হিন্দুত্ববাদের বর্তমান পিতা নরেন্দ্র মোদি হলে ডোনাল্ড ট্রাম্প হলেন এই হিন্দুত্ববাদের ‘খালু’। গ্রামের আবদুল আলী শহরে এসে যেমন করে মালুম করতে পারে না যে, শিঙ্গাড়ার ভেতরে আলু ঢুকল কেমন করে! তেমনি এ দেশের অনেকেই ঠাহর করতে পারেনি যে, এই প্রিয়া সাহা হোয়াইট হাউজে পৌঁছল কিভাবে? যে ট্রাম্প নিজের দেশের সংখ্যালঘুদের রীতিমতো টেররাইজ করে রেখেছেন, সেই খালুর অন্তরটি পৃথিবীর অন্যান্য অংশের সংখ্যালঘুদের দুঃখ-কষ্ট নিয়ে ভীষণ ভারাক্রান্ত হয়ে পড়েছে। সমগ্র পৃথিবী থেকে সংখ্যালঘুদের ডেকে নিয়ে তাদের কষ্টের কথা শুনেছেন। বোধগম্য কারণেই কাশ্মির এবং ফিলিস্তিনের কেউ এই খালুর কাছে ঘেঁষতে পারেনি। তবে প্রতীয়মান যে, বিশেষ আমন্ত্রণ পেয়ে বাংলাদেশ থেকে উড়ে গিয়েছিলেন প্রিয়া সাহা।
স্বামী দুদকের বড় অফিসার, দুই মেয়ে আমেরিকায় থেকে পড়াশোনা করেন। নিজে এনজিওর মালিক, যাদের অধিকাংশের মূল কাজ দেশের মিসকিনি দেখিয়ে বাইরে থেকে খয়রাত এনে সেগুলো মজা করে ভক্ষণ করা। এই নেত্রী সম্পর্কে স্থানীয় বাসিন্দাদের আরো মারাত্মক অভিযোগ রয়েছে। নিজের ভাইয়ের একটি ভাঙা ঘর নিজেই পুড়িয়ে আশপাশের প্রতিদ্বন্দ্বীদের নাকি ফাঁসিয়েছেন। এখন সেই ঘটনায় পুরো দেশ ও জাতিকে কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে ফেলেছেন। হিন্দু-বৌদ্ধ-খ্রিষ্টান ঐক্য পরিষদের ডাকসাইটে নেত্রী। খুশী কবিরসহ মন্ত্রী, এমপিদের সাথে বহু ছবি এখানে-ওখানে ছড়িয়ে আছে।
এদের হম্বিতম্বিতে বরাবরই সবার তটস্থ অবস্থা। এই দেশ থেকে এত কিছু পাওয়ার পরও মনে কেন এত ক্ষোভ রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে? এই দেশে যে দলটিকে নিজেদের অত্যন্ত প্রিয় বলে গণ্য করেন, তাদের বিরুদ্ধেও এমন মারাত্মক অভিযোগ করলেন কেন? এই প্রশ্ন অনেকের মনেই। উত্তরটি খুঁজতে গিয়ে অতীতের কিছু স্মৃতি ভেসে উঠেছে।
যৌবনের ঊষালগ্নে মেরিন একাডেমিতে কিছু অদ্ভুত অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হয়েছিলাম। বাল্যকালে হবুচন্দ্র রাজা ও গবুচন্দ্র মন্ত্রীকে নিয়ে কবিতা পড়েছিলাম। একাডেমিতে গিয়ে মনে হলো, সেই হবুচন্দ্রের রাজত্বে আক্ষরিক অর্থেই ঢুকে পড়েছি। একেকজন সিনিয়র ছিলেন একেকজন হবুচন্দ্রের রাজা। প্রজা সব জুনিয়র। মজার ব্যাপার হলো, ভুক্তভোগী সেই জুনিয়ররা সিনিয়র হয়ে পড়লে এরাই আবার একেকজন পরের ব্যাচের জন্য হবুচন্দ্র হয়ে পড়ত। এই হবুচন্দ্রদের উর্বর মস্তিষ্ক থেকে যেটাই বের হতো, সেটাই জুনিয়রদের জন্য অলঙ্ঘনীয় কানুন হয়ে পড়ত। অনেকটা যেন ‘কাঁদতে কেহ পারবে নাকো, যতই মরুক শোকে’। সিনিয়র কর্তৃক যেকোনো অবস্থায় জিজ্ঞাসিত হলে বলতে হতো, আই অ্যাম এক্সিলেন্ট, স্যার। বহুত বহুত ভালো আছি স্যার। অ্যাটেন্ডিং সি (অসুস্থতার গ্রেইড) নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকলেও একই জবাব দিতে হতো। জানতে চান, কেন বলতাম?
- খুশিতে, ঠ্যালায়, ভাল্লাগতো তাই।
অ্যাটেনশন হয়ে দাঁড়ালে হাত ও শরীরের মাঝখান বরাবর মিসাইল ছুড়লেও আলাদা বা ফাঁক করা সম্ভব হতো না। তার পরও সিনিয়ররা হাত ঢুকিয়ে নিজেই ফাঁক করে আবার চিৎকার দিয়ে উঠতেন, ‘ব্লাডি হেল, হোয়াই গ্যাপ (ফাঁক কেন)?’ ‘তখন কার্টুনের মতো আরো খিঁচা মেরে দুই হাতকে শরীরের সাথে শক্তভাবে লাগাতে হতো শরীরের শেষ শক্তিটুকু নিঃশেষ করে। তারপরও সিনিয়রদের ‘হোয়াই গ্যাপ’ চিৎকার বন্ধ হতো না।
এ অবস্থায় একটা মজার কাণ্ড ঘটে যায়। আমাদের এক বন্ধু প্যানিক হয়ে এমনভাবে দুই হাত শরীরের সাথে চেপে ধরেন যে, সিনিয়র মহোদয় মুশকিলে পড়ে গেলেন। জোর করে হাত ঢুকিয়ে নিজের হাত আর নাড়াতে পারছেন না। ‘হোয়াই গ্যাপ’ চিৎকার এবং হাত বের করার প্রচেষ্টা যুগপৎ চলতে থাকে। জুনিয়র লাইফের সবচেয়ে কষ্টের মুহূর্ত ছিল, এমন মজার দৃশ্য দেখেও হাসা সম্ভব হতো না।
ডান পা তুলতে বললে তুলতাম, পরের বার ডান পা উপরে রেখেই বাম পা তুলতে বললে সেটাও চেষ্টা করতাম। কোনো প্রতিবাদ করা যেত না কিংবা মন থেকে তখন যে উচিত কথাটি বের হয়ে যেত, তা প্রকাশ করা সম্ভব হতো না। কোনো কোনো ইংলিশ ডেইলি সম্পাদক সাহেবও এখন প্রয়োজনে দুই পা তোলার চেষ্টা করেন। উচিত কথাটি নাকি বলতে পারেন না। অথচ আজকের পরিস্থিতি সৃষ্টির জন্য তারা অন্যতম দায়ী। ‘এক/এগারো’ সৃষ্টি হওয়ার পথ সুগম করে তারাই বর্তমান হবুচন্দ্র এবং গবুচন্দ্রদের ক্ষমতায় এনেছেন।
যা হোক, নিদারুণ কষ্টের সেই চিত্রটি আবার স্মরণ হয়েছে ট্রাম্প খালুর কাছে এবার এক নারীর অভিযোগের ভিডিওটি দেখে। দেশের মানুষ তার এ অভিযোগটি শ্রবণ এবং দর্শন করে ফেলবেন, তা হয়তো তিনি এবং তার প্রমোটররা আঁচ করতে পারেননি। কারণ, তিনি শুধু প্রিয় দেশটির বিরুদ্ধেই অভিযোগ উত্থাপন করেননি; প্রিয়তম দলটির বিরুদ্ধেও মারাত্মক অভিযোগ উত্থাপন করেছেন। এতে বলা যায়, কৌশলগত কারণে এ দেশের কোনো কোনো দলকে ব্যবহার করলেও মূলত এ দেশের কেউ তাদের প্রিয় নন।
ওপরের গল্পের মতো পারফেক্ট অ্যাটেনশন হওয়ার একই কিসিমের খিঁচা বা তটস্থ ভাব দেখছি গোবেচারা রাষ্ট্রটির। এটি যতই অ্যাটেনশন বা সেকুলার হয়, ততই দাসগুপ্ত এবং সাহারা চিৎকার করে ওঠেন, ‘হোয়াই গ্যাপ (মৌলবাদ)?’ রাষ্ট্রটি আরো খিঁচা মেরে গ্যাপ কমায়, সেকুলার বনে যায় অধিকতর। তার পরও হুঙ্কার বা নালিশ থামে না। এই গ্যাপ কমাতে কমাতে ৮ শতাংশ জনসংখ্যার জন্য ৩৩ শতাংশ সরকারি চাকরির ব্যবস্থা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী জানিয়েছেন, এই সংখ্যা ২৫ শতাংশ। অথচ আমাদের চেয়ে অধিকতর সেকুলার হওয়ার দাবিদার ভারতের পশ্চিমবঙ্গে ৩০ শতাংশ মুসলিমের মধ্যে সরকারি চাকরি মিলেছে মাত্র ২ শতাংশের কপালে। ওসি, ডিসি, এসপির মতো গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে বাটি চালান দিয়েও সেখানে মুসলিম খুঁজে পাওয়া যাবে না।
এত কিছুর পরও যদি ডোনাল্ড ট্রাম্পের কাছে প্রিয়া সাহা অভিযোগ করেন, তবে এই কষ্ট আমরা রাখি কোথায়? ট্রাম্পের কাছে তিনি নালিশ করে এসেছেন, এ দেশ থেকে নাকি ৩৭ মিলিয়ন হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিষ্টান উধাও হয়ে গেছে! ঐক্য পরিষদের সতীর্থরা মূল থিমটিকে সমর্থন করেছেন।
শুধু ডিজঅ্যাপিয়ার শব্দ ভুল বলে অভিহিত করেছেন। এরা যে তিন কোটি ৭০ লাখ মিসিং পপুলেশনের কথা উল্লেখ করেছেন, হুবহু তাদের ‘ইন্ডিয়ায় পাওয়া গেছে’ বলে কলকাতার একটি পত্রিকাই জানিয়েছে।
আমাদের মেরিন প্রফেশনের যে ক’জন সংখ্যালঘু সদস্যকে চিনি, তাদের বেশির ভাগই কলকাতায় জমি কিনেছেন, বাড়ি করেছেন। এটা শুধু তাদের একার ব্যাপার নয়। ‘উন্নত ও নিরাপদ’ জীবনের আশায় সংখ্যাগুরুদের একটা বড় অংশও অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাজ্য, যুক্তরাষ্ট্র প্রভৃতি দেশে পাড়ি জমিয়েছেন। তাদের কেউ আর এ দেশে ফিরে আসবেন বলে মনে হয় না। তেমনি সংখ্যালঘুদের অনেকেই কলকাতা বা ইন্ডিয়ায় মাইগ্রেট করেছেন উন্নত ও নিরাপদ জীবনের কথা ভেবেই। রানা ও প্রিয়ারা এদেরও মিসিং বলেছেন এবং গোবেচারা রাষ্ট্রটিকে হুঙ্কার ছুড়ছেন এদেরকে খুঁজে বের করার জন্য।
অনুমেয় যে, এই মিসিংরা কেউ কষ্টে নেই, সবাই নিজের পছন্দের জায়গায় মোটামুটি ভালোই আছেন।
এ যেন একাডেমির হবুচন্দ্র সিনিয়রদের সেইসব কানুন। আদিষ্ট হয়ে তখনকার হার্টথ্রব সব নায়িকাকে একেক করে মায়ের বোন খালা ডাকতে হয়েছিল। মেরিন একাডেমিতে এলাম গো, ‘ববিতা খালা বাঁচাও গো, রোজিনা খালা বাঁচাও গো!’
অসহায় রাষ্ট্রকেও তেমন কোরাস তারা ধরিয়ে দিতে চান। কেউ কেউ রাষ্ট্রটির বগলে হাত ঢুকিয়ে যখন ‘হোয়াই গ্যাপ’ বলে চিৎকার করছেন, তখন দেশ ছেড়ে যাওয়া ভাগ্যবানেরা নিজ নিজ পছন্দের জায়গায় বসে কোরাস গাচ্ছেন, নিশ্চিহ্ন হয়ে গেলাম গো, ট্রাম্প খালু বাঁচাও গো!
আমাদের পূর্বপুরুষেরা এ দেশটিকে দু-দু’বার স্বাধীন করেছেন কি হম্বিতম্বি খাওয়ার জন্য! এ দিকে, খালু খোঁজ নিয়েছেন বাড়ির আঙিনায় হেলিকপ্টার নামাতে পারবেন কি না!
প্রিয়া সাহা যদি নিজের সম্প্রদায়ের সঠিক অবস্থা তুলে ধরে বক্তব্য দিতেন, আমরা তার বা তাদের পক্ষে দাঁড়াব। এ কলামটি জীবনের শেষ পর্যন্ত মজলুমের পক্ষে থাকবে ইনশা আল্লাহ। যারা নিজের সম্প্রদায়ের পক্ষে সত্য কথা তুলে ধরতে পারেন না, তারা অন্য সম্প্রদায়ের পক্ষেও ন্যায্য কথা বলতে পারবেন না। এগুলোর বিপরীতে যারা কাজ করেন তারা স্বার্থপর বা মতলববাজ বলে ধরে নিতে হয়। এরা কাজ করেন বা কথা বলেন নিজের কোনো স্বার্থের কথা চিন্তা করে।
সব সাপোর্টিং ডকুমেন্ট নিয়েই বলা যায়, পৃথিবীর মধ্যে সবচেয়ে প্রিভিলাইজড সংখ্যালঘু কোন দেশে রয়েছে। দয়া করে এই অধমকে ভুল বুঝবেন না। পুরো সংখ্যালঘু সম্প্রদায়কে টার্গেট করে এ কথাটি বলছি না মোটেও। বরং একটি সম্প্রদায়ের আবেগ-অনুভূতিকে যারা স্রেফ নিজেদের স্বার্থে ব্যবহার করেন, আমি তাদের বিরুদ্ধে।
আইনের শাসনের অভাবে যে লুটেরা বা দুর্বৃত্ত সংখ্যালঘু পরিবারের সম্পদ দখল করে- খোঁজ নিয়ে দেখুন তার হাত থেকে সংখ্যাগুরুরাও নিরাপদ নয়। কিন্তু এই বিচ্ছিন্ন ঘটনাকেই ‘মুসলিম ফান্ডামেন্টালিস্টদের কাজ’ বলে অনেকে প্রচার চালায়। আমার আপনার নীরবতা এবং পাছে ‘রাজাকার’ বলে এই ভয় মতলবি কিছু লোকের সাহস অনেক বাড়িয়ে দিয়েছে। বাঘা বাঘা অনেক মন্ত্রী-এমপির সাথে দেখা গেছে প্রিয়া সাহাকে ওঠাবসা করতে। প্রধানমন্ত্রীর কাছে পৌঁছানোও তার পক্ষে অসম্ভব ছিল না। তাদের কাউকে না জানিয়ে তিনি সরাসরি কেন ট্রাম্পের কাছে অমূলক অভিযোগটি করতে গেলেন? যে আওয়ামী লীগ তাদের জন্য এত কিছু করল- সেই দলকেও এতটুকু খাতির করলেন না!
২.
মানুষের মন ও শরীর দুটোই অত্যন্ত জটিল এক যন্ত্রবিশেষ। জৈবিক এবং অজৈবিক সব যন্ত্রের রোগ বা ব্যারাম সারানোর জন্য সঠিক রোগ নির্ণয় অত্যন্ত জরুরি। এটিকে ইঞ্জিনিয়ারিং ভাষায় বলা হয় ‘রুট কজ অ্যানালাইসিস’। একইভাবে সমাজ, ধর্ম ও রাজনীতিতে কোনো ব্যারাম দেখা দিলে রুট কজ অ্যানালাইসিসটি করা দরকার। যে সমাজে এটি সঠিকভাবে করা সম্ভব হয়, সেই সমাজ বসবাসের জন্য বেশি উপযোগী বলে গণ্য করা হয়। দুর্ভাগা দেশের প্রথম শ্রেণীর নাগরিকত্ব বাদ দিয়ে সেসব দেশের দ্বিতীয় বা তৃতীয় শ্রেণীর নাগরিকত্ব গ্রহণ করতেও আপত্তি থাকে না। এই লোভনীয় দেশগুলোর প্রায় সব দেশই পশ্চিমা বিশ্বের গণতান্ত্রিক দেশ। এসব দেশের সবচেয়ে বড় আকর্ষণ হলো, রাষ্ট্রব্যবস্থায় আইনের শাসনের উপস্থিতি।
কিন্তু বর্তমান মানবসভ্যতার সবচেয়ে বড় ট্র্যাজেডি হলো, তারা নিজেদের দেশে গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করে ফেললেও আমাদের মতো দেশে সেগুলো প্রতিষ্ঠায় আগ্রহ দেখান না। অনেক সময় উল্টো কাজটি করে থাকেন এবং নানা কিসিমের স্বৈরাচার টিকিয়ে রাখতে সহায়তা দিয়ে থাকেন। এদের মধ্যে সর্বাগ্রে নাম আসে ইউনাইটেড কিংডম এবং মূলত তাদেরই রক্তের উত্তরাধিকারীদের নিয়ে সৃষ্ট সুপার পাওয়ার ইউনাইটেড স্টেটস অব আমেরিকার। এরা ভারতবর্ষের সবচেয়ে বড় ক্ষতি করে গেছে রাজনীতিতে হিন্দু-মুসলিম ধর্মীয় কার্ডটির অপব্যবহার শিখিয়ে। ডিভাইড অ্যান্ড রুলের জন্য যে কার্ডটির ব্যবহার শুরু হয়েছিল, সেটিই দিন দিন এই উপমহাদেশে আরো জটিল এবং মারাত্মক রূপ ধারণ করেছে। এই ধর্মীয় লাইন বরাবর ইন্ডিয়া এবং পাকিস্তান নামক যে দু’টি রাষ্ট্রের সৃষ্টি হয়েছিল- সেই রাষ্ট্রীয় ও রাজনৈতিক বিভাজন জাত ক্ষোভ ও বিদ্বেষ আজো কলোনিয়াল মাস্টারদের কাক্সিক্ষত ফল দিয়ে যাচ্ছে। দু’টি দেশই তাদের জনগণের বিরাট অংশকে অভুক্ত রেখে সেই টাকা দিয়ে এক দেশ অন্য দেশকে ঘায়েল করার জন্য অস্ত্র আমদানি করছে। এখানে মূল অস্ত্র বিক্রেতা ঘুরেফিরে আগেকার সেই কলোনিয়াল মাস্টার এবং তাদের রক্তের ও স্বার্থের নতুন উত্তরাধিকার।
এ দু’টি রাষ্ট্রের একটির পেট থেকেই বাংলাদেশের জন্ম। আমাদের জন্মপ্রক্রিয়ায় অন্য রাষ্ট্রটি অনেকটা দাইয়ের ভূমিকা গ্রহণ করেছে। ফলে ইন্ডিয়া ও পাকিস্তানের মধ্যকার অস্থিরতা আমাদের ধমনিতেও প্রবাহিত। ব্রিটিশ-ভারত ভেঙে যে তিনটি রাষ্ট্রের জন্ম হয়েছে, এর প্রতিটি দেশেই সংখ্যালঘু এবং সংখ্যাগুরুর জটিল ব্যারাম সৃষ্টি হয়েছে। এই ব্যারাম অবয়বে ধর্মীয় হলেও কারণটি পুরোপুরি রাজনৈতিক।
পাকিস্তান এবং ইন্ডিয়া উভয় দেশে সংখ্যালঘুদের অবস্থা খুবই শোচনীয়। ইন্ডিয়ায় শতকরা প্রায় ৩০ শতাংশ সংখ্যালঘুর মধ্যে সরকারি চাকরিতে ৫ শতাংশও খুঁজে পাওয়া যায় না। পাকিস্তানেও এ পরিস্থিতি এর চেয়ে ভালো হওয়ার কথা নয়। সেই তুলনায় আমাদের বাংলাদেশ অনেক ভালো। ১০ শতাংশ সংখ্যালঘুর মধ্যে সরকারি চাকরির প্রায় ২৫ শতাংশ তাদের দখলে। এ পরিস্থিতি শুধু বর্তমান সরকার করেনি, ১০-১২ বছর আগেও এই পার্সেন্টেজ খুব একটা কম ছিল না। বিষয়টি নিয়ে এ দেশের মানুষ প্রশংসা পেতেই পারে। এটা ঠিক, এ দেশের সংখ্যালঘু সম্প্রদায় আগে থেকেই শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়েছিল। সরকারি চাকরিতে অধিক নিয়োগে সেটাও একটা কারণ হতে পারে। একইভাবে জন্মনিয়ন্ত্রণের হার শহরের শিক্ষিত পরিবারগুলোতেই বেশি দেখা যায়। ফলে শতকরা হারে হিন্দুদের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে সেটাও একটা বড় কারণ হতে পারে।
আমি সব সময় মজলুমের পক্ষে। সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের অনেকেই নির্যাতনের শিকার। কার্যত সেটা সাম্প্রদায়িক লাইন বরাবর নয়। ‘দেশে থাকলে ভোট পাই, দেশ ছাড়লে জমি পাই’- সেই নির্যাতন এই ঘৃণ্য পলিসির কারণে।
সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের কিছু লোককে ঘুষের আদলে (যেমন- ‘বটতলার উকিল’কে প্রধান বিচারপতি বানিয়ে তা জনসমক্ষে বলাও হয়েছে) যে সুযোগ সুবিধা দেয়া হচ্ছে তা এই সম্প্রদায়ের সাধারণ সদস্যদের কিঞ্চিৎ মানসিক তৃপ্তি দেয়া ছাড়া অন্য কোনো কাজে লাগছে না। প্রকৃত বিচারে প্রিয়া সাহা গং এ দেশের সংখ্যালঘুদেরও বন্ধু নন। তাদের ভূমিকা পুরো দেশ ও রাষ্ট্রব্যবস্থাটিকে অস্থির করে তুলছে এবং সংখ্যালঘু ও সংখ্যাগুরুকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়ে দিচ্ছে। আমেরিকা প্রবাসী লেখিকা এবং মেধাবী মিসাইল বিশেষজ্ঞ ও প্রকৌশলী সাবিনা আহমেদের কথায়, ‘প্রিয়া সাহারা সংখ্যালঘুদের অধিকার চায় না, আগের মতো তাদের জমিদারি ফিরে পেতে চায়।’
তাদের নিয়ে পুরো দেশ তটস্থ। বাংলাদেশের রিফাত, নয়ন, মিন্নিদের পায়ের তলার মাটি ওলটপালট হয়, কিন্তু সুনাম দেবনাথদের আজো কিছু হয় না। এ ধারাটি সেই মোগল আমল বা তার আগে থেকেই রয়েছে। কাজেই এই শ্রেণী-বিভাজনটি কিন্তু ধর্মের লাইন বরাবর নয়। এ বিভাজনটি হয়েছে জালেম এবং মজলুমের লাইন বরাবর। জালেম ও মজলুম উভয় লাইনে যেমন মুসলিম রয়েছেন, তেমনি অন্য সম্প্রদায়ের মানুষও রয়েছেন। অর্থাৎ সংখ্যাগুরুদের সাথে অনেক সংখ্যালঘুও রয়েছেন। সংখ্যাগুরু এবং সংখ্যালঘুদের এই বিভাজন রাজনৈতিক স্বার্থ থেকেই সৃষ্ট।
এটা সত্য, দেশের সব সংখ্যালঘু সাহা, দাসগুপ্ত কিংবা দেবনাথদের মতো সামাজিক কিংবা অর্থনৈতিক ‘জমিদারি’ উপভোগ করছেন না। সংখ্যালঘুর পরিচয় ব্যবহার করে সুযোগ নিচ্ছেন ওপরতলার মুষ্টিমেয় কয়েকজন।
বাদবাকিদের অবস্থা বাস্তবে করুণ। দেশে রাজনৈতিক দুর্বৃত্তায়নে সংখ্যাগুরুদের মতো সংখ্যালঘুদের অবস্থাও শোচনীয়। কাজেই প্রকৃত গণতন্ত্র এবং আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা ছাড়া সংখ্যাগুরু কিংবা সংখ্যালঘু, কারো মুক্তিই সম্ভব নয়। সেই পথে সবচেয়ে বড় বাধা সুবিধাভোগী সাম্প্রদায়িক গং।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন