পাকিস্তানের প্রধান শহরে
02 June 2014, Monday
১৯৬৬-তে আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যায় শেষ। মন ভালো নেই। কেননা '৬৪ এবং '৬৫-তে আমি পরপর মা ও দিদিকে হারিয়েছি। এরপর অসুস্থ ছিলাম কিছুদিন, ডিপ্রেশনের কারণে উচ্চ রক্তচাপজনিত অসুখে। ভাইয়া তখন পাকিস্তান ইন্টারন্যাশনাল এয়ারলাইন্সের রিজার্ভেশনে চাকরি করছে। হঠাৎ একদিন এসে আমাকে পিআইএর করাচি যাওয়ার একটা টিকিট দিয়ে বলল_ যাও, করাচি ঘুরে এসো। এটা ওয়ান ওয়ে টিকিট। যখন ইচ্ছা হবে ফেরার, আমাকে লিখো, আমি ফিরতি টিকিট তোমায় পাঠিয়ে দেব।
একদিন বিকেলে পিআইএর করাচিগামী ফ্লাইটে উঠে বসলাম। এই প্রথম দীর্ঘ বিমান ভ্রমণের অভিজ্ঞতা। এর আগে কেবল বার তিনেক মায়ের সঙ্গে প্লেনে কলকাতা গিয়েছি। সেই পঞ্চাশের দশকে শুরু। যখন পিআইএ ছিল না। ওরিয়েন্ট এয়ারওয়েজ নামে একটি ব্যক্তিমালিকানার বিমান সংস্থা ঢাকা আর কলকাতার মধ্যে সপ্তাহে তিন দিন সার্ভিস চালু করেছিল। ঢাকা-করাচির মধ্যে তখন বোয়িং ৭০৭ উড়োজাহাজের সার্ভিস চালু ছিল। এটিই প্রথম দূরপাল্লার জেট প্লেন। চার ইঞ্জিনের জাহাজ, বিকট শব্দ করে উড়ে যেত মাথার ওপর দিয়ে। উড়োজাহাজে ঢুকেই থতমত খেয়ে গেলাম। আমার ওই বয়স পর্যন্ত উড়োজাহাজ এত বড় হতে পারে সে সম্বন্ধে আমার কোনো ধারণাই ছিল না। আমার অভিজ্ঞতায় ১৫-২০ জন প্যাসেঞ্জার নিয়ে এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় উড়োজাহাজ চলাচল করে। সে জায়গায় বোয়িং ৭০৭-এ আমার যতদূর মনে পড়ে, ১৫০ জন যাত্রী ভ্রমণ করে। একে প্লেন কে বলবে? এ তো একটি স্বয়ংসম্পূর্ণ বাজার। তখন টগবগে যৌবন আমার। প্লেনে উঠেই অপূর্ব দ্যুতি ছড়ানো পাকিস্তানি সব এয়ার হোস্টেসদের দেখে বিগলিত হয়ে গেলাম। বিরাট আয়োজন শেষে আস্তে আস্তে গদাই লস্করী চালে বিশাল বপু বোয়িং ৭০৭ এগিয়ে চলল টেক অফ পয়েন্টের দিকে। সেখানে কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে ভালোভাবে দম নিয়ে জাহাজের চারটি ইঞ্জিন যখন একসঙ্গে গর্জন করে উঠল, সেই আর্তনাদে আমার তো প্রাণ ওষ্ঠাগত। তিন ঘণ্টা পর এয়ার হোস্টেসের সুমিষ্ট গলায় বলা হলো আমরা করাচির আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অল্পক্ষণের মধ্যেই অবতরণ করতে যাচ্ছি। তবে, বাংলা পাকিস্তানের অন্যতম রাষ্ট্রভাষা হলেও ওই রাতের ঘোষণা কেবল ইংরেজি এবং উর্দুতে দেওয়া হয়েছিল, এখনও স্পষ্ট মনে আছে।
প্রসঙ্গত মনে পড়ে গেল, আমাদের স্বাধীন বাংলাদেশের বিমানবন্দর এবং উড়োজাহাজে বাংলা ঘোষণার কথা। আমি জানি না কে বা কারা এই বাংলায় ঘোষণাগুলো লিখেছে। একটা উদাহরণ দিই। ইংরেজিতে ঘোষণা করা হলো, 'This is to announce the departure of flight number BG etc etc etc..' বাংলায় এর অনুবাদ করা হয়েছে একেবারেই আক্ষরিক অর্থে। এতে করে ভাষার প্রতি সুবিচার করা হয়েছে বটে, কিন্তু যারা শুনছেন, তাদের মাথা ঘুরে যাচ্ছে। ঘোষণাটি এ রকম, 'বিমান তার ঢাকাগামী ফ্লাইট নম্বর ০০১ যাত্রার সময় ঘোষণা করছে।' স্বভাবতই প্রশ্ন আসে, বিমান যাত্রার সময় ঘোষণা করছে? তাহলে কয়টায় ছাড়বে? বাংলা রূপান্তরটি স্বয়ংসম্পূর্ণ হতো, যদি বলা হতো বিমানের ঢাকাগামী ফ্লাইট ০০১ যাত্রার জন্য প্রস্তুত। আমার মনে হয় এই ঘোষণাগুলো লেখেন কোনো মাছিমারা কেরানি, যিনি পুরনো একটি দলিল নকল করতে গিয়ে উড়ন্ত মাছির পেছনে দৌড়ে ফেরেন, কেননা পুরনো দলিলে একটি মরা মাছি লেগে রয়েছে। অতএব, নতুনটিতে একটি মাছি মেরে সেঁটে দিতে হবে। যাক এসব অবান্তর কথা।
করাচিতে প্লেন থেকে নামলাম রাত ৮টায়। ভাইয়া তার করাচি আসার অভিজ্ঞতা থেকে আমাকে বলেছিল পিআইএর যাত্রীবাহী বাসে করে শহরের কেন্দ্রে গিয়ে এবং সেখান থেকে একটি অটোরিকশায় আমাদের মামা নাসির হায়দারের বাড়ি বাহাদুরাবাদ হাউজিং সোসাইটিতে যেতে। সেই কথামতো আমি মামার বাড়িতে পেঁৗছলাম রাত সাড়ে ৯টায়। দেশ থেকে ১২০০ মাইল দূরে এক বাঙালিকে পেয়ে মামি এবং বাচ্চারা সবাই হৈ হৈ করে উঠল।
করাচিতে ছিলাম প্রায় পৌনে দুই বছর। সেখানকার কথা লিখতে হলে করাচি নিবাসী আমার এক বাঙালি কবিবন্ধুর কথা মনে পড়ে যায়। তার একটি কবিতার প্রথম চরণ ছিল, 'এদেশ উটের দেশ, এদেশ গাধার দেশ...!'
কবিতার এই চরণটি শুনতে বিদ্রূপের মতো হলেও আসলেই কিন্তু সত্য ছিল। তখন করাচিতে গেলে শহরের সর্বত্র রাস্তায় কিংবা গলিঘুঁজিতে গাধা এবং উটের সমাবেশ চোখে পড়ত। এই দুই জীবই ব্যবহৃত হতো ভার বহনে। করাচি শহরের সীমানা ছাড়িয়ে সামান্য দূরে গেলেই স্পষ্ট বোঝা যেত যে, শহরটিকে ঘিরে আছে মরুভূমি। সর্বত্র ঝোপঝাড় এবং কাঁটাবন দেখা যেত। বাসে চড়ে এদিক-সেদিক গেলে সারা শরীর ধুলোয় মাখামাখি হয়ে যেত। ওই সময় আমি বার কয়েক করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়েছি। বিশ্ববিদ্যালয় ভবনের নির্মাণ তখনও শেষ হয়নি। সেখানেও ধুলাবালির কমতি নেই। করাচি বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগে পড়াতেন অধ্যাপক মুজিবর রহমান খান। ইনিই সেই বিখ্যাত 'পাঠক মুজিবর রহমান', যিনি ষাটের দশকে তার জলদগম্ভীর কণ্ঠস্বরে রেডিও পাকিস্তানের বাংলা সার্ভিসে খবর পড়তেন। স্বনামের এমন অভিনব ঘোষণা এর আগে আমি কোনোদিন শুনিনি। তিনি বলতেন, এখন রাত ৮টা। বাংলা খবর। পাঠক মুজিবর রহমান। পরে তিনি বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির নাটক বিভাগের পরিচালক হিসেবে দায়িত্বভার গ্রহণ করেন এবং সে সময় আমাদের সঙ্গে তার ঘনিষ্ঠতা হয়।
আমি যখন ঢাকা থেকে করাচির প্লেনে চড়লাম তখন ভাইয়া আমার পকেটে ৩০০ পাকিস্তানি রুপি গুঁজে দিয়েছিল আর বলেছিল যে, আমি যদি করাচিতে থেকে যাই, তাহলে প্রতি মাসে বাড়ি ভাড়া থেকে আমার বরাদ্দ ২০০ রুপি মনিঅর্ডার করে পাঠাবে। এহেন আর্থিক নিরাপত্তার আশ্বাসে আমি তো মহাফুর্তিতে ছিলাম। তবে দুয়েক মাসের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে, ওই কাঁচা বয়সে করাচি হেন একটি বর্ণময় শহরে ২০০ রুপিতে মাস কাটানো অসম্ভব।
সারাদিন টই টই করে ঘুরতাম। খাওয়ার প্রতি আমার দুর্বলতা সেই বাল্যকাল থেকেই আছে। অতএব, অর্জন যতই সামান্য হোক না কেন, খাওয়ার বরাদ্দটা আগেই করে রাখতাম। করাচিতে দর্শনীয় বেশ কিছু স্থান ছিল। যেমন ক্লিফটনের সমুদ্রসৈকত। শহরের মাঝখানে হিল পার্ক, সদর এলাকা, গান্ধী গার্ডেন ইত্যাদি। এই সব জায়গায় নানা রকম মুখরোচক খাবার পাওয়া যেত। করাচির ফুচকা খুব বিখ্যাত ছিল। ওখানে এর নাম ছিল গোলগাপ্পা। এ ছাড়াও সদর এলাকায় ছোট ছোট খাবারের দোকানে নানা রকম কাবাব পাওয়া যেত। ওই এলাকাতেই করাচির বিখ্যাত কুলফি-মালাইয়ের স্বাদ এখনও মুখে লেগে রয়েছে। এলফিনস্টোন স্ট্রিটকে বলা হতো করাচির অক্সফোর্ড স্ট্রিট। এখানে আলোকমালায় সজ্জিত নানা ব্র্যান্ডের দোকান ছিল। আমার সাধ্যের বাইরে ছিল ওইসব দোকানে ঢোকা। তবে, ফুটপাত দিয়ে হেঁটে হেঁটে সব দোকান দেখতাম প্রতি সন্ধ্যায়। নানা রকম বিচিত্র এবং বর্ণময় তৈজসের সমাহার ছিল সেই দোকানগুলোতে। সেসঙ্গে ওখানে বাজার করতে আসা মানুষের জৌলুসও আমাদের আকর্ষণ করত ওই বয়সে।
করাচি পাকিস্তানের প্রধান শহর। এই শহরটি তখন চারিত্রিক দিক দিয়ে ছিল কসমোপলিটন। আধুনিক পশ্চিমা পোশাক, খাদ্য, সংস্কৃতি এবং জীবনধারায় অভ্যস্ত ছিল তখনকার করাচি। ইসলামিক রিপাবলিক অব পাকিস্তান উগ্র ইসলামী ছিল না আদৌ। পরবর্তীকালে জেনারেল জিয়াউল হক নামে এক সামরিক শাসকের আমলে সমগ্র পাকিস্তানের চেহারা বদলে যায়। পাকিস্তানের জনগণ বঞ্চিত হয় ইতিহাসসমৃদ্ধ লাহোর, হায়দরাবাদের শাহ আবদুল লতিফ ভিটাইয়ের মর্মভেদী আধ্যাত্মিক সঙ্গীত, মহেঞ্জোদারোর ঐতিহাসিক স্থাপত্যের আবেদন_ এসব অমূল্য সম্পদ থেকে।
করাচি প্রবাসে শহর করাচি এবং আশপাশের বেশ কিছু দর্শনীয় স্থান ভ্রমণ সম্বন্ধে উল্লেখ করতে চাই। আমরা সবাই জানি, এই নগরটি আরব সাগরের পাড়ে। অতএব, বেশ কিছু সমুদ্রসৈকত ছিল করাচির প্রধান আকর্ষণ। তার মধ্যে ক্লিফটন বিচ, স্যান্ডসপিট এবং প্যারাডাইস পয়েন্ট ছিল প্রধান। এসব সৈকতে সপ্তাহান্তের দিনে যাওয়া হতো আমাদের।
বন্ধু-বান্ধব মিলে বেশ হুল্লোড় হতো। করাচি থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার দূরে 'হালেজি লেক' বলে একটি বিশাল হ্রদ ছিল। সেখানকার প্রধান আকর্ষণ ছিল নানা ধরনের অতিথি পাখি। মনে আছে, এখানে কয়েকজন বন্ধুর সঙ্গে আমি কয়েক রাত কাটিয়েছিলাম। ঘুম ভেঙেছিল নানা ধরনের পাখির কলকাকলিতে। করাচির ফ্রেয়ার হল, যার নির্মাণ ১৮৬৫ খ্রিস্টাব্দে করাচির এম্প্রেস মার্কেটের কাছে, একটি অতি আকর্ষণীয় পুরনো ব্রিটিশ স্থাপত্যের নিদর্শন। এভাবে দেখতে দেখতে আমার করাচি প্রবাস শেষ হয়ে এলো। আমি করাচির ঘরদোর গুটিয়ে এক সকালে ঢাকার উদ্দেশে পিআইএর বিমানে উড্ডীন হলাম।
(সমকাল)
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন