এ কেমন বাংলাদেশ দেখছি আমরা?
23 July 2019, Tuesday
একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন। একজন মহিলাকে সন্দেহের বশবর্তী হয়ে কিছু মানুষ মারছে। মারতে মারতে হিংস্র হয়ে ওঠা দানবের সংখ্যা বাড়ছে তো বাড়ছেই। এ ভদ্রমহিলা কোন শ্রমিক বা গরীব কেউ না যা তার পোশাক কিংবা আচার-আচরণ দেখে সন্দেহ হবার কথা। তাকে ছিনিয়ে আনা হয়েছে খোদ হেডস্যারের রুম থেকে। রেনু আসলে কেমন ছিলেন, তা জানতে প্রতিবেশি আর তার স্বজনদের সঙ্গে কথা হয় বিভিন্ন পত্রিকার প্রতিবেদকদের। রেনুর সঙ্গে একই বাসায় থাকতেন ভাগ্নে সৈয়দ নাসির উদ্দিন টিটু। তিনি বলেন, ‘খালা স্নেহপরায়ণ ছিলেন। একজন শিক্ষিত-সচেতন নারী। ছেলেধরা তো দূরের কথা, নূন্যতম অপরাধও করতে পারেন না তিনি। ছেলেমেয়ের ভবিষ্যৎ নিয়ে উদ্বিগ্ন ছিলেন, হয়তো ওদের আগামী নিয়ে একটু মানসিক যন্ত্রণাও ছিল তার।’
এমন একজন মহিলাকে প্রকাশ্য দিবালোকে পিটিয়ে মারাকে আমরা বলছি গণপিটুনি। কি হয়েছে আমাদের আসলে? এখন এটা ভাবার সময় এসেছে। বলবো- না ভাবলে আমাদের আত্মীয় স্বজনদের যে কেউ এমন গণপিটুনির শিকার হতে খুব বেশি দেরি নাই। তখন আপনি আমি আমরাও চোখের পানি ফেলবো। আর মিডিয়ায় নিউজ হবে স্বজনদের কেউ। আমি ব্যক্তিগতভাবে দেখছি এর ভেতর সমাজের পচন। গলে যাওয়া সমাজের লাশ।
এখন সবকিছু বলা বা লেখার সময় না। তবু বলবো উন্নয়ন হলেই কি সমাজ বা দেশ এগোয়? সেটা যে হয় না তা বোঝার জন্য খুব বেশি লেখাপড়ার দরকার পড়ে না। সে কথা থাক। এখন আমাদের ভাবতে হবে বাংলাদেশ আসলে কী চায়? কী চায় আমাদের জনগণ? তারা কি এভাবে বাঁচতে আগ্রহী? শুধু শুনি মানুষের মনে রাগ দ্রোহ বা ঘৃণা জমছে। কিন্তু কই তার তো একটা নমুনাও দেখিনা। মানুষতো কোন ডাকাত, চোর বা দাগী আসামির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে না। এই যে রিফাত হত্যা বা বিশ্বজিৎ হত্যাকাণ্ড তাতে কি দেখলাম আমরা? নিরীহ প্রতিরোধহীন ছেলেগুলো প্রাণ দিল রাজপথে। মানুষ ভিডিও করলো। দেখলো। কেউ কেউ সেগুলো রিলে করারও ব্যবস্থা করলো। কই একজনও তো এগিয়ে আসেনি! সামাজিক মাধ্যমে কান্নাকাটি আর আহাজারি কি আসলে মানুষকে ভোঁতা ও নিস্প্রাণ করে দিচ্ছে? বরং দাগী আসামিগুলো মরেছে চোরাগোপ্তা হামলায়। যার পোশাকি নাম ক্রস ফায়ার। তাদের একজনকেও মানুষ মারেনি বা মারতে পারেনি।
এটা কী প্রমাণ করে? এটা কি চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দেয় না যে সমাজ মূলত আসামী বা অপরাধীদের অভয়ারণ্য? তারা নিরাপদে থাকে। নিরাপদে চলাফেরা করতে পারে। তাদের মরণ ও বৈধ অস্ত্রধারীদের হাতে। আইনের হাতে। আর নিরীহ সাধারণ মানুষ মরছে রাস্তায়। তাও আবার গণপিটুনিতে।
আবারো বলি আপনি আমি চোখ বুজে কোন দৃশ্য কল্পনা করার শক্তিও হারিয়ে ফেলেছি। যে কারণে আমাদের সব অ্যাকশন আর প্রতিক্রিয়া বায়বীয়। বীভৎস নারকীয় ঘটনার এমন সফল চিত্রায়ন যেন শ্যুটিং। মানুষ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে দেখে। ছবি তোলে। আপলোড করে। আর লাইক পায়। খুনী সে গণপিটুনির নায়ক হিসেবে নিরাপদে সে জায়গা ছেড়ে চলে যেতে পারে। এর নাম অগ্রগতি? মানুষের মন ও মগজ নিয়ে যে সমাজ ভাবেনা বা যার কোন মাথাব্যথা নাই তার উন্নয়ন হলে কি আর না হলেই বা কি?
আমাদের দেশ তো এমন ছিল না। আমরা পাশের দেশ ভারতের পশ্চিম বঙ্গের সাথে নিজেদের তুলনা করে সবসময় মায়া ভালোবাসা প্রীতির কারণে গর্ববোধ করতাম। আমাদের বিশ্বাস ছিল আমরাই ভালোবাসায় এগিয়ে। কিন্তু এখন কী দেখছি? তারা স্বার্থপর হোক আর কৃপণ বা পরিমিত হোক তাদের দেশে এমন ঘটনা ঘটেনা। একটাও না। তারাও কিন্তু বাঙালি। তাদের সাথে আমাদের ধর্ম ভাষা খাবার সংস্কৃতি সব বিষয়ে মিল আছে। কখনো কখনো তা অভিন্ন একাকার। তাহলে তাদের ওখানে এমন উগ্রতা নাই কেন? এ প্রশ্ন আমাদের মনকে করতেই হবে। উত্তর পাবেন। তাদের রাজনীতি ও সমাজ আমাদের চাইতে ঢের বেশি গণতান্ত্রিক। তাদের আইন বা বিচার রাজনীতি নিয়ন্ত্রণ করলেও আমাদের মত একপেশে না। খুন বা গণপিটুনি হলে সেখানে নিশ্চয়ই তার বিহিত হয়। আমাদের কি হয়?
আজকাল আর একটা হাস্যকর ব্যাপার ঘটে। খবরে দেখলাম স্থানীয় এমপি নিহত রেনুর মেয়ে তাসনিম তুবার পড়ালেখার দায়িত্ব নিয়েছেন লক্ষ্মীপুর-২ আসনের এমপি কাজী শহীদ ইসলাম পাপুল। এর মানে কি? গরু মেরে জুতা দান? মা নিহত হলেন কিছু উগ্র মানুষের পিটুনিতে সে মায়ের শিশু কন্যা এখনো বুঝতেই পারছে না তার মা আর নাই। তার লেখাপড়ার দায়িত্ব মানে কী? ফাজলামোর একটা সীমা আছে। এই মেয়েটি কি ভাবে ট্রমা কাটাবে বা কি ভাবে বড় হবে তার খবর নাই ফোঁপরদালালী করে বলা হচ্ছে উনারা পড়াবেন। একবছর পর যখন এই ঘটনা সোশাল মিডিয়া ও মিডিয়া থেকে সরে যাবে বা গুরুত্ব হারাবে তখন তুবা মেয়েটি কি কাজ করে, পড়ে না বেঁচে আছে- সে খবর রাখবেন আপনারা? খামোখা রাজনীতি করার জন্য দরদী সাজার এসব অপপ্রক্রিয়া বন্ধ করুন দয়া করে।
সবার আগে সমাজকে ঠিক করতে হবে। বায়বীয় দুনিয়ায় খালি লাভ ইউ, লাইক ইউ- করতে করতে মানুষ শক্তিহীন হয়ে যাচ্ছে। তার প্রতিবাদ প্রতিরোধের শক্তিও শেষ। তাই আছে খালি পোস্ট দেওয়া। সামাজিক মাধ্যমে সাড়া ফেলে কী হয়? সরকারের টনক নড়ে? নড়ার পর? দু একটা আশ্বাসবাণী আর কদাচিৎ বিচার। বিচার হলেই যে শাস্তি হয় তার গ্যারান্টি দেবে কে? তাই সমাজের সচেতনতা আর রুখে দাঁড়ানো জরুরি। মানুষ যদি রুখে দাঁড়াতো এসব ঘটনা ঘটতো না। মুশকিল হচ্ছে আজকাল মব বা জনরোষের কাছে সবাই অসহায়। হবে না কেন? যে দেশে রাজনীতি পুলিশের মাথা ফাটিয়ে দেয়। পুলিশ ধরে নিয়ে গেলে নাগরিক আর ঘরে ফেরে না। রাস্তায় কাউকে ইচ্ছেমত পিটিয়ে মেরে ফেলা যায় সে সমাজে কে নেবে দায়? কার ঘাড়ে কটা মাথা যে জান দিতে এগিয়ে আসবে।
সরকারের দায়িত্ব অনেক বেশি। তাদের কাজ সামাজিক নিরাপত্তা ও সুশাসন নিশ্চিত করা। তা না হলে উন্নয়ন ভেস্তে যেতে বাধ্য। আমরা দূরদেশে দেখি সমাজ কতটা সংহত। রাতবিরেতে মানুষ কতটা নিরাপদ। আমরা যদি সত্যি উন্নত হতাম আমাদের দেশেও তাই হতো। আমাদের সবকিছু কাগুজে। তাই নিরাপত্তাও এখন কাগজে কলমে থাকে।
আবারো বলি একবার চোখ বন্ধ করে ভাবুন। আপনার স্ত্রী, আপনার কন্যা, আপনার বোন বা ভাইকে কেউ ছেলেধরা সন্দেহ করে পিটাচ্ছে। তার জান বের হয়ে যাবার আগে সে একবার প্রিয়জনদের মুখ দেখার চেষ্টা করছে। তার চোখে ভাসছে বাড়িতে রেখে আসা সন্তানের মুখ। সে রক্তে ভেসে যেতে যেতে মনে করছে এই দেশে তার জন্ম হয়েছিল। এই মাটিতে সে বড় হয়েছে। কত আনন্দ বেদনায় কত মানুষ পাশে দাঁড়িয়েছে। আজ এমন মরণের কালে কেউ এগিয়ে আসছে না। সে কি এইদেশ কে আর্শীবাদ করতে করতে মারা যাবে না অভিশাপ দিতে দিতে? আজকাল এসব ঘটনায় নির্বাক স্বার্থপর মানুষদের দেখে মাটিও হতবাক। আকাশ গোপনে কাঁদে। বাতাস উদাস হয়ে চলে যায়। এইদেশ মুক্ত করার জন্য যারা জান দিয়েছিলেন, যারা ইজ্জত দিয়েছিলেন- আজো যারা কল্যাণ আর ভালোর যাত্রী তারা নীরবে চোখ মুছে আর মনে মনে বলে- এমন দেশতো আমরা চাইনি।
উৎসঃ বিডিনিউজ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন