রাজাকারের তালিকাটাও ঠিক মতো করা গেল না?
18 December 2019, Wednesday
গোড়াতেই বলি, শেখ হাসিনার সরকার আছে বলেই রাজাকার তালিকা ‘আলোর মুখ’ দেখেছিল। তবে দু:খের বিষয় যাচাই-বাছাই না করে তালিকাটি তৈরি হওয়ায় আবার বাতিলও করে দিতে হলো।
একটা সময় এদেশে রাজাকার বলাটাও নিষিদ্ধ ছিল। এমন মনে হচ্ছিল একদিন মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়ন করে তাদের বিরুদ্ধে প্রচার করা শুরু হবে। সে জায়গাটা আমূল পরিবর্তন করে দিয়েছেন বঙ্গবন্ধু কন্যা। কিন্তু যখনই আওয়ামী লীগ শাসনে থাকে আর কোন বড় কাজ করে বা কাজে হাত দেয় তখনই দেখি ঝামেলা পাকায়। ‘ষড়যন্ত্র’, ‘ষড়যন্ত্র’- বলে আমরা তা অন্যের কাঁধে চাপানোর চেষ্টা করলেও আসলে কোথায় যে ঘাপলা বোঝা মুশকিল।
এবারও ব্যতিক্রম হয়নি। বড় আশা নিয়ে বাঙালি বুক বেঁধেছিল এতকাল পরে হলেও রাজাকরদের একটা তালিকা তো বের হলো। কিন্তু বের হতে না হতেই কি দেখলাম আমরা? মুক্তিযোদ্ধাদের নাম চলে এসেছে সে তালিকায়। খুব বেশি দূর যেতে হবে না। মনীষা নামের একটা মেয়ে সবার নজর কেড়েছিলো মেয়র পদে দাঁড়িয়ে। বরিশাল শহরের মেয়েটি পেশায় চিকিৎসক। কিন্তু তার ধ্যান রাজনীতি। তাও আবার সমাজতান্ত্রিক রাজনীতি। খুব ছোট একটা দল বাসদের হয়ে ইলেকশান করা মেয়েটির বুকের পাটা আছে। ভয় ডর নাই বলেই সে দাঁড়াতে পেরেছিল । কিন্তু মাস্তানতন্ত্র বা গুন্ডাতন্ত্র বসে থাকে নি। তারা তার হাত ভেঙে দিতে চেয়েছিল। আহতও হয়েছিল মনীষা। তখনকার খবরগুলো দেখলেই বুঝবেন সে কাকে বা কাদের দায়ী করেছিল।
অধুনা দেশে ও সমাজে সবাই আওয়ামী লীগ। এবার দেশে গিয়ে দেখলাম আওয়ামী লীগ ছাড়া কিছু নাই। ধর্ম-অধর্ম-ব্যবসা-চুরি-ডাকাতি খেলা যাই বলি না কেন, সব আওয়ামী। আর এদের অনেকের মুখ আমার চেনা। চিনি বলেই বুঝি এর ভেতর কতটা ফাঁকি আছে। আমার বোঝার দরকার কী? মাননীয় প্রধানমন্ত্রী স্বয়ং বলেছেন- এত আওয়ামী লীগ নেতা থাকতে কেন বঙ্গবন্ধুর লাশ পড়ে ছিল বত্রিশ নম্বরে? কেন? এই প্রশ্ন আমাদেরও। আজ আবার এই রাজাকার তালিকাও প্রমাণ করেছে আওয়ামীময় সমাজে মূলত ভেতরটা নড়বড়ে।
মনীষার বাবা অ্যাডভোকেট তপন কুমার চক্রবর্তী একজন মুক্তিযোদ্ধা। মনীষার দাদুকে ধরে নিয়ে গিয়েছিল দালালেরা। আর ফেরেননি। তাঁর পত্নীও নাকি রাজাকার! এমন ঘটনা খাঁটি মুক্তিযোদ্ধা অনেকের বেলায় ঘটেছে। যে কারণে এখন একে অন্যের কাঁধে দোষ চাপানোর লড়াই শুরু হয়ে গেছে।
মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে ধারাবাহিকভাবে কাজ করে আসা সংগঠনগুলোর নেতারা বলছেন, দালাল আইনের আওতায় তালিকাভুক্ত রাজাকারদের গেজেট অনুসরণ করা হলে এই বিভ্রান্তি তৈরি হত না। রাজাকারের এই তালিকা প্রকাশের আগে বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে আলোচনা করা ছিল জরুরি। এ প্রেক্ষাপটে ভুলের জন্য দুঃখ প্রকাশ করে মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক বলেন, “একাত্তরে প্রকৃতপক্ষে স্বাধীনতাবিরোধী ছিলেন না, এমন কারো নাম সরকারের প্রকাশিত স্বাধীনতাবিরোধীদের তালিকায় এসে থাকলে তা বাদ দেওয়া হবে।”
তবে ভুলের দায় অস্বীকার করে মুক্তিযুদ্ধ মন্ত্রী বলেছেন, “এই তালিকাটি ১৯৭১ সালে করা। আমি স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে সংগ্রহ করেছি।”
অন্যদিকে স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল বলেন, “স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে তালিকা সরবরাহ করার সময় যেসব ব্যক্তির নাম-মামলা প্রত্যাহার হয়েছিল, সে বিষয়ে ‘নোট’ দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তালিকা প্রকাশের ক্ষেত্রে ওই সব ‘নোট’ বিবেচনায় নেওয়া হয়নি।” মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয় ওই নোটগুলো বিবেচনায় নিয়ে যথাযথ যাচাই-বাছাইয়ের মাধ্যমে একাত্তরের স্বাধীনতাবিরোধী তালিকা আবার প্রকাশ করবে বলে আশা প্রকাশ করেছেন তিনি।
এভাবেই চলছে বাহাস। কিন্তু ফাঁকতালে কী হচ্ছে? যেখানে দেশের এক বিরাট অংশে মুক্তিযুদ্ধ মূলত স্মৃতি কিংবা অতীত যে বিশাল অংশ বিভ্রান্ত তারা জানলো রাজাকারদের তালিকাও ভুলে ভরা। যার মানে সামনে আপনি শুদ্ধ তালিকা করে আনলেও সংশয়ের ওপরে যেতে পারবেন না। কে দায়ী? কারা আছে এর পেছনে? এটাতো মানতেই হবে এর মতো জরুরী কাজ দুটো নাই। একজন মানুষকে সারাজীবনের জন্য দেশদ্রোহী ঘোষণার আগে আপনি তথ্য যাচাই করবেন না? দুনিয়ার অনেক দেশের জাদুঘরে এমন তালিকা আছে। তারা যাচাই-বাছাই করে জনগণকে জানিয়ে দিয়েছে কারা তাদের মুক্তি ও স্বাধীনতার বিরুদ্ধে ছিল। সেটা খাঁটি তালিকা বলেই তারদের ইতিহাসে কূটতর্ক নাই। আমাদের বিতর্ক জীবনেও শেষ হবে না। মাত্র আটচল্লিশ বছর লাগলো একটা তালিকা করতে। ভুলে গেলে চলবে না মুক্তিযুদ্ধের সাথে জড়িত মানুষদের অনেকেই আজ নাই। অনেকে স্মৃতিভৃষ্ট। আর অনেকে আছেন একদা যুদ্ধে গেলেও এখন নিজেই দালাল-রাজাকার। মনে রাখতে হবে আ স ম আবদুর রব কতটা তেজী ছিলেন। সে সময়কার রব আর আজকের রব এ আকাশ পাতাল তফাৎ। বীরোত্তম কাদের সিদ্দিকী। সর্বোচ্চ খেতাবে ভূষিত যোদ্ধা এখন কী বলেন? বাঘা কবেই বেড়াল হয়ে গেছে।
এমন জটিল বাস্তবতা মাথায় রাখার পরও আওয়ামী লীগের তালিকা যে বালখিল্য খেলা দেখালো তার নাম কি আসলেই ভুল? আর যে কারণে স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীকে নির্দেশনা দিতে হয়েছে তা বাতিলের।
এ নির্দেশনার কথা বলে যেসব বড় নেতারা শান্তি পায় তাদের কি একবারও মনে হয়না এর ভেতর লজ্জা আছে। সব বিষয়ে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর মত ব্যস্ত নেতাকে টেনে আনা কি করে গৌরবের হয়? তিনি কি কারো ওপর বিশ্বাস রাখতে পারবেন না? সবচেয়ে বড় কথা আজ বিভক্ত সমাজ আর ওৎ পেতে থাকা স্বাধীনতা বিরোধীদের প্লেটে আরো একবার গরম টপিক তুলে দিল আওয়ামী লীগ। তারা কেন সুযোগ নেবে না? বরং নেয়াটাই উচিৎ। তারা তো বলবেই যে লিস্ট পরিবর্তন করতে হয় তার ভেতর নিশ্চয়ই গলদ আছে। আর এই গলদ মূলত দেশ বিভাজনের, সমাজ বিভাজনের। তখন কি জবাব দেবেন আপনারা?
এটা প্রমাণিত- রাজনীতি এখন মৃত। তাই জবাবদিহিতাও নাই । থাকলে এমন হতে পারতো না। বাহাত্তরে তালিকা না করে যে ভুল, সে ভুলের প্রায়শ্চিত্ত করতে গিয়ে আরো একটা বড় ভুল করেছে সরকারী দল। সত্যি কথা বলতে কি আবেগ থাকার পরও মানুষ মুক্তিযুদ্ধকে অতীত মনে করে। সে অতীত যদি গৌরব বয়ে আনার পরিবর্তে বিতর্কের জন্ম দেয়, তখন মানুষ বিভ্রান্ত হবেন এটাইতো স্বাভাবিক। হয়তো এ যাত্রায় কোনওভাবে তা ম্যানেজ হবে। তবে দুই মন্ত্রণালয়ের বাহাস আর আওয়ামী লীগের নেতাদের কথায় এটা স্পষ্ট আমাদের কারো মাঝে- সেই টান, সেই আবেগ আর নাই। যা থাকলে এই কাজটিকে পবিত্র মনে করা হতো। কারণ কাউকে যেমন অকারণে এমন অভিধা দেওয়া ‘গুনাহ’, তেমনি আসল বাদ দিয়ে নকলকে তালিকায় রাখা মানে মূল রাজাকার দালালদের ছাড় দেয়া। অনেকে বলেন সমাজে থৈ থৈ করা রাজাকারের ভিড়ে নাকি এখন মুক্তিযোদ্ধা বা যুদ্ধের মানুষ পাওয়াই মুশকিল।
রাজাকারের তালিকাটাও ঠিকমতো কেন করা গেল না, বাংলাদেশ জবাব চাইলে কী উত্তর দেবেন আপনারা?
উৎসঃ বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন