আলবদরীয় রাজনীতি কি শেষ হবে?
06 May 2016, Friday
আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির দণ্ড কার্যকরে এখন আর কোনো বাধা নেই। সুপ্রিম কোর্টের রিভিউ আবেদন বাতিল হওয়ার পর এখন শুধু রায় কার্যকরের অপেক্ষা। আলবদর নেতা মতিউর রহমান নিজামীর প্রতি আমার ব্যক্তিগত ক্ষোভ আছে। আলবদর বাহিনী ১৯৭১ সালে নিজামীর নির্দেশে আমার শিক্ষকদের হত্যা করেছে। অধ্যাপক গিয়াসউদ্দীন আহমেদ, অধ্যাপক ভট্টাচার্য, অধ্যাপক আবুল খায়ের, অধ্যাপক রশীদুল হাসান—তাঁরা ছিলেন আমার সরাসরি শিক্ষক। শিক্ষার মাধ্যমে মানব উন্নয়ন, ছাত্রদের প্রতি ভালোবাসা—এসব আমি তাঁদের কাছ থেকে শিখেছি। তাই সব সময় আমার মনের মধ্যে এটা ছিল যে এই লোকটির বিচার হওয়া উচিত। আজকে যে শুভ্র শ্মশ্রুমণ্ডিত মতিউর রহমান নিজামীকে আমরা দেখি, যাকে দেখলে কখনোই মনে হয় না যে এই লোকটি একসময় কত অমানবিক ছিল! তারা মানুষকে শুধু মেরেই ক্ষান্ত হয়নি, মানুষের চোখ উপড়ে নিয়ে বস্তায় ভরে রেখেছিল। এমন বস্তাবন্দি চোখ মিরপুর, মোহাম্মদপুর থেকে উদ্ধার করা হয়েছিল। মোহাম্মদপুরের ফিজিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারের দারোয়ান বলেছিল, মেঝে থেকে ছয় ইঞ্চি পুরো রক্ত জমে কাদাটে হয়ে গিয়েছিল। আজকে রায়েরবাজার বধ্যভূমিও সেই সাক্ষ্য বহন করে।
মতিউর রহমান নিজামীকে ইসলামী চিন্তাবিদ বা ইসলামী রাজনীতির ধারক মনে করেন অনেকে। ধর্মীয় মনোভাব থেকে এটা মনে হতে পারে। কিন্তু এই মানুষটির পেছনের ইতিহাস যে এমন কুৎসিত, এটা জানার পর এ মনোভাব নিশ্চয় কারো থাকবে না। আমরা আশা করি, মতিউর রহমান নিজামীর ফাঁসির রায় দ্রুত কার্যকর হবে। কিন্তু এর সঙ্গে এটা আশা করা যায় যে এই রায় কার্যকরের ফলে আলবদরীয় রাজনীতি শেষ হওয়ার পথে আরো এক ধাপ এগিয়ে যাবে।
আজকে বাংলাদেশে যা ঘটছে তা হলো মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার পরের প্রতিক্রিয়া। এখনো এ দেশে মুক্তিযুদ্ধ, সেক্যুলারিজম, গণতন্ত্রের প্রতীক শেখ হাসিনা। সে কারণে দেখা যাচ্ছে বারবার শেখ হাসিনাকে হত্যার ষড়যন্ত্র হচ্ছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের রায় কার্যকর করার মধ্য দিয়ে নিজামীদের রাজনীতির ওপর আঘাত আসছে। এই কারণে তারাও মরিয়া হয়ে উঠছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশের সবচেয়ে বড় জঙ্গি সংগঠন হলো জামায়াত। আর এই সংগঠনের সহযোগী হলো বিএনপি। জঙ্গিরা এখন বিভিন্ন নামে কাজ করছে। একজনের পর একজনকে খুন করছে। তাদের সঙ্গে কোনো যুক্তি চলে না। কারণ তাদের রাজনীতি হচ্ছে অন্ধ কুসংস্কারজনিত বিশ্বাস। তারা এই সরকারকে বিদেশিদের কাছে ব্যর্থ প্রমাণ করতে চাইছে। তারা বাংলাদেশকে পাকিস্তানের কাতারে প্রতিষ্ঠিত করতে চায়। বাঙালি সত্তাকে পরাস্ত করতে চায়। তারা জানে শেখ হাসিনাকে হত্যা করতে পারলে মুক্তিযুদ্ধের যে উজ্জীবিত শক্তি, তা আর থাকবে না। সেখানে হয়তো অন্য কেউ আসবে, যার মাধ্যমে তারা নিজেদের শক্তি প্রতিষ্ঠিত করতে পারবে। যাদের রাজনীতির মূল হলো হিংসা, বিদ্বেষ, হত্যা—সেই রাজনীতি আমরা কখনোই করতে দিতে পারি না।
খুবই দুঃখের সঙ্গে বলতে হচ্ছে, আমরা যে রাজনীতির কথা সরকারকে বলতে চাচ্ছি সরকার তা গ্রহণ করছে না। এই মতিউর রহমান নিজামীরা ১৯৭১ সাল থেকে শুরু করে ১৯৯০ থেকে ১৯৯৬, ২০০১ থেকে ২০০৭ সাল—এই সময়ে কখনো জিয়াউর রহমান, কখনো এরশাদ আবার কখনো খালেদা জিয়ার শক্তি ব্যবহার করে জামায়াতি রাজনীতিকে শক্তিশালী করেছে। তারা বাংলাদেশে অন্ধকারের রাজনীতি প্রচার করেছে। তাই এখন মানবতাবিরোধী অপরাধীদের বিচারের কথা উঠলে বিএনপি কোনো কথা বলে না। একেবারে চুপ থাকে। তাদের রাজনীতি মানুষের মনোজগতে একটা আধিপত্য বিস্তার করে আছে। এই আধিপত্য শুধু সাংস্কৃতিক লড়াইয়ের মাধ্যমেই ধ্বংস করা সম্ভব।
বাংলাদেশ সরকারের বর্তমান ঝোঁক প্রবৃদ্ধির দিকে। অন্য বিষয়গুলো না দেখে শুধু জিডিপি বৃদ্ধি করতে গেলে সৌদি আরব বা মধ্যপ্রাচ্যের অন্য কোনো দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের পার্থক্য থাকবে না। কিন্তু আমরা কি সেই বাংলাদেশ চাই? নতুন প্রজন্ম কি এটা চায়? তাহলে আমাদের সেই আধিপত্যের বিরুদ্ধে সাংস্কৃতিক লড়াই চালাতে হবে। শেখ হাসিনা দেশের অর্থনীতিকে যে জায়গায় নিয়ে গেছেন সেখান থেকে নামবে না। স্বাভাবিক চলমানতা বজায় থাকবে। সরকারের দরকার শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে জিডিপি বৃদ্ধি করা। সরকার সামরিক খাতে যে ব্যয় করে তা সাংস্কৃতিক উন্নয়নে লাগে না। এটা কমিয়ে শিক্ষা ও সংস্কৃতিতে ব্যয় বাড়ানো দরকার। সমালোচনা হয় সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে। এটি করতে পারলে আমরা বর্তমান সনদ বিক্রির শিক্ষা থেকে বেরিয়ে এসে ইতিহাস, সংস্কৃতির শিক্ষায় শিক্ষিত হতে পারব। আর এটা খুবই স্পষ্ট যে বারাবার জামায়াতের রাজনীতি নিষিদ্ধ করার কথা বলা হয়। আমি এর সঙ্গে বিএনপির রাজনীতি নিষিদ্ধ করার দাবি জানাই। একটা স্বচ্ছ, শক্তিশালী দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তুলতে না পারলে শুধু নিজামীর ফাঁসি আখেরে দেশের রাজনীতির জন্য কোনো সুফল বয়ে আনতে পারবে না।
লেখক : অধ্যাপক, ইতিহাস বিভাগ,
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন