করোনাভাইরাসের মতো ভয়াবহ যে ঘাতক ওৎ পেতে আছে
29 June 2020, Monday
বাংলাদেশে করোনাভাইরাস এখন তার ভয়াল থাবা নিয়ে বিস্তার লাভ করেছে। মানুষের জীবন আছে মহা সংকটে। একদিকে কোভিড-১৯ এর ছোবল আরেক দিকে অনাহার আর অর্থকষ্ট। এমনও শুনছি কিছু কিছু মানুষের সামনে নাকি দুটো পথ খোলা। হয় করোনাভাইরাসে মৃত্যু হবে নয়তো অনাহারে। মানুষ কোনটা বেছে নিতে পারে সেটা অনুমান করা কঠিন কিছু না। এই মহামারী এবং সমস্যা যখন দেশ ও জাতিকে পাগল করে তুলেছে তখন চোখের আড়ালে সমাজকে ধ্বংসের প্রায় শেষ সীমায় নিয়ে যাচ্ছে আরেক গুপ্ত সমস্যা। এটিকে এখন আর গোপন না বলাই সমীচীন। এই অন্ধত্ব বা উগ্রতা একদিনে তৈরী হয়নি। বঙ্গবন্ধু ও চার জাতীয় নেতাকে হত্যার পর যে যখন গদীতে তার আমলে কোনো না কোনো ভাবে এই প্রক্রিয়া বেগবান হতে পেরেছে। আমরা ধরে নিয়েছিলাম বঙ্গবন্ধুকন্যা শেখ হাসিনার সময় এটি আস্তে আস্তে লঘু হয়ে পড়বে। বা এর কার্যকারিতা নষ্ট করার কাজ চলবে। আসলে কি তা হয়েছে? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বাঙালি প্রেম ও বাঙালিয়ানাকে শ্রদ্ধা করেই বলি তার অজান্তে তার সামনে নানা ভাবে এই প্রক্রিয়া আজ এতটাই শক্তিশালী যে সে এখন এক একচোখা দৈত্য। যাকে রোখা প্রায় অসম্ভব।
আমরা ধরে নিই এটা নাকি ভারত বিরোধিতার ফসল। একসময় তা ছিল। যখন মাওলানা ভাসানী থেকে শুরু করে চৈনিক বামেরা ফারাক্কা নিয়ে নানা ভাবে মাঠ গরম করতেন তখন তা এমনই ছিল। কিন্তু যত দিন গিয়েছে এরশাদ, খালেদা জিয়া, এমনকি আওয়ামী লীগ আমলেও এর বিস্তার বেড়েছে। আজ এটা এমন এক রোগ যার সংক্রমণ করোনাভাইরাসের চাইতে কম কিছু না। বাড়তে বাড়তে এমন এক পর্যায়ে চলে গেছে মনে হতে পারে আর কোনোদিন আমাদের জাতি এ ভয়াবহতা থেকে মুক্তি পেতে পারে। এ ছাড়াও মানুষের ভেতর যে সংস্কৃতি ও মূল্যবোধ তাকেও গিলে ফেলেছে এই উগ্র অন্ধত্ব। আপনি হয়তো ভাবছেন আমি হিন্দু বা অমুসলিমদের কথা বলছি। না, মোটেও না। আমার প্রথম উদাহরণটি এদেশের এক স্বনামধন্য রবীন্দ্রসঙ্গীত শিল্পী। যাকে পুরো দেশ এমনকি পাশের দেশেও এক নামে সবাই চেনে। শান্তিনিকেতনের কৃতি ছাত্রী রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা আমাদের জাতির সম্পদ। আমার মনে আছে শেখ হাসিনা যখন শান্তিনিকেতনে বাংলাদেশ ভবনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে গিয়েছিলেন তার সাথে ছিলেন ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদী। মোদী তার ভাষণে সবার আগে যার নামটি উচ্চারণ করেছিলেন তিনি রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা। এই কৃতি সন্তানটি যে শান্তিনিকেতনের ছাত্রী সেটাই বলতে চেয়েছিলেন মোদী। প্রধানমন্ত্র স্বয়ং তার গানের ভক্ত। চ্যানেল আইয়ের আয়োজনে বন্যার জন্মদিনে তিনি ফোন করে তাকে শুভেচ্ছা জানাতে ভোলেননি। এই সব তার কীর্তি।
তিনি যখন করোনাভাইরাস আক্রান্ত স্বাভাবিক কারণেই তা সংবাদ। আর এই সংবাদটি প্রকাশিত হবার সাথে সাথেই আমরা দেখলাম পঙ্গপালের দল কিভাবে ঝাঁপিয়ে পড়ল। আমি নিজে এর ভুক্তভোগী। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম-এর অনেক মতামতে ভিন্নধর্মী বলে গালি শোনাটা আমার অভ্যাসের অংশ এখন। কিন্তু বন্যা তো কোনো অমুসলিম নামের কেউ না। তার ধর্মীয় পরিচয় বাঙালি মুসলিম। তাছাড়া আপনি আমাকে এমন একটা ছবি বা কাহিনী দেখাতে পারবেন যেখানে তাকে উগ্র মনে হয়েছে? বরং তার স্বভাবের মতো কথার মতো তিনি শীতল, শান্ত। সে বরেণ্য নারী যখন কঠিন করোনাভাইরাসে আক্রান্ত তখন দেশের এক বিপুল বিরাট জনগোষ্ঠী নেমে পড়ল তাকে অভিশাপ দিতে অভিশপ্ত করতে। কী কারণ? তার অপরাধ তিনি রবীন্দ্রনাথ নামের এক হিন্দুর গান করেন। অথচ এই মূর্খেরা জানেই না রবীন্দ্রনাথ হিন্দু ছিলেন না। মূর্তি পূজাবিরোধী ব্রাহ্ম হলেও এদের চোখে তিনি হিন্দু। কমেন্টসগুলো কিন্তু উড়িয়ে দেবার মতো না। কেউ কেউ তাকে বলেছে কপালের টিপ মুছে নজরুলের গান গাইলে করোনাভাইরাস চলে যাবে। এদের দৌড় বা মগজে কি আছে তা এসব কথায় স্পষ্ট। বোকা ভণ্ড লোকগুলো জানে না নজরুল কতগুলো শ্যামা সঙ্গীত বা কালী বন্দনা লিখেছেন। যেখানে রবীন্দ্রনাথ কখনো যাননি। নজরুলের মতো অসাম্প্রদায়িক বাঙালি মানুষকেও এরা প্রয়োজনে সাম্প্রদায়িক ঢাল বানাতে চেষ্টা করছে। তাদের এই মনোভাবকে পাত্তা না দেবার বা কাউন্ট না করার পরামর্শদাতারাও মূলত এক ধরনের সাম্প্রদায়িক। এরা আমার চোখে কাকের মতো। কাক মানুষের বিষ্ঠা খাবার সময় চোখ বন্ধ করে ফেলে যাতে কেউ না দেখে। কিন্তু দুনিয়া যে তা দেখছে সেটা কাক টের পায় না। এরা মুখে এসব বলে মনে শান্তি পায় বটে কিন্তু এটা ঠিক জানে দিনে দিনে এই অপকর্ম আজ পাহাড় হয়ে উঠেছে চোখ বন্ধ করে তার অস্তিত্ব নাই বলা যাবে না।
সত্যপ্রসাদ মজুমদার নামে বুয়েটের এক শিক্ষক সে বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য পদে নিয়োগ লাভ করেছেন। সরকারের বুকের পাটা আছে বটে। এমন সমাজে শেখ হাসিনাকেই যখন বলা হয় “কওমী জননী” সত্য বাবু কি না উপাচার্য। ব্যাস শুরু হয়ে গেল গালাগালি আর বীভৎস সব কমেন্টস। ঘোর কলিকালে সত্য যখন জীবনের সব জায়গা থেকে পালিয়ে বেঁচেছে সেখানে বুয়েটে তিনি কি করবেন তার জবাব দেবে সময়। তবে এটা দেখলাম মুক্তিযুদ্ধ আর অসাম্প্রদায়িক যে বাংলাদেশ তা আসলে এখন অলীক।
এই বিকৃতি কতটা ভয়ংকর তার সর্বশেষ উদাহরণ আওয়ামী লীগের প্রয়াত নেতা মোহাম্মদ নাসিম। তার মৃত্যুর আগে যে উল্লাস আর পরবর্তীতে যে আস্ফালন তা যদি আওয়ামী লীগ বুঝতে না পারে তবে তাদের কপালে দুঃখ আছে। আমাকে কেউ কেউ এমন কথা বলে স্বান্তনা দিয়েছেন, দেখুন ধর্ম প্রতিমন্ত্রীর বেলায় কি এমন হয়েছিল? নাসিম সাহেব বিতর্কিত বলে এমনটা হয়েছে। কিন্তু আমার মন বলছে এটা যেমন সত্য তেমন সত্য নাসিমের পিতা এদেশকে পাকিস্তান থেকে মুক্ত করার নেতা ছিলেন আর নাসিম নিজেও ছিলেন আওয়ামী লীগের সামনের সারির নেতা। এটাও আপনাদের গালাগালির বড় কারণ। যেভাবেই আমরা দেখি না কেন পাকিস্তানপ্রীতি আর ভারত বিরোধিতার বল গড়াতে গড়াতে মাঠের বাইরে ছক্কা হাঁকিয়ে এখন সেঞ্চুরির পথে। কারো সাধ্য নাই একে ঠেকাতে পারে।
কঠিন করোনাকালে মানুষ যখন একে অন্যের পাশে দাঁড়াতে মরিয়া, মানুষ যখন শুভকামনা, দোয়া আর আত্মবিশ্বাসের জন্য পাগল তখন এই প্রবণতা কী মনে করিয়ে দেয়? রাজনীতির ভুল একমুখিনতা আর অচলায়তন কি এর জন্য দায়ী? না এর বাইরেও আছে নানাবিধ কারণ? মধ্যপ্রাচ্যের প্রভাব ভারত বিরোধিতা অমুসলিম বা বাঙালি সংস্কৃতির প্রতি নেতিবাচক মনোভাব সব মিলিয়ে উগ্রতা এখন বিষবৃক্ষ। আজ যা রেজওয়ানা চৌধুরী বন্যা, সত্য বাবু কিংবা মোহাম্মদ নাসিমের জন্য সত্য অচিরেই তা দেশের শীর্ষ থেকে নিম্ন সবস্তরের জন্য কাল হয়ে দাঁড়াতে বাধ্য। সত্যিকারের বুদ্ধিবৃত্তি আর মননহীনতার আকালে কে বা কারা পথ দেখাবেন? আদৌ আমরা বাঙালি থাকবো কিনা সেটাই এখন মৌলিক প্রশ্ন। তবু চাই জয় হোক বাঙালির জয় হোক বাংলাদেশের।
উৎসঃ বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন