য বন্ধ করে দেয়া। কারণ এই বিচারের উপযোগী দ্বিতীয় কোন ভবন ২০০৯ সালে দশ মাস ধরে খুঁজে রাজধানীর কোথাও আমরা পাইনি।
আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্ভাগ্য হচ্ছে তিরিশ লাখ জীবনের মূলে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও অধিকাংশ সময় বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে স্বাধীনতাবিরোধী ‘শান্তি কমিটি’, ‘রাজাকার’, ‘আলবদর’ এবং তাদের সহযোগীদের দ্বারা। ’৭৫-এর পর থেকে জিয়া, এরশাদ ও খালেদার বদৌলতে তারা প্রশাসনের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নিজেদের অবস্থান সুদৃঢ় করেছে, বিচার বিভাগ তার ব্যতিক্রম নয়। আট বছর ধরে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি ক্ষমতায় থাকার পরও প্রশাসন ও বিচার বিভাগ এই অভিশাপ থেকে মুক্ত হতে পারেনি।
আমাদের আরও দুর্ভাগ্য হচ্ছে প্রধান বিচারপতির মতো মর্যাদার সুউচ্চ আসনে বসে আছেন ’৭১-এ পাকিস্তানী হানাদার বাহিনীর অন্যতম সহযোগী শান্তি কমিটির আত্মস্বীকৃত সদস্য। বিচারপতি সিনহাকে আমরা এর আগে বিনীত অনুরোধ জানিয়েছিলাম ট্রাইব্যুনাল বন্ধের উদ্যোগ থেকে সরে আসার জন্য। আমাদের অনুরোধের প্রতি তিনি কর্ণপাত করেননি। এখন সময় এসেছে এ কথা স্পষ্টভাবে বলার- আমাদের যাবতীয় অনুরোধ অগ্রাহ্য করে তিনি যদি বর্তমান ভবন থেকে ট্রাইব্যুনাল সরাতে চান তাহলে তা করতে হবে আমাদের লাশের ওপর দিয়ে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য ৪৫ বছর ধরে রাজপথে পড়ে আছি, স্বজন হারিয়েছি, জেলে গেছি, জামায়াতীদের হামলায় শারীরিক পঙ্গুত্বও মেনে নিয়েছি। ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের প্রাণের দাবি ও গণরায় মেনে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করেছেন। পঁচিশ বছর আগে শহীদ জননী জাহানারা ইমামের প্রথম জনসভায় শেখ হাসিনা ঘোষণা করেছিলেন, ‘প্রয়োজন হলে বুকের রক্ত দিয়ে হলেও বাংলাদেশের মাটিতে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করব।’ তাঁর সঙ্গে কণ্ঠ মিলিয়ে বলতে চাই- যুদ্ধাপরাধীদের বিচার বানচালের যে কোন ষড়যন্ত্র আমরা বুকের রক্ত দিয়ে হলেও প্রতিহত করব।
উৎসঃ জনকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন