এবার স্বাধীনতা দিবসের চেয়ে গণহত্যা দিবসের প্রতি মানুষের আগ্রহ বেশি। অবশ্য গণহত্যা ও স্বাধীনতা দিবসটির পার্থক্য কয়েক ঘণ্টার। ২৫ মার্চ মধ্যরাতের আগেই শুরু হয় গণহত্যার অপারেশন সার্চলাইট। মধ্যরাতের পর বঙ্গবন্ধু আনুষ্ঠানিক স্বাধীনতার ঘোষণা দেন।
১৯৭১ সালে প্রতিদিনই গণহত্যা হয়েছে। এমন অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল যে, গণহত্যা স্বাভাবিক বিষয়ে পরিণত হয়েছিল। স্বাধীনতার বিষয়টিই ছিল মুখ্য। সেজন্য গণহত্যার বিষয়ে আলাদা গুরুত্ব দেয়া হয়নি। বাংলাদেশের ইতিহাস চর্চার ক্ষেত্রেও একই দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় পাই। গুরুত্ব পেয়েছে বিজয়, সাহসের গৌরবগাথা। কারণ বাঙালি এত বড় বিজয় কখনও দেখেনি, বরং সবসময় তাকে চিত্রিত করা হয়েছে ভীতু বাঙালি বা ভেতো বাঙালি বলে।
বেনজীর ভুট্টো এক সাক্ষাৎকারে আমাকে বলেছিলেন, স্কুলে তারা বাঙালিদের অদ্ভুত হিসেবেই জানতেন, যারা রুটি খায় না, ভাত খায়, যারা পুরোপুরি মুসলমান না অর্থাৎ হিন্দু সংস্কৃতিতে আছে। এই হিন্দু সংস্কৃতির বিষয়টি কেউ কিন্তু বিশদভাবে বলেননি। এটা অনার্য সংস্কৃতি হতে পারে, যা দ্বারা এই ভূখণ্ডের সবাই কম-বেশি প্রভাবান্বিত।
বিজয় মহিমান্বিত হল, যা স্বাভাবিক এবং ইতিবাচক। কিন্তু এতে মুক্তিযুদ্ধের প্রধান দিক গণহত্যা, নির্যাতন আড়ালে চলে গেল। ফলে, তা রাজনীতিতেও প্রভাব ফেলেছিল। উদাহরণ হিসেবে বলি, বিদেশে বাংলাদেশের গণহত্যা, নির্যাতনের বিষয়টি আড়াল করে রাখা হয়েছিল। এবং সবসময় মুক্তিযুদ্ধকে গৃহযুদ্ধ বা বিদ্রোহ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। কেননা সেক্ষেত্রে হত্যার বিষয়টি গুরুত্ব পায় না। গুরুত্ব পেলে এরা রাষ্ট্র হিসেবে অপরাধী হয়ে পড়ে। কিন্তু এরা তো সবসময় নিজেদের গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে জাহির করেছে।
বিএনপি-জামায়াত সবসময় গণহত্যার বিষয়টি চাপা দিয়ে রাখতে চেয়েছে। কারণ, গণহত্যা গুরুত্ব পেলে পাকিস্তানকে কাঠগড়ায় দাঁড়াতে হয়। খালেদা জিয়া যখন বলেন, ৩০ লাখ শহীদ হয়নি, তখন তা ভেবেচিন্তেই বলেন। জামায়াত-বিএনপির মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার হচ্ছে, যেখানে গণগত্যার বিষয়টিই প্রধান। এটিকে যদি তুচ্ছ করা যায়, তাহলে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার প্রশ্নের সম্মুখীন হয়। সে কারণেই স্বাধীনতাবিরোধীরা গণহত্যা বিষয়টিকে বিতর্কিত করে তুলতে চেয়েছিল।
আমরা এ কারণে গণহত্যা, নির্যাতন বিষয়টিকে সামনে নিয়ে আসতে চেয়েছি। সামষ্টিক এবং ব্যক্তিগত পর্যায়ে নানাভাবে গণহত্যার বিষয়টি সামনে রাখতে চেয়েছি। ব্যক্তিগতভাবে গণহত্যা বিষয়ক অনেক বই লিখেছি, শাহরিয়ার কবিরও। খুলনায় বাংলাদেশের প্রথম গণহত্যা-নির্যাতন আর্কাইভ ও জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছি। গণহত্যা নির্ঘণ্ট প্রকাশ করেছি। ওই জাদুঘরের তরফ থেকে বধ্যভূমি ও গণহত্যার স্থানে ফলক বসানো হচ্ছে। গণহত্যার আন্তর্জাতিকীকরণের প্রচেষ্টাও অব্যাহত ছিল। শাহরিয়ার কবির এ ক্ষেত্রে বিশেষ ভূমিকা রেখেছিলেন। আমরা চেয়েছিলাম একুশে ফেব্রুয়ারি যেমন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস, তেমনি ২৫ মার্চ হোক আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস। কিন্তু, সবাই যা বলেছেন তা হল, আপনারা জাতীয়ভাবে তা পালন করেন কিনা। যদি নিজেরা না করে থাকেন তাহলে অন্যরা করবে কেন?
এ প্রশ্নের উত্তর আমরা দিতে পারিনি। তবে ২০১৫ সালে জাতিসংঘ অবশেষে ৯ ডিসেম্বরকে আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস ঘোষণা করে। ১৯৪৮ সালের এইদিন জাতিসংঘ গণহত্যাসংক্রান্ত একটি প্রস্তাব গ্রহণ করেছিল।
একাত্তরের ঘাতক-দালাল নির্মূল কমিটি গত ২৫ বছর ধরে গণহত্যা দিবস পালন করে আসছে। শহীদ মিনারে কালরাত্রি পালনে সিভিল সমাজের সবাই অংশগ্রহণ করছেন। সাংস্কৃতিক জোট এ উপলক্ষে বিশেষ আয়োজনও করে। আমাদের চেষ্টায় সারা দেশে বিক্ষিপ্তভাবে হলেও ‘কালরাত্রি’ বা গণহত্যা দিবস পালিত হতে থাকে।
অবশেষে, সরকার ২৫ মার্চকে জাতীয় গণহত্যা দিবস ঘোষণা করেছে। অনেকে, বিশেষ করে সাংবাদিকরা আমাকে প্রশ্ন করেছেন, এ দিবস ঘোষণায় এত দেরি হল কেন? মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকারের তো এত দেরি করার কথা নয়। হ্যাঁ, দেরি হয়েছে, তারপরও হয়েছে এবং শেখ হাসিনা ছিলেন বলেই হয়েছে। কিন্তু সব দায় তো সরকারের নয়, আমাদেরও দায় আছে। নিজ নিজ অবস্থান থেকে তো আমরা সে দায় পূরণ করি না।
আরেকটি প্রসঙ্গ আলোচনায় আনা দরকার। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে ফ্যাসিস্ট বা নাজি পদের উদ্ভব হল কেন? সেখানে নাজি বা ফ্যাসিস্ট শব্দটি নোংরা গালি বিশেষ। তাদের মানসজগৎ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর এমনভাবে তৈরি হয়েছে। একটা পরম্পরা তৈরি হয়েছে। ইউরোপে বিজয়কে গুরুত্ব দেয়া হয়েছে। কিন্তু আরও বেশি গুরুত্ব দেয়া হয়েছে গণহত্যাকে। সেই থেকে গত ৭০ বছর ফিল্ম-সাহিত্য-চলচ্চিত্রে গণহত্যার বিষয়টি বারবার এসেছে। বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা হয়েছে। গণহত্যা জাদুঘর হয়েছে। শুধু তাই নয়, গণহত্যা অস্বীকার করলে শাস্তির আইনও করা হয়েছে। সুতরাং নাজি বা ফ্যাসিস্টরা গণহত্যাকারী, এ কথা বংশপরম্পরায় তারা জানছে, ভুলতে দেয়া হচ্ছে না। বিজয়ের স্মৃতি ক্ষণস্থায়ী। কিন্তু শোক, দুঃখ, বেদনা বা গণহত্যা- নির্যাতনের সঙ্গে যুক্ত যা, তা রক্তের মধ্যে খেলা করে বংশপরম্পরায়। যেমন- একুশে ফেব্রুয়ারি, তার পরম্পরা আছে, সব আমলেই তা পালিত হয়েছে। বাংলাদেশে একুশে ফেব্রুয়ারি সম্পর্কে মানুষ যতটা জানে, গণহত্যা সম্পর্কে ততটা জানে না। কারণ ১৯৭৫ সালের পর একটানা ২১ বছর পাকিস্তানি বাঙালিরা দেশ শাসন করেছে। তারা তো মুক্তিযুদ্ধকেই অস্বীকার করেছে।
সরকারিভাবে গণহত্যা দিবস পালনের তাৎপর্য এই যে, তৃণমূল পর্যায় থেকে অনেকটা বাধ্যতামূলকভাবে তা পালিত হবে। ফলে, গণহত্যা নিয়ে মানুষ জানবে, ভাববে। আমরা আরও বলেছি সংবিধান দিবস, মুক্তিযোদ্ধা দিবস পালন করতে। আমরা করিও। এইসব দিবস পালনের তাৎপর্য কী হতে পারে তা উল্লেখ করছি। ফেব্রুয়ারিতে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস ও বইমেলা, মার্চের ১ তারিখ সফল অসহযোগ আন্দোলন, ২ তারিখ পতাকা উত্তোলন দিবস, ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর ভাষণ, ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্মদিন, ২৫ মার্চ গণহত্যা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবস, ২৭ মার্চ প্রতিরোধ দিবস, ১৭ এপ্রিল বাংলাদেশ দিবস, ১৪ এপ্রিল ১ বৈশাখ, ১ ডিসেম্বর মুক্তিযোদ্ধা দিবস, ৬ ডিসেম্বর স্বীকৃতি দিবস, ১৪ ডিসেম্বর শহীদ বুদ্ধিজীবী দিবস, ১৬ ডিসেম্বর বিজয় দিবস- এমনি প্রতি মাসে জাতীয় ইতিহাসের সঙ্গে জড়িত একটি দিবস আছে। সেগুলো পালিত হলে সারা বছর আমরা গণতান্ত্রিক ও বাংলাদেশের আন্দোলনের ইতিহাসের মধ্যেই থাকব। তখন আর স্বাধীনতার বিপক্ষের শক্তির বিভ্রান্তিকর রাজনীতি মানসজগতে ঠাঁই পাবে না।
গণহত্যা দিবসকে আরও সংহত করার জন্য সরকারি-বেসরকারিভাবে আরও কিছু উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। যেমন- গণহত্যা, নির্যাতনের স্থান, বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণ করা উচিত, আরও আঞ্চলিক জাদুঘর প্রতিষ্ঠা, বইপত্র প্রকাশ, গবেষণায় প্রাতিষ্ঠানিক সাহায্য প্রয়োজন। সবার আগে জামায়াত নিষিদ্ধ জরুরি। কারণ, গণহত্যার সঙ্গে এরা জড়িত।
গণহত্যার স্মৃতিকে সংরক্ষণ করার জন্য নির্মূল কমিটি এবার ৩০ লাখ শহীদের স্মরণে ৩০ লাখ বৃক্ষরোপণের আহ্বান জানিয়েছে। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি ২৫ মার্চ এই কার্যক্রম উদ্বোধন করবেন। শহীদরা যে রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেছিলেন তা এখন প্রাকৃতিক বিপর্যয়েরও সম্মুখীন। আমরা যদি এক বছরে ৩০ লাখ গাছ লাগাই, তা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক বিপর্যয় রক্ষায় অনেক সহায়তা করবে। শুধু তাই নয়, এ বৃক্ষগুলো সতেজ থেকে আমাদের শহীদদের স্মৃতি জাগরূক রাখবে।
মুনতাসীর মামুন : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়; ইতিহাস গবেষক
উৎসঃ যুগান্তর
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন