স্বাধীন দেশে আমরা কী চেয়েছিলাম, আর কী পেলাম?
26 March 2024, Tuesday
বাংলাদেশের স্বাধীনতার মাস এটি। আমাদের গর্ব আর ভালোবাসার মাস। একাত্তরের মার্চ মাস দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার। সে বাংলাদেশ আর আজকের বাংলাদেশে অনেক তফাৎ। সে মাসটি ছিল বুক ভরা বাঙালি হবার মাস। বাঙালি জাতীয়তাবাদের জন্য আমাদের প্রাণ ও হৃদয় আকুল হবার মাস। আজকের বাংলাদেশ অনেক এগিয়ে। সে বাংলাদেশকে তলাবিহীন ঝুড়ি বলে উপহাস করা হতো, যে আমেরিকা তার সর্বশক্তি দিয়ে স্বাধীনতাকে বিপন্ন করার চেষ্টা করেছিল সে আমেরিকা এখন কুপোকাত। দেশ এগিয়েছে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তাঁর প্রজ্ঞা আর শক্তি দিয়ে দেশকে এগিয়ে নিয়ে গেছেন। আজ যে অবস্থানে আমরা তা এককালে কল্পনাও করা যেতো না। সত্যি এই, বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক ভাবমূর্তি এখন অনেক উঁচুতে। কারো সাধ্য নাই আমাদের অর্জনকে চোখ রাঙাতে পারে। এমন একটা শক্তিশালী অবস্থানে থাকা স্বদেশ আজ সবার গর্ব।
এই দেশটি খেলাধুলা আর্থিক উন্নয়ন সহ নানা বিষয়ে নিজের জায়গা করে নিচ্ছে। এশিয়ার দেশগুলোর ভেতর বাংলাদেশ এবং তার অর্থনীতি সবার প্রশংসা কুড়িয়ে চলেছে। এতো অর্জনের পর ও সমাজ আর সংস্কৃতির বেলায় আমরা সেভাবে এগোতে পারছি না। এর দায় আসলে কার? গোড়াতেই আমরা সমাজের নানা দিকে তাকালে দেখব অসংগতি আর বৈষম্যে ভরা। এমন তো কথা ছিল না। স্বাধীন দেশের সমাজ আসলে কী ধরনের হবার কথা? এই মাত্র কদিন আগে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন পালিত হয়ে গেলো। একশ পাঁচ বছর বয়সে পড়তেন জনক। ঘাতকের দল পঞ্চাশের পরপরই তাঁর জীবন কেড়ে না নিলে কেমন হতো এদেশের চেহারা? আর যা হতো বা না হতো এটা মানতে হবে সামাজিক বৈষম্য সাম্প্রদায়িকতা অনাচারের কবলে পড়তো না স্বদেশবাসী। বঙ্গবন্ধু তাঁর প্রতিটি ভাষণে বারবার মানুষকে মানুষ হবার ডাক দিয়ে গেছেন। এই মানুষ হবার তালিকাটি একটি শুদ্ধ তালিকা। যেখানে ধনী-গরিবের ভেদাভেদ আর ধর্ম বা সম্প্রদায়গত বিভেদ থাকার কথা না। এগুলো তিনি ভয়ংকরভাবে ঘৃণা করতেন। তাঁর কন্যাও তাই মানেন।
কিন্তু যে সরকারি দলের চেহারা আমরা দেখছি তাতে নেতাদের ভেতর এই দায়িত্বববোধ কম। অথচ আওয়ামী লীগই পারে সমাজকে শান্ত সংহত ও স্থির রাখতে। আসলে কারো সময় নাই সমস্যার গভীরে যাবার। স্বদেশের বড় যেকোনো প্রতিষ্ঠানের দিকে তাকালেই চোখে পড়বে অনিয়ম। আজকাল শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের চেহারাও ভয়াবহ। যখনই কোনো ব্যক্তি অবসরে যান বা পদ ছাড়তে বাধ্য হন তখনই বেরিয়ে আসে কেলেঙ্করির খবর। ভয়াবহ সব কেলেঙ্কারি জাতিকে এখন অবশ করে ফেলেছে। উপাচার্য বা তেমন পদের মানুষজনের কেলেঙ্কারির খবর যদি সত্য হয় তো কপালে ভয়াবহ দুর্যোগ নামতে বাধ্য। প্রায় জায়গাতেই আমরা আর্থিক কেলেঙ্কারির চূড়ান্ত নগ্ন রূপ দেখি। তারচেয়েও ভয়াবহ ইদানীংকালের ছাত্র ছাত্রীদের আত্মহত্যার খবর। সমাজ কোনোভাবেই এটা সমথর্ন করে না। বাচ্চারা স্কুল কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে যায় পড়াশোনা করার জন্য। এই সেদিনও আমাদের দেশের বিদ্যাপীঠগুলো ছিল শান্তি আর প্রগতির দূর্গ। সে প্রগতি এখন প্রশ্নের মুখোমুখি। কে কোন পোশাক পরবে, কোন অলংকার পরিধান করবেÑ এটা সমাজ বা প্রতিষ্ঠান নিয়ন্ত্রণ করতো না। এটা ছিল ব্যক্তি স্বাধীনতা। সে পাট চুকে গেছে। তা যাক। তার চেয়েও ভয়াবহ যন্ত্রণার নাম যৌনতা ।
আজকাল এই যৌনতা সামাজিক মিডিয়ার বড় এক আশ্রয়। রীল, ফটো, টিকটক, ইউটিউব যে নামেই ডাকা হোক না কেন, সব মিলিয়ে ওই যৌনতারই রমরমা। তরুণ-তরুণীদের মনোজগত পড়ার বা জানার ইচ্ছে নাই কারো। মা-বাবা ভাই বোন সবার আছে আলাদা এক বায়বীয় জগৎ। সে নেশায় বুঁদ মানুষের স্বপ্ন সাধ সব আবর্তিত হচ্ছে ডিজিটাল মিডিয়াকে ঘিরে। আমরা যারা দেশের বাইরে বসবাস করি যারা মনে করি বা বিশ্বাস করি যে আমরা গণতান্ত্রিক দেশ ও উদার সমাজের অধিবাসী আমরা কিন্তু এমন কোনো বাস্তবতা দেখি না। অস্ট্রেলিয়ার বাঙালি তরুণ-তরুণীদের ভেতরও নেই এই প্রবণতা। তারা আজকাল ফেসবুক ব্যবহারও কমিয়ে দিয়েছে। ইনস্টাগ্রামে বিজনেস বা সোশ্যাল কাজকর্ম সারাই তাদের ব্রত। আমাদের বেলায় ঠিক তার উল্টো। অস্বীকার করি না ফেসবুক বহু অসাধ্য সাধন করছে। কাউকে কাউকে এমপি পর্যন্ত বানিয়ে ছেড়েছে। এর প্রভাবে অনেক অনিয়ম হটতে বাধ্য হয়েছে। কিন্তু এটাও মানতে হবে, এর ভয় দেখিয়ে এর মাধ্যমে ভাইরাল করার হুমকি দিয়ে অনেকের জীবন নরক বানিয়ে ছাড়ছে কেউ কেউ। যার কারণে এখন আত্মহত্যার মতো ভয়াবহ পরিণতিও মেনে নিতে বাধ্য হচ্ছে অনেকে। এর প্রতিরোধ দেখি না। প্রতিবাদ বা সরব হয়ে ওঠার নিয়মটা ও অদ্ভুত। কেউ মারা না যাওয়া পর্যন্ত এর কোনো খবর পাওয়া যায় না। এই যে অবন্তিকা বা সাদি মহম্মদÑ তারাও সামাজিক অনিয়মের শিকার। সাদি মহম্মদ দেশবরেণ্য একজন শিল্পী হওয়ার পরও যে অভিমান নিয়ে মারা গেলেন সমাজ বা সংস্কৃতি তার কোনো খবর রাখতো না। কেউ জানতেন না এমন একটা বেদনার গল্প? এটা যদি মানতেই হয় তাহলে এটাও মানতে হবে সমাজ এখন বিচ্ছিন্ন এক দ্বীপ। যে দ্বীপের বাসিন্দারা একসাথে থাকে ঘুমায়, খায়-দায়, কিন্তু কেউ কারো খবর রাখে না।
যৌন হয়রানির বিষয়টি নতুন কিছু না। বিভিন্ন স্কুল-কলেজে এসব ঘটনা নতুন ঘটছে না। অথচ আমরা কথা বলি শুধু তখন ই যখন কেউ নাই হয়ে যায়। একজন শিক্ষক একজন অভিভাবক। আমাদের সমাজ একসময় জানতো শিক্ষক মানে মা বাবার মতো নির্ভর করতে পারা কেউ। সে জায়গাটা আজ ভয়াবহ এক বিপর্যয়ের মুখোমুখি। শিক্ষকের তাড়নায় ছাত্রীকে মরতে হয় এর চাইতে বড় লজ্জা আর কী হতে পারে? যেসব কথাবার্তা আর ঘটনা বেরিয়ে আসে তাতে লজ্জা শরমে মুখ দেখানো ভার। অথচ যারা করে বা করেই চলেছে তাদের কোনো বিকার নাই এবং আমরা সবাই জানি আরো কোনো নতুন ঘটনা আছে, যা কিছুদিন পর বেরিয়ে আসবে। এর নাম বিকৃতি। এর মানে সমাজ এখন উন্নতি অগ্রগতির সাথে তাল মিলিয়ে চলতে পারছে না। তার যাত্রা উল্টো পথে।
স্বাধীনতার এই মাসে বাঙালি নানা দিক থেকে এগোলেও তার সমাজ আর সংস্কৃতি বাঁধা পড়ে গেছে ডিজিটাল নামের ফাঁদে। আমাদের স্বাধীনতার স্বপ্ন আর সাধনা এখনো হারিয়ে যায়নি। কিন্তু অবলুপ্ত হওয়ার পথে। ধর্ম, সংস্কৃতি, আনন্দ-বিনোদন, শিশু-তারুণ্য সবার মনে একটাই প্রশ্ন, আমরা কি এই সমাজ চেয়েছিলাম? না আমরা তা চাইনি। আমরা সহজ, সাধারণ আর মায়ার এক সমাজ চেয়েছিলাম। যে সমাজে মানুষের চিন্তা হবে উচ্চ, জীবন হবে সাধারণ ও সরল। স্বাধীন জাতির এই স্বপ্ন কি অধরাই থেকে যাবে? না শেখ হাসিনার অন্যান্য অর্জনের মতো এদিকটাও ঝলসে উঠবে আবার।আস লেখক : কলামিস্ট। সিডনি, অস্ট্রেলিয়া থেকে
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন