গণহত্যাকারী কামারুজ্জামানের ফাঁসি : এরপর কী
12 April 2015, Sunday
বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকালে সংঘটিত গণহত্যা ও মানবতাবিরোধী অপরাধের একজন প্রধান হোতা, ঘাতক আলবদর বাহিনীর মূল সংগঠক, জামায়াতে ইসলামীর শীর্ষস্থানীয় নেতা মোহাম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর হয়েছে ঢাকার কেন্দ্রীয় কারাগারে ১১ এপ্রিল রাত সাড়ে ১০টায়। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য গঠিত ঢাকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল দীর্ঘ চার বছর শুনানির পর কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন ২০১৩ সালের ১৩ মে। আসামিপক্ষ সেই রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে আপিল করলে সেখানেও তার মৃত্যুদণ্ডাদেশ বহাল রাখা হয় (৩ নভেম্বর ২০১৪)। কামারুজ্জামানের আইনজীবীরা সুপ্রিম কোর্টের রায় পুনর্বিবেচনার আবেদন করেন। সেই মামলায়ও তাঁরা হেরে যান (৬ এপ্রিল ২০১৫)। মৃত্যুদণ্ডাদেশ ৯ এপ্রিলই কারাগারে পৌঁছে যায়। আসামিকে রাষ্ট্রপতির কাছে ক্ষমা চাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল। এই গণহত্যাকারী বোধগম্য কারণে সে সুযোগ নেয়নি। কারণ রাষ্ট্রপতির কাছে দণ্ড মওকুফ বা হ্রাসের আবেদন তারাই করতে পারে, যারা অপরাধ স্বীকার করে। মামলা চলাকালে আপিলে বা রিভিউয়ের সময় কখনো আসামির আইনজীবী অপরাধ স্বীকার করে দণ্ড লাঘবের আবেদন করেননি। যার ফলে দেশের প্রচলিত বিধান অনুযায়ী কামারুজ্জামানের দণ্ড কার্যকর করতে কোনো বাধা ছিল না।
কামারুজ্জামানের আগে এই মামলায় মাত্র একজনের ফাঁসি হয়েছে। সে ব্যক্তিও জামায়াতের গুরুত্বপূর্ণ নেতা ও একজন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধী। ২০১৩ সালের ডিসেম্বরে তাকে ফাঁসিতে ঝোলানোর আগে জাতিসংঘের মহাসচিব ও আমেরিকার পররাষ্ট্রমন্ত্রীসহ অনেকেই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে ফোন করে বলেছিলেন কাদের মোল্লাকে ফাঁসি না দেওয়ার জন্য। শেখ হাসিনা তাঁদের বলেছেন, কাদের মোল্লার বিরুদ্ধে গণহত্যার অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হয়েছে। দেশের উচ্চতম আদালত তাকে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছে। আসামি তার অপরাধ স্বীকার করে নিয়ম অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির কাছে প্রাণভিক্ষাও চায়নি। তা ছাড়া আন্তর্জাতিক বিধান অনুযায়ী গণহত্যার অপরাধ কোনো সরকার বা রাষ্ট্র ক্ষমা করতে পারে না, করলে তা আন্তর্জাতিক আইনের লঙ্ঘন হয়। জাতিসংঘ মহাসচিবের পক্ষ থেকে কামারুজ্জামানের ব্যাপারেও একই অনুরোধ করা হয়েছে, যা সরকার যুক্তিসংগত কারণে উপেক্ষা করেছে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রশ্নবিদ্ধ, বিলম্বিত ও বানচাল করার জন্য জামায়াত ও তাদের সহযোগীরা বিভিন্ন দেশে শত শত কোটি টাকা ব্যয় করে বহু লবিস্ট নিয়োগ করেছে, বহু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানকে ভাড়া করেছে গণহত্যাকারীদের পক্ষে সাফাই গাওয়ার জন্য। দেশের ভেতরেও এই বিচার বিঘ্নিত করার জন্য বিএনপি ও হেফাজতে ইসলামকে সঙ্গে নিয়ে জামায়াত কম সন্ত্রাস করেনি। মাসের পর মাস হরতাল-অবরোধ ডেকে নিরীহ মানুষ হত্যা ও জনগণের সম্পদ ধ্বংস করে জামায়াত যথাসাধ্য চেষ্টা করেছে, মানুষ যাতে এই বিচারে বিমুখ হয়; কিন্তু তা হয়নি। মুক্তিযুদ্ধে ৩০ লাখ শহীদের পরিবারের সদস্যরা দীর্ঘ চার দশক ধরে এই বিচারের অপেক্ষায় দিন গুনছেন। স্বজনহারাদের হৃদয়ের রক্তক্ষরণ আজও বন্ধ হয়নি।
স্বাধীনতার পর বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭১ সালের ঘাতক-দালালদের বিচারের উদ্যোগ নিয়েছিল। এই বিচারের জন্য আইন প্রণয়ন করে ৭৩টি ট্রাইব্যুনালে সাড়ে তিন বছরে ৭৫২ জন যুদ্ধাপরাধীকে মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবনসহ বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড প্রদান করা হয়েছিল। দুর্ভাগ্যের বিষয় হচ্ছে, ১৯৭৫ সালে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ও তাঁর সহযোগীদের নৃশংস হত্যার পর বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জেনারেল জিয়াউর রহমান ক্ষমতায় এসে এই বিচার বন্ধ করে দিয়েছিলেন। সাজাপ্রাপ্ত ও বিচারাধীন প্রায় ১১ হাজার যুদ্ধাপরাধীকে তিনি কারাগার থেকে মুক্তি দিয়েছিলেন। তা না হলে কামারুজ্জামানদের ফাঁসিতে ঝোলার কথা ছিল চার দশক আগে। বিচারহীনতার অভিশাপ মোচন করতে জাতিকে অপেক্ষা করতে হয়েছে দীর্ঘ ৪০ বছর।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর নাৎসি যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য মিত্রশক্তি ন্যুরেমবার্গ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছিল। এরপর বিভিন্ন দেশে সরকার স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের জন্য বিশেষ ট্রাইব্যুনাল গঠন করেছে। তবে বাংলাদেশ হচ্ছে একমাত্র দেশ, যেখানে এই ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়েছে দীর্ঘ গণ-আন্দোলন ও গণদাবির ফল হিসেবে। গণহত্যাকারীদের বিচারের দাবি শহীদ পরিবার, মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী গোটা জাতির পক্ষ থেকে উত্থাপিত হয়েছে যুদ্ধ শেষ হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই। বঙ্গবন্ধু স্বদেশে প্রত্যাবর্তনের আগে সৈয়দ নজরুল ইসলাম ও তাজউদ্দীন আহমদের সরকার যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের সিদ্ধান্ত ঘোষণা করেছিল। ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি পাকিস্তানের কারাগার থেকে মুক্তিলাভ করে স্বদেশে ফেরার প্রথম দিনই বঙ্গবন্ধু ১৯৭১ সালের গণহত্যাকারী ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা বলেছিলেন এবং দুই সপ্তাহের ভেতর দালাল আইন প্রণয়ন করে বিচারকার্য আরম্ভ করেছিলেন।
১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর জেনারেল জিয়া যখন সংবিধান পরিবর্তন করে জামায়াত ও যুদ্ধাপরাধীদের বাংলাদেশের রাজনীতিতে অংশগ্রহণের সুযোগ করে দেন, তখন শহীদ পরিবারের সদস্য, মুক্তিযোদ্ধা ও নাগরিক সমাজ প্রতিবাদ করেছে। এই প্রতিবাদ সংগঠিত আকারে দেশব্যাপী গণ-আন্দোলনের আকারে ছড়িয়ে পড়ে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি শহীদজননী জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে 'একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি' গঠনের পর। কবি সুফিয়া কামাল, অধ্যাপক কবীর চৌধুরী, মুক্তিযুদ্ধের অধিনায়ক কর্নেল নূরউজ্জামান, অধ্যাপক আহমদ শরীফ, অ্যাডভোকেট গাজীউল হক, কথাশিল্পী শওকত ওসমান, কবি শামসুর রাহমান প্রমুখ ১০১ জন বিশিষ্ট নাগরিক নির্মূল কমিটির ঘোষণায় স্বাক্ষর করে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার ও তাদের দল নিষিদ্ধকরণের দাবি জানিয়েছিলেন। তখন ক্ষমতায় ছিল খালেদা জিয়ার বিএনপি। সরকার গঠনের জন্য ১৯৯১ সালে জামায়াতের সমর্থন প্রয়োজন ছিল বিএনপির। দলের শীর্ষ নেতা, শীর্ষ যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমকে নাগরিকত্ব প্রদানের শর্তে বিএনপিকে সমর্থন দিয়েছিল জামায়াত। বঙ্গবন্ধুর সরকার ১৯৭২ সালেই ৩৯ জন শীর্ষস্থানীয় যুদ্ধাপরাধীর নাগরিকত্ব বাতিল করেছিল, যাঁদের অন্যতম ছিলেন জামায়াতের তৎকালীন আমির গোলাম আযম।
নির্মূল কমিটির ঘোষণায় চূড়ান্ত সময় বেঁধে বলা হয়েছিল, সরকার যদি ২৫ মার্চের (১৯৯২) ভেতর যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের বিচার না করে, ২৬ মার্চ গণ-আদালত গঠন করে তাঁর বিচার হবে। সরকার এ দাবির প্রতি কর্ণপাত করেনি। গণ-আদালত সফল করার জন্য শহীদজননী জাহানারা ইমাম আওয়ামী লীগসহ মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সব রাজনৈতিক, সামাজিক, পেশাজীবী, সাংস্কৃতিক ও গণসংগঠনের সমন্বয়ে গঠন করেছিলেন 'মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি'। ২৬ মার্চ ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-আদালতে যুদ্ধাপরাধী গোলাম আযমের প্রতীকী বিচার প্রত্যক্ষ করার জন্য পাঁচ লক্ষাধিক মানুষের সমাগম হয়েছিল।
জাহানারা ইমাম সেই সময় বিভিন্ন সমাবেশে একটি কথা বারবার বলতেন, মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তির বিভক্তির কারণে বাংলাদেশের অস্তিত্ববিরোধী জামায়াত এত শক্তিশালী হয়েছে। ১৯৯১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে সমঝোতা করে জামায়াত জাতীয় সংসদে ১৭টি আসন পেয়েছিল। স্বাধীনতাবিরোধী, মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক জামায়াতের এই উত্থান জাতিকে কতটা ক্ষুব্ধ করেছিল, তা মূর্ত হয়েছে শহীদজননীর আন্দোলনের ব্যাপকতা ও ধারাবাহিকতায়। এরপর বহু সংগঠন যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবি করেছে। বিএনপি-জামায়াত সরকারের বহু নির্যাতন, হত্যা, সন্ত্রাস মোকাবিলা করে বাংলাদেশে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রধান জাতীয় দাবিতে পরিণত হয়েছে। ২০০৮ সালের নবম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষের মহাজোটের অভূতপূর্ব বিজয়ের প্রধান কারণ ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকার।
কাদের মোল্লার পর কামারুজ্জামানের ফাঁসি জাতিকে বিচারহীনতার অভিশাপ থেকে কিছুটা হলেও মুক্ত করেছে। তবে কামারুজ্জামানের বিচারের প্রক্রিয়ায় আমাদের অনেক সীমাবদ্ধতাও বারবার আলোচিত হয়েছে। আমরা প্রথম থেকেই ট্রাইব্যুনালের রসদ, দক্ষ জনবল ও নিরাপত্তার ঘাটতির কথা বলছি, যা এখনো পূরণ হয়নি। এই ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিতদের আপিলের শুনানির জন্য সুপ্রিম কোর্টে একটি পৃথক বেঞ্চ গঠনের দাবিও আমরা ক্রমাগত করে যাচ্ছি। সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে আরো বিচারপতি নিয়োগ করে ট্রাইব্যুনালে দণ্ডিত যুদ্ধাপরাধীদের আপিল শুনানির জন্য পৃথক বেঞ্চ গঠন আরো জরুরি হয়ে উঠেছে।
সবচেয়ে জরুরি হচ্ছে যুদ্ধাপরাধীদের দল হিসেবে জামায়াতের বিচার। ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামানরা ব্যক্তিগত শত্রুতা চরিতার্থ করার জন্য গণহত্যা করেনি। 'শান্তি কমিটি', 'রাজাকার', 'আলবদর', 'আলশামস' প্রভৃতি ঘাতক বাহিনী গঠিত হয়েছিল দলের সাংগঠনিক সিদ্ধান্ত অনুযায়ী, দলের রাজনীতি ও দর্শন বাস্তবায়নের জন্য; যে দর্শনের নাম 'মওদুদীবাদ'। মুক্তিযুদ্ধের সময় নৃশংসতম গণহত্যা ও মানবতার বিরুদ্ধে যাবতীয় অপরাধকে ইসলামের নামে বৈধতা দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। ব্যক্তির পাশাপাশি দলের বিচার ও জামায়াত-শিবিরের মৌলবাদী সাম্প্রদায়িক রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা আমরা দুই যুগ ধরে বলছি। মুক্তিযুদ্ধের ৩০ লাখ শহীদ পরিবারের জন্য ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে হলে, বাংলাদেশকে মৌলবাদ ও সাম্প্রদায়িকতার অভিশাপ থেকে মুক্ত করতে হলে, গণহত্যার পুনরাবৃত্তি বন্ধ করতে হলে, মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় ধর্মনিরপেক্ষ মানবিক সমাজ গঠন করতে হলে; সর্বোপরি সভ্যতার বোধ প্রতিষ্ঠা করতে হলে জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধকরণের বিকল্প নেই।
লেখক : একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন