সমস্যার গভীরে যেতে হবে
04 August 2019, Sunday
এই মুহূর্তে দেশ দুটি প্রকট সমস্যায় জর্জরিত। এর একটি হল ডেঙ্গুজ্বরের ভয়াবহ বিস্তৃতি এবং অপরটি হল পাস্তুরিত দুধের সমস্যা। এদেশে বেশ ক’বছর ধরেই বৃষ্টির মৌসুমে ডেঙ্গুর প্রাদুর্ভাব লক্ষ করা গেছে। কিন্তু এই বছরের মতো অতীতে ডেঙ্গুকে কেন্দ্র করে জনমনে এত শঙ্কা ও উদ্বেগ কখনও দেখা যায়নি। অতীতে ডাক্তাররা ডেঙ্গু নিয়ে আতঙ্কিত বোধ না করারই পরামর্শ দিয়েছেন। প্যারাসিটামলের মতো মামুলি ওষুধেই ডেঙ্গুজ্বরের চিকিৎসা সম্ভব বলে চিকিৎসকরা মানুষকে আশ্বস্ত করেছেন। ত
বে ব্যতিক্রম ক্ষেত্রে কিছু বাড়তি উপসর্গ দেখা দিত। যেমন গায়ে র্যাশ ওঠা এবং দাঁতের মাড়ি দিয়ে রক্ত বের হওয়া। এ ধরনের লক্ষণ দেখলে ডাক্তাররা রোগীর অধিকতর যত্নের পরামর্শ দিতেন। ক্ষেত্র বিশেষে রক্তের প্লাটিলেট বাড়ানোর জন্য শরীরে অতিরিক্ত প্লাটিলেট প্রবাহ বাড়ানোর পদক্ষেপ নেয়া হতো। এ ধরনের ডেঙ্গুকে বলা হয় হ্যামোরেজিক ডেঙ্গু। হ্যামোরেজিক ডেঙ্গুতে দেহের অভ্যন্তরে রক্তক্ষরণ হয় এবং ভয়াবহ পরিণতিরও শঙ্কা থাকে।
এ বছরের ডেঙ্গু অতীতের মতো নিরীহ নয়। অনেক ক্ষেত্রেই ডেঙ্গু ভীতিপ্রদ হয়ে উঠেছে। এ বছরের ডেঙ্গুতে প্রাণসংহারের শঙ্কা অনেক গুণ বেড়ে গেছে। ডেঙ্গু শক সিনড্রোম এবং এর ফলে মাল্টি অর্গান ফেইলিউর দেখা দিলে রোগীকে বাঁচানো কঠিন হয়ে পড়ে। ৩১ জুলাই পর্যন্ত তথ্যে দেখা যায়, ডেঙ্গুর ফলে পঞ্চাশেরও অধিক সংখ্যক মানুষ প্রাণ হারিয়েছেন।
রাজধানী ঢাকাতেই ডেঙ্গুর প্রকোপ সর্বাধিক। হাসপাতালগুলোতে অনেক ডেঙ্গু রোগী ভর্তি হতে পারছেন না। ডেঙ্গুকে কেন্দ্র করে বেসরকারি হাসপাতালগুলোর বিরুদ্ধে অমানবিক ব্যবসারও অভিযোগ উঠেছে। রাজধানীর অন্তত দুটি বড় বেসরকারি হাসপাতালের বিরুদ্ধে অমানবিক বাণিজ্যের অভিযোগ উঠেছে। কোনো কোনো ডায়াগনস্টিক সেন্টারের বিরুদ্ধে রক্ত পরীক্ষায় অবহেলারও অভিযোগ আছে।
এর মধ্যেই দেশের বেশ ক’টি জেলায় ডেঙ্গু ছড়িয়ে পড়েছে। ঈদুল আজহার সময় লোকজন যখন রাজধানী ছেড়ে মফস্বলে যাবে তখন এই রোগ আরও বিশাল আকারে ছড়িয়ে পড়তে পারে বলে বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা প্রকাশ করেছেন। ডেঙ্গুর ভাইরাসটি এবার আর অতীতের মতো মামুলি নয়। এটি এখন ভয়াবহ রূপ ধারণ করেছে এবং আক্রান্ত রোগীদের জন্য ভয়াবহ পরিণতিও ডেকে আনছে। যারা উচ্চমার্গের চিন্তা করেন, তারা এজন্য জলবায়ু পরিবর্তনকে দায়ী করছেন।
তবে ডেঙ্গুর এই ভয়াবহ প্রাদুর্ভাবের সঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের কী সম্পর্ক আছে তার জন্য গভীর গবেষণা প্রয়োজন। অমন গভীর চিন্তার আগে আমরা যেদিকে মনোযোগ দিতে পারতাম সেটা হল এডিস মশার বংশবিস্তারের সুযোগ ধ্বংস করা। এ কাজের দায়িত্ব একদিকে যেমন সিটি কর্পোরেশনের, অন্যদিকে তেমনি ব্যক্তি নাগরিকদেরও। মশক নিধনকারী ওষুধ নিয়ে সিটি কর্পোরেশন যে কেলেঙ্কারি করেছে, তা ক্ষমাহীন। যখন জানা গেল আমদানিকৃত ওষুধ অকার্যকর, তখন বলা হল কার্যকর ওষুধ আনতে ৩-৪ মাস লেগে যেতে পারে।
লন্ডন থেকে মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনার পর এখন বলা হচ্ছে অতি শিগগিরই কার্যকর ওষুধ আমদানি করা হবে। প্রয়োজনবোধ করলে বিমানের মাধ্যমেই আমদানি করা হবে। এটা এখন নিশ্চিত যে মশক নিধনকারী ওষুধ কেলেঙ্কারির মূলে রয়েছে মারাত্মক দুর্নীতি। এই দুর্নীতি অন্য ১০ রকম দুর্নীতির মতো নয়। এর সঙ্গে জড়িয়ে আছে মানুষের জীবন-মরণের প্রশ্ন।
কোনো দুর্নীতিই গ্রহণযোগ্য নয়। কিন্তু সব দুর্নীতি সমাজে ও অর্থনীতির ওপর সমান প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করে না। অধিকাংশ দুর্নীতি তাৎক্ষণিকভাবে মানুষের মৃত্যুর কারণ হয় না। কিন্তু মশক নিধনকারী ওষুধকে কেন্দ্র করে যে দুর্নীতি হয়েছে তা নাগরিক জীবনকে ভয়াবহ মৃত্যুঝুঁকির মধ্যে ফেলে দিয়েছে। এর জন্য দায়ীদের শাস্তি কি আমরা দেখতে পাব?
পাস্তুরিত দুধকে কেন্দ্র করে অনেক তর্ক-বিতর্কের সৃষ্টি হয়েছে। গবেষকরা ল্যাবরেটরিতে পরীক্ষা করে দেখেছেন, বাজারে বিভিন্ন কোম্পানির যে পাস্তুরিত দুধ বিক্রয় করা হয় তাতে সিসা, অ্যান্টিবায়োটিক ও ডিটারজেন্টের মতো মানবদেহের জন্য ক্ষতিকর উপাদান রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট মামলা হয়েছে। হাইকোর্ট ৫ সপ্তাহের জন্য সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোর উৎপাদিত পাস্তুরিত দুধের উৎপাদন ও বিপণন নিষিদ্ধ করেছেন।
এর বিরুদ্ধে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলো আপিল বিভাগে আবেদন জানানোর পর একে একে সব কোম্পানির ওপর নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করা হয়েছে। মাঝখানে খামারিরা দুধ বিক্রয় করতে না পেরে রাস্তায় মানববন্ধন করে এবং দুধ রাস্তায় ঢেলে দিয়ে বিক্ষোভ করেছে। অপরদিকে প্রধানমন্ত্রী প্রশ্ন তুলেছেন, এসবের মধ্যে বিদেশ থেকে গুঁড়ো দুধ আমদানিকারকদের কারসাজি রয়েছে কিনা। কারসাজি তো থাকতেই পারে।
একটি দেশে যখন বিভিন্ন স্বার্থবাদী গোষ্ঠী থাকে তখন তারা ছলে-বলে-কৌশলে তাদের স্বার্থ উদ্ধার করতে চাইবে। রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের দায়িত্ব হল স্বার্থগোষ্ঠীগুলো যাতে তাদের অশুভ প্রভাব বিস্তার করতে না পারে, তার জন্য তীক্ষ্ণ নজরদারি করা। এদেশে এই কাজটি কতটুকু হয়, তা নিয়ে লাখ ডলার মূল্যমানের প্রশ্ন রয়েছে। হয়তো দেখা যাবে স্বার্থবাদী গোষ্ঠী ও প্রশাসনের কোনো কোনো মহলের যোগসাজশে অপকর্মগুলো হচ্ছে।
আমার কাছে মনে হয়েছে, দুধের সমস্যাটির মূলে প্রবেশ করা হয়নি। খামারিরা যে গাভী পালন করে সেগুলোকে যে খাবার দেয়া হয়, তার মধ্যেই সমস্যা নিহিত। খামারিদের কেউ ভুল পরামর্শ দিচ্ছে কিনা, সেটা তলিয়ে দেখতে হবে। পশু চিকিৎসকরা অনেক সময় পশুকে রোগবালাই থেকে মুক্ত রাখার জন্য গো-খাদ্যের সঙ্গে অ্যান্টিবায়োটিক যোগ করার পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এ ছাড়া কৃত্রিম উপায়ে দুধ তৈরিরও অভিযোগ রয়েছে।
এ পর্যায়ে ডিটারজেন্ট ব্যবহার করা হয় বলে প্রশ্ন উঠেছে। পশু অসুস্থ হলে প্রয়োজনমতো অবশ্যই ওষুধ খাওয়াতে হবে। কিন্তু তা যদি মাত্রাতিরিক্ত হয়ে যায় এবং বিনা প্রয়োজনে খাওয়ানো হয় তাহলে সেটা ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে। প্রাণিবিজ্ঞানে ‘ফুড চেইন’ বলে একটি কথা আছে। ফুড চেইনের মধ্য দিয়েই বিপণনকৃত দুধে ক্ষতিকর উপাদানগুলো প্রবেশ করেছে। কিন্তু এই কথাটি কেউ প্রত্যক্ষ নজরে আনছেন না।
ফলে ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে যথার্থ ক্ষেত্রের বাইরে। আসল কথা হল, ফুড চেইনের মধ্য দিয়ে দুধে ক্ষতিকর উপাদান যুক্ত হচ্ছে কিনা সেটা তলিয়ে দেখা এবং এর নিরসনের জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণ করা। কিন্তু কাজটি অত সহজ নয়। মাঠপর্যায়ে হাজার হাজার খামারির এতদিনকার অভ্যাসে পরিবর্তন আনা খুবই কঠিন। আরও কঠিন সার্বিক প্রশিক্ষণসমৃদ্ধ পশু চিকিৎসক নিয়োগ করা।
অনেক সময় প্রশিক্ষিত পশু চিকিৎসকরাও দ্রুত ফল লাভের জন্য ভুল পরামর্শ দিয়ে থাকেন। এসব জ্ঞানপাপীকে শোধরানো সত্যই কঠিন। গ্রামাঞ্চলে যেসব পশু খামারি রয়েছেন তাদের সচেতন করে তোলা এবং পশু রোগের জন্য সুষ্ঠু চিকিৎসা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে প্রয়োজন বিশাল ও আন্তরিক উদ্যোগ। যে দেশে প্রায় সব প্রতিষ্ঠানই ভেঙে পড়েছে সে দেশে পশু চিকিৎসা প্রতিষ্ঠান সঠিকভাবে কাজ করবে সেটি খুবই বাড়তি আশা।
তা সত্ত্বেও আশা করতে হয়। তবে গোটা পরিস্থিতিকে শোধরানোর জন্য সময়ের প্রয়োজন। এদেশের মানুষ ভালো কিছু গ্রহণ করতে জড়তা অনুভব করে না। এটাই হল আশাবাদের ভিত্তি। যদি সঠিক আয়োজনের মাধ্যমে গো-স্বাস্থ্যের বিষয়টি দেখভাল করা যায় তাহলে পরিস্থিতির উন্নতি হতে বাধ্য।
এদেশে অনেক সমস্যাই চিহ্নিত হয়। কিন্তু যথার্থ চিন্তার অভাবে এসব সমস্যার জটটি কোথায় নিহিত তা নিরূপণ করা হয় না। অনেক সময় শূন্যে গদা ঘোরানো হয়। ফলে সমস্যা সমস্যার জায়গাতেই থেকে যায়। সময়ের ব্যবধানে সমস্যাগুলো জটিল থেকে জটিলতর হয়ে ওঠে। মানুষ চরম দুর্ভোগের কবলে পড়ে। ডেঙ্গু ও পাস্তুরিত দুধের সমস্যা আমাদের বলে দিচ্ছে সমস্যার মূলে যেতে হবে।
ডেঙ্গুর মতো ভয়াবহ রোগ থেকে মুক্ত থাকতে হলে নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখার জন্য সব ধরনের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে। এই মৌলিক কাজটি করা হয়নি বলে মানুষ চরম আতঙ্কে রয়েছে। হাসপাতালে ঠাঁই নেই। কোনো কোনো বেসরকারি হাসপাতাল লাখ টাকার ব্যবসা করছে। বহু কর্মদিবস হারিয়ে যাচ্ছে। রোগ নির্ণয় ও চিকিৎসার জন্য ব্যক্তি ও পরিবার পর্যায়ে বহু অর্থ ব্যয় হচ্ছে। যদি নগরীকে পরিচ্ছন্ন রাখা যেত এবং সময়মতো কার্যকর মশক নিধনকারী ওষুধ প্রয়োগ করা হতো তাহলে এত বড় বিপর্যয়ে পড়তে হতো না।
একইভাবে যখন দুগ্ধ খামার গড়ে ওঠে তখন থেকেই যদি পশুর চিকিৎসা ও সঠিক গো-খাদ্যের ব্যবস্থা করা হতো তাহলে পাস্তুরিত দুধ নিয়ে যে বাকবিতণ্ডার সৃষ্টি হয়েছে এবং সমস্যার রাজনীতিকরণ হয়েছে, সেসব হতো না। এদেশে চমৎকার সব উদ্যোগ এসেছে। কিন্তু এসব উদ্যোগ থেকে কী ধরনের নেতিবাচক প্রভাব সৃষ্টি হতে পারে সেগুলো নিয়ে কখনই গভীরভাবে চিন্তা করা হয়নি। জাতি হিসেবে চিন্তার রাজ্যে আমরা মামুলিপনার এবং সিরিয়াস না হওয়ার ঘেরাটোপের মধ্যেই আবদ্ধ রয়েছি। জানি না কখন এ থেকে মুক্তি মিলবে।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন