মাদকমুক্ত দেশ ও সমাজ : কোথায় সমাধান
29 May 2018, Tuesday
মাদক যে ভয়াবহ তা মাদকসেবীরাও জানে। প্রকৃতির নিয়মে তার বুকে সুধা ও মধু দুয়ের জন্ম। প্রকৃতির ছত্রাক যেমন পেনিসলিন, তেমনি অফিয়াম বা গাঁজাও তার বুকে জন্মায়। হিন্দু ধর্মের দেবদেবতারা নানা ধরনের মাদক সেবন করতেন, এমন কাহিনিও জানি আমরা। কোনো কোনো ওষুধে মাদক থাকতেই হয়। আপনার হাত-পা কেটে-ছিঁড়ে গেলে জায়গাটা পরিষ্কার করার জন্য অ্যালকোহল মিশ্রিত পানি বা অন্যকিছুর দরকার পড়ে। মাঝে মাঝে আমি যখন ময়লা হাত পরিষ্কারের জন্য লোশন ব্যবহার করি, নিজের অজান্তেই হাসি পায়। কারণ তার উপাদানে কয়েক ফোঁটা অ্যালকোহল থাকে। কথাগুলো বলার কারণ এই, সব বিষয়ের-ই ভালো-মন্দ দুটো দিক আছে। অ্যালকোহলের বা বিষের কিংবা মাদকের ভয়ানক দিকটা আমরা নিয়েছি ভালো বা দরকারি দিকটা নিই না।
বাংলাদেশ এখন এমন এক বাস্তবতায় আছে, যেখানে সমাজের মতো হিপোক্রেসি আর কোথাও নেই। এত হিপোক্রেট একটা সমাজ দুনিয়ায় বিরল। মানুষ সারা সময় ধর্মের কথা বলে বা আচরণের ভাণ করে অথচ তার তলায় ঘন অন্ধকার। সমাজের সবদিকে খালি মারমুখী আচরণ। একদিকে অবাধ যৌনতার হাতছানি, আরেক দিকে মদ-মাদক। ভয়াবহ হলেও সত্য এই বাস্তবতার পেছনে আছে রাজনীতি। যখন থেকে রাজনীতি আগ্রাসী আর সব খাবার জন্য মুখিয়ে আছে, তখন থেকে এই হাল। মাদক আমাদের যৌবনেও ছিল। আমাদের সতীর্থদের অনেকেই বিশ্বাস করত এ ছাড়া শিল্প হয় না। বিশেষত যারা কবিতা লিখতেন এবং ছবি আঁকতেন তাদের ধারণা একমাত্র গঞ্জিকা বা মদই পারে তাদের ঘোরের ভেতর নিয়ে যেতে। অথচ তারা ভুলে যেত রবীন্দ্রনাথের জীবনে মাদকের বিষয় ছিল না। মাইকেল মদ খেতেন বটে, তবে সে মদ নিজেকে ধ্বংস করার কাজে ব্যবহার হয়েছিল মাত্র। তবে মানতেই হবে, তখন মাদক মানে দু-একবার গঞ্জিকা বা মদ। পরে এলো হেরোইন। সে আরেক বিভীষিকা। সেই বিভীষিকা যে কত মানুষের জীবন, যৌবন ও সম্পর্ক নষ্ট করেছে ভাবতেই শিউরে উঠি।
by Taboola Sponsored Links You May Like
Reading These 5 Books Will Change Your Life
Blinkist
Play this Game for 1 Minute and see why everyone is addicted
Delta Wars
এখন দিন বদলেছে। কত নাম, কতশত আকারে পাওয়া যায় মাদক। এর আগে ভারতের তৈরি ফেনসিডিল ছিল রমরমায়। বেচারি ফেনসিডিল আমরা খেতাম গলার কফ পরিষ্কারের জন্য, আর শেষে হলো জীবন নষ্টের এক হাতিয়ার। ভারত গেল তো এলো মিয়ানমার। শুনি ওখান থেকেই নাকি আসে ইয়াবা। আমাদের রাজনীতি ও সমাজ সব সময় অন্যকে দোষ দিয়ে নিজের গা বাঁচাতে ব্যস্ত। পাড়ার এক মাসিমার মতো। তার ছেলে অঙ্কে ফেল করে বলতেও মাধবের কারণে হয়েছে। ইংরেজিতে ফেল করলে বলত কালাম তার মাথা খেয়েছে। বাংলায় গোল্লা পেলে বলত সেলিনা ছেলেটাকে খেয়ে ফেলল। একবারও নিজের ছেলের দোষ দেখতেন না। ফেনসিডিল ভারতের দোষ, মারিজুয়ানা আমেরিকার দায়, মদ পাশ্চাত্যের চাপানো আর ইয়াবা মিয়ানমারের। আর আমরা? এত নির্দোষ যে যা দেয় তাই সেবন করি ওষুধ মনে করে। এই প্রবণতা বন্ধ করতে হবে। মনে রাখতে হবে, যেসব দেশ ও সমাজকে দোষারোপ করছি, তারা কিন্তু সাবধানে ব্যবহার করছে। আর আমরা ভোদাই বলেই আমাদের ওপর চাপিয়ে দিতে পারছে। আর এই পারার কারণ আমাদের সমাজ আজ বিপর্যস্ত অভিভাবকহীন।
মূলত যারা মাদক নেয় তারা আমাদের সন্তান। পরিবার কখনো কোনো ছেলে বা মেয়েকে মাদকাসক্ত হতে বলে না, চায়ও না। তারা তা করে সমাজে মিশে বড় হওয়ার পর। বন্ধু-বান্ধব কিংবা পরিবেশের কারণে প্রথম প্রথম শখ করে নিলেও একসময় সে আর মাদক ছাড়া বাঁচতে পারে না। পয়সা জোগাড় করতে না পারলে খুন-জখম, এমনকি মা-বাবাকেও হত্যা করে। চুরিচামারি তো তুচ্ছ বিষয়। এই যে মাদকাসক্তি, এর পেছনে আছে সমাজের একাংশের যোগাযোগ। এতদিন ধরে মাদক ব্যবসা চলে আসছে আর রাজনীতি বা আইন বাহিনী জানে না এটা মানতে হবে? আমি তাদের কঠোরতাকে সমর্থন করেই বলি, এতদিন যাদের আশ্রয়-প্রশ্রয়ে মাদক ব্যবসা দেশের সর্বত্র তার অন্ধকার ও সর্বনাশের হাত বাড়িয়েছে তাদের দমন করুন। কিন্তু এই দমনের নামে হঠাৎ কঠোরতা প্রশ্নের জবাব দিচ্ছে। ওই যে বলছিলাম রাজনীতি, সে যদি জড়িতই না থাকে তো হঠাৎ করে একদল মাদক নির্মূলের নামে প্রশংসা ও কৃতিত্ব চাইবে কেন? আর একদল হঠাৎ করে মাদক ব্যবসায়ী কিংবা যারা ক্রসফায়ারে মারা যাচ্ছে, তাদের জন্য সাফাই গাইবে কেন? মূল দুশমন আপনাদের ঘরে ঘরে।
আমাদের জাতীয় সংসদে একজন এমপির নামের সঙ্গে ইয়াবার নাম জড়িয়ে আছে। সেটা কি সরকারি দলের নেতারা জানতেন না? আমরা তো এমন ছবিও দেখেছি, যেখানে ইনি পরমানন্দে শীর্ষ কাউকে মিষ্টি তুলে দিচ্ছেন। হতে পারে তিনি তখন তা জানতেন না। এখন জেনে বলছেন যে যত বড় হোক বা যত শক্তিশালী হোক, ছাড় নেই। সংসদে দাঁড়িয়ে এরশাদ, যিনি প্রধানমন্ত্রীর দূত তিনিও বললেন তিনি ভূত চেনেন এবং ভূতের শাস্তি চান। বলাই যথেষ্ট? তারপর আর কোনো অ্যাকশন আছে? এদিকে মাদক নির্মূলের নামে সারা দেশে চলছে ক্রসফায়ার। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কার্যক্রমের বিরুদ্ধে বলাটা অনুচিত। নিশ্চয়ই তাদের কাছে প্রমাণ আছে। কিন্তু সেই স্বচ্ছতা যদি প্রকাশিত না হয়, মানুষের মনে প্রশ্ন থেকেই যাবে। এমনিতেই একমুখী রাজনীতি আর রাজনীতিহীনতায় মানুষ ক্লান্ত। তারা এখন মনে করছে, যে কেউ যে কোনোদিন শিকার হতে পারে। কারণ রাষ্ট্র ধারণাটির জন্ম হয়েছিল মানুষকে নিরাপদে রাখার জন্য। মানুষ একটি ভৌগোলিক সীমায় সুখে-শান্তিতে থাকবে বলেই দেশের জন্ম দেয়। সে দেশ ও সমাজকে বাঁচানোর দায় সবার। তাই বলে নির্বিচারে হত্যাটা কি সমর্থনযোগ্য। এ বিষয়ে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব একটা স্বচ্ছ ধারণা আর পরিষ্কার ছবি না এলে বিষয়টা রাজনীতিকে আরও ঘোলাটে করবে। বিএনপি সচিব অলরেডি বলেছেন, এর কারণ নিজেদের মানুষের মুখোশ আড়াল করা এবং প্রমাণ সরিয়ে দেওয়া। তার কথা মিথ্যা প্রমাণ করা যাবে না তখন। কারণ বিষয় এখনো ঝাপসা।
মাদক নিয়ন্ত্রণে হঠাৎ কঠোরতা, আমাদের মানবাধিকারকর্মী বা নেতাদের হঠাৎ উত্তেজিত করলেও এরা মূলত সং। এদের কোনো পাওয়ার বা সমাজভিত্তি থাকলে পাহাড়ে-সমতলে এত আপরাধ হতে পারত না। মাদকের মতো ভয়াবহ একটা সংক্রামক বিষয়, যা আমাদের তারুণ্যকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, যা আমাদের যুবশক্তিকে নষ্ট করে দিচ্ছে তাকে এভাবে দমন করা যাবে আদৌ? কে না জানে এ এক বিশাল সিন্ডিকেট। এর পেছনে নামিদামি মানুষ, সংঘবদ্ধ চক্র আরও কত কিছু কাজ করছে। তাই এর সমাধান হতে হবে আন্তরিক ও ধারাবাহিক। সেটা না করে হঠাৎ দামাল ছেলে কামাল ভাইয়ের মতো কিছু মানুষকে মেরে ফেললেই কি সমাধান মিলবে। সমাজ আজ নতজানু। শিশু-কিশোর যুবাদের ভেতর এক ধরনের নেশা আর হতাশা। খুলে গেছে দুনিয়া, মোবাইলে নীল ছবি। হাতের কাছে ইয়াবা। আছে নারী নির্যাতন ও আরও নানাবিধ কুকাজ। এতসবের ভেতর প্রেম, ভালোবাসা, শুদ্ধতা জাগানো কঠিন হলেও সেটাই সমাধান।
দরকার উপযুক্ত শিশু সংগঠন। খেলাঘর, কচিকাঁচার মতো সংগঠন। দরকার যুবশক্তিকে শুদ্ধ রাজনীতি খেলাধুলায় ফিরিয়ে আনা। দরকার শিল্পসাহিত্যের জন্য উদার সমাজ। তবেই তাদের মন ফিরবে ঘরে। ফিরবে দেশের ও দশের কল্যাণে। ঘর, পরিবার, সমাজ আজ ভাঙনের মুখে। সেটা ঠেকাতে হলে রাজনীতিকেও শুদ্ধ হতে হবে। সেখানেই সমাধান।
আমরা চাই মাদক ও নেশামুক্ত সমাজ। ক্রসফায়ারহীন সমাজ। রাজনীতির শুদ্ধতায় পূর্ণ একটি দেশ। কবে পাব আমরা?
অজয় দাশগুপ্ত : কলাম লেখক
উৎসঃ আমাদের সময়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন