মুক্তিযুদ্ধের উপপ্রধান সেনাপতি, বাংলাদেশ বিমান বাহিনীর প্রাক্তন প্রধান, ‘সেক্টর কমান্ডার্স ফোরাম’-এর সভাপতি এবং প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার মহাজোট সরকারের প্রাক্তন পরিকল্পনামন্ত্রী এয়ার ভাইস মার্শাল (অব.) এ কে খন্দকার বীরউত্তম মুক্তিযুদ্ধের ৪৩ বছর পর ‘১৯৭১ : ভেতরে বাইরে’ লিখে যেভাবে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষ-বিপক্ষ শিবিরে নিন্দিত ও নন্দিত হয়েছেন বাংলাদেশে এর আগে অন্য কোন গ্রন্থ প্রকাশের ক্ষেত্রে এমনটি হয়নি। তাঁর এই স্মৃতিকথা নিয়ে গত এক সপ্তাহ ধরে প্রতিদিন প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় আলোচনা-সমালোচনার ঝড় বয়ে যাচ্ছে। তিন দিনে বইয়ের প্রথম সংস্করণ নিঃশেষিত হয়ে দ্বিতীয় সংস্করণও শেষ হতে চলেছে। একই সঙ্গে শেষ হয়ে যাচ্ছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের একজন তারকা অধিনায়কের যাবতীয় গৌরবময় অর্জন।
প্রথমে বলা প্রয়োজন, জাতীয় সংসদে এই গ্রন্থটি সম্পর্কে যে ভাষায় প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করা হয়েছে এবং কয়েকজন মন্ত্রী যেভাবে এ কে খন্দকারের সমালোচনা করেছেন আমি তা সমর্থন করি না। এ ক্ষেত্রে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের বক্তব্য আমার কাছে যথাযথ মনে হয়েছে। আমাদের জানা প্রয়োজন, এ কে খন্দকারের আলোচ্য গ্রন্থটি মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস নয়, নিছক স্মৃতিকথা। আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথায় মানুষ এমন অনেক কথা লেখেন যার সঙ্গে ইতিহাসের কোন সম্পর্ক থাকে না। অধিকাংশ আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথায় লেখক নিজেকে বা প্রিয়জনদের কল্পনারাজ্যের মহানায়কে পরিণত করেন, একইভাবে অপছন্দের নায়কদের পরিণত করেন খলনায়কে। এতে ইতিহাসের কোন ক্ষতি হয় না, বড় জোর কিছু সময়ের জন্য কিছু মানুষকে বিভ্রান্ত করা যায়। তবে স্মৃতিকথা, গল্প, উপন্যাস বা নাটকেও যদি এমন কোন বিষয়ের অবতারণা করা হয় যা রাষ্ট্রের ভিত্তিমূলে আঘাত করে, জাতির গৌরব ও অর্জনকে হেয় করে এবং সর্বোপরি রাষ্ট্রের অস্তিত্ব বিপন্ন করে তখন সে বিষয়টি হালকাভাবে দেখা উচিত নয়।
আত্মজীবনী বা স্মৃতিকথা ইতিহাস না হলেও বরেণ্য ঐতিহাসিক অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন উনবিংশ শতাব্দীর পূর্ব বাংলার সামাজিক ইতিহাস লিখতে গিয়ে সংবাদপত্র ও সাময়িকীর পাশাপাশি সাহিত্য এবং স্মৃতিকথা থেকেও তথ্য সংগ্রহ করেছেন। তার গবেষণায় ব্যবহৃত আত্মজীবনীর তালিকায় বিখ্যাত জনের পাশাপাশি অখ্যাত বীরাঙ্গনার নামও আছে। আত্মজীবনী ও স্মৃতিকথাকে ইতিহাসের অন্যতম উৎস হিসেবে ব্যবহার করে মুনতাসীর মামুন ইতিহাস রচনার ক্ষেত্রে নতুন দিগন্তের উন্মোচন করেছেন। আমাদের আশংকা হচ্ছে কিছু মৌলিক বিষয় যদি খন্দকার সাহেব তার বহুল আলোচিত গ্রন্থে সংশোধন না করেন শুধু ইতিহাসের আস্তাকুঁড়ে নিক্ষিপ্ত হবেন না, বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সৃষ্টিতত্ত্ব অস্বীকার করবার জন্য তাকে ইতিহাসের কাঠগড়ায়ও দাঁড়াতে হবে।
এই গ্রন্থের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত পাঠ করলে লেখকের অনেক স্ববিরোধিতা যেমন ধরা পড়ে, তেমনি তার রাজনীতি, সমাজ, ইতিহাস, দর্শন, কূটনীতি এমনকি সমরনীতি সম্পর্কেও দীনতা ও অজ্ঞতা প্রকট হয়ে ওঠে। প্রতিটি বিষয় নিয়ে লিখতে গেলে দীর্ঘ পরিসর প্রয়োজন। আমি নির্দিষ্টভাবে দুটি গুরুতর ত্রুটি সম্পর্কে উল্লেখ করতে চাই। এ ত্রুটি ইচ্ছাকৃত না অনিচ্ছাকৃত সে আলোচনায় না গিয়েও বলতে পারি এসব তার কষ্টকল্পনাপ্রসূত অভিব্যক্তি বা ‘উইশফুল থিংকিং’ ছাড়া আর কিছু নয়। প্রকৃত বাংলায় একটি প্রবাদ আছে- ‘হাতে পাঁজি মঙ্গলবার!’ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত ছিলেন না এমন কথা পাকিস্তানিরাও বলে না, বলে বাংলাদেশে পাকিস্তানি মানসিকতাসম্পন্ন কিছু ব্যক্তি, কিংবা চরম বঙ্গবন্ধুবিদ্বেষীরা। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে তার ভ্রান্তি নিরসন করতে গিয়ে দ্বিতীয় সংস্করণে তা তিনি সংশোধন করে ‘জয় পাকিস্তান’-এর আগে ‘জয় বাংলা’ যুক্ত করেছেন সম্ভবত অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের পরামর্শে বা বিচারপতি হাবিবুর রহমানের প্রভাবে। তিনি যদি কষ্ট করে ’৭১-এর দৈনিক পত্রিকা দেখতেন, কিংবা স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্র দেখতেন তাহলে জানতে পারতেন বঙ্গবন্ধু ‘জয় বাংলা, জয় পাকিস্তান’ বলেছিলেন ’৭১-এর ৩ জানুয়ারির ভাষণে। ৭ মার্চের ভাষণে তিনি শুধু ‘জয় বাংলা’ বলেছেন। বঙ্গবন্ধুর দুটি ভাষণের পূর্ণ বিবরণ তখনকার সংবাদপত্রে আছে, স্বাধীনতাযুদ্ধের দলিলপত্রেও আছে। বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণ সম্পর্কে শত শত লেখা আছে দেশে ও বিদেশে।
রাজনৈতিক ভাষণের ইতিহাসে আমার বিবেচনায় এটি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ ৫টি ভাষণের অন্যতম। ৭ মার্চের ভাষণ স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা ছিল না, ছিল স্বাধীনতার প্রস্তুতি ও দিক নির্দেশনা। বঙ্গবন্ধুকে হেয় করার জন্য যারা বলেন বঙ্গবন্ধু একটি জাতিকে কোন দিক নির্দেশনা না দিয়ে স্বেচ্ছায় কারাবরণ করেছিলেন- তাদের নেতা জিয়াউর রহমান স্বয়ং বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণকে ‘স্বাধীনতার সবুজ সংকেত’ বলেছেন, যার ভিত্তিতে সামরিক বাহিনী স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছে। জিয়াউর রহমান তার জীবদ্দশায় কখনও দাবি করেননি বঙ্গবন্ধু নয়, তিনি স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন।
স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে এ কে খন্দকার বলেছেন, ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এমন প্রমাণ তিনি কোথাও পাননি। আবার জিয়াউর রহমান সম্পর্কেও বলেছেন, স্বাধীনতা ঘোষণার কোন এখতিয়ার বা যোগ্যতা জিয়াউর রহমানের ছিল না। তাহলে কি ২৬ মার্চ আসমান থেকে ফেরেশতা বা জিন-ভূত নেমে এসে বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন? যারা ঐতিহাসিক কোন বিষয়কে কেন্দ্র করে স্মৃতিকথা লেখেন তারা কখনও শুধু নিজের স্মৃতির ওপর নির্ভর করেন না, অন্যের স্মৃতির ওপরও নয়। সমকালীন রাজনৈতিক ইতিহাসের জন্য তাদের নির্ভর করতে হয় সংবাদপত্র, সাময়িকী, রাষ্ট্রীয় মহাফেজখানায় রক্ষিত দলিলপত্র ও প্রামাণ্য ইতিহাস গ্রন্থের ওপর।
২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এই তথ্য আমাদের মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সংরক্ষিত আছে, ২৭ ও ২৮ মার্চ বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় সকল দৈনিকে প্রকাশিত হয়েছে, বিভিন্ন দেশে সরকারের গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদনে সংরক্ষিত রয়েছে এবং সর্বোপরি উল্লেখিত হয়েছে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। আমি ১৮ বছর আগে কলকাতায় আনন্দবাজার পত্রিকার সিনিয়র সাংবাদিক সুখরঞ্জন সেনগুপ্তের কাছ থেকে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বঙ্গবন্ধুর স্বাধীনতা ঘোষণার সংবাদ টেলিপ্রিন্টারে প্রেরিত প্রিন্ট শিট থেকে সংগ্রহ করেছিলাম। এই বার্তাটি ২৬ মার্চ বিশ্বের সকল গণমাধ্যমে টেলিপ্রিন্টারের মাধ্যমে প্রেরণ করেছিল ৫টি আন্তর্জাতিক বার্তা সংস্থা- বিবিসি, ইউএনআই, পিটিআই, এনডিপি ও টিএসএ। এই টেলিপ্রিন্টার বার্তার প্রথম বাক্যটি ছিল ‘SHEIKH MUJIBUR RAHMAN TONIGHT PROCLAIMED EAST PAKISTAN A SOVEREIGN INDEPENDENT PEOPLES REPUBLIC OF BANGLADESH.’
১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতার যুদ্ধ আরম্ভ হয়েছে স্বাধীন বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ঘোষণার মাধ্যমে। কোন্্ প্রেক্ষিতে বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতা ঘোষণা করেছিলেন তার বর্ণনা রয়েছে এর ১৫ দিন পর ১০ এপ্রিল মুজিবনগর থেকে প্রচারিত স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার কর্তৃক ঘোষিত স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে। বাংলাদেশের নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ কর্তৃক জারিকৃত স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্রের বয়ান আরম্ভ হয়েছে এইভাবে-
‘যেহেতু একটি সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে প্রতিনিধি নির্বাচনের জন্য ১৯৭০ সনের ৭ই ডিসেম্বর হইতে ১৯৭১ সনের ১৭ই জানুয়ারি পর্যন্ত বাংলাদেশে অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়, এবং
যেহেতু এই নির্বাচনে বাংলাদেশের জনগণ ১৬৯ জন প্রতিনিধির মধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় ১৬৭ জনকে নির্বাচিত করেন, এবং
যেহেতু সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে জেনারেল ইয়াহিয়া খান জনগণের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণকে ১৯৭১ সনের ৩রা মার্চ তারিখে মিলিত হইবার জন্য আহ্বান করেন, এবং
যেহেতু এই আহূত পরিষদ-সভা স্বেচ্ছাচারী ও বেআইনীভাবে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়, এবং
যেহেতু পাকিস্তানী কর্তৃপক্ষ তাহাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষার পরিবর্তে এবং বাংলাদেশের প্রতিনিধিগণের সহিত আলোচনা অব্যাহত থাকা অবস্থায় একটি অন্যায় ও বিশ্বাসঘাতকতামূলক যুদ্ধ ঘোষণা করে, এবং
যেহেতু এইরূপ বিশ্বাসঘাতকতামূলক আচরণের পরিপ্রেক্ষিতে বাংলাদেশের সাড়ে সাত কোটি মানুষের অবিসংবাদিত নেতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশের জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণের আইনানুগ অধিকার প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে ১৯৭১ সনের ২৬শে মার্চ তারিখে ঢাকায় যথাযথভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা প্রদান করেন এবং বাংলাদেশের মর্যাদা ও অখণ্ডতা রক্ষার জন্য বাংলাদেশের জনগণের প্রতি উদাত্ত আহ্বান জানান,...।’
‘১০ এপ্রিল ১৯৭১ তারিখে চৎড়পষধসধঃরড়হ ড়ভ ওহফবঢ়বহফবহপব’ মুজিবনগরে প্রণীত হয়েছে প্রথমে ইংরেজিতে, যার খসড়া প্রণয়ন করেছেন ১৯৭০-এর নির্বাচনে জাতীয় সংসদে নির্বাচিত সাংসদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, যা অনুমোদন করেছেন পাকিস্তানের জাতীয় ও প্রাদেশিক পরিষদে নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিগণ। এই ঘোষণাপত্র অনুযায়ী গঠিত হয়েছে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সরকার ও মন্ত্রিসভা, যাঁরা ১৭ এপ্রিল মুজিবনগরে শপথ গ্রহণ করেন। স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ২৩ মে ১৯৭২ তারিখে বাংলাদেশের গেজেটের অতিরিক্ত সংখ্যায় প্রকাশিত হয় এবং সংবিধান প্রণয়নের পর এর অংশে পরিণত হয়।
‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ হচ্ছে স্বাধীনতাকামী কোন দেশের স্বাধীনতার পক্ষে দৃঢ়োক্তি বা দাবি। এই ঘোষণাপত্র আন্তর্জাতিক আইন দ্বারা তখনই বৈধতা লাভ করে যখন তা প্রদান করেন দেশের বা জাতির নির্বাচিত প্রতিনিধিরা বা স্বাধীনতা সংগ্রামের অবিসংবাদী নেতৃত্ব। ২০০৮ সালের ১৭ ফেব্রুয়ারি জারিকৃত কসোভোর একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা সার্বিয়া যখন আন্তর্জাতিক আদালতে চ্যালেঞ্জ করে তখন (জুলাই ২০১০) আদালতের রায়ে এই নিরিখে বলা হয়- ‘কসোভোর স্বাধীনতার ঘোষণা আন্তর্জাতিক আইন লংঘন করেনি।’ ২০১১-এর ১৭ ফেব্রুয়ারি মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা কসোভোর স্বাধীনতার ৩য় বার্ষিকীতে প্রদত্ত এক বাণীতে দুই দেশের সম্পর্কোন্নয়ন সম্পর্কে আশাবাদ ব্যক্ত করে কসোভোর আর্থসামাজিক অগ্রগতি ও সমৃদ্ধি কামনা করেছেন।
বহু দেশ আনুষ্ঠানিক ঘোষণা প্রদান ছাড়াই ঔপনিবেশিক প্রভুদের সঙ্গে দেনদরবার ও সমঝোতা করে স্বাধীন হয়েছে। পাকিস্তানের জাতির জনক মোহাম্মদ আলী জিন্নাহ যেমন বলেছেন তিনি একটি টাইপ রাইটারের সাহায্যে পাকিস্তান স্বাধীন করেছেন। স্বাধীনতার জন্য ভারতবাসীকে লড়াই করতে হয়েছে প্রায় ১৫০ বছর। তারপরও ভারত স্বাধীন হয়েছে সমঝোতার মাধ্যমে। সমঝোতার স্মারক হিসেবে শেষ ব্রিটিশ ভাইসরয় লর্ড মাউন্টব্যাটেন কিছুকাল স্বাধীন ভারতের গভর্নর জেনারেলের দায়িত্ব পালন করেছেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতা লাভের ঘটনার সঙ্গে মিল পাওয়া যাবে আমেরিকার স্বাধীনতার ঘোষণা এবং স্বাধীনতা যুদ্ধের সঙ্গে। তবে একটি ক্ষেত্রে বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অন্য যে কোন দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের তুলনায় বৈশিষ্ট্যপূর্ণ ও গুরুত্বপূর্ণ দাবি করতে পারে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধসহ সরকার কিভাবে পরিচালিত হবে, রাষ্ট্রপতির ক্ষমতা কী হবে তা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে যেভাবে বলা হয়েছে বিশ্বের অন্য কোন দেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে সেভাবে বলা হয়নি। যে কারণে ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি, বঙ্গবন্ধুর স্বদেশ প্রত্যাবর্তনের দিন পর্যন্ত বাংলাদেশ শাসিত হয়েছে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের দ্বারা। এই ঘোষণাপত্রে প্রদত্ত ক্ষমতা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ১৯৭২-এর ১১ জানুয়ারি বাংলাদেশের অস্থায়ী সংবিধান আদেশ জারি করেন। এই ঘোষণাপত্র একাধারে ছিল মুক্তিযুদ্ধকালীন সংবিধান এবং বাংলাদেশের মূল সংবিধানের ‘জেনেসিস’ বা ‘সৃষ্টিতত্ত্ব’। বাংলাদেশের সংবিধান প্রণীত হওয়ার পর চতুর্থ তফসিলের ১৫০ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র বাংলাদেশের সংবিধানের অবিচ্ছেদ্য অংশ।
বঙ্গবন্ধু কোন্্ পরিস্থিতিতে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন সে বিষয়টি যেমন স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে নির্দিষ্টভাবে বলা হয়েছে এবং এর সঙ্গে আরও বলা হয়েছে-
‘আমরা বাংলাদেশের নির্বাচিত প্রতিনিধিগণ, বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতার অধিকারী জনগণ কর্তৃক আমাদিগকে প্রদত্ত কর্তৃত্বের মর্যাদা রক্ষার্থ, নিজেদের সমন্বয়ে যথাযথভাবে একটি গণপরিষদরূপে গঠন করিলাম এবং পারস্পরিক আলোচনা করিয়া এবং বাংলাদেশের জনগণের জন্য সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক সুবিচার নিশ্চিত করণার্থ, সার্বভৌম গণপ্রজাতন্ত্র রূপে বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠা ঘোষণা করিলাম এবং তদ্বারা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কর্তৃক ইতিপূর্বে ঘোষিত স্বাধীনতা দৃঢ়ভাবে সমর্থন ও অনুমোদন করিলাম।’
যেহেতু বঙ্গবন্ধু ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘোষণা করেছেন এবং যেহেতু এই ঘোষণা নির্বাচিত গণপ্রতিনিধিরা স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে অনুমোদন করেছেন সেহেতু ঘোষণাপত্রের শেষে বলা হয়েছে- ‘আমরা আরও সিদ্ধান্ত গ্রহণ করিতেছি যে, স্বাধীনতার এই ঘোষণাপত্র ১৯৭১ সালের ২৬ মার্চ তারিখে কার্যকর হইয়াছে বলিয়া গণ্য হইবে।’ স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র ১০ এপ্রিল জারি করা হলেও এই ঘোষণাপত্র এবং বাংলাদেশের সংবিধান অনুযায়ী ২৬ মার্চ ১৯৭১ থেকে বাংলাদেশ একটি স্বাধীন রাষ্ট্র। এই দিন থেকে বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানী সামরিক জান্তা পরিণত হয়েছে দখলদার বাহিনীতে, যাদের দখলদারিত্ব রক্ষার জন্য গণহত্যা, ধর্ষণ, লুণ্ঠন ও অগ্নিসংযোগ করেছে জামায়াত এবং তাদের সহযোগীরা।
বাংলাদেশের স্বাধীনতা প্রথম কে ঘোষণা করেছেন এ নিয়ে ২০০৯ সালে হাইকোর্টে একটি মামলা হয়েছিল। ‘ড. এম এ সালাম বনাম বাংলাদেশ সরকার...’-এর মামলায় বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হক যে যুগান্তকারী রায় প্রদান করেছেন সেখানে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের উল্লেখ ছাড়াও ১৯৪৮ সাল থেকে ১৯৭১ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কিভাবে বাঙালী জাতিকে ধাপে ধাপে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন তার বিস্তারিত বিবরণ দিয়েছেন বিভিন্ন সরকারি নথিপত্র, সংবাদপত্রে প্রকাশিত বঙ্গবন্ধুর ভাষণ এবং ঐতিহাসিকদের রচনাবলীর ওপর ভিত্তি করে।
বিচারপতি খায়রুল হক তাঁর রায়ে ১৯৬৪ সালে প্রদত্ত বঙ্গবন্ধুর একটি ভাষণ উল্লেখ করে লিখেছেন-
‘১৯৬৪ সনের ১২ই জুলাই তারিখে সমগ্র পূর্ব পাকিস্তানে আইউব সরকারের নির্যাতনের বিরুদ্ধে ‘জুলুম প্রতিরোধ দিবস’ পালিত হয়। ঐদিন পল্টন ময়দানে শেখ মুজিব একটি অসাধারণ বক্তৃতা প্রদান করেন। তাঁহার বক্তৃতার প্রারম্ভে বলেন-
‘সোনার বাংলার ভাইয়েরা আমার! স্বাধীনতার ১৭ বছর পরে আবার জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রামে নামতে হবে, ১৭ বছর পরে আবার ভোটের অধিকারের জন্য সংগ্রাম করতে হবে, ১৭ বছর পরে আবার রাজবন্দীদের মুক্তির জন্য আন্দোলন করতে হবে- একথা কোন দিন ভাবিনি। নিজ দেশে নিজেদের সরকারের বিরুদ্ধেও ব্রিটিশ আমলের মতো জনগণের স্বাধীনতার জন্য সংগ্রাম করতে হবে ভাবলে মন আমার শিউরে ওঠে।’
বিচারপতি খায়রুল হকের এই রায়ে বিভিন্ন দেশের সংবাদপত্র, সরকারি দলিলপত্র, এমনকি পাকিস্তানের যাবতীয় প্রকাশ্য ও গোপন নথিপত্রের তথ্য উদ্ধৃত করে বঙ্গবন্ধু কর্তৃক স্বাধীনতার প্রথম ঘোষণা প্রদান সম্পর্কে উল্লেখ করা হয়েছে। ২৬ মার্চ পাকিস্তানের সামরিক জান্তাপ্রধান জেনারেল ইয়াহিয়া খান স্বাধীনতার ঘোষণার জন্যই বঙ্গবন্ধুকে রাষ্ট্রদ্রোহী ও বিশ্বাসঘাতক বলেছিলেন।
বাংলাদেশের স্বাধীনতাবিরোধীরা সব সময় ‘স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র’ অস্বীকার করেছে। কারণ এটা মানতে গেলে ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন রাষ্ট্র এবং বাংলাদেশে অবস্থানকারী পাকিস্তানি সামরিক জান্তা ও সামরিক বাহিনী অবৈধ ও দখলদার সরকার ও হানাদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হবে। ১৯৭২-এর ৪ জুন পাকিস্তান থেকে প্রকাশিত জামায়াতে ইসলামীর দলীয় মুখপত্র ‘সাপ্তাহিক এশিয়া’য় জামায়াত এক বিবৃতিতে বাংলাদেশকে স্বীকৃতি না দেয়ার জন্য তাদের সরকারকে অনুরোধ জানিয়ে বলেছিল- স্বীকৃতি দেয়া হলে ১৯৭১-এর যুদ্ধ স্বাধীনতার যুদ্ধ ছিল এটা মেনে নেয়া হবে, পাকিস্তানী সৈন্যরা দখলদার বাহিনীতে রূপান্তরিত হবে, বাংলাদেশ তাদের যুদ্ধাপরাধের দায়ে বিচারের সুযোগ পাবে এবং এই যুদ্ধের ক্ষয়ক্ষতির জন্য বাংলাদেশ পাকিস্তানের কাছে ক্ষতিপূরণ চাইতে পারবে।
স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র চ্যালেঞ্জ করে এ বছরের শুরুতে খালেদা জিয়া তনয় তারেক রহমান বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ, বাংলাদেশ রাষ্ট্রের ভিত্তি এবং ১৯৭১-এর ২৬ মার্চ থেকে আরম্ভ করে ’৭২-এর ১৬ ডিসেম্বর সংবিধান কার্যকর হওয়ার পূর্ব পর্যন্ত মুক্তিযুদ্ধসহ সরকারের যাবতীয় কার্যক্রমের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করেছেন। এ কে খন্দকার স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র অস্বীকার করে নিজেকে তারেক রহমানের স্তরে নামিয়ে এনেছেন, যে তারেক জামায়াতকে সহোদর বিবেচনা করেন।
দুর্ভাগ্যের বিষয় এই যে, স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র সম্পর্কে মুক্তিযুদ্ধের উপ-সেনাপ্রধান সেনাপতি এ কে খন্দকারের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে এর অস্তিত্ব সম্পর্কে কোন ধারণা ছিল না, এবং পরবর্তী ৪৩ বছরেও তিনি জানবার চেষ্টা করেননি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের কোন দলিলের অস্তিত্ব ছিল।
খন্দকার সাহেব লিখেছেন, বাংলাদেশ স্বাধীন করবার জন্য বঙ্গবন্ধুর কোন প্রস্তুতি ছিল না; থাকলে নয় মাসের অনেক আগেই নাকি দেশ স্বাধীন হয়ে যেত। ১৯৪৮ সালের ভাষা আন্দোলন থেকে আরম্ভ করে ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু কিভাবে জাতিকে স্বাধীনতার জন্য প্রস্তুত করেছেন এ বিষয়ে শত শত প্রবন্ধ লেখা হয়েছে, প্রামাণ্য গ্রন্থের সংখ্যাও কম নয়। আমি ও মুনতাসীর মামুনসহ অনেকে লিখেছেন ১৯৬১ সাল থেকে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার জন্য কিভাবে গোপনে সশস্ত্র সংগ্রামের প্রস্তুতি গ্রহণ করেছেন এবং মুক্তিযুদ্ধের পশ্চাদভূমি হিসেবে ব্যবহারের পাশাপাশি মুক্তিযোদ্ধাদের প্রশিক্ষণ ও অস্ত্র প্রদানের জন্য কিভাবে ভারতকে রাজি করিয়েছেন। একই সঙ্গে প্রকাশ্যে গণতান্ত্রিক আন্দোলনের সুযোগ গ্রহণের মাধ্যমে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করে জাতির স্বাধীনতার আকাক্সক্ষাকে সর্বোচ্চ পর্যায়ে নিয়ে গেছেন তিনি। তিনি জানতেন কখন ছয় দফার কথা বলতে হবে, কখন এক দফার কথা বলতে হবে। আমরা বরং বলতে পারি বাংলাদেশকে স্বাধীন করবার জন্য বঙ্গবন্ধু বারবার মৃত্যুর ঝুঁকি নিয়ে যেভাবে গোপনে ও প্রকাশ্যে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন পৃথিবীর অন্য কোন দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের নায়করা তা করতে সক্ষম হননি। এ কারণেই স্বাধীনতা ঘোষণার ১৫ দিনের ভেতর সরকার গঠন, ভারতের প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর আনুষ্ঠানিক বৈঠক, মুক্তিযুদ্ধের সূচনা- সবই সম্ভব হয়েছিল এবং মাত্র নয় মাসের যুদ্ধে বাংলাদেশ স্বাধীনও হয়েছিল। এত সংক্ষিপ্ত সময়ে সরকার গঠন, সার্বিক মুক্তিযুদ্ধ সংগঠন এবং বিজয় অর্জনের ঘটনা বিশ্বের অন্য কোন দেশের ক্ষেত্রে ঘটেনি। পূর্বপ্রস্তুতি ছাড়া তিব্বতের দালাইলামা ৫৫ বছর আগে ৫০ হাজার তিব্বতী নিয়ে ভারতে এসেছেন, এখনও তিব্বত স্বাধীন করতে পারেননি। স্বাধীনতার জন্য ফিলিস্তিনীরা গত ৬৬ বছর ধরে লড়াই করছেন, এখনও তা অর্জিত হয়নি।
এ কে খন্দকারের লেখায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস পাল্টে যাবে না, ইতিহাস নির্ধারিত স্থান থেকে বঙ্গবন্ধুও বিচ্যুত হবেন না। তবে যাদের উৎসাহ বা প্ররোচনায় তিনি এই স্মৃতিকথা লিখেছেন তাদের উদ্দেশ্য সফল হয়েছে। মুক্তিযুদ্ধের আজন্ম শত্রু জামায়াত তাদের মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাসবিনাশী ষড়যন্ত্রে একটি মোক্ষম অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করছে এ কে খন্দকারের স্মৃতিকথাকে। তার মতো একজন বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধাকে নিজেদের শিবিরে আনতে পেরে জামায়াত কী পরিমাণ উল্লসিত হয়েছে তাদের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিদিন তার বিবরণ আমরা প্রত্যক্ষ করছি। তার এই অপমান ও অধঃপতন আমাদের বেদনাহত করেছে। অজ্ঞানতা অপরাধ নয়। তিনি যদি অজ্ঞানতাবশত এসব লিখে থাকেন আমরা আশা করব দ্বিতীয় সংস্করণের মতো তৃতীয় বা চতুর্থ সংস্করণে তা সংশোধন করবেন। যদি না করেন তাহলে এটাই প্রতীয়মান হবে বঙ্গবন্ধুর ঘাতকদের মতো বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়ে তিনি মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছিলেন। পার্থক্য এটুক্ইু- ডালিম, রশীদ, নূররা তাদের কাজ সম্পন্ন করেছেন সাড়ে তিন বছরে, এ কে খন্দকার করছেন সাড়ে তেতাল্লিশ বছর পর।
(জনকন্ঠ )
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন