কাশ্মীর ভূস্বর্গে দাবানল
08 August 2019, Thursday
কাশ্মীর এখন জ্বলন্ত টপিক। হঠাৎ করে মনযোগের কেন্দ্রবিন্দু হয়ে ওঠা এই অঞলে কি হচ্ছে আসলে? ভারতীয় সংবিধানের যে অনুচ্ছেদের ফলে জম্মু ও কাশ্মীর বিশেষ স্বায়ত্তশাসনের মর্যাদা পেয়ে আসছিল, তা বাতিল করে কেন্দ্রের শাসনের আওতায় আনতে পার্লামেন্টে বিল তুলেছে নরেন্দ্র মোদীর সরকার।নিরাপত্তার কড়াকড়ি আর ধরপাকড়ে বিরোধপূর্ণ ওই উপত্যকাজুড়ে থমথমে পরিস্থিতির মধ্যেই বিজেপি সরকারের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ সোমবার পার্লামেন্টে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রপতির আদেশে সংবিধানের ৩৭০ ধারা রদ করার কথা জানান।
পাশাপাশি ‘জম্মু ও কাশ্মীর সংরক্ষণ বিল’ নামে আরও একটি প্রস্তাব তিনি পার্লামেন্টে তোলেন, যা পাস হলে জম্মু ও কাশ্মীর থেকে লাদাখকে আলাদা করে ফেলা হবে। জম্মু ও কাশ্মীর এবং লাদাখ হবে আলাদা দুটো কেন্দ্রশাসিত অঞ্চল। এনডিটিভির খবরে বলা হয়, আপাতত দুই জায়গায় দুজন লেফটেন্যান্ট গভর্নর কেন্দ্র সরকারের নির্দেশনা অনুযায়ী প্রশাসনিক কর্মকাণ্ড পরিচালনা করবেন। জম্মু ও কাশ্মীরে আইনসভা থাকবে, তবে লাদাখে তা থাকবে না।
কাশ্মীর নিয়ে যুদ্ধ এবং তাবৎ বাক-বিতন্ডা চলে আসছে আমাদের ছেলেবেলা থেকে। আমরা যখন পূর্ব পাকিস্তানে ছিলাম তখন সে বালক বেলায় কাশ্মীর যুদ্ধের কারণে খোঁড়া বাংকারে মাটির গর্তে লুকিয়ে থেকেছি অনেকবার। সেই পাকিস্তান ভেঙে বাংলাদেশ হলো কত পানি গড়ালো ইতিহাস কতভাবে বদলালো কিন্তু কাশ্মীর সমস্যার সমধান মিললো না। ভারতের নির্বাচনের ঠিক আগে আমরা একটি যুদ্ধ যুদ্ধ ভাব দেখেছিলাম। যদিও নিন্দুকেরা বলে তা নাকি পাতানো খেলা। আর তার কারণ ছিল পিছিয়ে পড়া ইমেজ ফিরিয়ে এনে মোদীর ভোটযুদ্ধে জয়লাভ করা। মোদী শেষতক জিতেছেন। জেতার পর তিনি যে এই স্বায়ত্বশাসিত রাজ্যটির ওপর প্রতিশোধ নেবেন তা ভাবা গেলেও কিভাবে তা হবে বোঝা যায়নি। এখন তা স্পষ্ট হয়ে উঠছে।
যারা ইতিহাস জানেন বা খবর রাখেন তাদের অজানা না কিভাবে কাশ্মীর ভারতে ঢুকেছিল। তখনো বলপ্রয়োগের ব্যাপার ছিলো। রাজা চাইতেন ভারতে যেতে প্রজারা ভিন্ন কিছু। সে সময় শান্তি আর সৌহাদ্যের জায়গা এতটা নষ্ট হয়নি। নেহেরু যেমন বুদ্ধি খাটিয়ে ছাড় দিয়ে তাঁর পূর্ব পুরুষদের কাশ্মীরকে ভারতে রেখেছিলেন তেমনি সীমান্ত গান্ধীর কথা ভুললেও চলবে না। খান আবদুল গাফফার খানের পুত্র ফারুকও ছিলেন সেখানকার মূখ্যমন্ত্রী। ঘটনা কিন্তু বদলায়নি। একদিকে যেমন জম্মু পর্যন্ত ভারতের অবিচ্ছেদ্যতা আরেকদিকে শ্রী নগর মানেই সংঘর্ষ আর হত্যা। মুসলমান প্রধান এই এলাকায় যে নারকীয় ঘটনাগুলো ঘটে তার পেছনে ভারতের হাত অস্বীকার করা যাবে না। আবার আজাদ কাশ্মীর নামে যেটুকু পাকিস্তানের দখলে তার প্রভাব এড়ানোও কঠিন। ফলে ভারত পাকিস্তান আর কাশ্মীর এই তিন মিলে এক অরাজক কাণ্ড । আর আজ তা এমন এক জায়গায় চলে এসেছে যেখানে নিরাপত্তা আর সহাবস্থান বলে কিছুই থাকলো না।
দুনিয়া বদলে গেছে। কোন দেশের সমস্যায় এমনকি বাইরের দেশ তাদের কব্জা করলেও কেউ কিছু বলে না। আমেরিকা ও সোভিয়েত ইউনিয়নের আমলে যে ভারসাম্য তা আর নাই। মধ্যপ্রাচ্যে একের পর এক দেশ তামা হয়ে গেছে। তাদের জনগোষ্ঠী আজ শরণার্থী। ইরাক সিরিয়া লিবিয়া কোথাও মানুষ শান্তিতে নাই। কিন্তু কারো কোন বলার কিছু নাই। না ইউরোপ না আমেরিকা না অন্যকোন দেশ। জাতিসংঘ নামে যে প্রতিষ্ঠান আজ তার নিজেরই কোন ঠিক নাই। তার কথা কেউ শোনে না। আফগানিস্তানের কথা ভাবুন। সেদেশে আজ কত বছর ধরে লড়াই চলছে? কাবুল কি আসলে কোন বাসযোগ্য বা থাকার মত শহর? তাতে কি? কারো টনক নড়ে না। কেউ এনিয়ে এখন আর মাথাও ঘামায় না। যেন এটাই নিয়তি। এটাই স্বাভাবিক।
কাশ্মীর দীর্ঘকালের এক সমস্যা। নরেন্দ্র মোদী ক্যারিশম্যাটিক লিডার। তিনি আঁট ঘাট না বেঁধে নামেননি। তাঁর ভালো জানা আছে পাকিস্তান মুখে তড়পালেও কিছু করতে পারবে না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর অনেকেই তাদের বন্ধু। শুধু বন্ধু না জব্বর মিত্রতার সম্পর্ক এখন। ইরান আছে নিজের ঝামেলায়। তাহলে কে দাঁড়াবে কার হয়ে? আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কথা বলা মানে এখন ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। কথিত মানবতাবাদী আর কিছু সংগঠন ব্যতীত মূলত কেউই মুখ খুলবে না। আর এই ফাঁকে ভারতীয়রা তাদের কাজ সারবে।
যেমনটা আমরা শ্রীলংকায় দেখেছি। শেষদিকে লংকানরা তাই করেছিল। চারদিক থেকে ঘিরে ধরে তামিলদের মেরে সাইজ করেছিল। সে অসম যুদ্ধে প্রায় নিশ্চিহ্ণ হয়ে গেছে তামিল যুবশক্তি। বলা হয় নারী ও শিশু ছাড়া কেউই বাঁচেনি সেখানে। এমন নৃশংসতা আমরা কম্বোডিয়ায়ও দেখেছি। লাওসেও আছে এমন বর্বরতার ইতিহাস। কাশ্মীর কি সে পথে যাচ্ছে?
সেখানকার মানে ভারতের নেতাদের কে কি বলছেন তার ভেতর থেকেও ঘটনা আঁচ করা সম্ভব। যেমন– কংগ্রেসের গুলাম নবী আজাদের মতো কাশ্মীরি নেতার আক্ষেপ, ‘‘মহারাজ, প্রধানমন্ত্রী হয়ে মুখ্যমন্ত্রীর পরে এবার উপ রাজ্যপাল শাসন করবেন কাশ্মীর! এর থেকে লজ্জার কী হতে পারে।’’ প্রাক্তন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী পি চিদম্বরমের মতে, কাশ্মীরকে ভারতের উপনিবেশে পরিণত করেছে বিজেপি সরকার। আগামী দিনে কাশ্মীর ভারত থেকে বেরিয়ে যেতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেন অনেক বিরোধী।
জবাবে অমিত বলেন, ‘‘যত নষ্টের গোড়া ৩৭০ অনুচ্ছেদ।’’ তাঁর যুক্তি, এর ফলে গোটা দেশের সঙ্গে মিশতে পারেননি কাশ্মীরিরা। ব্যবসায়ীরা, শিল্পপতিরা উপত্যকায় জমি কিনতে পারেননি। ফলে লগ্নিও হয়নি। মানুষ গরিবই রয়ে গিয়েছেন। ওই অনুচ্ছেদ উঠে গেলে কাশ্মীর ভারত থেকে বেরিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, আরও ভাল করে দেশের সঙ্গে তার আত্তীকরণ ঘটবে। অমিতের দাবি, অনুচ্ছেদ ৩৭০-কে হাতিয়ার করেই উপত্যকায় সন্ত্রাসে উস্কানি দিয়েছে পাকিস্তান। গত তিন দশকে ৪১ হাজার মানুষের মৃত্যুর পিছনে অনুচ্ছেদ ৩৭০ রয়েছে বলেই মত অমিতের। তাঁর দাবি, কাশ্মীরের সাধারণ মানুষ নন, সে রাজ্যের তিনটি পরিবার যারা এ যাবৎ রাজত্ব করে এসেছে, তারাই সবচেয়ে আতঙ্কিত।
বোঝা যাচ্ছে এক মরণ কামড় দিতে চলেছে বিজেপি। সন্ত্রাস আর হানাহানি একদা ভূস্বর্গ নামে পরিচিত কাশ্মীরকে বহুকাল থেকে নরক বানিয়ে রেখেছে। এখন শুরু হলো আধিপত্য পর্ব। যারা এর ভেতর ভারত আবার ভাঙার ইন্ধন দেখছেন তারা যেমন শংকিত আবার যারা নির্যাতন ও ভয়াবহ সংখ্যালঘু নিপীড়নের কথা বলছেন আমরাও তাদের মত ভীত। উপমহাদেশে গান্ধী ও শান্তি এ-দুই শব্দ সমার্থক ছিলো। এখনো তা শেষ হয়ে যায়নি। তবে এভাবে চললে অচিরেই ভারতকে অশান্তির মাশুল গুণতে হবে। সাথে থাকবে আগাম বিপদের ভয়াবহতা। কিভাবে তা ফিরে আসে তা এখন দেখার বিষয়।
উপমহাদেশের অবিচ্ছেদ্য ইতিহাস ধর্মীয় অনুভূতি আর মানবিকতার বিবেচনায় এর প্রভাব আমাদের দেশেও পড়বে। তাই আমাদের সাবধানতা অবলম্বন জরুরী। আমরা যেন এর কারণে আমাদের শান্তি বা পরিবেশ বিষিয়ে না তুলি। পাশাপাশি আমরা এটাও চাইবো কাশ্মীরের নারী শিশুসহ নিরাপরাধ মানুষ যেন কোন নির্যাতন বা হয়রাণীর শিকার না হয়। তারা মানুষ। তারা তাদের ভূখণ্ডে স্বাধীন ও মাথা উঁচু করে বাঁচার অধিকার রাখে। তা যদি না হয় বা দিতে না পারে তাহলে গণতান্ত্রিক দেশ বলে গর্ব করার অধিকার কি ভারতের থাকবে আদৌ?
উৎসঃ বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন