বাংলাদেশ কি শুধু বনপোড়া হরিণীর মতো চিৎকার করবে?
14 November 2016, Monday
আর্থার লয়েড ক্লে ১৮৬৪ সালে এসডিও হয়েছিলেন নাসিরনগরের। লিখেছেন তিনি, নাসিরনগরকে তখন অনেকে ব্রাহ্মণবাড়িয়া বলতেন। কয়েকটি খড়োঘর, শস্যক্ষেত্র ছাড়া আর কিছু ছিল না নাসিরনগরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া নামটি আস্তে আস্তে গ্রাস করে নাসিরনগর নামটিকে। তবে, পাকি আমলে একে বলা হতো বি.বাড়িয়া। স্টেশনের বোর্ডেও তাই লেখা হতো। এখনও অনেকে পাকিদের মতো বি.বাড়িয়া বলে সুখ পান। শালার হিন্দু নাম আর বলতে হলো না! যা হোক, সেই মুসলমানত্ব আবার চাগার দিয়ে উঠেছে নাসিরনগরে। ব্রাহ্মণবাড়িয়া চাপা পড়ে গেছে। খবরের কাগজে এখন প্রতিদিন নাসিরনগর। উন্নয়নের ব্যাপারটা ধামাচাপা পড়ে গেছে।
নাসিরনগরে কী ঘটেছে তা ঘটা করে বলার কিছু নেই। প্রধানমন্ত্রী থেকে শুরু করে মুদি দোকানি খবরের কাগজ পড়েন বা টেলিভিশন দেখেন সবাই জানেন। পুলিশী তদন্তের প্রয়োজন হয় না। রসরাজ যে ফেসবুকে পোস্ট করতে পারেন না এটি সবাই জানলেও পুলিশের জানার কথা নয় সে জন্য আগেভাগেই তাকে গ্রেফতার করা হয়। আদালতে রসরাজের পক্ষে কাউকে দাঁড়াতে দেয়া হয়নি। বিষয়টি বিচারক জানতেন না, তাই তখনই তাকে রিমান্ডের আদেশ দেন। পুলিশী তদন্ত এক বছরের কমে শেষ হবে কিনা সন্দেহ। তারপর কী বলে যেন বলে ডিউ প্রসেস অব ল’ ফলো করতে হবে। ততদিনে রসরাজের পরিবার অক্কা পাবে। ইউএনও তো জানতেন না হেফাজতি বা হেজাবিরা দাঙ্গা বাধায়। ওসিও জানতেন না। সুতরাং হেজাবিরা যদি সমাবেশ করে ক্ষতি কী! এটি তো তাদের নাগরিক অধিকারের মধ্যে পড়ে। তাতে দাঙ্গা বাধলে কী করা। এক-আধটু দাঙ্গা সবখানেই হয়।
নাসিরনগরের আগে এত বড় পূজা গেল। বাগেরহাটে চুলকাটি নামে এক গ্রামে গেলাম। ৫৬১টি প্রতিমা। স্বেচ্ছাসেবক ৬৫ জন। তার মধ্যে ৬০ জন মুসলমান। মনে হলো, যা চাচ্ছিলাম, শেখ হাসিনার নেতৃত্বে সে রকম একটি রাষ্ট্র অবশেষে আমরা পাচ্ছি। তবুও সে বিশ্বাস দৃঢ় ছিল না। কারণ, আমরা ঘরপোড়া গরু। নিমিষেই লোককে চোখ উল্টে ফেলতে দেখেছি। আরেকটি কারণ ছিল, রাজনৈতিক নেতৃত্বের ধারণা সব ঠিক আছে। কিন্তু, অনেক কিছুই ঠিক নেই, তা তারা জানেন না। জানতেও চান না। কারণ, তাদের অধিকাংশের বউ-বাচ্চা বিদেশে, বাড়ি কেনাও হয়ে গেছে। ভিসা রেডি। বাংলাদেশের কী হলো না হলো তাতে কী আসে যায়। এ দৃষ্টিভঙ্গি না থাকলে নাসিরনগর বা তার পরবর্তী ঘটনাসমূহ ঘটত না।
এদিক থেকে ট্রাম্পের উত্থান সান্ত¡নাদায়ক। ইউরোপেও এমনটি হবে। আমাদের রাজনৈতিক নেতৃত্ব ও তাদের লেঙ্গটরা এখন ইউরোপ, আমেরিকায় শান্তিতে থাকবেন বা ঢুকতে পারবেন কিনা সেটাই বিবেচ্য। আমেরিকানদের অনেকেই এখন আর আমেরিকা থাকতে চাইছেন না।
শুধু আমাদের দেশে নয়, ভারত, শ্রীলঙ্কা, মিয়ানমার থেকে শুরু করে মধ্যপ্রাচ্য, আমেরিকা, ইউরোপে যা ঘটছে এবং যা ঘটবে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে তা সভ্যতাকে বিপন্ন করে তুলবে। এটি যখন ভাবি তখন ক্লান্ত এবং হতাশ লাগে। আমরা যেভাবে দেখতে চেয়েছিলাম বিশ্ব ও নিজের দেশকে তা আর সেভাবে থাকছে না। নিজেদের যদি ষাটের জেনারেশন ধরি তাহলে বলতে হবে, আমরা বেড়ে উঠেছিলাম লিবারালিজম বা উদারনীতির ভিতর দিয়ে অর্থাৎ প্রগতির ধারায়। ঐ সময় উপনিবেশের শৃঙ্খল ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে, রক্ষণশীল চিন্তা বা এস্টাবলিশমেন্টের বিরুদ্ধে তরুণরা রাস্তায় নেমেছে। বিশ্বজুড়ে তরুণরা রাস্তায়। মুখে যুদ্ধবিরোধী সেøাগান, বিটলস্ আর লোকায়ত গান, সঙ্গীত শুধু নয় মানসজগত তোলপাড় করে দিচ্ছে। ‘মেক লাভ নট ওয়ার’ সেটিই সেøাগান। বাংলাদেশ আন্দোলন/যুদ্ধ যে সফল হলো তার কারণÑ দেশে-বিদেশে তরুণদের সমর্থন। বাইরে যখন গেছি তখন বন্ধুত্ব গড়ে উঠেছে ধর্মের ভিত্তিতে নয়, চিন্তার ভিত্তিতে। ষাটের ধাক্কায়ই স্নায়ুযুদ্ধের অবসান হতে লাগল। আমরা এমন দেশ চেয়েছিলাম যা হবে গণতান্ত্রিক ও ধর্মনিরপেক্ষ। পুরো পৃথিবীটাও সেভাবে বদলে যাবেÑএ ছিল ধারণা।
এর পর অনেক বছর কেটে গেছে। নতুন এক বিশ্বব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল। এখন সে ব্যবস্থাও ভেঙ্গে পড়ছে, সেই পুরনো প্রত্যাখ্যাত ব্যবস্থায়ই ফিরে আসছে এবং তরুণরাই সে ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনছে। সমাজে বিভক্তি বাড়ছে। রাষ্ট্রে রাষ্ট্রে যুদ্ধের সম্ভাবনা বৃদ্ধি পাচ্ছে। আর এসব থেকে আমরা নিজেদের সরিয়ে রাখতে পারব না।
আরবি মুসলমানদের ধর্ম ব্যবহারের চেষ্টা যা জিহাদ নামে পরিচিত তা ষাটের দশক থেকে যে বিশ্ব ব্যবস্থা গড়ে উঠছিল তা তচনচ করে দিচ্ছে। মানুষের মনের আদিম প্রবৃত্তিগুলো যা ঢেকে রাখার চেষ্টা হচ্ছিল তা এই মুসলমানদের কারণেই আবার জাগ্রত হয়। পাশ্চাত্যে যে মানবতাবাদের সৃষ্টি হয়েছিল সেটিও হুমকির সম্মুখীন।
নাসিরনগর, গোবিন্দগঞ্জ, মানিকগঞ্জের ঘটনা আর ডোনাল্ড ট্রাম্পের বিজয় দেখে এ কথাগুলো মনে হলো। ট্রাম্পের বিজয় কোন গণতন্ত্রের বিজয় নয়। এ বিজয় প্রতিক্রিয়ার ও বর্ণবাদের। পৃথিবীর মানুষের একটি বড় অংশই জন্মগতভাবে প্রতিক্রিয়াশীল ও ধর্মান্ধ। প্রশ্ন উঠতে পারে, পৃথিবী এতটা এগোলো কীভাবে? উত্তরটা জটিল ও পরস্পরবিরোধী মনে হতে পারে।
পৃথিবী এগিয়েছে, এগোয় প্রগতিবাদীদের জন্য। তারা সারা জীবন প্রগতির জন্য লড়াই করে, মার খায়, লড়াই করে ফের এবং এক সময় নিজেদের ধারায় ক্ষমতা আনতে পারে। তার সময়টুকুতেই দেশ এগোয়, উন্নয়ন হয়, অর্জন হয়। কিন্তু এর সময় কম। প্রতিক্রিয়াশীলরা সবসময় ঐক্যবদ্ধ, তারা কাউকে অন্তর্ভুক্ত করে না। প্রগতিবাদীরা স্বাভাবিকভাবেই ঐক্যবদ্ধ নয় এবং উদারনীতির কারণে তারা সবাইকে অন্তর্ভুক্ত করে। প্রতিক্রিয়াশীলদেরও সেসব কারণে এবং এর সম্মিলিত ফল পরাজয়।
প্রতিক্রিয়ার ধারকরা মর্তে যে জীবন যাপন করে তা করতে দেয় প্রগতিবাদীরা।
পাশ্চাত্য এবং আমেরিকায় যে মানবতাবাদী ধারা গড়ে উঠেছিল তা আজ থাকবে কিনা সেটা বড় প্রশ্ন হয়ে দাঁড়িয়েছে। ট্রাম্প মেয়েবাজিতে ওস্তাদ, টাকা চুরিতেও, মানুষকে অবিরাম গালাগালে দক্ষ, অশ্বেতাঙ্গদের নরকের কীট মনে করে, অভিবাসীদের ও মুসলমানদের বহিষ্কারের হুমকি দেয়। এর কোনটিই মানবতাবাদ ও সভ্যতার পক্ষে নয়। লক্ষ্য করবেন, মিডিয়া থেকে শুরু করে কেউ কিন্তু বলেনি যে, ট্রাম্পের পূর্বপুরুষও অভিবাসী। মেয়েরা প্রচুর পরিমাণে ভোট দিয়েছে ট্রাম্পকে। কেননা, তারা তাকে পৌরুষের প্রতীক হিসেবে বিবেচনা করেছে। সদ্য নাগরিকত্ব পাওয়া হিজাব পরা এক তরুণী জানালেন, তিনি ট্রাম্পকে ভোট দিতেন যদি কয়েকদিন আগে নাগরিকত্ব পেতেন।
চলবে...
উৎসঃ জনকণ্ঠ
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন