স্যার উইলিয়াম পেটি ছিলেন সপ্তদশ শতাব্দীতে ইংল্যান্ডের একজন স্বনামধন্য পণ্ডিত ব্যক্তি। তার জন্ম ২৬ মে ১৬২৩ ও মৃত্যু ১৬ ডিসেম্বর ১৬৮৭। তিনি ছিলেন একাধারে অর্থনীতিবিদ, চিকিৎসক, বিজ্ঞানী ও দার্শনিক। তিনি কিছুকালের জন্য ইংল্যান্ডের পার্লামেন্টের সদস্য ছিলেন। জ্ঞানী ব্যক্তি হওয়ায় তাকে রয়েল সোসাইটির চার্টার মেম্বারও করা হয়।
বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী এই মানুষটি অর্থনৈতিক তত্ত্বে অবদান রাখার জন্য এবং রাজনৈতিক পাটিগণিতের পদ্ধতি সৃষ্টির জন্য আজও আলোচিত হন। উইলিয়াম পেটির মতো ব্যক্তির লেখা পড়লে বিস্মিত হতে হয়! সেকালে ইউরোপের পণ্ডিত ব্যক্তিরা একাধিক শাস্ত্রে ব্যুৎপত্তি সম্পন্ন ছিলেন। আজকের স্পেশালাইজেশনের এই যুগে খুব কম মানুষই পাওয়া যাবে যারা একাধিক শাস্ত্রের চর্চা করেন।
উইলিয়াম পেটির দুটি উক্তি পাশাপাশি রেখে আলোচনা করলে বোঝা যাবে কেন কানেক্টিভিটি (connectivity) যুগপৎ হতে পারে কল্যাণকর এবং ঝুঁকিপূর্ণও বটে। পেটি বলেছেন, If caravans don't move, the soldiers will march. তার আরেকটি উক্তি হচ্ছে, Every seaman is not only a navigator, but merchant and also a soldier. তার প্রথম উক্তিটির সরল অনুবাদ করলে অর্থ দাঁড়াবে, যদি বাণিজ্যের কাফেলা অগ্রসর হতে না পারে তাহলে সৈন্যরা এগিয়ে আসবে।
দ্বিতীয় উক্তিটির অর্থ দাঁড়ায়, প্রত্যেক নাবিকই একাধারে একজন নেভিগেটর, ব্যবসায়ী এবং সৈনিক। পেটি কেন এরকম দুটি গুরুত্বপূর্ণ উক্তি করেছিলেন তা খোলাসা করে বলা প্রয়োজন।
পেটির সময়ে মনে করা হতো বাণিজ্যিক সম্পর্ক না থাকলে রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধ অনিবার্য হয়ে ওঠে। বাণিজ্য সম্পর্কের বন্ধনে আবদ্ধ দেশগুলো একে অপরের দ্বারা উপকৃত হয়। তাই তাদের মধ্যে যুদ্ধ বাধার সম্ভাবনা হ্রাস পায়। আবার অন্যদিকে আমরা জানি পেটির জীবনকালে ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি, ইন্দো-ডাচ কোম্পানি এবং ইন্দো-ফরাসি কোম্পানি ইউরোপ থেকে অনেক দূরের দেশ ভারতবর্ষ এবং তার আশপাশের দেশগুলোতে বাণিজ্যের একচেটিয়া কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে মরিয়া হয়ে উঠেছিল।
সুতরাং এই সামুদ্রিক বাণিজ্যে নিয়োজিত কোম্পানিগুলো একে অপরের সঙ্গে কখনও কখনও মরণপণ যুদ্ধে অবতীর্ণ হতো। শুধু তাই নয়, বাণিজ্য করার, বিশেষ করে শুল্কমুক্ত বাণিজ্য করার জন্য এরা এই অঞ্চলের রাজা-মহারাজা, নবাব-বাদশাদের সঙ্গে সুসম্পর্ক স্থাপনেরও চেষ্টা করত। যা ছিল এক ধরনের কূটনীতি। আবার এই অঞ্চলে ক্ষমতার দ্বন্দ্ব-বিরোধে এই কোম্পানিগুলো কোনো না কোনো রাজা-নবাব অথবা তাদের প্রতিপক্ষের সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্কে আবদ্ধ হতো।
নবাব সিরাজউদ্দৌলার বিরুদ্ধে লর্ড ক্লাইভ মীর জাফর গোষ্ঠীর সঙ্গে মিত্রতার সম্পর্কে মিলিত হয়। অন্যদিকে নবাব সিরাজউদ্দৌলা ফরাসি কোম্পানির কাছ থেকে সাহায্যের প্রত্যাশা ব্যক্ত করেছিলেন। ক্ষমতা-দ্বন্দ্বের এরকম জটিল সম্পর্কে জড়িয়ে পড়ার ফলে এসব বাণিজ্য কোম্পানির নাবিকরা একাধারে হতো নৌবহর পরিচালনাকারী, ব্যবসায়ী এবং সৈনিক। সে সময়ে বাণিজ্য বহরগুলো যুদ্ধাস্ত্রে সজ্জিত থাকত। তাই দেখা যাচ্ছে, বাণিজ্য যেমন হতে পারে শান্তিরক্ষার হাতিয়ার, আবার হতে পারে যুদ্ধের ইন্ধনদাতা।
বর্তমান যুগে বিশ্বায়নের ফলে নানা ধরনের বাণিজ্য জোট গঠনের উদ্যোগ আমরা লক্ষ করছি। বাণিজ্য ছাড়াও এসব জোটের লক্ষ্য বিনিয়োগসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে সম্পর্কের উন্নতি ঘটানো। অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, প্রতিদ্বন্দ্বিতার চেয়ে সহযোগিতার নীতি শ্রেয়। কারণ এর ফলে সব পক্ষই উপকৃত হতে পারে।
বিভিন্ন জোট, আঞ্চলিক জোট এবং উপ-আঞ্চলিক জোটের মাধ্যমে জোটবদ্ধ দেশগুলো একে অপরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ মসৃণ, সহজগম্য এবং সময়সাশ্রয়ী করে অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধ হতে পারে। এই সমৃদ্ধি আসে বাজার সম্প্রসারণ, পর্যটনের বিকাশ, কলকারখানা স্থাপন, উৎপাদন ও বিপণন ব্যয় হ্রাস এবং যাতায়াত সহজীকরণের মাধ্যমে। এ কারণেই আধুনিক অর্থনীতিতে কানেকটিভিটির বিষয়টি বহুলভাবে আলোচিত হচ্ছে।
বেল্ট অ্যান্ড রোড নামে গণচীনের মহা উদ্যোগটি নানা দৃষ্টিকোণ থেকে আলোচিত হচ্ছে। বিশ্বের শতাধিক দেশ এই উদ্যোগে শামিল হয়েছে। গণচীন বলছে, এ যাবৎকালে দেশটি অর্থনৈতিকভাবে যে সমৃদ্ধি অর্জন করেছে সেটি সে অন্য দেশগুলোর সঙ্গেও ভাগ করে নিতে চায়।
মনে হচ্ছে, একবিংশ শতাব্দীতে সর্বহারার আন্তর্জাতিকতাবাদ সমৃদ্ধির আন্তর্জাতিকতাবাদের রূপ ধারণ করতে যাচ্ছে। অনেকে আবার চীনের এই উদ্যোগকে কিছুটা সন্দেহের চোখেও দেখছেন। তারা মনে করেন, উদীয়মান চীন তাদের বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগ বিশ্বজুড়ে একাধিপত্য প্রতিষ্ঠার জন্যই ব্যবহার করবে।
চীনের উদ্যোগটি যদি এতই খারাপ হয় তাহলে বিশ্বের এতগুলো দেশ কেন তাতে শামিল হতে চাইছে? আইএমএফের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৫০ সালের মধ্যে চীন হয়ে উঠবে বিশ্বের এক নম্বর অর্থনৈতিক শক্তি। একই সময়ে ভারতের অবস্থান হবে দ্বিতীয় এবং মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের হবে তৃতীয়।
বাংলাদেশ বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগে শামিল হয়েছে ইঈওঘ উদ্যোগের মাধ্যমে। এর পাশাপাশি বাংলাদেশ আরও একটি উদ্যোগে শামিল হয়েছে। এই উদ্যোগটির নাম হল ইইওঘ, অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া ও নেপাল। ভুটান এই উদ্যোগে এখনও আনুষ্ঠানিকভাবে শামিল হয়নি।
ভুটান মনে করে, এই উদ্যোগে শামিল হলে তার পরিবেশ ও প্রকৃতি ক্ষতিগ্রস্ত হবে। ফলে ভুটানের গ্রস ন্যাশনাল হ্যাপিনেস বৃদ্ধির লক্ষ্য ব্যাহত হবে। বাংলাদেশের বিবিআইএনে শামিল হওয়া নিয়ে চীনের কোনো আপত্তি নেই, যদিও এই উদ্যোগে ভারত একটি বিশাল ও শক্তিশালী পক্ষ। চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং স্পষ্ট করে দিয়েছেন, চীন বেল্ট অ্যান্ড রোড উদ্যোগের বহির্ভূত অন্যান্য সহযোগিতামূলক উদ্যোগকে নেতিবাচকভাবে দেখে না।
এখন দেখা যাক, বিবিআইএন উদ্যোগের সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জগুলো কী। এই উদ্যোগ সফল হলে সংশ্লিষ্ট দেশগুলো বাণিজ্য, বিনিয়োগ, পর্যটন এবং বিদ্যুৎ শক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে বহুবিধ সুবিধা অর্জন করবে। কিন্তু প্রশ্ন জাগে বিবিআইএন উদ্যোগের প্রকৃত সাফল্য অর্জনের সম্ভাবনা নিয়ে।
বিবিআইএন উদ্যোগটি ২০১৫ সালে বাংলাদেশ, ভুটান, ইন্ডিয়া এবং নেপালের মধ্যে মোটর ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্ট রূপে স্বাক্ষরিত হয়। এর ফলে নেপাল ও ভুটানের মতো ভূবদ্ধ দেশগুলো ভারত ও বাংলাদেশের বন্দর বাণিজ্যের জন্য ব্যবহার করতে পারবে। মোটর ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্ট বাণিজ সুবিধা বৃদ্ধিতে তখনই সফল হবে যখন অংশগ্রহণকারী দেশগুলোর প্রত্যেকের জন্য সুবিধাজনক বাণিজ্য চুক্তি স্বাক্ষরিত হবে। কিন্তু বিদ্যমান বাণিজ্য চুক্তিগুলোর স্বরূপ কী?
সার্কভুক্ত দেশগুলোকে নিয়ে সাফটা চুক্তি এখন পর্যন্ত সত্যিকারের মুক্ত বাণিজ্যের চেতনায় বাস্তবায়িত হয়নি। দ্বিপাক্ষিক বাণিজ্যিক চুক্তিগুলো এখন পর্যন্ত অসন্তোষজনক। ভারতের সঙ্গে নেপালের বাণিজ্য ভারসাম্যহীনতা বিরাজ করছে। কারণ ভারত এ ক্ষেত্রে অশুল্ক বাধা সৃষ্টি করছে। বাংলাদেশের ক্ষেত্রেও একই সমস্য বিদ্যমান। নেপাল ভারতের সঙ্গে ভারসাম্যপূর্ণ বাণিজ্যের জন্য দেনদরবার করছে।
মোটর ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্ট সফল করার জন্য প্রয়োজন অংশগ্রহণকারী দেশগুলোতে বাণিজ্যের পকেটগুলো চিহ্নিত ও উন্নত করা। এগুলো কি চিহ্নিত হয়েছে? প্রশ্ন ওঠে, কী ধরনের পণ্য উৎপাদিত হবে এবং বাণিজ্যের অন্তর্ভুক্ত হবে? যেসব সড়ক দিয়ে আন্তঃদেশীয় যোগাযোগ হওয়ার কথা সেগুলো কি আন্তর্জাতিক মানের উন্নত? এগুলোকে উন্নত করার জন্য কে বিনিয়োগ করবে? এই বিনিয়োগ কি অর্থনৈতিকভাবে যৌক্তিক হবে? কীভাবে লেনদেনের জন্য ব্যবহৃত মুদ্রার প্রশ্নটির সফল সমাধান হবে?
এই উদ্যোগ সফল করার জন্য প্রয়োজন একটি সহায়ক ট্রানজিট চুক্তি। নেপাল ও ভারতের মধ্যে বিদ্যমান ট্রানজিট চুক্তিটি নানা বাধা-বিপত্তিতে আকীর্ণ। এই চুক্তির ফলে নেপাল কেবল কলকাতা ও ভিশাখাপত্তম বন্দরের মাধ্যমে বহির্বাণিজ্য করতে পারে। এমন কোনো ট্রানজিট চুক্তি কি স্বাক্ষরিত হবে, যার ফলে পণ্যসামগ্রী অবাধে বিবিআইএনের অন্তর্ভুক্ত সব দেশের মধ্যে বেচা-কেনা হতে পারবে।
মোটর ভেহিক্যাল এগ্রিমেন্টে যে সড়ক চিহ্নিত করা হয়েছে, সেই সড়কটি ভারতের অতি স্পর্শকাতর এলাকার মধ্য দিয়ে গেছে। যার নাম হল ‘চিকেন নেক’। এ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট পক্ষগুলো কিভাবে সীমান্ত ব্যবস্থাপনা করবে এবং নিজ নিজ নিরাপত্তাসংশ্লিষ্ট উদ্বেগগুলো নিরসন করবে? ভুটানের সংসদ নানা ধরনের উদ্বেগের কথা উল্লেখ করে চুক্তিটি র্যাটিফাই করতে অসম্মত হয়েছে। প্রশ্ন দাঁড়ায়, কীভাবে অন্য পক্ষগুলো একই ধরনের উদ্বেগের সমাধান করবে।
বিবিআইএনের সাফল্য অনেকটাই নির্ভর করছে ভারত কীভাবে এটি নিয়ে অগ্রসর হবে? ভারতই প্রথম এ ব্যাপারে উদ্যোগ নিয়েছিল। এখন ভারতের কর্তব্য হল তার প্রস্তাব যাতে বাস্তবায়িত হয় সে চেষ্টা করা। এর অর্থ দাঁড়ায় ভরতকেই বিবিআইএনের অন্তর্ভুক্ত দেশগুলোতে অবকাঠামো নির্মাণের অর্থায়নের মডেল দাঁড় করাতে হবে।
এই লক্ষ্যে ভারতকে একটি তহবিল গঠন করতে হবে। কারণ ভারত ছাড়া অন্য দেশগুলো অর্থনৈতিকভাবে তুলনামূলকভাবে অনেক বেশি দুর্বল। যদি এসব দেশের জনগণ কৃষি ও কৃষি প্রক্রিয়াকরণ শিল্প স্থাপনের জন্য আর্থিক সহযোগিতা পায়, তাহলেই কেবল মোটর ভেহিক্যালস এগ্রিমেন্টকে পরবর্তী ধাপে উন্নীত করা সম্ভব হবে। প্রশ্ন দাঁড়ায় এ ব্যাপারে কতটা ভরসা পাওয়া যায়? আরও প্রশ্ন হল, ভারত কি চীনের প্রভাব খর্ব করতে এই উদ্যোগ নিয়েছে?
এই আলোচনার পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, সংকীর্ণ জাতীয়তাবাদী চিন্তাভাবনার কাঠামোর মধ্যে কানেকটিভিটির উদ্যোগ হয়তো বারবার হোঁচট খেতে থাকবে। বহুল কাক্সিক্ষত সর্বজনীন কল্যাণ হয়ে পড়তে পারে সুদূরপরাহত।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
সংশোধনী : গত রোববার প্রকাশিত ‘শতফুল ফুটতে দাও’ কলামে অসাবধানতাবশত একটি ভুল হয়েছে। ছাপা হয়েছে, ‘‘আহমদ শরীফ সম্পাদিত বাংলা একাডেমি সংক্ষিপ্ত বাংলা অভিধানে ‘মঙ্গা’ শব্দটি আছে।’’ আসলে এই অভিধানে ‘মঙ্গা’ শব্দটি নেই।
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন