আমাদের অভাবটা কোথায়
18 January 2021, Monday
এই কলাম যখন লিখতে বসেছি তখন আমাদের সামনে অনেক কিছুই আলোচনা করার আছে। দেশ পঞ্চাশ বছর পূর্তি করার প্রস্তুতিতে রয়েছে। এ সময় পেছনে তাকিয়ে দেখার মতো অনেক বিষয় আছে। সবচেয়ে বড় জিজ্ঞাসার বিষয় হচ্ছে, আমরা স্বাধীনতার অঙ্গীকার কতটা বাস্তবায়ন করতে পেরেছি? এই মূল্যায়ন জরুরি। আমাদের সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলোর অবস্থা অত্যন্ত করুণ। কোনো প্রাতিষ্ঠানিকতা দাঁড় করানো সম্ভব হয়নি। সরকার ও ক্ষমতাসীন দল একাকার হয়ে গেছে, এর ভেতর সরকার ও সে দলে নানা সঙ্কটের জন্ম হয়েছে। সরকারি দল ক্ষমতার লড়াইয়ে নিজেদের এক গ্রুপ অন্য গ্রুপকে চ্যালেঞ্জ করে সঙ্ঘাতের মুখোমুখি অবস্থানে রয়েছে। এই দুঃখবোধ ও বেদনা আমাদের কতটা ভাবাচ্ছে- এ প্রশ্নটির একটা যৌক্তিক সমাধান খুঁজে পাওয়া দরকার। গণতন্ত্র যেন ‘সোনার হরিণ’।
সরকার সব ব্যাপারে সাফল্য দাবি করছে অথচ এ যুক্তি খণ্ডানোর কোনো পথ খোলা রাখা হয়নি। তাই জনমনে নানা প্রশ্ন থাকলেও সবাই নিয়তিবাদী হয়ে বসে আছেন। কোনো ভিন্নমত সহ্য করা হয় না, অথচ সর্বত্র গণতন্ত্রের জয়ঢাক বাজানো হচ্ছে।
খ. মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নিয়ে আলোচনা তুঙ্গে। আমরা চরিত্রগতভাবে যুক্তরাষ্ট্র সম্পর্কে সবসময় গভীর পর্যবেক্ষণে থাকি। বড় দেশ বলে কথা! তাই, তাদের নিয়ে সারা বিশ্ব ভাবে। একজন ট্রাম্প, যাকে কেউ বলে ‘পাগল’, কেউ ভাবে ‘জোকার’, কারো ধারণা তিনি এক ধরনের ‘মাতাল’। হেন অপকর্ম নেই যা তিনি করেননি। তার পরও তার প্রতি সমর্থন উল্লেখ করার মতো। তা বলে জনগণের ওপর দোষ চাপিয়ে লাভ নেই, গরিষ্ঠ মানুষ তাকে পছন্দ করেনি, এটাই মার্কিন গণতন্ত্রের সৌন্দর্য। তার চেয়েও বড় কথা, তাদের প্রাতিষ্ঠানিকতা। নির্বাচন কমিশন নিয়ে তাদের আস্থায় কোনো চিড় ধরেনি। প্রশাসন নিয়ে দলীয়করণের অভিযোগ তোলা হয়নি। বিচার বিভাগ নিয়ে কারো কোনো প্রশ্ন নেই। অথচ বর্তমান বিচার বিভাগকে সাজিয়েছিলেন ট্রাম্প। নির্বাচনে তার দলীয় লোকজনও তীব্র অভিযোগ আমলে নিতে পারেননি। তাই যুক্তরাষ্ট্রকে শেষ পর্যন্ত রক্ষা করেছে এর প্রাতিষ্ঠানিকতার মৌল বৈশিষ্ট্যটি। অন্যথায় দেশটির অঙ্গরাজ্যগুলো ছিটকে পড়ত। তাদের পররাষ্ট্রনীতি ও বিভিন্ন দেশ নিয়ে তাদের ভাবনার সাথে দ্বিমত করার যথেষ্ট সুযোগ রয়েছে। কিন্তু স্বীকার করতেই হবে, তারা তাদের প্রাতিষ্ঠানিকতার ব্যাপারে শতভাগ সৎ ও নিষ্ঠাবান। এই নিষ্ঠার প্রমাণ রাখতে সংবিধানকে যেকোনোভাবেই হোক, রদবদল করার পক্ষে নয়। যদিও কিছু বিষয় নিয়ে নতুন করে ভাবার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। সেটাও নিয়মতান্ত্রিকতাকে চ্যালেঞ্জ করে নয়। এটাই তাদের ভারসাম্যের প্রমাণ।
আমাদের নির্বাচন কমিশন যখন ভোট গণনার বিষয়টি নিয়ে রসাত্মক মন্তব্য করছে তখন মার্কিন জনগণ তো বটেই যেন শয়তানও অট্টহাসি দিয়েছে। অথচ মার্কিন নির্বাচন কমিশন এতটা স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতার প্রমাণ রেখেছে যে, তা রীতিমতো উপমা দেয়ার মতো। নির্বাচন কমিশনের সাথে ট্রাম্পের দলীয় লোকজনও সংশ্লিষ্ট ছিলেন। তারা তাদের সাংবিধানিক দায়িত্ব পালনে একচুলও ছাড় দেননি। এটাই হলো সংবিধানের প্রতি নিষ্ঠার প্রমাণ, অথচ আমাদের কমিশন নিয়ে মন্তব্য করাও রুচিকর নয়। তাই এত আশঙ্কার পরও মার্কিন ভারসাম্যপূর্ণ ব্যবস্থা দেশটিকে শেষ পর্যন্ত একটা অবস্থানে নিয়ে গেছে। আমাদের সরকারের উচিত এর ভালো দিকগুলো নিয়ে ভাবা। বিরোধী দল বলতে বাংলাদেশে কার্যত বিএনপি যদিও ‘গৃহপালিত’ বিরোধী দল বলতে জাতীয় পার্টি রয়েছে। তাদেরও আত্মসমালোচনা করার সময় এসেছে। তাদের অতীত বর্তমান ও ভবিষ্যৎ নিয়ে জনগণকে যথার্থ বার্তা দেয়া, দমনপীড়ন নিয়ে কান্নাকাটি করার সময় রাজনীতিতে নেই। বাস্তবে এমন একটি পরিকল্পনা করার সময় এসেছে তারা কোন প্রক্রিয়ায় জনগণের কাছে যাবেন। সরকার সাধারণত স্বৈরতন্ত্রে অভ্যস্ত। এটাকে তারা অহঙ্কার ভাবতে শুরু করেছে। অথচ দেশের সবচেয়ে প্রবীণ দল, দেশের স্বাধীনতায় তাদের ভূমিকা সব বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু দেশের সংবিধান রক্ষা, চর্চা ও অনুশীলনের অঙ্গীকার তারা পালন করতে নারাজ কেন? তারা ক্ষমতার বাইরে যেতে চান না, কিংবা ভয় পান, অথচ আল্লাহ এমন কোনো নিয়ম রাখেননি। কোনো দলই শেষ কথা নয়, পৃথিবীর তাবৎ মানুষ সাক্ষ্য দেবে সব মানুষ ও দল একসময় গুরুত্বপূর্ণ অবস্থানে থাকে; কিন্তু অপরিহার্য হয়ে যায় না, প্রত্যেক মানুষের ব্যাপারেও এটি শতভাগ সত্য। অতীত শাসকদের ইতিহাস সামনে রাখলে এই বাস্তবতা সহজেই বোধগম্য হওয়া সম্ভব। আশা করি শাসক দল ভবিষ্যৎ নিয়ে ভাববে।
অপর পক্ষে মার্কিন রাজনীতিতে বিরোধী দলকে চ্যালেঞ্জ করা হয় না, তারা ছায়া সরকারের ভূমিকা পালন করে। স্মরণ রাখতে হবে, ট্রাম্প এবং রিপাবলিকান এক বিষয় নয়। সময়ে দেখা যাবে, রিপাবলিকানরা কিভাবে দায়িত্বশীল আচরণ করবেন।
গ. আমাদের ‘জাতির বাতিঘর’ খ্যাত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় শতবর্ষে পৌঁছেছে। এ দিকে বিশ্ববিদ্যালয়টি ঐতিহ্য হারিয়ে এখন একটি সাধারণ বিশ্ববিদ্যালয়। যখন সেখানে ছাত্র ছিলাম তখন ভিসি হিসেবে পেয়েছি ফজলুল হালিম চৌধুরীকে। সবাই তাকে সমীহ করে সহযোগিতা করত। মনে আছে, ডাকসু নির্বাচনে তিনি ছাত্র সংগঠনগুলোকে একবার ডেকেছিলেন। সবাই দলমত ভুলে তাকে সম্মান দেখানোর প্রেক্ষাপটে আমরা সবাই গিয়ে হাজির হয়েছিলাম। তার কোনো দলীয় পরিচয় ছিল না, তিনি ছিলেন প্রকৃত অর্থে, শিক্ষাবিদ। আজকের ভাইস চ্যান্সেলর হন দলীয় পরিচয় নিয়ে। শিক্ষক নিয়োগ করা হয় রাজনীতির পরিচয় নিয়ে। তাই বিশ্ববিদ্যালয়টি এখন এশিয়ার মধ্যে কোনো অবস্থানে নেই। এককালের ‘প্রাচ্যের অক্সফোর্ড’ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় কোনো ইমেজই ধরে রাখতে পারছে না। এ দায় কার?
আমরা এর প্রাক্তন ছাত্র হিসেবে আজ পরিচয় দিতে গর্ববোধ করি না, এটা মনকে শুধু ভারাক্রান্ত করে না, অনির্বচনীয় দুঃখবোধেও আচ্ছন্ন করে।
ওপরে তিনটি প্রসঙ্গ নিয়ে সংক্ষিপ্ত আলোচনা করেছি। দু’টি বিধিবিধান অনুস্মৃতির অভাবে এবং সংবিধান অনুসরণ না করার কারণে প্রাতিষ্ঠানিকতার অভাবে সমস্যা ও সঙ্কটের উদ্ভব ঘটেছে। অন্য দিকে যুক্তরাষ্ট্র সংবিধান অনুস্মৃতি এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত থাকার কারণে ঘোলাটে পরিস্থিতির মধ্যেও প্রাতিষ্ঠানিকতা হারায়নি।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন