নাড়ির সম্পর্কই অকৃত্রিম
05 May 2018, Saturday
উত্তর কোরিয়া (সঠিক রাষ্ট্রীয় নাম ডেমোক্রেটিক পিপলস রিপাবলিক অফ কোরিয়া) বিগত দিনগুলোতে যখন একের পর এক ক্ষেপণাস্ত্র পরীক্ষা চালাচ্ছিল, তখন কোরীয় উপদ্বীপে উত্তেজনা এমন পর্যায়ে পৌঁছে গিয়েছিল যাতে মনে হচ্ছিল এ যাত্রা বোধহয় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধ বেধেই যাবে।
ক্ষেপণাস্ত্রগুলোর টার্গেট ছিল কখনও জাপান, কখনও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মালিকানাধীন গুয়াম দ্বীপ এবং সর্বশেষে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মূল ভূখণ্ড। এক পর্যায়ে এ রাষ্ট্রটি খুব শক্তিশালী হাইড্রোজেন বোমার বিস্ফোরণ ঘটিয়েও পরীক্ষা চালায়। পর্যবেক্ষকদের ধারণা, বোমাটিকে হাইড্রোজেন বোমা বলা হলেও তা ছিল একটি আণবিক বোমা।
এ রকম উত্তেজনাকর পরিস্থিতিতে যুগান্তরের পাতায় একটি বিশ্লেষণধর্মী কলাম লিখে আমি উপসংহারে পৌঁছেছিলাম, এরকম ভীতি সৃষ্টি করে উত্তর কোরিয়া তার প্রতিপক্ষদের কাছ থেকে কিছু সুবিধা আদায় করে ক্ষান্ত হবে। তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের মতো কোনো ঘটনা ঘটবে না।
গত শুক্রবার উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার শীর্ষ নেতারা দুই কোরিয়ার সীমান্তবর্তী গ্রাম পানমুনজমে এক বৈঠকে মিলিত হন। এ বৈঠকে তাদের হৃদ্যতাপূর্ণ আলোচনা হয় এবং উভয়ের মুখেই ছিল আন্তরিক হাসির ছাপ। এ প্রথমবার উত্তর কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতা সীমান্তরেখা পাড়ি দিয়ে পা রাখলেন দক্ষিণ কোরিয়ার মাটিতে।
এ সময় একে অপরের হাত ধরে চলছিলেন। উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং মুন ও দক্ষিণ কোরিয়ার প্রেসিডেন্ট মুন জে-ইন সীমান্তবর্তী গ্রামের পিস হাউসে ঐতিহাসিক বৈঠকে মিলিত হন। দুই দফা বৈঠকের পর যৌথ ঘোষণায় তারা ৬৮ বছরের যুদ্ধের ইতি টানার ও কোরীয় উপদ্বীপকে পরমাণু অস্ত্রমুক্ত করার ঘোষণা দেন।
উল্লেখ্য, ১৯৫১ থেকে ১৯৫৩ পর্যন্ত কোরীয় উপদ্বীপে এক রক্তক্ষয়ী যুদ্ধ হয়েছিল। যুদ্ধটি হয়েছিল কমিউনিস্টপন্থী ও কমিউনিস্টবিরোধী বাহিনীর মধ্যে। তখন কমিউনিস্টপন্থীদের নেতৃত্বে ছিলেন কিম ইল সুং। কিম ইল সুং সোভিয়েত ইউনিয়ন ও চীনের সমর্থন লাভ করেছিলেন। চীন ভলন্টিয়ার ফোর্স পাঠিয়ে এ যুদ্ধে অংশগ্রহণ করে।
সবেমাত্র তখন চীনে মাও জে ডং-এর নেতৃত্বে কমিউনিস্ট বিপ্লব সম্পন্ন হয়েছিল। নব প্রতিষ্ঠিত চীন গণপ্রজাতন্ত্র অন্য যে কোনো বিশ্বশক্তির তুলনায় ভঙ্গুর অবস্থায় ছিল। দীর্ঘদিনের সশস্ত্র সংগ্রামের মধ্য দিয়ে চীনবিপ্লব সম্পন্ন হয়েছে। ১৯৪৯-এর ১ অক্টোবর বিপ্লবের নেতা মাও জে ডং ঘোষণা করেছিলেন, চীন এখন উঠে দাঁড়িয়েছে।
যখন চীনের ঘর গোছানোর পালা, তখন চীনকে জড়িয়ে পড়তে হল প্রতিবেশী কোরিয়ার কমিউনিস্টদের পক্ষ নিয়ে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে। এ যুদ্ধে মাও জে ডং-এর এক পুত্র সন্তানও নিহত হয়েছিলেন। অপরদিকে কমিউনিস্টবিরোধীদের পক্ষ নিয়েছিল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। শান্তির নামে জাতিসংঘের পতাকা ব্যবহার করে মার্কিনি সেনারাও এ যুদ্ধে অংশ নিয়েছিল।
শেষ পর্যন্ত ৩৮ ডিগ্রি দ্রাঘিমায় কোরিয়াকে বিভক্ত করে যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করা হয়। কোরিয়ার উত্তর অংশ চলে যায় কমিউনিস্টদের নিয়ন্ত্রণে এবং দক্ষিণ অংশ কমিউনিস্টবিরোধীদের হাতে। অস্ত্রবিরতি হলেও যুদ্ধবিরতি হয়নি। এক ধরনের যুদ্ধাবস্থা বিরাজ করছিল গত ৬৮ বছর ধরে।
উত্তর কোরিয়াকে মার্কিন নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়তে হয়েছিল। এক সময়কার মার্কিন প্রেসিডেন্ট জর্জ বুশ উত্তর কোরিয়াকে শয়তানের অক্ষশক্তির সদস্য বলেও নিন্দা করেছিলেন। কার্যত বহির্বিশ্বের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়া উত্তর কোরিয়াকে ভয়ঙ্কর ধরনের অর্থনৈতিক দুর্যোগের কবলে পড়তে হয়েছিল।
পশ্চিমা সংবাদমাধ্যমে উত্তর কোরিয়ায় দুর্ভিক্ষ ও অনাহারের খবর প্রকাশ করা হচ্ছিল। অনাহার-দুর্ভিক্ষ সেখানে কতটা প্রবল ছিল তা বাস্তবে কখনই যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে এটুকু বোঝা যায় অবরোধের কবলে পড়লে যে কোনো দেশের অবস্থা সঙ্গিন হতে পারে।
অবরোধ কার্যকর করার জন্য চাপ এতই প্রবল ছিল যে, প্রতিবেশী বন্ধুরাষ্ট্র চীনকেও এই অবরোধে অনিচ্ছা সত্ত্বেও শামিল হতে হয়। শেষ দিকে চীন উত্তর কোরিয়াতে জ্বালানি সরবরাহ কমিয়ে দিয়েছিল।
প্রতিকূল আন্তর্জাতিক ও অর্থনৈতিক অবস্থার মধ্যে উত্তর কোরিয়া কী করে ক্ষেপণাস্ত্র ও পারমাণবিক বোমা তৈরির প্রযুক্তি আয়ত্ত করল সে এক বিস্ময়ের ব্যাপার। সেই রহস্য হয়তো ভবিষ্যতে কোনোদিন উন্মোচিত হবে। চরম উত্তেজনাকর পরিস্থিতির মধ্যে উত্তর কোরিয়ার নেতা ঘোষণা করেছিলেন, তার আঙুলের নিচেই রয়েছে পারমাণবিক বোমার সুইচটি। এ ঘোষণার জবাবে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বললেন তার আঙুলের নিচে রয়েছে আরও বড় সুইচ।
দৃশ্যপটের নাটকীয় পরিবর্তন ঘটল। উত্তর কোরিয়ায় গিয়ে সিআইএ প্রধান হঠাৎ করে উত্তর কোরিয়ার রাজধানী পিয়ং ইয়ং-এ গেলেন। তারপরেই জানা গেল উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উনের সঙ্গে বৈঠকে মিলিত হবেন। এ বৈঠকটি মে মাসের শেষ দিকে অথবা জুন মাসে অনুষ্ঠিত হতে পারে।
উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার সর্বোচ্চ নেতাদের মধ্যে বৈঠকের পর ট্রাম্পের সঙ্গে কিমের বৈঠকের বিষয়টি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে অন্যতম আলোচনার বিষয়ে পরিণত হয়েছে। গত শুক্রবার ট্রাম্প দফায় দফায় উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতাদের বৈঠক নিয়ে টুইট করেছেন, ‘অত্যন্ত ইতিবাচক’ মন্তব্য করেছেন।
কিমের সঙ্গে তার সাক্ষাতের বিষয়টি নিয়ে কথা বলতেও ভোলেননি। ওয়াশিংটন সফররত জার্মানির চ্যান্সেলর অ্যাঙ্গেলা মার্কেলের সঙ্গে যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ট্রাম্প বলেন, কিমের সঙ্গে তার সম্ভাব্য সাক্ষাতের স্থান-তালিকায় যে দেশগুলো ছিল তার সংখ্যা ২টিতে কমে এসেছে। তবে বৈঠকের স্থান হিসেবে সিঙ্গাপুরই শেষ পর্যন্ত বেছে নেয়া হতে পারে।
দুই কোরিয়ার কাছাকাছি আসার এই প্রক্রিয়ায় ক্রীড়াঙ্গনও ভূমিকা পালন করেছে। দক্ষিণ কোরিয়ায় অনুষ্ঠিত অলিম্পিকে উত্তর কোরিয়া একটি টিম পাঠিয়েছিল যার নেতৃত্ব দেন উত্তর কোরিয়ার নেতা কিমের বোন।
কিছু কিছু বিষয়ে উত্তর কোরিয়া ও চীনের মধ্যে মতপার্থক্য সত্ত্বেও গত মাসে উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম বেইজিংয়ে গিয়েছিলেন চীনের প্রেসিডেন্ট শি চিন পিং-এর সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে। এ সাক্ষাতে কিম পেয়েছেন উষ্ণ আতিথেয়তা। সবকিছু দেখেশুনে মনে হয় উত্তর কোরিয়ার অল্প বয়সী এই নেতা কূটনীতিতেও কম পারদর্শী নন।
উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার কাছাকাছি আসার পেছনে বড় ধরনের ভূমিকা পালন করেছেন দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা প্রধান সুহ হুন। দুই দেশের নেতারা যখন ঘোষণা দিচ্ছিলেন তখন সব ক্যামেরার ফোকাস ছিল ওই দুই নেতার ওপর।
তখন পাশেই একজন চোখের পানি লুকানোর চেষ্টা করছিলেন। তিনি আর কেউ নন, দক্ষিণ কোরিয়ার গোয়েন্দা প্রধান সুহ হুন। এই চোখের পানি আনন্দের এবং প্রায় দুই দশকের চেষ্টার পর ঐতিহাসিক অর্জনের। দুই কোরিয়ার মধ্যে বৈরিতার অবসান ঘটিয়ে সম্পর্ক উন্নয়নের জন্য সুহ হুন ১৮ বছর কাজ করেছেন। একজন গোয়েন্দা প্রধান এ রকম ভূমিকা পালন করবেন, তা বিশ্বাস করা যায় না। বিভক্তি সত্ত্বেও দুই কোরিয়া বরাবরই বলে এসেছে জাতীয় পুনঃএকত্রীকরণের ইচ্ছার কথা।
কোরিয়ার বিভক্তি শুধু একটি দেশকেই বিভক্ত করেনি, বিভক্ত করেছে অনেক পরিবারকে। তাই দুই কোরিয়ার মানুষের মধ্যে পুনরায় এক দেশে মিলিত হওয়ার আকাক্সক্ষা খুব প্রবল। উত্তর ও দক্ষিণ ভিয়েতনাম একত্রিত হয়েছে। বিভক্ত জার্মানি আবার একদেশে পরিণত হয়েছে। ভিয়েতনামের ক্ষেত্রে সমাজতান্ত্রিক ব্যবস্থার অধীনে।
জার্মানির ক্ষেত্রে বলা যায়, পূর্ব জার্মানিতে সমাজতন্ত্রের পতন ঘটিয়ে দুই জার্মানি মিলে এক পুঁজিবাদী জার্মানি হয়ে গেছে। এখন দেখার বিষয় দুই কোরিয়ার একদেশে পরিণত হওয়ার ফর্মুলাটি কী দাঁড়াচ্ছে। এটা কি হবে একদেশ, দুই ব্যবস্থা?
যেমনটি হয়েছে চীন ও হংকং-এর মধ্যে এবং ভবিষ্যতে হতে পারে চীন ও তাইওয়ানের মধ্যে। আজ যা অসম্ভব মনে হয়, কাল সেটাই হতে পারে নিরেট বাস্তবতা। এছাড়া দুই ধরনের আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থার যোগফলে এক ব্যবস্থায় কনভার্জেন্সের তত্ত্বও আমরা জানি। এ কনভার্জেন্সে দুই ব্যবস্থায় বিদ্যমান কিছু বৈশিষ্ট্য লোপ পায় এবং কিছু বৈশিষ্ট্য টিকে যায়। হয়ে ওঠে নতুন ধরনের এক ব্যবস্থা।
অনেক তিক্ততা ও বৈরিতার পরেও দুই কোরিয়া একে অপরের প্রতি হাত বাড়িয়ে দিয়েছে নাড়ির টানে। এই টান এবং এই আবেগ যে কত তীব্র হতে পারে সেটা বোঝা যায় দুই কোরিয়ার নেতাদের এক টেবিলে বসার আনন্দঘন মুহূর্ত দেখে। শুধু তাই নয়, দুই নেতা দেশের দুই অংশের মাটি দিয়েছে তাদের লাগানো গাছের মূলে। এর প্রতীকী তাৎপর্য অত্যন্ত গভীর। দক্ষিণ কোরিয়ার যে গোয়েন্দা প্রধান উত্তর কোরিয়ার সঙ্গে শান্তি স্থাপনের জন্য দীর্ঘদিন ধরে কাজ করেছেন তার পরিবারের একটি অংশ উত্তর কোরিয়াতে থাকে।
উত্তর কোরিয়ার নেতা কিম জং উন মারণাস্ত্র পরীক্ষা করে একটি বিশ্বযুদ্ধ বাধিয়ে দেবেন বলে মনে করা হচ্ছিল। আসলে সেটা তার মূল লক্ষ্য ছিল না। আপাতত মনে হচ্ছে তার লক্ষ্য ছিল তার দেশের ওপর থেকে অবরোধ প্রত্যাহার করিয়ে নেয়া এবং দেশটিকে সমৃদ্ধির পথে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু আবেদন-নিবেদন করে কিংবা করজোড়ে মিনতি করে এই লক্ষ্য অর্জন সম্ভব ছিল না। এই লক্ষ্য অর্জনের জন্যই তিনি সামরিক শক্তি সংহত করেছিলেন। আপস আলোচনা শক্তির অবস্থান থেকেই করতে হয়। দুর্বলকে কেউ পাত্তা দেয় না। বাংলাদেশ রোহিঙ্গা শরণার্থীদের নিয়ে যে সমস্যায় পড়েছে সেটা শক্তির অবস্থান থেকে মোকাবেলা করা হলে অনেক আগেই সমাধান হয়ে যেত বলে আমাদের
দেশের কোনো কোনো সমরবিশেষজ্ঞ মনে করেন। এর অর্থ এই নয় যে, যুদ্ধ করতে হবে। উত্তর কোরিয়া যুদ্ধ
করেনি। কিন্তু অনেক কিছু অর্জন করবে বলে মনে হয়। অবশ্য আন্তর্জাতিক অঙ্গনে প্রতিটি সমস্যার নিজস্ব কিছু বৈশিষ্ট্য থাকে, যেটি অন্য কোনো সমস্যার সঙ্গে
হুবহু এক রকম করে দেখা যায় না। আমাদের দেশের নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের অন্তত একজন মনে করেন, উত্তর ও দক্ষিণ কোরিয়ার নেতৃত্বের মধ্যে বৈঠক সম্ভব করতে
চীনের নীরব কূটনীতি কাজ করেছে। কূটনীতিতে নীরব ও সরব প্রক্রিয়ার সফল সম্মিলনই এনে দিতে পারে কূটনৈতিক সাফল্য।
ড. মাহবুব উল্লাহ: অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন