সবাই যখন নিজের ছায়াকেও ভয় পায়
22 July 2018, Sunday
আমরা এমন এক সমাজে বাস করছি যেখানে ভীরুতা, কাপরুষতা, প্রতিবাদহীনতা, বশ্যতা ও সমর্পণবাদ সর্বব্যাপক হয়ে উঠেছে। এই যখন সমাজের চিত্র তখন দেখা যায় ব্যক্তি পর্যায়ে মানুষ দিন দিনই নিষ্ঠুর, স্নেহ ভালোবাসাহীন, স্বার্থপর এবং ন্যায়নীতিবিবর্জিত হয়ে উঠেছে।
এখন এমন এক নষ্ট সময় যখন ভাই ভাইকে হত্যা করতে, বোন ভাইকে হত্যা করতে, পিতা-মাতা সন্তানকে হত্যা করতে, সন্তান পিতা-মাতাকে হত্যা করতে এবং দীর্ঘদিনের বন্ধু বন্ধুকে হত্যা করতে সামান্যতম কুণ্ঠাবোধ করে না। মনে হয় সব ধরনের ন্যায়-নীতি এবং মহত্ত্ব সমাজ থেকে হারিয়ে যেতে চলেছে।
মহামারী আকারে ধর্ষণের মতো কুপ্রবৃত্তি সমাজের চিরায়ত মূল্যবোধের গোড়ায় কুঠারাঘাত হেনে চলেছে। নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার এই যে তাণ্ডব, একে সমাজবিজ্ঞানীরা Brutalization of the Society হিসেবে চিহ্নিত করেছে।
এ কথা মানতেই হবে এমনকি ৫০ বছর আগেও আমাদের সমাজে এত ব্যাপকহারে এমনসব নিষ্ঠুরতার ঘটনা দেখা যায়নি। অর্থের লোভেই হোক, বিষয় সম্পত্তি হস্তগত করার জন্যই হোক, কোনো নারীর দ্বারা প্রত্যাখ্যাত হওয়ার কারণেই হোক অথবা নেশাদ্রব্য ক্রয় করতে না পারার কারণেই হোক খুন-খারাবির মতো নিষ্ঠুরতায় লিপ্ত হতে অনেকেরই বাধে না।
ধর্ম প্রচারকরা, বিশেষ করে গৌতম বুদ্ধ রিপুর তাড়নাকে জয় করার ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিয়েছেন। মানুষ যেমন রিপুর তাড়নার কাছে পরাজিত হতে পারে, আবার তেমনি এগুলোকে পরাস্ত করে হয়ে উঠতে পারে মহীয়ান।
মানুষের অন্তরে দুটি সত্তার মধ্যে দ্বন্দ্ব চলতে থাকে অবিরাম। একটি সত্তা পাপের পথে কিংবা অমানবিকতার পথে মানুষকে প্রলুব্ধ করে। অন্য সত্তাটি প্রতিনিয়ত বলতে থাকে অমন খারাপ কাজ করো না, অমন পাপের পথে পা বাড়িও না, অমন নিষ্ঠুর হয়ে তোমার মানবিক সত্তাকে বিলুপ্ত করে দিও না।
এই যে দ্বিবিধ সত্তা, এর মধ্যে কাম্য ও শ্রেয় সত্তাটি যখন জয়ী হয় তখনই কেবল মনুষ মানুষ হয়ে ওঠে। অন্যদিকে যখন খারাপ সত্তাটি প্রাধান্য বিস্তার করে তখন মানুষ অমানুষে পরিণত হয়।
আমাদের এ উপমহাদেশের দুটি প্রধান ধর্মের একটিতে বলা হয়েছে মানুষ হল ‘আশরাফুল মাকলুকাত’; আর অন্যটিতে মানুষকে চিহ্নিত করা হয়েছে ‘অমৃতষ্য পুত্র হিসেবে’। মানুষের এ বৈশিষ্ট্যই মানুষকে অন্যসব ইতর প্রাণী থেকে পৃথক করেছে। পাশ্চাত্যের দার্শনিকরা মানব প্রকৃতি বা Human Nature নিয়ে বিশাল বিতর্ক করেছে।
তাদের একটি পক্ষের মতে, মানুষ স্বভাবজাতভাবেই উত্তম। অন্য পক্ষ যথাযথ নিয়ন্ত্রণের অনুপস্থিতিতে মানুষের স্বভাবের মধ্যে ক্লেদাক্ত প্রবণতা বিদ্যমান বলে মতপ্রকাশ করেছেন।
এই ক্লেদাক্ত প্রবণতামুখী অবস্থাই হল State of Nature. এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই গঠিত হয়েছিল রাষ্ট্র। রাষ্ট্র তার আইনকানুন, বিধি-বিধান বল প্রয়োগের মাধ্যমে কার্যকর করে সমাজজীবনকে শান্তি ও শৃঙ্খলার পথে এগিয়ে নিয়ে যায়। অর্থাৎ কেবল রাষ্ট্র নামক সংস্থাটিই পারে মানুষকে বিশৃঙ্খলা ও নৈরাজ্যের পথ থেকে দূরে রাখতে।
আলোচনার সূত্রপাত ঘটাতে আমি বলেছিলাম, আজ যত নিষ্ঠুরতা ও অমানবিকতার ঘটনা প্রত্যক্ষ করি, তেমনটি ৫০ বছর আগেও ছিল না। মানুষের মধ্যে অনাচার ও নিষ্ঠুরতা সবকালেই ছিল। তা না হলে ধর্মগ্রন্থে মানবজাতির পিতা আদম (আ.)-এর দুই সন্তানের মধ্যে খুনাখুনির কাহিনী কেন লিপিবদ্ধ হয়েছে।
রোমান সম্রাটরা গ্লাডিয়েটরদের লোহার খাঁচায় পুরে বাঘ বা সিংহের মতো হিংস্র পশুর সঙ্গে যুদ্ধে লিপ্ত হতে বাধ্য করত। এতে রোম সমাজের প্রভুস্থানীয়রা পৈশাচিক আনন্দ পেত। তখন এরকম বাধ্যতামূলক মরণখেলা ছিল আইনসম্মত। কারণ তখনকার সমাজে সম্রাটের আকাক্সক্ষাই আইন হিসেবে বিবেচিত হতো।
তাই দেখা যাচ্ছে কুপ্রবৃত্তির তাড়না সব যুগেই কিছু না কিছু ছিল। এখন গণতন্ত্রের যুগ, সভ্যতার যুগ এবং আইনের শাসনের যুগ, তাহলে আমাদের মতো সমাজে কেন এত নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতার বিস্তার ঘটছে?
কেউ বলবেন, জনসংখ্যা অনেক বেশি হয়ে গেছে তাই নিষ্ঠুরতা ও পৈশাচিকতার মতো অপরাধও অনেক বেড়ে গেছে। আবার কেউ বলবেন, এখন মিডিয়ার যুগ। মিডিয়ার কল্যাণে আমরা সব ঘটন-অঘটনের সংবাদ ঘরে বসেই পাই।
তাই প্রতিনিয়ত মানুষের মধ্যে অমানুষের নিষ্ঠুর আচরণের এতসব খবর আমাদের চোখের সামনে ভেসে ওঠে। এসব যুক্তি মেনে নিলেও বলতে হয়, নিকৃষ্ট ঘটনাগুলোর হার অনেকগুণ বেড়ে গেছে। ৫০-৬০ বছর আগে গণমাধ্যমের এত বিশাল ব্যাপকতা ছিল না।
কিন্তু চারপাশের ৫-১০ গ্রামে কোনো লোমহর্ষক ঘটনা ঘটলে তার খবর এক কান অন্য কান হয়ে অবশ্যই নিজ কানে এসে পৌঁছে যেত। আমার ছোটবেলা কিংবা তরুণ বয়সের অভিজ্ঞতা আমাকে স্পষ্ট করে দেয় ওই সময়ে এমন নিষ্ঠুর ঘটনা কদাচিৎ ঘটত। কোনো গ্রামে খুনের ঘটনা ঘটলে, যার বেশিরভাগই ঘটত জমিজমা নিয়ে, সে গ্রামে মাত্র দু’জন লাল পাগড়িধারী মানুষ আসছে শুনে গ্রামের সব মানুষ ভয়ে পালিয়ে যেত।
লাল পাগড়িধারীরা ছিল সে সময়ের পুলিশ। আর এখন রাস্তার পাশে কিংবা ডোবার মধ্যে লাশ পড়ে থাকলেও গ্রামের মানুষকে নির্বিকার থাকতে দেখি। পুলিশের আগমনে পালিয়ে যাওয়া তো দূরের কথা, মানুষের মধ্যে ভয়ডর বলতে কিছুই দেখা যায় না। সেকালে ছিনতাই নামক অপরাধটির কথা আমরা জানতামই না। হ্যাঁ, এ কথা সত্য যে কালেভদ্রে চুরি-ডাকাতির ঘটনা ঘটত।
ডাকাতির তুলনায় চুরির ঘটনাই বেশি ঘটত। সিঁদেল চোরদের কথা আমরা শুনতাম। ওরা মাটির মেঝের একপাশে গর্ত খুঁড়ে গভীর রাতে চুরি করার জন্য গৃহস্থের ঘরে ঢুকত।
গৃহস্থবাসীরা যখন ঘুমের ঘোরে অচেতন তখন ওরা নীরবে চুরির কাজটি সম্পন্ন করত। শুনে মজা পেতাম, চোর গায়ে প্রচুর সরিষার তেল মেখে চুরি করতে আসত। দৈবাৎ গৃহস্থ জেগে উঠে চোরটিকে জড়িয়ে ধরতে পারলে চোরটি যেন পিছলে পালিয়ে যেতে পারে। এমনটিই ছিল সে সময়ের অপরাধচিত্র।
আর আজকাল দিনদুপুরে খুন-খারাবি করতেও অপরাধীদের কোনো ভয়ডর লাগে না। অনেক সময় এসব দুর্বৃত্ত প্রকাশ্যে ঘোষণা দিয়ে অপরাধে লিপ্ত হয়। সেই অপরাধের সঙ্গে নিষ্ঠুরতাও হয়ে পড়ে প্রায় নিত্যসঙ্গী। ভিকটিমকে খুন করে তার লাশ টুকরো টুকরো করে ফেলতে দুর্বৃত্তরা দ্বিধা করে না।
এমনসব ঘটনা অহরহই ঘটছে। মহামারীর মতো নিষ্ঠুর, নির্মম ও নির্দয় অপরাধের এত বিস্তার কেন এখন হচ্ছে, সেটা এক বড় প্রশ্ন।
বাংলাদেশের সমাজে এখন আমরা যে নিষ্ঠুরতার প্রাবল্য লক্ষ্য করছি সেটা কি অহড়সরব-এর ধারণা দিয়ে ব্যাখ্যা করা যায়? এ ধারণাটি প্রথম উল্লেখ করেছিলেন ফরাসি দার্শনিক জ্যাঁ মেরি গুইয়ো (১৮৫৪-৮৮)। তিনি The Non-religion of the Future নামে একটি গ্রন্থ রচনা করেছিলেন।
এ গ্রন্থে কীভাবে একটি সমাজ সুনির্দিষ্ট আইন ছাড়া চলে তার ব্যাখ্যা করেছেন। তার এ ধারণা ফরাসি সমাজতত্ত্ববিদ এমিল দুরখিম তার Division of Labor in Society গ্রন্থে আরও সম্প্রসারিত করেছেন।
সামন্তবাদী ইউরোপীয় সমাজে যখন সংঘবদ্ধ গিল্ড শ্রমিকরা উদীয়মান মধ্যবিত্তের চাহিদা ক্রমান্বয়ে পূরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছিল, তখন মনে করা হতো আলস্য ও অভ্যাসের দাসে পরিণত হওয়ায় তারা পরিবর্তনের ক্ষমতা হারিয়ে ফেলেছিল এবং শিল্পায়িত সমাজের সঙ্গে খাপ খাওয়াতে পারছিল না।
এ অবস্থায় সব সামাজিক রীতিনীতি বিভ্রান্ত ও অস্পষ্ট হয়ে পড়েছিল। এরকম সমাজকে দুরখিম Normlessness অর্থাৎ নীতিনৈতিকতাহীন বলে উল্লেখ করেছিলেন। অর্থনৈতিক নিয়ন্ত্রণমুক্ত অবস্থা যখন বাধামুক্ত হয়ে পড়ে, তখন এমন এক অবস্থার উদ্ভব হয় যখন সামাজিক নীতিগুলো সমাজের কর্মকাণ্ডের জন্য আর কার্যকর থাকে না।
ব্যক্তির ক্ষেত্রে এ নীতিহীনতা চরম আত্মবিধ্বংসী হয়ে ওঠে। যাতে মানুষ নিজেই নিজের ক্ষতি করতে দ্বিধাবোধ করে না। এ ব্যাপারটি দুরখিম তার বিখ্যাত ঝঁরপরফব গ্রন্থে বিশ্লেষণ করেছেন। পরবর্তীকালে মার্কিন সমাজতত্ত্ববিদ রবাট ম্যাকাইভার ব্যক্তিকে ‘এনোমি’ আক্রান্ত হিসেবে চিহ্নিত করেছেন।
এরকম ব্যক্তিরা সমাজের প্রতি কোনো বন্ধন অনুভব করে না। এরকম অবস্থায় একটি শিল্পায়িত সমাজ অনির্দিষ্টকালের জন্য রুগ্ন হয়ে পড়ে। বাংলাদেশে ১৯৭১-এর পর এমন সামাজিক পরিবর্তন এসেছে বা আসছে যেগুলোর সঙ্গে নিষ্ঠুর আচরণে মগ্ন ব্যক্তিরা খাপ খাওয়াতে না পেরে এমন সব পাপাচারে লিপ্ত হচ্ছে।
এ দেশে গভীর সামাজিক অধ্যয়ন ও গবেষণা হয় না। যদি হতো তাহলে আমরা সমাজের ব্যক্তি সদস্যরা কেন এত নির্দয় ও নিষ্ঠুর হয়ে উঠছে তা বুঝতে পারতাম।
এবার আসা যাক রাষ্ট্রের প্রসঙ্গে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব হল Normlessness-এর জায়গায় Norm প্রতিষ্ঠা করা। কিন্তু রাষ্ট্রই যদি Normlessness-এর আবর্তে বন্দি হয়ে যায়, তাহলে norm প্রতিষ্ঠা করবে কে? যে রাষ্ট্র গুম, খুন, বিচারবহির্র্ভূত হত্যাকাণ্ড এবং বিচারহীনতার সংস্কৃতিতে জড়িয়ে পড়ে সে রাষ্ট্রের পক্ষে সমাজকে Normlessness থেকে norm-এ ফিরিয়ে আনা প্রায় অসম্ভব।
বস্তুত রাষ্ট্রীয় সংস্থার Normlessness সমাজের ব্যক্তি সদস্যদের Normless হতে উৎসাহিত করে। এর ফলে সামাজিক বন্ধনের আর কোনো কিছুই অটুট থাকে না।
এবার আসা যাক চূড়ান্ত প্রশ্নে। কেন জনগণ সংঘবদ্ধ হয়ে অন্যায়ের প্রতিবাদ করে না। সরকারের আনুকূল্য লাভকারী কিছু লোক ঊনসত্তরের মতো প্রতিবাদ-প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারার জন্য বিরোধী মতের লোকদের প্রায়ই উপহাস বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্য করে থাকেন। কিন্তু এ ক্ষেত্রেও গভীর বিশ্লেষণের প্রয়োজন আছে।
ইংরেজি ভাষায় Afraid of one's own shodwo বলে একটি বচন চালু আছে। এ বচনটির অর্থ হল মানুষ ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে এমন নির্বাক ও সাহসহীন হয়ে পড়ে যে, সে তার নিজের ছায়াকেই ভয় পায়। দার্শনিক প্লেটোও এরকম ভয়-ভীতিকর অবস্থার কথা বলেছিলেন।
হ্যানরি ডেভিড থোরু কনকর্ডের নগর প্রতিনিধিদের জন ব্রাউনের ফাঁসিতে নগরীর ঘণ্টা বাজাতে সাহস করেনি বলে উল্লেখ করেছেন। রাষ্ট্রের নাগরিকরা যখন সমাজ ও রাষ্ট্রের Normlessness-এর কারণে ভীতসন্ত্রস্ত হয়ে কোনো অন্যায়ের বিরুদ্ধে টুঁ-শব্দটি করতে চান না, তখন সব ধরনের সামাজিক নৈরাজ্য ও নিষ্ঠুরতা বল্গাহীনভাবে বিস্তৃতি লাভ করে। অর্থাৎ কেউ নিরাপদ বোধ করে না। সবাই নিজের ছায়াকেও ভয় পায়।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন