জীবনের নিরাপত্তার অধিকার কবে নিশ্চিত হবে?
21 July 2019, Sunday
একটি দেশে রাষ্ট্রই হল সর্বোচ্চ সংস্থা। এই সংস্থা দেশের যাবতীয় বিষয়াদি নিয়ন্ত্রণ করে। উদ্দেশ্য, নাগরিকদের জীবন নিরাপদ, নির্ঝঞ্ঝাট ও শান্তিময় করে তোলা। রাষ্ট্র যদি এই দায়িত্ব পালনে ব্যর্থ হয় তখন ওই রাষ্ট্রকে ব্যর্থ রাষ্ট্র হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। একটি রাষ্ট্র নানা কারণে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত হতে পারে। এই কারণগুলোর মধ্যে গৃহযুদ্ধ, রাষ্ট্রবহির্ভূত শক্তির জঙ্গি তৎপরতা, আইনের শাসন ভেঙে পড়া এবং সর্বব্যাপী নৈরাজ্য ও অরাজকতা বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য। বিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ব্যর্থ রাষ্ট্রের প্রসঙ্গটি বারবার সামাজিক বিজ্ঞানের আলোচনায় এসেছে। এখনও সে আলোচনা অব্যাহত।
ব্যর্থ রাষ্ট্রের উপাদান কমবেশি সব রাষ্ট্রেই আছে। কিন্তু যখন এসব উপাদান রাষ্ট্রের সহন ক্ষমতা অতিক্রম করে যায়, তখন রাষ্ট্র ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। নাগরিক জীবনও বিপন্ন হয়ে পড়ে। অনেক সময় উগ্র জাতীয়তাবাদী তৎপরতা এবং জাতিগত বিদ্বেষের ফলে একটি রাষ্ট্রের অভ্যন্তরে কোনো ধর্মীয় গোষ্ঠী বা কোনো এথনিক গোষ্ঠী এমন অত্যাচার, অবিচার, বৈষম্য ও বিদ্বেষের শিকার হয় যে, তারা সেদেশে বাস করাকে নিরাপদ মনে করে না। ফলে তারা ওই দেশ ছেড়ে অন্য দেশে জীবনের নিরাপত্তা লাভের আশায় অভিগমন করে।
তারা যদি অন্য রাষ্ট্রের আশ্রয় পায় তাহলে তারা সাময়িকভাবে হলেও নিরাপদ বোধ করেন। কারণ তাদের আশ্রয়স্থলে প্রাণ হারানোর মতো হুমকি থাকে না। কিন্তু তারা আশ্রয় প্রদানকারী রাষ্ট্রের নাগরিকত্বও পায় না। এই অবস্থায় তারা হয়ে পড়ে রাষ্ট্রহীন নাগরিক। রাষ্ট্রহীন হওয়ার মতো বেদনাদায়ক পরিস্থিতি আর কী হতে পারে! বর্তমান বিশ্বে রাষ্ট্রহীন নাগরিকের সংখ্যা বিশাল। মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর অত্যাচার এবং এথনিক ক্লিনজিং অপারেশনের ফলে বাংলাদেশে আশ্রয় নিতে বাধ্য হয়েছে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠী।
তাদের জীবন যে কত দুঃখময় তা ভাষায় বর্ণনা করা যাবে না। এরা সবাই রাষ্ট্রহীন মানুষ। মিয়ানমার এদের নাগরিকত্ব স্বীকার করে না, বাংলাদেশের পক্ষে এদের নাগরিকত্ব প্রদান সম্ভব নয়। এই পরিস্থিতিতে এরা এখন এক পরিচয়হীন জনগোষ্ঠীতে পরিণত হয়েছে। এদের বিভিন্ন জাতীয় ও আন্তর্জাতিক সংস্থার কৃপা ও অনুদানের ওপর নির্ভর করতে হয়। অন্যদিকে বাংলাদেশও তাদের নিয়ে দারুণ সমস্যায় আছে। আন্তর্জাতিক মহল এদের জন্য করুণা প্রকাশ করলেও নিজ বাসভূমিতে ফিরে যাওয়ার প্রশ্নে তেমন কার্যকর কিছুই করছে না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার এক সহপাঠী ছিল। তার নাম জিসান হোসেন। অবাঙালি পরিবার থেকে আগত আমার এ বন্ধুটি ছিল খুবই প্রগতিশীল এবং দর্শনমনস্ক। আমরা তাকে ফিলোসফার বলে ডাকতাম। সে অনার্সে সেকালে প্রথম শ্রেণি লাভ করেছিল। ’৭১-এর মুক্তিযুদ্ধ শুরু হলে তাদের পরিবারে বিরাট বিপর্যয় নেমে আসে। রেলওয়েতে চাকরি করা তার পিতার পক্ষে কর্মস্থলে থাকা সম্ভব হচ্ছিল না। পরিবারটি অনাহার ও অর্ধাহারে নিপতিত হয়। জিসান এমএ পরীক্ষার পর ইংরেজি পত্রিকায় সাংবাদিকতার কাজ করত। কিন্তু যুদ্ধ পরিস্থিতিতে তাও করা সম্ভব হল না। যুদ্ধ শেষে তার খবর নিয়ে জানা গেল পরিবারের ১৮ সদস্য নিয়ে সে খুবই দুর্দশার মধ্যে আছে। অপুষ্টিতে সে যক্ষ্মা রোগাক্রান্ত হয়ে পড়ে।
আমরা কয়েক বন্ধু মিলে প্রফেসর রেহমান সোবহানকে বিষয়টি জানালে তিনি জিসানকে পরিকল্পনা কমিশনে একটি চাকরির ব্যবস্থা করেন। সাময়িকভাবে হলেও জিসান কিছুটা স্বস্তি পায়। তারপর পাকিস্তানে অবাঙালিদের যাওয়ার ব্যবস্থা হলে জিসান পাকিস্তানে চলে যায়। সেখানে পাকিস্তান ইনভেস্টমেন্ট কর্পোরেশনে সে একটি ভালো চাকরি পায়। সেখানে কর্মরত থাকা অবস্থায় বিশ্বব্যাংকের একটি রিক্রুটমেন্ট টিমের কাছে সাক্ষাৎকার প্রদান করে। বিশ্বব্যাংকের টিমটি তার প্রতিভা ও মেধা দেখে খুবই সন্তুষ্ট হয় এবং তাকে বিশ্বব্যাংকে ইয়াং প্রফেশনাল হিসেবে নিয়োগ দান করে।
এই পদ থেকে পদোন্নতি পেয়ে সে একটি কান্ট্রি ডেস্কের দায়িত্ব পায়। সেই দেশটি হল ভিয়েতনাম। জিসান উচ্চতর একাডেমিক ডিগ্রি অর্জনের চেষ্টা করেনি। কিন্তু তা সত্ত্বেও পিএইচডি পর্যায়ের ডিগ্রিধারীরা বিশ্বব্যাংকে যে চাকরি পায়, সে সেরকমই চাকরি পেয়েছিল। ওয়াশিংটনে বিশ্বব্যাংকের এক সম্মেলনে অংশগ্রহণ করতে গিয়ে জিসানের সঙ্গে বহু বছর পর আমার দেখা হয়। আমি তাকে জিজ্ঞাসা করলাম, অবসর গ্রহণের পরে কি সে পাকিস্তানে ফিরে যাবে?
ত্বরিত গতিতে সে জবাব দিল, ‘পাকিস্তান তো আমার দেশও নয়, জন্মভূমিও নয়। আমার যে কোনো দেশ নেই। আমি তো রাষ্ট্রহীন এক হতভাগা মানুষ।’ জিসান চমৎকার ইংরেজি লিখত। সে আমাকে কয়েকটি ডায়েরি বুক দেখাল, যেগুলো সে উপন্যাস লেখার কাজে ব্যবহার করছিল। আমার দৃঢ় বিশ্বাস তার এই লেখাগুলো যদি প্রকাশিত হতো তাহলে সে আন্তর্জাতিকভাবে খ্যাতিমান ঔপন্যাসিকের মর্যাদা পেত। এই মুহূর্তে সে কোথায় আছে জানি না। শুনেছি অবসর গ্রহণের পর এক থাই মহিলাকে বিয়ে করে সে থাইল্যান্ডে আছে। ব্যাংককে যখনই যাওয়ার সুযোগ হয়েছে তখনই তার অবস্থান জানতে চেষ্টা করেছি। কিন্তু কোনো খোঁজ পাইনি। জিসান হল সেসব রাষ্ট্রহীন মানুষদের মধ্যে একজন, যার দীর্ঘশ্বাস বলে দেয় রাষ্ট্রহীন হওয়া কত বেদনাদায়ক ও মর্মন্তুদ।
রাষ্ট্রের উৎপত্তি নিয়ে দার্শনিক ও সমাজবিজ্ঞানীদের মধ্যে দুটি প্রধান ধারা আছে। এর একটি ধারা হল রাষ্ট্র একটি সামাজিক চুক্তির ফল বা সোশ্যাল কনট্র্যাক্ট থেকে রাষ্ট্রীয় সংস্থার উৎপত্তি। রাষ্ট্র সংস্থা বর্জিত মানুষদের মধ্যে বিশৃঙ্খলা, নৈরাজ্য এবং খুন-খারাবি দেখে মানুষ উপলব্ধি করল এমন একটি সংস্থার প্রয়োজন যার কাছে তারা তাদের স্বাধীনতা আংশিকভাবে হলেও সমর্পণ করবে। সেই সংস্থা রাজতান্ত্রিক হোক কিংবা গণতান্ত্রিক হোক তার কাজ হবে সমাজে শৃঙ্খলা বজায় রাখা। মানুষের তিনটি মৌলিক অধিকার হল Life, liberty and property. সমাজে বাস করে যদি প্রাণ রক্ষা করা না যায় তাহলে তো জীবন অর্থহীন হয়ে পড়বে।
হয়ে পড়বে প্রচণ্ড অনিরাপদ। একইভাবে অর্জিত বিষয়সম্পদ যদি আগ্রাসীদের থাবা থেকে রক্ষা করা না যায় তাহলেও জীবন হয়ে পড়বে অনিরাপদ। সুতরাং এই নিরাপত্তার বিষয়গুলো দেখভাল করার জন্য একটি সংস্থার প্রয়োজন। যার দায়িত্ব হবে বল প্রয়োগ করে হলেও নাগরিকদের ন্যায্য নিরাপত্তা বিধান করা। অবশ্য এই রাষ্ট্রে নাগরিকরা কিছু স্বাধীনতাও ভোগ করবে। যেমন বাকস্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা এবং বিচার চাওয়ার স্বাধীনতা। রাষ্ট্রতত্ত্ব সম্পর্কে আরেকটি ব্যাখ্যা এসেছে মার্কস এঙ্গেলসের লেখা থেকে। তারা মনে করেন, রাষ্ট্র হল শ্রেণি নিপীড়নের হাতিয়ার।
একটি রাষ্ট্রে একটি অধিপতি শ্রেণি প্রভুত্ব করে। তারা তাদের স্বার্থ রক্ষার্থে শাসিত শ্রেণিগুলোর ওপর দমন-পীড়ন চালায়। এই দমন-পীড়ন সবসময় কদর্যভাবে প্রকাশ পায় না। সভ্য রাষ্ট্রে দমন-পীড়ন হয় খুবই সুকৌশলে এবং নাগরিকদের বোধ ও চেতনায় যাতে ধরা না পড়ে তার পন্থা ও প্রক্রিয়া নিশ্চিত করে। তবে একথা ঠিক, রাষ্ট্রের বিভিন্নমুখী ব্যাখ্যা যাই থাকুক না কেন, রাষ্ট্রের কাজ হল নাগরিকদের জীবনের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।
গণতান্ত্রিক স্বাধীনতা বা বাকস্বাধীনতা বাংলাদেশে কতটুকু আছে তার বিচারের ভার বাংলাদেশের নাগরিকদের ওপরই রইল। প্রশ্ন হল, নাগরিকদের জানমাল রক্ষায় রাষ্ট্র বাংলাদেশে কতটুকু দায়িত্বশীল আচরণ করছে। আমরা যখন দেখি বিচারকের খাস কামরায় এক আসামি অন্য আসামিকে ছুরিকাঘাতে হত্যা করে তখন অবশ্যই ভাবতে হবে এদেশের নাগরিকরা কতটা নিরাপদ। গুম, খুন এবং বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড তো রয়েছেই। কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জে লোমহর্ষক ৭ খুনের ঘটনা ঘটেছিল। এই ঘটনার সঙ্গে রাষ্ট্রের একটি এলিট বাহিনীর কিছু সদস্য জড়িত থাকার অভিযোগ উঠেছিল।
মিডিয়া অত্যন্ত সরব হওয়ার ফলে ঘটনাটি ধামাচাপা দেয়া সম্ভব হয়নি। এখন অপরাধীদের বিচার হচ্ছে। তবে মাঝে মাঝে অভিযোগ ওঠে এসব অপরাধীর মধ্যে রুই-কাতলা পর্যায়ের ব্যক্তিরা কিভাবে কারাগারে রাজার হালে রয়েছেন। আরেক অপরাধী যাকে মাদক ব্যবসায়ের জন্য দণ্ডিত করা হয়েছে সেও টাকার জোরেই হোক বা অন্য কোনো ক্ষমতার কারণে হোক, তার কারামেয়াদের একটি বড় সময় হাসপাতালের কেবিনে অবস্থান করে কাটিয়ে দিচ্ছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর এক সদস্যের খুনে জড়িত হওয়ার বিষয় নিয়ে দৈনিক প্রথম আলো ১৭ জুলাই শেষ পাতায় একটি বড় শিরোনাম করেছে, ‘লাখ টাকার খুনে জড়িত র্যাব সদস্য।’ এই সংবাদের সারসংক্ষেপ থেকে জানা যায়, ৩ শতক জমির জন্য হবিগঞ্জের চুনারুঘাট থেকে কৃষক দুলামিয়াকে মাইক্রোবাসে ঢাকায় এনে খুন করা হয়। অপহরণ ও হত্যায় অংশ নেন র্যাব সদস্যসহ ৮ জন। মাইক্রোবাস চালক ও এক খুনি জবানবন্দি দিয়েছেন। এ যাত্রাও হয়তো অভিযুক্ত র্যাব সদস্যটি রেহাই পাবে না। কারণ বহুল প্রচারিত দৈনিকে খবরটি ফলাও করে প্রকাশিত হয়েছে।
রক্ষক যখন ভক্ষক হয়ে পড়ে তখন কী আশা করা যেতে পারে? জনগণের করের অর্থে যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে পোষা হয় তারা যদি আইনের মারাত্মক ব্যত্যয় ঘটায় তাহলে নাগরিকদের জীবনের অধিকার কত ঠুনকো হয়ে পড়ে তা অনুমান করার জন্য আইনস্টাইন হওয়ার প্রয়োজন নেই। হ্যাঁ এক শ্রেণির নাগরিক এদেশে বাড়তি নিরাপত্তা ভোগ করে। এদের জন্য থাকে গানম্যান এবং ঘটনা বিশেষে সামনে পেছনে পুলিশের সশস্ত্র পাহারা। এই বিশেষ শ্রেণির নাগরিকদের নিরাপত্তার জন্য জনগণের করের অর্থ ন্যায্য অনুপাতের বাইরে গিয়ে ব্যয় করা হচ্ছে।
আমরা কিছু ইউরোপীয় দেশের কথা জানি। যেসব দেশের প্রধানমন্ত্রীরা কোনোরকম প্রহরা ছাড়াই দৈনন্দিন জীবনে চলাফেরা করেন। অত বেশি বাংলাদেশে আমরা এখন আশা করি না। তবে এইটুকু আশা করি, সব নাগরিক যেন ভাবতে পারে তাদের জীবনের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্র এমন একটি সুষ্ঠু ব্যবস্থা গড়ে তুলেছে যেখানে তারা নির্ভয়ে দৈনন্দিন কাজকর্ম চালিয়ে যেতে পারে।
সংবাদপত্রে আরও দেখলাম, অধ্যাপক আনু মুহাম্মদকে সপরিবারে গুম করার হুমকি দেয়া হয়েছে। তিনি থানায় জিডি করেছেন। কিন্তু কতটুকু সুফল পাবেন তা নিয়ে সন্দেহের অবকাশ আছে। আমাদের দেশটি সে রকম দেশ কবে হবে, যেদিন সব নাগরিক শ্রেণি, ধর্ম, বর্ণ নির্বিশেষে জীবন নিয়ে সমানভাবে নিরাপদ বোধ করবে। এটাও মুক্তিযুদ্ধের অবিচ্ছেদ্য চেতনা সাম্যেরই অন্তর্গত।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন