টেলিভিশন সংবাদে যেদিন সন্ধ্যায় দেখলাম অর্থমন্ত্রী এমএ মুহিত বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের রগড়াচ্ছেন, সেদিন গায়ে খানিকটা লেগেছিল কিন্তু আমোদও পেয়েছিলাম। তাঁর বক্তব্যের প্রথম অংশটা থেকে মারাত্মক ছিল দ্বিতীয় অংশটি, যেটিতে তার বিশাল ক্রোধ ফুটে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা প্রথমটি নিয়ে মেতে উঠেছিলেন, দ্বিতীয়টির কথা প্রায় ভুলে গিয়েছিলেন। দ্বিতীয়টি ভুলে না গেলে যে কী লঙ্কাকা- হতো তা ভাবতেই কাহিল লাগছে। কবে যে শিক্ষকরা স্মার্টফোনের মতো স্মার্ট হবেন! যা হোক, আমোদ লেগেছিল অন্য কারণে। কারণ, তার বক্তব্য অর্থমন্ত্রীর মতো ছিল না। বোঝা যাচ্ছিল তিনি একটি গ্রুপের মুখপাত্র হিসেবে কথা বলছেন এবং অনেক তথ্য না জেনে। আমাদের সমস্যা হলো আমরা পরের মুখের ঝাল খাই।
এ ঘটনার পর, আমি বিভিন্ন জনবিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ফোন পেয়েছি। তখন ছিলাম রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে। ঢাকার মতো সেখানেও দেখি প্রধান আলোচ্য এমএ মুহিত। জানা কথা যে, কোথাও তার পক্ষে একটি বাক্যও শুনিনি। কনিষ্ঠরা এই বলে অভিযোগ করেছেন, আপনি কিছু লিখছেন না কেন? সরকারের যে কেউ যা তা বলে পার পেয়ে যাবে! ভাবটা এমন, যেন, আমি লিখলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে। ও রকম হলে তো প্রধানমন্ত্রী আমাকে তাঁর উপদেষ্টা বানাতেন। তারা আমাকে তাতাতে চাইলেও তখনই কলম নিয়ে বসে পড়িনি। বয়স শিখিয়েছে ধৈর্য ধরতে। আগে, এরকম কিছু শুনলে ঝাঁপিয়ে পড়তাম তৎক্ষণাৎ। যে বয়সের যে ধর্ম। তা’ছাড়া আর কয়েক মাস পর বিশ্ববিদ্যালয় হবে আমার পুরনো কর্মক্ষেত্র। কে কী বেতন পাবে না পাবে তা নিয়ে আমার মাথাব্যথা কী? আর বৃদ্ধ বয়সে সরকারের প্রভাবশালীদের কোপে পড়ে লাভ কী? তারপরও কেন লিখছি। প্রশ্ন করতে পারেন। কারণ, চার দশকেরও বেশি বিশ্ববিদ্যালয়ের নুন খেয়েছি। আমরা যতই মিরজাফরের কথা বলি না কেন, মিরজাফর খুব বেশি লোক হয় না। নেমকহারাম শব্দটা আমাদের ভাষায়ই আছে। এই অত্যাশ্চর্য শব্দটির উদ্ভব বোধহয় এ কারণে যে, ধরে নেয়া হয় নুন খেলে গুণ গাইতে হয়। কেউ গাইবে না সেটি আশ্চর্যজনক। তাই নেমকহারাম!
নুনের গুণ গাইতে গিয়ে সমাধান হলো সেই প্রশ্নের যে, কেন অর্থমন্ত্রী এত উত্তেজিত হলেন। কারণ, তিনিও নুন খেয়েছেন আরেক প্রতিষ্ঠানের। তিনি মন্ত্রী হন আর যাই হন, তিনি সেই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে যেতে পারেন না। তাদের স্বার্থই তিনি দেখবেন, মন্ত্রী হলেও এবং এটাও স্পষ্ট হলো যে, তিনি এখনও রাজনীতিবিদ হয়ে উঠতে পারেননি। জনপ্রতিনিধি হতে পারেন, রাজনীতিবিদ হননি। আর এ বয়সে তা সম্ভবও নয়। তিনি কি লক্ষ্য করেননি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকদের বেতন নিয়ে আন্দোলনে কোন রাজনীতিবিদ মন্তব্য করেননি। এমনকি সুরঞ্জিত সেনগুপ্তও, যিনি প্রতিদিন কিছু না কিছু বলেন। কারণ, তিনি যে প্রতিষ্ঠান থেকে উঠে এসেছেন তার কাছে মনে হয়েছে বাংলাদেশে সেটিই সবচেয়ে বড় প্রতিষ্ঠান। পাকিস্তান আমলের সেই ধারণাটা রয়ে গেছে হয়ত। এ ধারণা আরও বদ্ধমূল হয়েছে সরকারের আমলা তোষণ নীতির কারণে। কিন্তু যারা রাজনীতি করেন বা জীবন শুরু করেছেন রাজনীতি দিয়ে তারা জানেন, বিশ্ববিদ্যালয় নামক প্রতিষ্ঠানের অন্তর্নিহিত শক্তি কী। সরকার হয়ত দেখছে, গুটিকয় শিক্ষক ব্যানার হাতে দাঁড়িয়ে থাকছেন, এদের আবার শক্তি কী! তারা ছাত্রদের হিসেবের মধ্যে আনেননি। বিশ্ববিদ্যালয় মানে ছাত্র-শিক্ষক। ১৯৫২ থেকে সমরশাসক মঈনউদ্দিন পর্যন্ত যত আন্দোলন হয়েছে তা শুধু ছাত্র বা শুধু শিক্ষকের নয়। ছাত্র শিক্ষক মিলিয়েই। সে প্রসঙ্গে পরে আসছি। তার আগে একটি ঘটনার কথা বলি।
১৯৭১ সালের যুদ্ধাপরাধী, খুনী মেজর জেনারেল রাও ফরমান আলীর সাক্ষাতকার নিচ্ছিলাম তার ডেরা রাওয়ালপি-িতে। কথায় কথায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কথা উঠল। দেখলাম তিনি বলা নেই কওয়া নেই ক্ষেপে গেলেনÑ তার মূল বক্তব্য ছিল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়! এখানকার মাস্টাররা হিন্দু ভাবাপন্ন, পাকিস্তানের বিরোধী। তারা ছাত্রদের মন বিষিয়ে দিচ্ছে। আর বাঙালীরাও পারে বটে। ছাত্রদের কথা, মাস্টারদের কথা শোনে। আর মানুষ কেন, ছাত্রনেতা যদি বলে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর দিয়ে পাখি উড়ে যাবে না তাহলে পাখিও তা মানবে। আসলে কথাটা অতিরঞ্জিত; কিন্তু পাকিস্তানীরা যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর প্রচ- ক্ষিপ্ত তা ফরমান আলীর বক্তব্যই প্রমাণ।
এ তো পাকিস্তান আমলের কথা। কিন্তু স্বাধীন হওয়ার পর বঙ্গবন্ধুর আমল ছাড়া এসব বিষয়ে সরকারের দৃষ্টি অস্বচ্ছ রয়ে গেছে। কারণ, বিশ্ববিদ্যালয় এদের সমর্থন করেনি। তাদের আস্থা রাখতে হয়েছে তাদের প্রতিষ্ঠান আমলাতন্ত্রের ওপর যা বহন করছে পাকিস্তানী ঐতিহ্য। আমরা যে সব আমলকে গণতান্ত্রিক সরকার বলে অভিহিত করি তারাও নানা কারণে নিজেদের শক্তিশালী মনে না করে পুরনো রীতিই বজায় রেখেছে। এ কারণে, উন্নয়ন হচ্ছে; কিন্তু মানসিক বিকাশ বা মুক্তচিন্তা হচ্ছে না। এটা কি আশ্চর্য নয় যে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক ধারণা পাকিস্তান আমলে রেখে দিয়েছি, ১৯৭১-এর পর তা শুধু রেখে দেয়া নয়, তার সঙ্গে ফিউশন হয়েছে পাকিস্তানী ঔপনিবেশিক চিন্তা-ভাবনা। এ থেকে রাজনীতিবিদ, আমলা বা শিক্ষক কেউই সম্পূর্ণভাবে বেরুতে পারছেন না। এটাই হচ্ছে ঔপনিবেশিকোত্তর উপনিবেশিক মন।
যাক, পুরনো প্রসঙ্গে ফিরে আসি। এ লেখা যখন লিখছি তখনও নানা অনুরোধ আসছে। এক সময় মনে বিভ্রম জাগছে, আরে লেখা ব্যাপারটা কি এতই শক্তিশালী! না, পরে বিভ্রম কেটে যাচ্ছে। তবে, একেবারে শক্তিহীন তাও ভাবি না। আমি তাদের বলেছি, জনাব মুহিতের বিরুদ্ধে আমি কিছু লিখতে পারব না। আমাদের পরিচয় চার দশক, ড. ফরাসউদ্দিনের সঙ্গেও। তারা আমাকে যথেষ্ট স্নেহ করেন। এবং গুরুজন হিসেবে আমি তাদের শ্রদ্ধা করি। আরেকটি কথা বলি, জনাব মুহিত সব ধরনের সরকারের সঙ্গে কাজ করেছেন। এদেশের প্রশাসনিক ব্যবস্থা সম্পর্কে তার ধারণা গভীর। এবং আমার জানা মতে তিনি জ্ঞানত কোন ব্যক্তির অপকার করেননি। ড. ইউনূসের সঙ্গে যখন সরকারের বোঝাপড়ার অভাব, তখন প্রথম বছরটি তিনি ড. ইউনূসের পক্ষেই ছিলেন। এরপর ড. ইউনূসের কর্মকা-ের সমালোচনা করেছেন, কিন্তু কোন ক্ষতি করতে এগোননি। আমি এবং আমরা যখন তার কাছে গেছি, সমাদরই পেয়েছি। আমরা ভিন্ন ভিন্ন পেশায় আছি, কিন্তু যখন কোন আলোচনা করছি তখন কোন সমস্যা হয়নি। এখন কেন আমরা মুখোমুখি? ব্যাপারটা ভেবে দেখেছি।
আসলে, আমাদের চিন্তা-ভাবনা নিয়ন্ত্রণ করছে আমাদের পেশাগত স্বার্থ। এবং সে চিন্তাটা গতানুগতিক, যেটি ড. ফরাসউদ্দিন বা জনাব মুহিতের মতো এনলাইটেন্ট মানুষের কাছে আশা করা যায় না। আজ যদি অর্থমন্ত্রী হতেন কক্সবাজারের জনাব বদি তাহলে মানুষ আর যাই হোক এনলাইটেনমেন্ট আশা করত না। ঝামেলাটা এখানেই হয়ে গেছে। যে পেশায় জীবন শুরু করেছি সেটি প্রথম প্রেম। ঝাড়ি খেলেই কি সেই প্রেম উধাও হয়ে যাবে? সে জন্য আমি তাদের সমালোচনা করব না, সমস্যাটা বোঝার চেষ্টা করব মাত্র।
দুই.
জনাব মুহিত শিক্ষকদের সম্পর্কে, বিরুদ্ধে বললে বোধহয় আরও নির্দিষ্ট হয়, যে কথা বলেছেন, তার দুটি ভাগ আছে। প্রথমটি বাংলায়, দ্বিতীয়টি ইংরেজীতে। পুরোটা ইংরেজীতে বললে তিনি শুধু নয়, সরকারও বিব্রতকর অবস্থায় পড়ত। কারণ, তাহলে অবশ্যম্ভাবী যে তিনি বলতেন, এইসব স্টুপিডরা কি সব রাবিশ বলছে। ভাগ্যিস তিনি বলেননি।
প্রথম ভাগে তিনি বলছেন, শিক্ষকরা বুঝতে পারছে না তাদের অজ্ঞতার কারণে। আমি স্বদেশকে ফোনে বললাম, আমাদের প্রিয় অর্থমন্ত্রীতো সবাইকে বিপদে ফেললেন। অতীশ দীপঙ্করকে বলা হতো শ্রী জ্ঞান। নিজেকে তা না ভাবলেও, চিন্তাটা ছিল শ্রী তো বটেই। এখন দেখা যাচ্ছে, আমরা ভুল করেছি। সরকার তো আমাদের অজ্ঞান ভাবছে। এখন আমি অজ্ঞান মুনতাসীর মামুন। বাকিরা শ্রী জ্ঞান এএমএ মুহিত, শ্রী জ্ঞান স্বদেশ রায় বা শ্রী জ্ঞান মোশাররফ হোসেন ভুঁইয়া।
আসলে অর্থমন্ত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, বেতন স্কেলের পুরো বিষয়টা শিক্ষকরা বুঝতে পারেননি। কিন্তু সেটা বোঝাতে গিয়ে হয়ে গেছে শিক্ষকদের সামষ্টিক অজ্ঞতা। এতে শিক্ষকদের ক্ষুব্ধ হওয়ার যথেষ্ট কারণ আছে। কারণ, অজ্ঞতা যদি আমাদের ভূষণ হয় তাহলে শিক্ষকতার ভিত্তিটাই থাকে না। এ পরিপ্রেক্ষিতে, শিক্ষক সমিতি ফেডারেশনের অধ্যাপক ফরিদউদ্দিন যদি বলেন, আমি অর্থনীতির শিক্ষক, অর্থনীতি আমি অর্থমন্ত্রীর থেকে বেশি বুঝি। উনি ইংরেজীর ছাত্র, উনি অর্থনীতির কি বোঝেন? আসলে অর্থমন্ত্রী হলে তো আমারই হওয়া উচিত। তিনি সাহিত্যচর্চা করুন অথবা অধ্যাপনা করুন। তাহলে ব্যাপারটা কোথায় গড়ায়? কিন্তু, মূল বিষয় সেটি নয়। আমরা বাঙালী মুসলমান নিম্নবিত্ত পরিবার থেকে সবে সচ্ছল মধ্যবিত্তে রূপান্তরিত হয়েছি। গরিব তার স্বার্থ বোঝেন না; কিন্তু মধ্যবিত্তের স্বার্থজ্ঞান টনটনে। শিক্ষকরা নিম্ন/সচ্ছল/ একেবারে গরিব পরিবার থেকে এসেছেন। তারা নিজেদের স্বার্থ বোঝেন না সেটি হয়।’ একজন আমলা তার স্বার্থ বুঝলে অন্যরা বুঝবে না তা হয় না। বুঝতে হয়ত একটু সময় লাগে। কিন্তু মধ্যবিত্ত তার স্বার্থ বোঝে।
পে-কমিশন যখন হয় তখন কমিশনের সদস্যরা তো শিক্ষক প্রতিনিধিদের সঙ্গে বসেছিলেন। তাদের মতামত নিয়েছেন। তাদের আশ্বাস দেয়া হয়েছিল তাদের গ্রেড ঠিক থাকবে। কিন্তু, গ্রেডেরও যে মারপ্যাঁচ আছে সেটি তারা উপলব্ধি করতে পারেননি।
এমনকি এতে তাদের যে ক্ষতি তাও তারা বোঝেননি। পে-কমিশনের কয়েকদিন পর আমি একজন শিক্ষক নেতাকে ফোন করে বললাম, কী হে ছিলাম কোথায়, তোমরা আনলে কোথায়? যারা সরকারী দল করেন নিষ্ঠভাবে কিছুর আশায় [না, আদর্শের মিশ্রণও আছে] তারা নিজেদের সরকারী প্রতিনিধি ভাবেন। আমাকে তিনি জানালেন, কেন স্যার সব তো ঠিকঠাক আছে। আমি বললাম, তোমার উত্তরটা বোধহয় ঠিক না। তিনি জানালেন, কী যে বলেন স্যার, আপনি বোঝেননি ব্যাপারটা। আমাদের বলা হয়েছে, অবস্থান ঠিক থাকবে, তাই তো আছে। আমি বললাম, তোমার চাকরি হয়েছে কয় বছর? জানাল, বিশ বছর। বললাম, তুমি আমার থেকে ২৩ বছর পিছিয়ে আছ। আমি ফরিদের সঙ্গে কথা বলি। তার সঙ্গে আমার তফাৎ এক বছরের। সে হয়ত বুঝবে। আমার অনুজ সহকর্মী পরদিন উপাচার্য পদে নিয়োগ পেয়ে চলে যান। তার সঙ্গে আর আলোচনার সুযোগ হয়নি। ফরিদও প্রথমে একই উত্তর দিয়েছিল। শিক্ষকদের অজ্ঞতা যেটা সেটা হলো, আমলাতন্ত্রের ও তাদের প্রতিভুদের মারপ্যাঁচ অতটা বুঝতে পারে না। এক ধরনের সারল্য তাদের মধ্যে কাজ করে। কারণ তারা কাজ করে ১৭ থেকে ২২ বছরের ছেলেমেয়েদের সঙ্গে। চিরজীবন এডলোসেন্টই থেকে যায়। এই পরিপ্রেক্ষিত থেকে দেখলে, শিক্ষকদের অজ্ঞ বলা যায় বটে।
চলবে...
প্রকাশিত : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০১৫
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন