দুনিয়া কেমন হবে, কেমন হবে আমাদের দেশের চেহারা?
14 April 2020, Tuesday
দুটো ভালো খবর দিয়ে শুরু করি। আমাদের প্রশান্ত পাড়ে করোনাভাইরাস সংক্রমণের হার কমে আসছে। সোশ্যাল ডিসটেন্সিং বা সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখা সম্ভবপর হচ্ছে বলে এই হার নিম্নমুখি। এমন না যে একেবারে শেষ হয়ে গেছে কিন্তু কমে আসছে । তারপরও শান্তি বা স্বস্তিতে নাই সরকার। চিফ মেডিকেল অফিসার সাফ জানিয়ে দিয়েছেন ছাড় দেয়ার কোন চিন্তা নাই সরকারের। তারা আরো কিছুদিন কড়া নিরাপত্তা আর দূরত্ব বজায় রাখবেন।
আর একটি সু-সংবাদ হলো ইংল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী বরিস জনসনের হাসপাতাল ত্যাগ। ভদ্রলোক গোড়ার দিকে নজর কাড়েননি। শুরুতে খুব একটা পছন্দের কেউ ছিলেন না। কিন্তু মহামারী করোনাভাইরাসের পর তার ব্যাকুল ও উদ্বিগ্ন মুখ দেখে বুঝতে পারছিলাম তিনি আন্তরিক।
সত্যি কথা বলতে কি বহু নেতার মুখ-চোখ-আচরণে এর ছিটেফোঁটা ও নাই। আপনি ট্রাম্পকে দেখলেই বুঝতে পারবেন, ভেতরে ভয় কিন্তু আচরণে উগ্র। এখনো আবোলতাবোল বকে চলেছেন। পরোক্ষভাবে তার কথা হলো, মানুষ মরলে মরুক বিজনেস চালু রাখতে হবে।
পাশের দেশ ভারতের মোদীর মুখে যতোটা আকুলতা বা বেদনা, তার চেয়ে বেশি বাতি জ্বালিয়ে ভূত তাড়ানোর তরিকা। পাকিস্তানের ইমরান খান এই সুযোগে রীতিমতো ভিক্ষায় নেমে গেছেন। লজ্জায় নিজের কথা মিনমিন করে বললেও উন্নয়নশীল দেশের নামে করোনাভিখারি ইমরান চান সাহায্য। আদেশ নির্দেশ বা হুকুম দেয়া এক কথা আর মমতা বন্দোপাধ্যায়ের চোখে পানি নিয়ে হাতজোড় করা নেতা কম।
বরিস জনসনও তাই করে চলেছিলেন। শরীর খারাপ নিয়েও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করতে গিয়ে মৃত্যুর মুখ থেকে ফিরে আসা তার কথা জানা জরুরী। অলৌকিক শক্তি আছে কি নাই সে দিকে না গিয়ে জীবন ফিরে পাওয়ার জন্য ধন্যবাদ জানিয়েছেন ডাক্তার নার্সসহ স্বাস্থ্যকর্মীদের। চমৎকার লেগেছে তার সত্য ভাষণ। তার মতে নিউজিল্যান্ড-পর্তুগাল এসব দেশের তিনজন নার্স ইন্টেন্সিভ কেয়ারে রাত-দিন জেগে তাকে চোখে চোখে রাখায় তিনি বেঁচে গেছেন। এরা যদি সারাক্ষণ মনিটর না করতো যেকোনও সময় নিভে যেতে পারতো তার জীবন দীপ। এবার বুঝুন, এই মেসেজের গভীরতা কোথায়? আমার আপনার মতো আম জনতার জন্য কে দেবে এমন সময়? কোথায় পাবেন এই সেবা?
বাংলাদেশে এখন যে সমস্যা তা হচ্ছে সামাজিক। সবাই বোঝে করোনাভাইরাসের আতংক কতটা ভয়ংকর। উন্নত বিশ্ব নামে পরিচিত আমেরিকা ইংল্যান্ড ইউরোপ আজ অসহায়ত্বে ভুগছে। যারা দুনিয়াকে ভরসা জোগাতো তাদের এই হাল দেখে অনেকে তৃপ্ত। আমাদের জনজীবনে গোঁজামিল আর অন্ধত্বের জয়জয়াকার। একদল লোক মহা আনন্দে তারা বলে বেড়াচ্ছে চীন নাকি আমেরিকাকে পরাজিত করে ফেলেছে আর চীনই এখন এক নম্বর দেশ। এরা ভুলে যায় কত লাখ মানুষ আমেরিকা আর ইউরোপে আছে আমাদের। কত বাঙালি অভিবাসন নিয়ে পড়াশোনা করতে বা ব্যবসা বানিজ্যে সেসব দেশে আছেন। আর চীনের সাথে কতটা সম্পর্ক আমাদের। এটা আমরা জানি চীন এখন আমাদের দেশে নানাভাবে সহায়তা করছে। কিন্তু সেটা একতরফা কিছু না। এতে উভয়ের লাভ জড়িত। আমরা চাই না তাদের সাথে আমাদের সম্পর্ক নষ্ট হোক। তা ছাড়া পূর্ব-ইউরোপসহ নানা দেশে চীনকে টার্গেট করে পোস্টার লিফলেটের ছড়াছড়ি চলছে। চীনা প্রধানমন্ত্রীর ছবিসহ বলা হচ্ছে- ‘ধন্যবাদ আপনাকে আমাদের বিপদে ফেলার জন্য।’
সিডনিতে চীনা দূতাবাসের সামনে পাগলামি করা মানুষের ভিডিও দেখে বোঝা সহজ মানুষ আস্তে আস্তে অধৈর্য আর তপ্ত হয়ে উঠছে। কিন্তু এটাও অন্যায্য। এমন কোন প্রমাণ নাই যে চীন ইচ্ছে করে করোনাভাইরাস ছড়িয়েছে। আসলে উহান প্রদেশের গোপনীয়তা জন্ম দিচ্ছে এসব নানা অসন্তোষের। বাংলাদেশের সামনে যেখানে কঠিন সময় সেখানে অন্যসব ভাবনার চাইতে জরুরি সামাজিক নিরাপত্তা।
একথা বলি না সরকারের আন্তরিকতা নাই। শেখ হাসিনা একজন প্রাজ্ঞ দূরদর্শী নেতা। তার প্রতি মানুষের ভরসা অটুট। কিন্তু মানতে হবে দল হিসেবে আওয়ামী লীগ তেমন কোন কাজ করছে না বা করে দেখাতে পারছে না যাতে মানুষ আশায় বাঁচতে পারে। বরং ইতোমধ্যে ত্রাণের চাল চুরির মত ন্যাক্কারজনক ঘটনায় জনগণ আতংকিত। এসব মানুষদের না আছে বিবেক না কোন মানবিক বোধ। এরা নৈতিকতা ধর্ম কিংবা ভালো কথা কিছুই শুনবে না। এদের ‘সাইজ’ করা না হলে এরা কখনোই কথা শোনার কেউ না। সমস্যা হচ্ছে আওয়ামী লীগের প্রবীণ সিনিয়র লিডারদের কেউ নাই শেখ হাসিনার পাশে। যারা নানাভাবে অভিজ্ঞ। এদের অভিজ্ঞতা কাজে লাগালে মঙ্গল হতো। এখন যে সব নবীনেরা আছেন তারা আন্তরিক হলেও তাদের সেই ইমেজ বা গ্রহণযোগ্যতা নাই। এমন সংকটকালে নেতারা ঘরবন্দি। সরকারী দলের সচিব নিজেই অসুস্হ। তার নিজের সেলফ কোয়ারেন্টিনে থাকা জরুরী। অন্যদিকে বিএনপি এখনো একটি জনপ্রিয় দল। তাদের জনপ্রিয়তা দেখা না গেলেও অদৃশ্যে তা কাজ করে। সে দলের মুখপাত্র রিজভির সাম্প্রতিক ছবি দেখে ভিড়মি খেলাম! তাদের দপ্তরে জনমানবশুন্য টেবিলে তিনি পিপিই পরিধান করে মাইক্রোফোনে জাতিকে বুঝিয়ে চলেছেন সরকারী দলের কী কী ভুল। মাঠে-ঘাটে নাই এমন একটা দলের কাছে জনগণ কী আশা করতে পারে?
সত্যি আমরা দুর্ভাগা জাতি। এত কোটি কোটি টাকার গল্প অথচ ইতোমধ্যে খাদ্যের ট্রাক আটক করে খাদ্য নিয়ে যাবার ঘটনা ঘটেছে। যার মানে মানুষ আর পারছে না। ঢাকার রাস্তায় খিদে পাগল মানুষের সারি। দেশের প্রায় সব জেলায় দ্রুত ছড়িয়ে পড়ছে করোনাভাইরাস। তারপরও নিরাপত্তা বিষয়টি জনমনে দাগ কাটছে না। অথবা তারা মানতে চাইছে না। এর পেছনে ধর্মের নামে অন্ধত্বের নামে যে সব উস্কানি তা বন্ধ করা জরুরি। সামাজিক সংগঠন বা অন্য সব কিছু এখন ঘরবন্দি। কে নেবে তার দায়িত্ব? বিজ্ঞান ছাড়া কোন গতি নাই।
কিন্তু আজ কত বছর হলো আমরা কোন বিজ্ঞানী পাইনি? কত বছর হলো দেশে একজন বিজ্ঞানী জন্মেছেন? সমাজ তো সেসব পথ আগেই রুদ্ধ করে রেখেছে। অথচ কয়দিন আগে ইতালীর প্রধানমন্ত্রীর একটি এক্সক্লুসিভ ইন্টারভিউ দেখলাম বিবিসির সাথে। তিনি সাফ জানিয়ে দিয়েছেন তার দেশ হয়তো অর্থনৈতিক মন্দা আর পতন ঠেকাবে পারবে কিন্তু দুনিয়া আগের মতো হবে না। সহজে যে হবে না সে কথাটা তিনি পরিষ্কার করে জানিয়ে দিয়েছেন। তার দেশে সবকিছু আস্ত আস্তে খুললেও রেঁস্তোরা হোটেল ক্যাফে ক্লাব খুলবে না সে ভাবে। যতদিন কোন ভেকসিনেশন টীকা ইত্যাদি বাজারে না আসছে ততোদিন এই সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখতে হবে মানুষকে। এভাবেই একদিন অভ্যাস বদলে যাবে আমাদের।
বাংলাদেশ এই পৃথিবীরই একটি দেশ। বিশ্ব যখন আমাদের সাথে যুক্ত হতে শুরু করেছে তখনই বড় হয়ে উঠতে পেরেছি আমরা। এই যে বড় হয়ে ওঠা এ কারণেই দরকার সবার সাথে চলা। দুনিয়াকে দেখে না শিখলে ঠেকে শিখতে হবে আমাদের। যা এখন কোনভাবেই কাম্য হতে পারে না। রাজনীতি আদর্শ বা শাস্ত্র সবকিছুর ওপরে এখন মানুষ। সে মানুষ বাঁচাতে আমাদের ঘরে থাকতে হবে। এই কঠিন সময়ে ঘরে থাকাই সবার জন্য মঙ্গল। দেশের সাথে থাকুন থাকুন বিশ্বের সাথে।
উৎসঃ বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন