নেগেটিভ বনাম পজিটিভ বাংলাদেশ
22 October 2020, Thursday
লেখা শুরু করার আগে একটা ছোট খবরে চোখ বুলাতে অনুরোধ করব আপনাদের। ভালো করে পড়ে দেখুন খবরটি। মির্জা ফখরুল বলেন, আইএমএফের রিপোর্টে দেখছি ভারতের জিডিপি ১০ শতাংশ কমে যাওয়ার সম্ভাবনা দেখা দিয়েছে। সেখানে বাংলাদেশের জিডিপি বেশি করে দেখানো, বাংলাদেশে অর্থনীতি এত চমৎকার দেখানো হচ্ছে। এর পেছনে আরও অনেক উদ্দেশ্য আছে। কোনো শুভঙ্করের ফাঁকি দিয়ে বাংলাদেশের মানুষকে বোকা বানানো হচ্ছে।
একমাত্র আমাদের দেশে আমাদের রাজনীতিতেই নেগেটিভিটি সবসময় বড় খবর। এটি একটি চালু দৈনিকের শীর্ষ কলামে বক্তার ছবিসহ ছাপা হয়েছে। সমালোচনা বিতর্ক বাদানুবাদ থাকার নামই গণতন্ত্র। দেশে মুখে যে যাই বলুক আসলে গণতন্ত্র কি তার কোনো স্পষ্ট ধারণা নাই। কোনো একটি সভ্য সমাজের সাথে তুলনা করলেই শুনতে হয়, আমরা কি আর ব্রিটিশ, আমেরিকা না ভারত, অস্ট্রেলিয়া? বুঝলাম তা না। কিন্তু তুলনা তো এদের সাথেই হবে। আর সে জায়গায় পৌঁছানোর কাজও জরুরি। বিষয়টা এমন আমি ডাক্তারি মানি কিন্তু পেসক্রিপশান মানি না। গণতন্ত্রহীনতার কথা বলে মুখে ফেনা তোলা বিএনপি মহাসচিবও কিন্তু গণতন্ত্রের চর্চা করলেন নেগেটিভিটি দিয়ে। বাজারে ইস্যুর অভাব?
দেশে ফোন করলেই শুনি আলু নাই, চাল নাই। বাজারে আছে কিন্তু ঘরে নাই আর নাই। সাধারণ মানুষ কি উন্নয়ন ধুয়ে পানি খাবে? তার চাই বাঁচার রসদ। মীর্জা ফখরুল তা নিয়ে বলেননি। বলেননি ধর্ষণ পরবর্তী বাস্তবতা আর সামাজিক প্রতিরোধহীনতা নিয়েও। তার হাতে তুরুপের যতগুলো তাস তার একটিও ব্যবহার করেননি তিনি। উল্টো প্রবৃদ্ধির মতো জটিল একটা বিষয় নিয়ে বললেন যা মানুষের মাথার ওপর দিয়ে যাবে। সে কারণেই বিরোধী দল বা বিরোধীতার রাজনীতি মানুষের মনে কোনো ভরসা দিতে পারছে না। পারবেও না।
নেগেটিভ বাংলাদেশ আমরা কেন চাইব? কেন আমরা চাইব আমাদের জিডিপি বা প্রবৃদ্ধি নীচের দিকে যাক? বাংলাদেশের সব কৃষক-মজুর-শ্রমিক কি আওয়ামী লীগ করেন? তাদের ভেতরে কি বিএনপি, কমিউনিস্ট পার্টি, জাসদ ইত্যাদি দলের লোক নাই? সবাই মিলে ভাল থাকার জন্য যদি দেশ হয় তাহলে এই শকুনী মন্তব্য কেন? সবাই জানেন বাংলাদেশের যেকোনো সরকার এমনকি দুনিয়ার যেকোনো দেশের সরকারই মূলত তাদের সাফল্যের কথা বলে, প্রচার করে। বিরোধীদের কাজ তার অসামঞ্জস্য বের করে ভুল ধরিয়ে দেয়া। এহেন মন্তব্যে তার কোনো ছায়া দেখলাম না। আমি এটা মানি সরকার বিরোধীদল সহ্য করতে পারছে না বা মানছে না এমন অভিযোগ আছে। সে অভিযোগগুলোর সমাধান কি? বিএনপি তো মধ্যবর্তী না ফ্রেশ নির্বাচন এনিয়ে কথা বলতে ব্যস্ত। ধরুন যদি ফ্রেশ নির্বাচন হয়ও কিন্তু আপনাদের কথামতো যেসব অনিয়ম বিশৃঙ্খলা সেগুলো’ র কি হবে? আপনারা কোন যাদুবলে সেসব ঠেকাবেন জনাব? সবাই জানি নির্বাচন ও ভোট এ দুটি বিষয় এখন একাকার না। নির্বাচন হলেই ভোট হচ্ছে বা ভোট দিতে পারছে এটাও মানা কঠিন। রাতের ভোট নামেও একটা বিষয় বেশ রসালো হয়ে চালু আছে। সেসব জায়গায় কি করবেন তার কোনো ঈঙ্গিত ছাড়া এমন প্রতিবাদ বা কথা মূলত নেগেটিভ রাজনীতির বহিঃপ্রকাশ।
আমি সবসময় দেখি বাংলাদেশে পজিটিভ কাজের কদর কম। সেগুলো নিউজ হলেও বুদবুদের মতো। ধর্ষণের পর যেসব প্রতিবাদী ছাত্র-ছাত্রীরা মিছিল সমাবেশ করে নোয়াখালী অভিমুখে রওয়ানা হয়ে গেল তারা তখন পর্যন্ত শিরোনাম হয়নি, যে মুহূর্তে তারা ফেনীতে আক্রান্ত হলো সে সময় থেকেই মিডিয়া ঘটনাটা লুফে নিলো। মিডিয়া পাশে না দাঁড়ালে তারা যে আরো আক্রমণ ও নাজেহালের শিকার হতো এ কথা যেমন সত্য তেমনি সত্য তাদের ভূমিকা আগাগোড়া একরকম থাকলে হয়তো এভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ে মারতে দুবার চিন্তা করতো আক্রমণকারীরা।
নেগেটিভ বাংলাদেশের আর একটি বৈশিষ্ট্য ভাল বা সুসংবাদকে যেনতেন প্রকারে পরিবেশন। আপনি আমি সবাই জানি এবার ঈদে মানুষ কতটা গৃহবন্দী আর সুবোধ সময় কাটিয়েছিল। সে খবর যতটা না মিডিয়া ফোকাস করেছে তার বেশি ছিল কখন, কোথায়, কিভাবে নিয়ম লঙ্ঘন হচ্ছিল। সতের কোটির দেশে আক্রান্ত করোনাভাইরাস রোগীর সংখ্যা কত সঠিকভাবে না জানলেও এটা বলতে দ্বিধা নাই গরীব ও নিম্মবিত্ত মানুষকে তেমন ভাবে আক্রমণ করতে পারেনি বলেই মৃতের হার কম। আর তারা মরলে, বস্তি উজাড় হলে কেউ ধামাচাপা দিয়ে তা গোপন করতে পারত না। আপনি রোহিঙ্গাদের কথাই ধরুন। ওইসব শরণার্থী শিবিরে মড়ক লাগলে কক্সবাজার বা টেকনাফ উখিয়া কি ভালো থাকতে পারত? সে গল্পগুলো কিন্তু কেউ বলে না। লেখেও না।
শারদীয় দুর্গা পূজা আসন্ন। হাটেবাজারে ক্রেতা বেড়েছে। মানুষ যে খুব একটা নিয়ম মানছে তাও না। কিন্তু এবার পূজায় আসলে কতটা সীমাবদ্ধতা থাকা উচিত আচরণ ও আয়োজন কতটা কেমন হওয়া দরকার তা নিয়ে কোনো কথা শুনি না। শারদীয়ার বড় অনুষঙ্গ কাপড় বা পোশাক। নতুন কাপড় না পরলে পূজা হয় না। বিশেষত বাচ্চাদের বেলায় এ কথা একশ পার্সেন্ট সত্য। করোনাভাইরাসের সময়ে হাজার হাজার পরিবার পথে বসেছে। নিম্ম আয় আর আয়হীন মানুষদের ঘরে কিসের ঈদ আর কিসের পূজা? তারপরও তাদের সন্তানদের বেলায় কি এটা সত্য নয় যে তারা ও চাইবে নতুন পোশাক? রাষ্ট্র, সমাজ, বিপ্লবীরা চুপ থাকলেও বহু মানুষ চুপ থাকেননি। বিদ্যানন্দ নামের যে সংগঠনটি দেশের মানুষের পাশে দাঁড়িয়ে এক টাকায় গরীবদের আহার যুগিয়ে দেশের মঙ্গল করে, তারা এসে দাঁড়িয়েছে পথে। ঢাকার কারওয়ান বাজারে মিডিয়া পূজা নামে পরিচিত পূজার জায়গায় দশ টাকায় নতুন পোশাক তুলে দিচ্ছে তারা। হিন্দু-মুসলমান জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে সবাই পারেন কিনতে। কিন্তু এই খবরটা তো ভাইরাল হলো না। জানাবার জন্য হুমড়ি খেয়ে পড়ল না সোশ্যাল মিডিয়া।
আমি যখন এ লেখা লিখছি তখন খবরে দেখলাম বিশ্বের ৭৬ শতাংশ ইলিশ মাছ আহরণের দেশ বাংলাদেশ। আমরা যারা সিডনিতে বসবাস করি আমরা আগ্রহ নিয়ে বসে থাকি কখন পাবো দেশী ইলিশ। এই আশা বিশ্ববাঙালির। আমরা এই মাছ নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি। আমাদের আনাজ, আমাদের পোশাক আমাদের বহুকিছু নিয়ে স্বপ্ন দেখতে পারি। কিন্তু আমাদের পছন্দ নুরুল হক নূর, যে কি না ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একটি নামকরা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র সংসদের ভিপি ছিল। যার কথা শুনলে আপনার মনে হবে কোনো লেখাপড়া না জানা ছেলে কথা বলছে। সম্প্রতি সেও ভাইরাল হয়েছে। কী বলে জানেন? তার অবস্থা নাকি খালেদা জিয়ার মতো হবে? এ কথায় যারা উল্লাসিত তারা একবারও ভাবেনি খালেদা জিয়া কয়েক দফার প্রধানমন্ত্রী। তিনি মন্দে-ভালোয় এদেশ শাসন করে গেছেন। তার আমলে বহু আয় উন্নতিও হয়েছে। এই পুচকে তাকে নিয়ে এমন কথা বলে যেন তাদের স্ট্যাটাস এক। আর আমরা নেগেটভিটি গিলতে গিলতে মনে করি ইহাই নিউজ।
সববিষয়ে নেগেটিভ হতে হতে আমরা পজিটিভিটি হারিয়ে ফেলছি। নায়ক, গায়ক, লেখক, শিল্পী, নেতা-অভিনেতা সবাই নেগেটিভ। পজিটিভ আমাদের প্রধানমন্ত্রী বঙ্গবন্ধু কন্যা শেখ হাসিনা। তাকে কখনো পারিনি, পারব না এমন কথা বলতে শুনেছেন? আর পজিটিভ আমাদের সাধারণ মানুষ। যারা পজিটিভ বলেই এত অসঙ্গতিতেও ভালো থাকেন, আনন্দে থাকেন। তাদের আশ্রয় যে মাটি, যে দেশ, সে বাংলাদেশও পজিটিভ। আমি তার সন্তান। আমি জানি সে সব পারে।
তাই আমি হতাশ হই না। ধৈর্য্য ধরি, অপেক্ষা করি।
উৎসঃ বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন