গান্ধীর সেই জবানবন্দি এখনও কত প্রাসঙ্গিক!
21 February 2018, Wednesday
ইতিহাসে যারা মহামানব হিসেবে গৌরব ও খ্যাতি অর্জন করেছেন, তাদের জীবন ও চিন্তাধারা সবসময় একই খাতে প্রবাহিত হয়নি। জীবনের রূঢ় বাস্তবতা এবং অভিজ্ঞতার আলোকে তাদের জীবনদর্শন ও কর্মকাণ্ডে আশ্চর্যজনক পরিবর্তন এসেছে।
প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতের জাতির জনক মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধীও এর ব্যতিক্রম ছিলেন না। আমাদের স্কুল, কলেজ ও শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে ইতিহাস পাঠ ও চর্চা খুবই সংক্ষিপ্ত করে ফেলা হয়েছে। যেটুকু ইতিহাস পাঠ এখনও বহাল আছে, সেটি কেবল একদেশদর্শী নয়, পরিধির দিক থেকেও অত্যন্ত সীমিত। ফলে যে নতুন প্রজন্ম আমাদের দেশে গড়ে উঠছে তারা ইতিহাসের বিশাল ক্যানভাসটি দেখতে পায় না। এবং তাদের চিন্তা-ভাবনাতেও দৈন্য গেড়ে বসে।
মোহন দাস করম চাঁদ গান্ধী, যিনি মহাত্মা গান্ধী হিসেবে সমধিক পরিচিত, ১৯২২ সালের ১৮ মার্চ আহমেদাবাদের জেলা ও দায়রা জজ মিস্টার ব্র“মফিল্ডের আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছিলেন, তা থেকেই বোঝা যায় কী কারণে তার চিন্তার জগতে বিশাল এক পরিবর্তন এসেছিল। আদালতের কাছে তিনি সগর্বে নিজেকে দোষী স্বীকার করেছিলেন। নিজেকে একজন রাষ্ট্রদ্রোহী হিসেবে পরিচয় দিতেও তিনি কুণ্ঠাবোধ করেননি।
আদালতে প্রদত্ত জবানবন্দি থেকে তার দৃঢ়প্রত্যয়ী এবং সাহসী চরিত্রটি ফুটে উঠেছিল। রাজক্ষমতার বিরুদ্ধে হিংসাত্মক প্রতিরোধের পথ বেছে নেননি বলে তার সমালোচকরা অনেক নিন্দা জ্ঞাপন করেছেন; কিন্তু তিনিও এক ধরনের অস্ত্র ধারণ করেছিলেন। সেই অস্ত্র হল অহিংসার অস্ত্র। তিনি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করতেন, অহিংসার অস্ত্র হিংসার অস্ত্র থেকে বহুগুণ শক্তিশালী হতে পারে। ইতিহাসের পাঠ ও চর্চা যতদিন অব্যাহত থাকবে, ততদিনই এ নিয়ে বিতর্ক চলবে। কিন্তু এর ফলে একজন মহান মানুষ হিসেবে তার শ্রেষ্ঠত্বে কমতি হবে না।
গান্ধী তার জবানবন্দিতে ওইসময় বলেছেন, ‘আমি ভারত ও ইংল্যান্ডের জনগণের কাছে দায়বদ্ধ। আমি তাদের শমিত করতে চাই এই বলে, কেন এই অভিযোগ উত্থাপন করা হয়েছে। আমার উচিত ব্যাখ্যা করা, কেন একজন দৃঢ় অনুগত এবং সহযোগী থেকে আমি একজন আপসহীন বিক্ষোভকারী এবং অসহযোগীতে পরিণত হলাম। আদালতের কাছে আমার বলা উচিত কেন আমি ভারতে আইনের দ্বারা প্রতিষ্ঠিত সরকারের বিরুদ্ধে বিদ্বেষ সৃষ্টি করছি।
১৮৯৩ সালে এক বৈরী পরিবেশে দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার জনজীবনের সূচনা হয়। ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আমার প্রথম যোগাযোগ সুখের ছিল না। আমি আবিষ্কার করলাম একজন মানুষ হিসেবে এবং একজন ভারতীয় হিসেবে আমার কোনো অধিকার নেই। অপরদিকে আমি আরও বুঝতে পারলাম, মানুষ হিসেবে আমার অধিকার না থাকার কারণ হল, আমি একজন ভারতীয়।
কিন্তু আমি আশ্চর্য হইনি। আমি ভাবলাম, ভারতীয়দের প্রতি এ আচরণ অন্তর্নিহিতভাবে এবং মূলত একটি ভালো ব্যবস্থার ওপর কালিমামাত্র। আমি সরকারকে স্বেচ্ছামূলক এবং হৃষ্টচিত্তে সহযোগিতা প্রদান করলাম। তখনই এর পূর্ণ সমালোচনা করেছি, যখন আমি অনুভব করেছি, এটি ত্রুটিপূর্ণ; কিন্তু কখনও ধ্বংস কামনা করিনি।
ফলত যখন ১৮৯৯ সালে বুওর চ্যালেঞ্জের ফলে সাম্রাজ্যের অস্তিত্ব বিপন্ন হয়ে পড়ে, আমি তখন এর প্রতি সেবার হাত বাড়িয়ে দেই এবং একটি স্বেচ্ছাসেবী অ্যাম্বুলেন্স কর্প্স গড়ে তুলি এবং বিভিন্ন জায়গায় কার্যক্রম গ্রহণ করি। একইভাবে ১৯০৬ সালে জুলু বিদ্রোহের সময় আমি একটি স্ট্রেচারবাহী দল গঠন করি এবং বিদ্রোহ অবসান পর্যন্ত এর জন্য কাজ করি। উভয় ক্ষেত্রেই আমি মেডেল পেয়েছি এবং এমনকি সংবাদ ভাষ্যে আমার নাম উল্লেখিত হয়েছে। দক্ষিণ আফ্রিকায় আমার কাজের জন্য লর্ড হার্ডিঞ্জ আমাকে কায়সারে হিন্দ্ পদক প্রদান করেন। ১৯১৪ সালে ইংল্যান্ড ও জার্মানির মধ্যে যুদ্ধ শুরু হলে আমি লন্ডনে একটি স্বেচ্ছাসেবী অ্যাম্বুলেন্স কপ্র্স গড়ে তুলি। এর জন্য কাজ করত লন্ডনে বসবাসরত ভারতীয়রা যাদের বেশিরভাগই ছিল ছাত্র। কর্তৃপক্ষ এর কাজকে মূল্যবান বলে স্বীকৃতি দিয়েছে। সর্বশেষে ১৯১৭ সালে লর্ড চেমস্ফোর্ড দিল্লিতে অনুষ্ঠিত যুদ্ধ সম্মেলন থেকে সেনা সংগ্রহের আবেদন জানালে ভগ্ন স্বাস্থ্য নিয়েও আমি খেদাতে একটি বাহিনী গড়ে তুলি। এই আহ্বানের প্রতি তখনই সাড়া দেয়া হয় যখন সংঘাতের অবসান ঘটে এবং হুকুম দেয়া হয় যে, আর অধিক সেনা সংগ্রহের প্রয়োজন নেই। এসব সেবাধর্মী প্রচেষ্টার মধ্য দিয়ে আমার এই বিশ্বাসের প্রতিফলন ঘটেছিল যে, সাম্রাজ্যে আমার দেশবাসীর জন্য সমতা অর্জনে এসব কাজে আসবে।
প্রথম মানসিক আঘাতটি আসে রাওলাট আইনের আকারে। এই আইনের উদ্দেশ্য ছিল জনগণের সব প্রকৃত স্বাধীনতা কেড়ে নেয়া। আমি অনুভব করলাম এর বিরুদ্ধে তীব্র বিক্ষোভে আমাকে নেতৃত্ব দিতে হবে।
তারপর ঘটল পাঞ্জাবের নৃশংসতা! জালিয়ানওয়ালা বাগের হত্যাকাণ্ড এবং তারপর প্রকাশ্যে বেত্রদণ্ড এবং অন্যান্য অবর্ণনীয় অপমানের ঘটনা ঘটতে থাকে। আমি আরও উপলব্ধি করলাম, ভারতের মুসলমানদের জন্য প্রধানমন্ত্রীর দয়ার্দ্র উক্তি অর্থাৎ তুরস্ক এবং ইসলামের পবিত্র স্থানগুলোতে সংরক্ষণ কার্যত বাস্তবায়িত হবে না। কিন্তু ১৯১৯ সালে অমৃতসর কংগ্রেসে আমার বন্ধুদের আবেদন-নিবেদন এবং মারাত্মক সাবধান বাণী সত্ত্বেও আমি সহযোগিতা এবং মন্টেগু-চেমসফোর্ড সংস্কারের পক্ষে লড়াই করি। আমার বিশ্বাস ছিল ভারতীয় মুসলমানদের প্রধানমন্ত্রী যে প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন তা তিনি পূরণ করবেন, পাঞ্জাবে ক্ষত দূর করবেন এবং সংস্কারগুলো অপূর্ণাঙ্গ এবং অসন্তোষজনক হওয়া সত্ত্বেও ভারতের জীবনে নতুন আশার যুগের সঞ্চার হবে।
কিন্তু সব আশা চূর্ণ-বিচূর্ণ হয়ে যায়। খেলাফতের প্রতিশ্রুতি পূরণ হওয়ার ছিল না। পাঞ্জাবের অপরাধের ওপর চুনকামের প্রলেপ দেয়া হয়। অনেক অপরাধী শাস্তি থেকে শুধু রেহাই পায়নি বরং তারা চাকরিতে বহাল আছে এবং কিছু ব্যক্তি ভারতীয় রাজস্ব থেকে পেনশন পেয়ে চলছে এবং কিছু কিছু ক্ষেত্রে তাদের পুরস্কৃতও করা হয়েছে। আমি আরও দেখলাম, সংস্কারের মধ্য দিয়ে অন্তরের কোনো পরিবর্তন এলো না। বস্তুত এগুলো ছিল ভারতের সম্পদ নিংড়ে নেয়ার পদ্ধতি মাত্র এবং এর দাসত্বকে প্রলম্বিত করা।
আমি অনিচ্ছা সত্ত্বেও এই উপসংহারে এলাম, ব্রিটিশদের সঙ্গে ভারতের যোগাযোগ একে অতীতের তুলনায় অনেক বেশি রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিকভাবে সহায়হীন করে তুলেছে। নিরস্ত্র ভারতের আগ্রাসনকারীদের বিরুদ্ধে যদি সে সশস্ত্র সংঘাতে জড়াতে চায়, এমন কোনো শক্তি তার নেই। অবস্থাটা এমন ছিল যে, আমাদের মধ্যকার কিছু মহান ব্যক্তি ভাবতে শুরু করলেন, ডমেনিয়ান মর্যাদা অর্জন করতে কয়েক প্রজন্ম নিঃশেষ হয়ে যাবে। সে এত দরিদ্র হয়ে পড়েছে যে দুর্ভিক্ষ প্রতিরোধের জন্য তার সামান্যই শক্তি আছে। ভারতের ব্রিটিশ শাসনের আগে লাখ লাখ কুটিরে সুতা কাটা হতো এবং কাপড় বুনা হতো সামান্য কৃষি সম্পদের সঙ্গে যোগ করার জন্য। ভারতের অস্তিত্বের জন্য অতি প্রয়োজনীয় কুটির শিল্পকে অবিশ্বাস্য হৃদয়হীন এবং অমানবিক প্রক্রিয়ায় ধ্বংস করা হয়েছে। ইংরেজ প্রত্যক্ষকারীরা এর বর্ণনা দিয়েছেন। শহরবাসীরা কমই জানে কীভাবে ভারতের অর্ধভুক্ত জনগণ প্রাণহীনতায় তলিয়ে যাচ্ছে। তারা যে দুঃখজনক আরাম-আয়েশ ভোগ করে তার উৎস হল বিদেশি শোষকদের জন্য কাজ করে দালালির অর্থ অর্জন এবং জনগণের কাছ থেকেই এই মুনাফা এবং দালালির অর্থ শুষে নেয়া। তারা খুব কমই উপলব্ধি করে যে ব্রিটিশ ভারতে আইনের দ্বারা যে সরকার গঠিত হয়েছে তার লক্ষ্য হল জনগণকে শোষণ করা। কোনো রকম ছলচাতুরী এবং পরিসংখ্যানের কারচুপি করে খোলা চোখে বহু গ্রামে যে কঙ্কালসার মানুষের অস্তিত্ব ধরা পড়ে তা মুছে ফেলা সম্ভব নয়। যদি আমাদের মাথার ওপরে কোনো ঈশ্বর থাকে, তাহলে ইংল্যান্ড এবং ভারতের শহরবাসীর ইতিহাসের এ নজিরবিহীন মানবতাবিরোধী অপরাধের জন্য জবাবদিহি করতে হবে। আইন নিজে থেকেই এই দেশে-বিদেশি শোষকদের স্বার্থে ব্যবহৃত হয়। পাঞ্জাবের সামরিক শাসনে মামলাগুলোর সম্পর্কে আমার নিরপেক্ষ পরীক্ষা-নিরীক্ষা আমার মধ্যে এই বিশ্বাসের জন্ম দিয়েছে যে কমপক্ষে ৯৫ শতাংশ দণ্ড সম্পূর্ণরূপে খারাপ। ভারতে রাজনৈতিক মামলাগুলোর অভিজ্ঞান আমাকে এই উপসংহারে নিয়ে এসেছে যে, ১০ জনের মধ্যে ৯ জন দণ্ডিত ব্যক্তি সম্পূর্ণরূপে নির্দোষ। তাদের অপরাধ তারা দেশকে ভালোবাসে। ভারতের আদালতে ইউরোপিয়ানদের বিরুদ্ধে ভারতীয়দের অপরাধের নামে ১০০টির মধ্যে ৯৯টি মামলায় ন্যায়বিচার অস্বীকার করা হয়েছে। এটি কোনো অতিরঞ্জিত চিত্র নয়। যেসব ভারতীয়ের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জানা যায়, প্রায় সব ভারতীয়র এসব মামলার সঙ্গে কোনো সংশ্লেষ নেই। আমার মতে, আইনের প্রয়োগকে শোষকদের স্বার্থে সচেতন বা অচেতনভাবে গণিকাবৃত্তিতে পরিণত করা হয়েছে।’
গান্ধীর এই জবানবন্দিটি আরও কিছুটা দীর্ঘ। কিন্তু ইতিমধ্যেই তার জনাববন্দিটির মূল চেতনা স্পষ্টভাবে ফুটে উঠেছে। ভারতীয় প্যানাল কোড মামলায় গান্ধী যে জবানবন্দি দিয়েছেন, সেটি এখনও বাংলাদেশ প্যানাল কোড নামে অব্যাহত আছে। স্বাধীন বাংলাদেশ এখনও পরাধীন দেশের আইন দিয়ে শাসিত হচ্ছে। পরাধীনতার সময়ে আইনের যূপকাষ্ঠে শত-সহস নিরপরাধ দেশপ্রেমিক প্রাণ বলি দিয়েছেন। সেই পরাধীন দেশের আদালতের সামনে দাঁড়িয়ে গান্ধী বলতে পেরেছেন, তোমাদের আইনে আমি অপরাধী। বিদেশি শাসকদের সঙ্গে যে গান্ধী আনুগত্য ও সহযোগিতার নীতি অনুসরণ করে সমনাগরিকত্বের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন সেই গান্ধী জীবনের রূঢ় বাস্তবতা এবং অভিজ্ঞতার মাধ্যমে বুঝতে পেরেছিলেন বিদেশি শাসক ও শোষকদের বিরুদ্ধে আপসহীন প্রতিবাদ ও প্রতিরোধের কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশ প্যানাল কোড ঔপনিবেশিক আমলের তুলনায় অনেক বেশি জটিল ও কঠিন করে তোলা হয়েছে। আমরা কি জানি কত নিরপরাধ মানুষ এই আইনের দণ্ড ভোগ করছেন, যেমনটি গান্ধী তার জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন? গান্ধী একজন ব্যারিস্টার ছিলেন। আইনশাস্ত্র তিনি ভালো করেই জানতেন। কিন্তু জবানবন্দি দিতে গিয়ে নিজেকে নির্দোষ প্রমাণ করতে আইনের চুলচেরা বিশ্লেষণে নিয়োজিত হননি। পুরো বিষয়টিকে তিনি রাজনৈতিক দৃষ্টিকোণ থেকে দেখেছেন এবং তার জবানবন্দির মাধ্যমে দেশবাসীকে সচেতন করে তুলতে চেয়েছেন। আমাদের জন্য পরম দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, স্বাধীন দেশেও নাগরিকরা পরাধীন দেশের নাগরিকদের মতো শাসক ও শোষকদের রোষানলে পড়ছেন। কত সংসার ও পরিবার ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে। দেশটা যদি আমাদের সবার হয়, তাহলে এ থেকে পরিত্রাণের পথ আমরা সবাই মিলে কেন খুঁজব না? আমাদের দুর্ভাগ্য আমাদের নেতৃত্ব দেয়ার জন্য গান্ধীর মতো একজন মহৎ পুরুষ নেই। প্রতীক্ষায় থাকব, নিশির অবসানে যে সূর্যোদয় হবে, তার সঙ্গে একজন মহামানবেরও আবির্ভাব ঘটবে।
ড. মাহ্বুব উল্লাহ্ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন