সবসময় দেখলাম মৃত্যু পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে। এবারও তার ব্যতিক্রম হলো না। বেশ কিছুদিন থেকে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জা লড়ছিলেন আওয়ামী লীগের সাবেক মন্ত্রী হেভিওয়েট নেতা মোহাম্মদ নাসিম। একই সময় গণস্বাস্থ্যের প্রধান জাফরুল্লাহ চৌধুরীও করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছিলেন। আশ্চর্য তো নয়ই অবাকও হইনি যখন দেখলাম এক শ্রেণির মানুষ পাগল হয়ে একজনের মৃত্যু কামনায় আর একজনের জন্য দোয়া করার কাজে লেগে গেল। বলার দরকার নাই তারা কার মৃত্যু চাচ্ছিল আর কার নিরাময়। আমাদের দায়িত্ব না কারও অবদান মাপা বা কে বড় বা কে ছোট নির্ণয় করে দেওয়া। কিন্তু আমরা এটুকু করি না একজনের জন্য কুৎসিত বদদোয়া আর একজনের জন্য শুভ কামনা।
বিনয়ের সাথে জানতে ইচ্ছে করে জাফরুল্লাহ চৌধুরী কি কখনো মন্ত্রী হয়েছিলেন? না দেশ বা সরকার পরিচালনায় অংশ নিয়েছেন? যে মানুষ এমন বিষয়ে টেস্টেড না , আপনি কি করে তাকে সার্টিফিকেট দিচ্ছেন? কী করে নিশ্চিত হলেন তিনি কোনওভাবেই বিতর্কিত হতেন না? বলে রাখি গণস্বাস্থ্যের করোনাভাইরাস পরীক্ষার কিট নিয়ে বিতর্কে আমি ব্যক্তিগতভাবে তার হয়ে কথা বলেছি। সরকারের কঠোর সমালোচনা করতেও দ্বিধা করিনি। কিন্তু অবাক হয়ে দেখলাম তাদের কথামতো সেই আশ্চর্যজনক কিট উধাও হয়ে গেল!
জাফরুল্লাহ চৌধুরী আক্রান্ত হলেন করোনাভাইরাসে। অন্তত একটা ভালো খবর যে তিনি ভালো হয়ে ফিরেছেন। কই আমাদের মন তো বলছে না এটা ঠিক হয়নি। তার অসুখ আরো দীর্ঘ হোক এমন কুভাবনা তো মনে আসে না। অথচ রাজনীতি যদি বিষয় হয়ে থাকে তাহলে এই চৌধুরীকে আমরা দেখেছি খালেদা জিয়ার সাথে আঁতাত করতে। সময় সময় এমন সব কথা বলেন যা মুক্তিযুদ্ধ ও একাত্তরের চেতনাবিরোধী। আমরাও তো একটা বিষয় মেলাতে পারি না গণস্বাস্থ্যের মতো প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার কী করে মান্ধাতা আমালের রাজাকারবান্ধব অন্ধকার রাজনীতির সাথে যুক্ত হয়ে যান! যারা বিজ্ঞান বা আধুনিকতায় বিশ্বাস করেন না, তাদের সহযাত্রী হয় কীভাবে জাফরুল্লাহ চৌধুরী হন? কিন্তু তারপরও আমরা তার মৃত্যু বা অমঙ্গল কামনা করতে পারবো না।
আমাদের সমাজের কথা বলছিলাম। আওয়ামী লীগ এখন যে চেহারায় সে চেহারা কি পঁচাত্তরে ছিল? তখনো দেশ শাসন রপ্ত করতে পারেনি দল। মাত্র সাড়ে তিন বছর আগে যে মানুষটিকে দেশ মাথায় তুলে রেখেছিল, একক সর্বজন প্রিয় নেতা বলে মেনে নিয়েছিল, তাকে তারা কী করলো? কী উপহার দিলো? খুনিদের হাতে নির্মমভাবে নিহত বঙ্গবন্ধু ও তার পরিবারের প্রতি আমি তেমন কোন বেপরোয়া সহানুভূতি দেখিনি।
আজ এতবছর পর এসে এ কথা বলতেই পারি সেদিন বাঙালি মনে মনে কী ভেবেছিল জানি না, বাইরে নীরব থেকে রক্তপাতকে মেনে নিয়েছিল বলেই লাখো মানুষের জানাজা হতে পারেনি। এতবড় মানুষ ও নেতার দাফন হয়েছিল নিরবে অবহেলায় । কাপড় কাচার সাবান দিয়ে গোসল করিয়ে রিলিফের কাপড় মুড়িয়ে কবরে যাবার কথা ছিল সর্বকালের সেরা রাজনৈতিক নেতা শেখ মুজিবের?
ঘটনা এখানেই শেষ না। আমরা বিস্ময় ও হতাশার সাথে দেখলাম কয়েক মাস পরে নভেম্বর মাসে জেলখানায় নিহত হলেন মুক্তিযুদ্ধের মূল কাণ্ডারি তাজউদ্দীন আহমেদ, ভারপ্রাপ্ত রাষ্ট্রপতি সৈয়দ নজরুল ইসলাম, জাতীয় নেতা মনসুর আলী ও কামারুজ্জামান। তাদের জানাজা হলেও মানুষ জানতে পারেনি। নিতান্ত অবহেলা আর তড়িঘড়ি করে দাফন কাজ শেষ করার ভেতর ছিলো চরম ঔদাসিন্য।
গত অক্টোবরে ঢাকায় বনানীতে থাকার সুবাদে এক দুপুরে আমি গিয়েছিলাম কবরস্থানে কবর দেখতে। আজও মনে হয় কি বিশ্বাসঘাতক আর নিমকহারাম আমরা!
এরা না থাকলে এই দেশ, এই পতাকা, এই মসনদ বা গাড়ি থাকতো? ঢাকার যে বাড়ন্ত ফুলে ফেঁপে ওঠা- কোনওকালে ভেবেছিল বাঙালি? অথচ আমরা ইতিহাসের নীরব দর্শক হয়ে কী দেখলাম? মুক্তিযুদ্ধের একজন সেক্টর কমান্ডার কিভাবে লাখো লাখো মানুষের কান্না আর অংশগ্রহণে বিদায় নিয়েছিলেন। সেদিন আমাদের একটি জাতীয় ইংরেজী দৈনিকের শিরোনাম ছিল: Whom they brought her warrior dead. বলাবাহুল্য তিনিও মারা গিয়েছিলেন সামরিক অভ্যুথানে। তার লাশ নিয়েও আছে গল্প-গাঁথা। আমার বাসা থেকে পাঁচ মিনিট হাঁটার দূরত্বে সার্কিট হাউজে মারা যাওয়া জিয়াউর রহমানের লাশ, প্রথমে চট্টগ্রামের অনতিদূরে এক গ্রামে দাফন করা হলেও, পরে আবার তা তুলে এনে রাজধানীতে দাফন করা হয়। আমি বলবো বিএনপির প্রতি মানুষের এই মৃত্যু পরবর্তী ভালোবাসা বা উপচে পড়া সহানুভূতির কারণ রাজনীতি।
যে রাজনীতি পাকিস্তান ভাঙার বেদনায় আকুল সে রাজনীতি ক্রমেই ধারণ করেছে ভারতবিরোধী উগ্র চেহারা। আজ দেশে ভারত বিরোধিতা, সংখ্যালঘু বিরোধিতা এবং আওয়ামী লীগ বিরোধিতা একাকার। সে রাজনীতি ভুলে গেছে মোহাম্মদ নাসিমের পিতা এদেশের একজন ত্যাগী নেতা। মনসুর আলীর মতো সহজ মানুষ এখন রাজনীতিতে বিরল। অন্তত মুক্তিযুদ্ধে তাদের পরিবারের অবদান, যৌবনের শুরুতে নাসিমের পিতা হারানো কিছুই মনে রাখিনি আমরা। শুধু মাথায় ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে আওয়ামী লীগের নেতা বা মন্ত্রী মানেই দুর্নীতিপরায়ণ। দেশ বা সমাজে হাজার সমস্যা মানুষের চুরি ডাকাতি বা মিথ্যার স্বভাব সবকিছুর জন্য দায়ী আওয়ামী লীগ। আমি বলি না- তারা তুলসি পাতা বা সাফ। কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলুন তো নাসিম কি একা পারতেন সমাল দিতে? না এটা একা কারো দ্বারা সম্ভব? আমি হলফ করে বলতে পারি স্বয়ং কোনও দেবদূতকে বসিয়ে দিলেও তিনি পারবেন না বাংলাদেশকে সঠিক পথে আনতে। সমাজে রন্ধ্রে রন্ধ্রে দুর্নীতি। মানুষের মগজের কোষে কোষে লোভ। আপনি সামাজিক মিডিয়াতেই দেখবেন মানুষ কতটা অসংযত লোলুপ আর সেক্স ক্রেজি। এটা কি রাজনীতির অবদান না আমাদের তৈরি?
বিষয় যাই হোক রাজনীতিতে মৃত্যু পরবর্তী প্রতিক্রিয়ায় বিএনপি এগিয়ে। এর কারণ বোঝা কঠিন কিছু না। এক কালের মুসলিম লীগ-জামাত-রাজাকার এবং বদলে যাওয়া বাংলাদেশের প্রতিক্রিয়াশীলরা একজোট। ফাঁসি দিয়ে কয়েকজনকে সাইজ করা গেলেও এর বিস্তার রোধ করা যায় নি। এর জন্য কঠিনভাবে দায়ী আওয়ামী লীগ। বারবার গদিতে আগমন আর দেশ শাসনে এসেও তারা সময়ের সঠিক ব্যবহার করেনি। বরং যেখানে একটু প্রতিবাদ বা বিদ্রোহের আগুন সেখানেই সমঝোতার নামে ছাড় । আমাদের প্রাণপ্রিয় নেতা শেখ হাসিনাকে বলা হচ্ছে ‘কওমী জননী’। এর চেয়ে বড় সত্য আর কি হতে পারে যা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় সমঝোতা কতটা নির্মম হতে পারে!
মোহাম্মদ নাসিমের করোনাকালে করুণ বিদায় যেভাবে বিরূপ প্রতিক্রিয়া ও তোপের মুখে পড়লো তাতে এটা নিশ্চিত বাংলাদেশ তার আদর্শ নীতি আর পথ থেকে অনেক অনেক দূরে সরে গেছে। এ সমাজে মৃত্যু পরবর্তী রাজনীতিতে আওয়ামী লীগ পিছিয়ে পড়বে এটাই স্বাভাবিক।
১৪ জুন, ২০২০, সিডনি
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন