ভারতের ওই মন্ত্রী কি ‘তথাকথিত’ শব্দের মানে জানেন?
22 November 2017, Wednesday
১৮ নভেম্বর দৈনিক যুগান্তর শেষের পাতায় একটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ ছেপেছে। এ ধরনের সংবাদ অন্য কোনো সংবাদপত্রে, অন্তত যেগুলো আমি দেখেছি, চোখে পড়েনি। সিঙ্গেল কলামে ছাপা এ সংবাদটির শিরোনাম হল, ‘‘ভারতের প্রতিমন্ত্রীর মন্তব্য- বাংলাদেশ ভারতের ‘তথাকথিত’ বন্ধু নিরাপত্তার হুমকি।’’ যুগান্তর ডেস্কের এ সংবাদে লেখা হয়েছে, ‘বাংলাদেশকে ভারতের জাতীয় নিরাপত্তার প্রতি হুমকি ও নয়াদিল্লির ‘তথাকথিত’ বন্ধু বলে মন্তব্য করেছেন ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হংসরাজ আহির। ভারতের নিরাপত্তার জন্য পাকিস্তান ও চীনের চেয়ে বাংলাদেশই বড় চ্যালেঞ্জ বলে মনে করেন তিনি। বৃহস্পতিবার আসাম সফরে গিয়ে অভ্যন্তরীণ নিরাপত্তাবিষয়ক এক অনুষ্ঠানে তিনি এ মন্তব্য করেন। মহারাষ্ট্র থেকে চারবারের নির্বাচিত আইনপ্রণেতা ৬৩ বছর বয়সী হংসরাজ বলেন, ‘শুধু চীন বা পাকিস্তান নয়, আমাদের জাতীয় নিরাপত্তার জন্য বাংলাদেশও বড় এক চ্যালেঞ্জ। আমি এটা জানি, কারণ আমি খুব মনোযোগ দিয়ে এটা দেখেছি।’ তিনি বলেন, ‘অনুপ্রবেশের মাধ্যমে বাংলাদেশ ভারতের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করছে।
একমাত্র স্মার্ট প্রযুক্তিই আমাদের ওই অনুপ্রবেশ দমনে সহায়তা করতে পারে।’ এনডিটিভি জানায়, স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর এ বক্তব্যের সঙ্গে বাংলাদেশ ও ভারত সরকারের অবস্থান এবং বক্তব্যের কোনো সামঞ্জস্য নেই। গত সপ্তাহেই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি উভয় দেশের ঐতিহাসিক বন্ধনকে নতুন মাত্রায় নিয়ে যাওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। এ দুই নেতা দু’দেশের জনগণের সংযোগ স্থাপনের বেশ কিছু প্রকল্পও উদ্বোধন করেন। ভারতের আরেক প্রতিবেশী চীনের ব্যাপারে কথা বলেন হংসরাজ। তিনি বলেন, ‘‘চীন আমাদের ‘খুব ঘনিষ্ঠ বন্ধু’ নয়।’’ পাকিস্তানের বিষয়ে তিনি বলেন, ‘পাকিস্তান অধিকৃত কাশ্মীর ভারতের অংশ। বিগত সরকারগুলোর গাফিলতির কারণেই তা পাকিস্তানের অংশ হিসেবে থেকে গেছে। তিনি আরও বলেন, ‘ভারত যদি পাকিস্তানের দখলে থাকা কাশ্মীরের অংশ নিজের করে নিতে চায়, তাহলে ভারতকে কেউ থামাতে পারবে না। কারণ এটা আমাদের অধিকার এবং আমরা কাশ্মীর ফিরিয়ে নেয়ার উদ্যোগ নেব।’
পুরো সংবাদটি উদ্ধৃত করার ইচ্ছা সংবরণ করা সম্ভব হল না। এ সংবাদ থেকে বাংলাদেশের সাবধানতা অবলম্বনের প্রয়োজনীয়তা সৃষ্টি হয়েছে। বাংলাদেশ এ মুহূর্তে মিয়ানমার থেকে বাস্তুচ্যুত রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপে দারুণ সংকটের মধ্যে রয়েছে। প্রায় প্রতিদিনই রোহিঙ্গা শরণার্থীরা মিয়ানমারের রাখাইন প্রদেশ থেকে বাংলাদেশে আসছে। এ বাড়তি জনসংখ্যার চাপে টেকনাফ ও আশপাশের এলাকায় বাংলাদেশিরা সংখ্যালঘুতে পরিণত হয়েছে। বাংলাদেশের পরিবেশ ও প্রতিবেশ এ বাড়তি জনসংখ্যার কারণে উজাড় হয়ে যাচ্ছে।
আন্তর্জাতিক মহল এ ব্যাপারে মিয়ানমার সরকারের ওপর চাপ সৃষ্টি করা সত্ত্বেও খুব নিকট-ভবিষ্যতে এ সমস্যার সুরাহা হবে বলে আশান্বিত হওয়া যায় না। আরও দুশ্চিন্তার বিষয় হল, এ প্রশ্নে বাংলাদেশ তার নিকট-প্রতিবেশী দেশগুলোর কাছ থেকে আশ্বস্ত হওয়ার মতো কোনো সমর্থন পাচ্ছে না। জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের থার্ড কমিটিতে বাংলাদেশের পক্ষে বিপুলসংখ্যক ভোট পড়লেও বেশ কিছু দেশ এ প্রস্তাবের বিরোধিতা করেছে কিংবা ভোট দানে বিরত থেকেছে। ভারতও ভোটদানে বিরত থেকেছে। অন্যদিকে চীন ও রাশিয়া বিরোধিতা করেছে। চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দু’দিনের ঢাকা সফরে এসেছেন। বাংলাদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রী তার সঙ্গে রোহিঙ্গা সমস্যা নিয়ে কথা বলেছেন। এর ফলাফল এ লেখার সময় পর্যন্ত জানা যায়নি। তবে একটি জিনিস পরিষ্কার, চীন চায় দ্বিপাক্ষিকতার ভিত্তিতে সমস্যার সমাধান হোক।
কিন্তু বাংলাদেশ মনে করে নিছক দ্বিপাক্ষিকতায় নিবিষ্ট হলে বৃহত্তর আন্তর্জাতিক সমর্থন দুর্বল হয়ে পড়তে পারে। এর ফলে মিয়ানমারের ওপর চাপ কমে যাবে। তাই বাংলাদেশের কূটনীতি হল দ্বিপাক্ষিক আলোচনার পাশাপাশি আন্তর্জাতিক চাপও ক্রিয়াশীল রাখা। চীন ও বাংলাদেশের মধ্যে বহুমুখী সুসম্পর্ক রয়েছে। অন্যদিকে চীন ও মিয়ানমারের মধ্যেও ঘনিষ্ঠ স্ট্র্যাটেজিক সম্পর্ক বিদ্যমান। চীন ও মিয়ানমারের মধ্যে দীর্ঘ অভিন্ন সীমান্ত রয়েছে, যা বাংলাদেশের সঙ্গে নেই।
বাংলাদেশ একটি ঘনবসতিপূর্ণ দেশ। বলা যায়, দেশটি পৃথিবীর সবচেয়ে ঘনবসতিপূর্ণ। জাতীয় নিরাপত্তার দৃষ্টিকোণ থেকে বাংলাদেশের বিশাল জনসংখ্যা একদিকে যেমন সম্পদ হিসেবে গণ্য হতে পারে, অন্যদিকে তেমনি এটি একটি বিশাল বোঝাও বটে। এ রকম একটি দেশকে সামরিক আক্রমণের মাধ্যমে জব্দ করার প্রয়োজন নেই। জনমিতিক আগ্রাসন এ দেশকে কাবু করার জন্য যথেষ্ট। বাংলাদেশের পক্ষে আকস্মিকভাবে কোনো দেশের তাড়িয়ে দেয়া লাখ লাখ মানুষের চাপ সহ্য করা সত্যিই কঠিন। এ অবস্থার মধ্যেও বাংলাদেশ যে মানবিক অবস্থান নিয়েছে সেটা খুবই সাহসিকতার কাজ।
মিয়ানমার সুপরিকল্পিতভাবে বাংলাদেশের ওপর রোহিঙ্গা শরণার্থীদের চাপিয়ে দিয়েছে। দেশটির সরকারের ভাষায় এরা রোহিঙ্গা নয়, এরা হল বাঙালি মুসলমান। অর্থাৎ বাংলাদেশই এদের আদি নিবাস। অথচ ইতিহাস সাক্ষ্য দেয় সেখানে এ জনগোষ্ঠী চুতর্দশ শতাব্দী থেকে বসবাস করছে। কিন্তু মিয়ানমার এদের তার দেশের নাগরিক বলে স্বীকার করতে চায় না। এজন্যই পাকিস্তান আমল থেকে, বিশেষ করে বাংলাদেশ আমলে বেশ ক’বার বিপুল সংখ্যায় বিভিন্ন সময়ে এদের বাংলাদেশে ঠেলে দিয়েছে। এবার তারা ইতিহাসের জঘন্যতম জাতিগত নিধনের পদ্ধতি বেছে নিয়েছে।
ভারতে বিজেপি নেতারা বিভিন্ন সময়ে বলার চেষ্টা করেছেন, তাদের দেশে দুই কোটি বাংলাদেশি বেআইনিভাবে অনুপ্রবেশ করেছে। ভারতের বর্তমান প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি তার নির্বাচনী প্রচারণার সময় বলেছিলেন, নির্বাচনে জয় লাভের পর এসব বাংলাদেশি অনুপ্রবেশকারীদের তল্পিতল্পাসহ বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেয়া হবে। ভারতের তরফ থেকে এ ধরনের অভিযোগ নতুন কিছু নয়।
কংগ্রেস শাসনের সময়েও একই ধরনের অভিযোগ করা হতো। এমনকি বিভিন্ন সময়েও পুশইনের চেষ্টা চলেছে। ১৯৯৯ সালের দিকে আসামের গভর্নর এসকে সিনহা, যিনি ভারতীয় সেনাবাহিনীর একজন অবসরপ্রাপ্ত লেফটেন্যান্ট জেনারেল, তার আশঙ্কার কথা ব্যক্ত করে তৎকালীন ভারতীয় রাষ্ট্রপতি কে আর নারায়ণনকে একটি রিপোর্ট পাঠিয়েছিলেন। সেই রিপোর্টে তিনি আশঙ্কা ব্যক্ত করেছিলেন, বাংলাদেশ থেকে অনুপ্রবেশ রোধ করতে না পারলে আসামের স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিজ ভূমিতে সংখ্যালঘিষ্ঠ হয়ে পড়বে এবং দীর্ঘমেয়াদে বাংলাদেশের মৌলবাদীরা বৃহত্তর বাংলাদেশ গঠনের চক্রান্ত বাস্তবায়িত করতে সক্ষম হবে। আসামের তৎকালীন এ গভর্নরের মতে, আসামের চারটি জেলা এর মধ্যেই মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ জেলায় পরিণত হয়েছে এবং আরও ৩টি জেলা সেই অবস্থার দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। এ নীরব জনমিতিক আগ্রাসন চলতে থাকলে ভূ-রণনৈতিকভাবে আসামের কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ জেলা হাতছাড়া হয়ে যাবে। ভারতীয় রাজনীতিকদের মনোজগতে এ রকম ভীতি সব সময়ই ক্রিয়াশীল ছিল। এ যাত্রা ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হংসরাজের মন্তব্য ব্যতিক্রম কিছু নয়।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল, ভারতের নিরাপত্তা-শঙ্কা ঘোচাতে বাংলাদেশ যথাসাধ্য করেছে। বর্তমান সরকারের সময় উত্তর-পূর্ব ভারতের বিদ্রোহী উলফা নেতাদের ভারতের হাতে তুলে দেয়া হয়েছে। এমনকি বিএনপির পক্ষ থেকেও ভারতকে আশ্বস্ত করা হয়েছে, বাংলাদেশের এক ইঞ্চি জমিও ভারতবিরোধী সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের জন্য ব্যবহার করতে দেয়া হবে না। শুধু তাই নয়, বাংলাদেশের ভূখণ্ড ব্যবহার করে ভারতেরই নিজস্ব ভূখণ্ডে সংক্ষিপ্ত যাতায়াতের সুযোগ হিসেবে করিডর সুবিধা দেয়া হয়েছে ভারতকে। বাংলাদেশ ভারতীয় পণ্যের বিশাল বাজারও বটে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের অভ্যুদয় ভারতকে পাকিস্তানের বিরুদ্ধে দুই ফ্রন্টে লড়াই করার ঝামেলা থেকে মুক্ত করেছে। ভারত বাংলাদেশের বন্দর সুবিধাও ব্যবহার করতে পারবে এবং পারছে।
বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে ট্রানজিটের জন্য বাংলাদেশ খুব সামান্য মাশুলই চেয়েছে, যা এ সংক্রান্ত কমিটির সুপারিশের তুলনায় অনেক কম। প্রধানমন্ত্রীর একজন উপদেষ্টা আগ বাড়িয়ে বলেছিলেন, ট্রানজিটের, জন্য ভারতের কাছ থেকে মাশুল চাওয়া হবে অসভ্যতা। প্রতিবেশীর প্রতি এমন ঔদার্য্যপূর্ণ আচরণের পরও ভারতের স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভাষায় বাংলাদেশ হল ‘তথাকথিত বন্ধু’ এবং নিরাপত্তার হুমকি। বাংলাদেশ ভারতের কাছ থেকে অভিন্ন নদীগুলোর পানির ন্যায্য হিস্যা পাচ্ছে না। যৎসামান্য পরিমাণ পণ্যসামগ্রী, যেগুলো বাংলাদেশ থেকে ভারতে রফতানি হয় সেগুলোও ভারতের ট্যারা ট্যারিফ ও ননট্যারিফ বাধার সম্মুখীন হচ্ছে। সব মিলিয়ে বলা যায়, ভারতকে বাংলাদেশ অনেক কিছু দিয়েছে; কিন্তু পেয়েছে সামান্যই। বাংলাদেশের অবকাঠামো গড়ার জন্য ভারত যে ঋণ দিয়েছে সেটা বন্ধনযুক্ত ঋণ।
এ কথা সত্য, অবিভক্ত ব্রিটিশ-ভারতের সময়ে পূর্ববঙ্গ থেকে বেশ কিছু অভিবাসী ভারতের আসামে গেছে। এ অভিবাসন শুরু হয়েছিল গত শতাব্দীর শুরুর দিকে। এরাই জীবনের ঝুঁকি নিয়ে আসামের বনজঙ্গল সাফ করে কৃষি কাজের জন্য জমি উদ্ধার করে আসামের অর্থনীতিতে বিশাল অবদান রেখেছে। ব্রিটিশ ভারতের সময়েই আসাম সরকার এ অভিবাসন থামিয়ে দেয়ার জন্য লাইন প্রথা চালু করেছিল। মওলানা ভাসানীর নেতৃত্বে আসামে অভিবাসনকারী পূর্ববঙ্গের কৃষকরা লাইন প্রথার বিরুদ্ধে আন্দোলন করেছে। এসব অভিবাসী আসামের সংস্কৃতি ও জীবনযাত্রার সঙ্গে বেশ কয়েক যুগ আগেই মিলেমিশে গেছে। আজ যদি বলা হয়, এদের সংখ্যা দুই কোটি এবং এদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠাতে হবে, তাহলে মিয়ানমার যা করছে তার সঙ্গে ভারতের তফাৎ থাকছে কোথায়? মতিভ্রমের কারণে ভারত যদি সত্যিকার অর্থে এমন কোনো পদক্ষেপ নেয়, তাহলে বাংলাদেশের অস্তিত্ব বিপন্ন হবে। মনে হচ্ছে বাংলাদেশ রাষ্ট্রটি দু’পাশে দুই প্রতিবেশীর চাপে চিঁড়ে চ্যাপ্টা হওয়ার উপক্রম হয়েছে।
বাংলাদেশ যাকে বন্ধু বলে আলিঙ্গন করছে, সেই দেশের একজন দায়িত্বশীল মন্ত্রী বাংলাদেশকে বলছে, ‘তথাকথিত বন্ধু’। স্বাভাবিকভাবেই বাংলাদেশের জনগণ ক্ষুব্ধ ও হতাশাবোধ করছে। আশা করি ভারতের শাসকমহল বাস্তবতা অনুধাবনের চেষ্টা করবেন এবং বাংলাদেশের বিপদের কারণ হবেন না।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অধ্যাপক ও অর্থনীতিবিদ
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন