‘শরৎ বাবু’কে উদ্দেশ করে একটি খোলা চিঠি লিখেছিলেন উপমহাদেশের প্রখ্যাত সঙ্গীতশিল্পী ভূপেন হাজারিকা। তিনি গেয়েছিলেন, শরৎ বাবু/খোলা চিঠি দিলাম তোমার কাছে/ তোমার মহেশ, গফুর এখন/কোথায় কেমন আছে/তুমি জানো না/হারিয়ে গেছে কোথায় কখন/তোমার আমিনা/শরৎ বাবু এ চিঠি পাবে কি না/জানি না আমি/এ চিঠি পাবে কি না জানি না/...
‘বর্গিরা আর দেয় না হানা/নেই তো জমিদার/তবু কেন এ দেশজুড়ে/নিত্য হাহাকার’
সুপ্রিয় সিনহা বাবু, আপনাকে উদ্দেশ করে এমনি একটি খোলা চিঠি লিখতে মন উসখুস করছে। শরৎ বাবুর মহেশ, গফুর ও আমিনার মতো একই করুণ অবস্থায় পড়েছে আপনার রেখে যাওয়া আইন-আদালত। জীর্ণশীর্ণ সেই বিচারব্যবস্থার চেহারা দিনকে দিন আরো রক্তশূন্য ও কদাকার হয়ে উঠছে। বিচারহীনতার সংস্কৃতি আজ আরো প্রকট রূপ ধারণ করেছে।
শিল্পী ভূপেন হাজারিকার সেই প্রশ্ন আজ এ দেশের কোটি কোটি মানুষের মনে অনুরণিত হচ্ছে। দেশে আজ পর্তুগিজ জলদস্যুরা নেই, এ দেশে আজ নীলকর ইংরেজরা নেই, বাংলাদেশে আজ পাকিস্তানিরাও নেই। তারপরও দেশে সেই হাহাকার রয়ে গেছে। হয়তো আরো বড় হাহাকার বা আতঙ্ক গ্রাস করেছে। দেশের মানুষ বলছে, ‘আম্মা গো ভিক্ষার (উন্নয়নের) দরকার নেই, কুত্তা সামলান।’ এ দিকে, নব্য বর্গিরা কখন কার ওপর চড়াও হয় তার কোনো নিশ্চয়তা নেই।
স্কুল-কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে মেয়েদের পাঠিয়ে মায়েরা আতঙ্কে থাকেন, তার আদরের মেয়ে না জানি কোন বদরুলের বদ-নজরে পড়ে। এ দেশের প্রতিটি মোবাশ্বেরের বাবা প্রিয় মোবাশ্বেরদের নিয়ে চিন্তায় থাকেন, কখন না জানি, তার কলিজার টুকরা সন্তান গুম হয়ে যায়। এয়ারপোর্টে মেয়েকে রিসিভ করতে গিয়ে বাবা (সাবেক রাষ্ট্রদূত) আর ফিরে আসেন না। অসহায় স্ত্রী ও দুই কন্যা শোনেন, কিভাবে প্রাণপ্রিয় স্বামী ও বাবাকে নিয়ে ক্রসফায়ারের নাটক মঞ্চায়ন করা হচ্ছে। প্রতিটি গুম আর খুনের পেছনে এরকম একেকটি ইতিহাস লুকিয়ে আছে।
স্বামীকে বেঁধে রেখে তার সামনে স্ত্রীকে ধর্ষণ আইয়ামে জাহেলিয়াতের যুগেও শোনা যায়নি। একজন মানুষের মৃত্যু হলে জাগতিক সব হিংসা-ঘৃণা-বিদ্বেষের ঊর্ধ্বে চলে যান। বিরোধী বা ভিন্ন মতাবলম্বী মানুষের লাশবাহী গাড়িতে জুতা দিয়ে পেটানো বা কবরের ওপর পাশবিক আক্রোশ মেটানো হয়। বিক্ষুব্ধ ভুক্তভোগীরা বলছেন, আওয়ামী জাহেলিয়াত আইয়ামে জাহেলিয়াতকেও হার মানিয়েছে।
রাষ্ট্রটিকে এ অবস্থায় ঠেলে দিতে আপনার ভূমিকাও ঢেকে রাখা সম্ভব হবে না। এ দেশের মানুষ সত্যিই মোমের মতো। যখনই জনগণ আপনার অনুতাপের উত্তাপ টের পেয়েছে কিংবা আপনি একটু দাঁড়াতে চাচ্ছেন বলে মালুম হয়েছে, তখনই আগের সব কর্ম ভুলে গেছে। আপনার প্রতি আগের ক্ষোভ রাতারাতি সহানুভূতিতে রূপান্তরিত হয়েছে।
ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স বলে যে ডকট্র্রিন আপনারা জারি করেছিলেন, ভাগ্যের নির্মম পরিহাসে তার শিকার হলেন নিজেই। আপনার এককালের সহকর্মী ও সহমর্মী এবং পরবর্তী সময়ে প্রতিদ্বন্দ্বী, বিচারপতি মানিকের কথাই ঠিক হয়েছে। তিনি হুঙ্কার ছেড়েছিলেন, ‘তুমি শুধু পদই ছাড়বে, না দেশও ছাড়তে হবে।’ সিনহা বাবু এ দেশে তাদের কথাই সত্যি হয়। আপনার বেলায়ও তারাই শেষ হাসি হেসেছেন।
মান্যবর, একবার শখ করে জানিয়েছিলেন, আপনিও শান্তি কমিটির সদস্য ছিলেন। আপনার এই ‘শখের রাজাকারি’কে তখন নির্দোষ কিছিমের জ্ঞান করা হয়েছিল। সেই নির্দোষ ভেজেটেরিয়ান স্বীকারোক্তিই মনে হচ্ছে, আপনার জন্য কাল হয়ে দাঁডিয়েছে। তারা আপনাকে ‘ছিঁচকে উকিল’ ডেকেছেন। আপনার নিজের গোত্রের একজন মহিলা নেত্রী আপনি হিন্দু নন বলেও ফতোয়া জারি করেছেন। অর্থাৎ এই নেত্রী বোঝাতে চেয়েছেন, আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কথা বললে একজন হিন্দুর হিন্দুত্ব পর্যন্ত নষ্ট হয়ে যায়।
সুপ্রিয় সিনহা বাবু, আপনি কিছুটা আশা জাগিয়েছিলেন দেশবাসীর মনে। বিচার বিভাগের স্বাধীনতা অক্ষুণœœ রাখার সর্বশেষ ও পরাজিত সিপাহসালার হিসেবে আপনি চিহ্নিত হয়ে থাকবেন, তাতে কোনো সন্দেহ নেই।
এ দেশের গণতন্ত্র কিংবা স্বাধীনতা সার্বভৌমত্ব যদি চিরতরে ধ্বংস হয়, আপনার ভূমিকা হবে অনেকটা বাংলা-বিহার-উড়িষ্যায় ইংরেজ মনোনীত নবাব মীর কাসিম আলীর মতো। সিরাজ উদ্দৌলার পতনে তিনিও নিজের শ্বশুরের সাথে মিলে ইংরেজদের সহায়তা করেছিলেন। কিন্তু শেষ সময়ে উনি ইংরেজদের মূল উদ্দেশ্য বুঝতে পারেন। ইংরেজরা মীরজাফরকে সরিয়ে তার জামাতা মীর কাসিমকে ক্ষমতায় বসায় ১৭৬০ সালে। তার মাঝে হঠাৎ বিবেক ও স্বাধীনতার চেতনা জাগ্রত হলেও তা কোনো কাজে আসেনি। তিনি স্বাধীনভাবে দেশ শাসন করতে চাইলে ইংরেজরা তাকে সরিয়ে আবারো সেরা বেঈমান মীরজাফরকে ক্ষমতায় নিয়ে আসে ১৭৬৩ সালে। জানি না, আপনার এই মহৎ প্রচেষ্টা ইতিহাসে মীর কাসিমের প্রচেষ্টার মতোই উচ্চারিত হয় কি-না।
প্রিয় মান্যবর, আপনি ইতিহাসের একজন খলনায়ক না-কি পরাজিত নায়ক- তা নির্ণয়ে আরো কিছুদিন সময় লাগতে পারে। তবে কথায় কথায় আদালত অবমাননার যে রেওয়াজ শুরু হয়েছিল, আপনি সেখানে নিজেকে গালির ক্রুশে উৎসর্গ করেছেন। প্রধান বিচারপতির চেয়ারে আসীন অবস্থায় সরকারের নেতা-নেত্রীরা আপনাকে এমন সরাসরি গালিগালাজ করেছেন যে, আদালত অবমাননা নিয়ে কোনো সমালোচককে এখন আর খুব বেশি ভাবতে হবে না। প্রধান বিচারপতিকে এমন সরাসরি গালিগালাজ যদি আদালত অবমাননা না হয়, তবে ছিটেফোঁটা সমালোচনা কিংবা ঠারে ঠুরে দুয়েকটি কথা এখন আর আদালত অবমাননার মধ্যে পড়ার কথা নয়। স্মরণীয় ব্যাপার হলো- আপনাকে গালিগালাজ শুরু করার পর থেকে এখন পর্যন্ত আর কোনো আদালত অবমাননার মামলা চোখে পড়েনি।
হে অনাকাক্সিক্ষত হুইসেল ব্লোয়ার, আজ আপনার ভাঙা স্বপ্নের ছেঁড়া টুকরাগুলো আমাদের অনুভবের সব স্তরে পৌঁছে গেছে। একজন প্রধান বিচারপতি হিসেবে আপনার সঙ্গে রাষ্ট্র যে অনাকাক্সিক্ষত আচরণ করেছে, সেটা আপনার বইয়ে পড়ে পুরো জাতি স্তম্ভিত। তবে আপনার বইটি ভবিষ্যতে অনেক বিচারের রাস্তা খুলে দেবে, তাতে কোনো সন্দেহ নেই- সেই বিচার যখনই হোক না কেন।
এই প্রেক্ষাপটে মনে পড়ে এই ভূখণ্ডের অন্য এক প্রধান বিচারপতির কাহিনী। তিনি টিক্কা খানকে শপথ পড়াতে অস্বীকার করেছিলেন। ইতিহাসের অত্যন্ত সঙ্কটময় মুহূর্তেও ভয়ঙ্কর সামরিক শাসকদের কোনো অধঃস্তন চামচা পিস্তল বা অন্য কিছু হাতে নিয়ে সেই বিচারপতিকে ভয় দেখাতে আসেনি। তখন সামরিক সরকারের প্রধান, আইনমন্ত্রী ও অ্যাটর্নি জেনারেল প্রধান বিচারপতিকে গভর্নর ভবনে ডেকে নিয়ে একসাথে চাপ প্রয়োগ করেননি। তখন সেই রাষ্ট্রের কোনো দুর্বৃত্ত কর্মচারীর মাধ্যমে সেই প্রধান বিচারপতিকে অপমান করা হয়নি। পরাধীন দেশে যে ধরনের রাষ্ট্রীয় দুর্বৃত্তপনা হয়নি, তা এই স্বাধীন দেশে ৫০ বছর পর সংঘটিত হয়েছে।
এই মুল্লুকে বড় অপরাধ হলো- সরকারের বিরোধিতা করা। সে জন্য শুধু বিরোধী দলই নয়, নিজ মতাবলম্বী বা পক্ষের কেউ বিরোধিতা করলেও একই পরিণতি ভোগ করতে হবে। এর সর্বশেষ নজির আপনি।
রাষ্ট্রের চোখে এখন সবচেয়ে বড় অপরাধী বিরোধী দলের সর্বোচ্চ নেতা-নেত্রীরা। আইন-আদালতকে ব্যবহার করে তাদের সর্বোচ্চ শাস্তির ব্যবস্থা করা হচ্ছে। এ অবস্থা অব্যাহত থাকলে দেশে গণতন্ত্র ও রাজনীতি বলে কিছু থাকবে কি?
একটা সময় পর্যন্ত আপনি নিজেও এই মেকানিজমে ব্যবহৃত হয়েছেন। কিন্তু এর খারাপ পরিণতি সম্পর্কে আপনার বিবেকের সেফটি ভাল্ব একসময় ব্লো শুরু করে দেয়। তবে ‘বিশেষ ব্যক্তি’দের বিবেকের সেফটি ভাল্ব কখনোই ব্লো করে না।
প্রিয় সিনহা বাবু, আপনি ভালোভাবেই অবগত আছেন, ‘এক-এগারো’র জরুরি সরকার বেগম জিয়ার নামে চারটি এবং বর্তমান প্রধানমন্ত্রীর নামে ১৫টি মামলা দিয়েছিল। বেগম খালেদা জিয়ার নামে সেই চারটি মামলা বেড়ে হয়েছে ৩৭টি। অথচ তার প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে সেই ১৫টি মামলা রাজনৈতিক বিবেচনায় প্রত্যাহার করা হয়েছে। এ প্রশ্নটি দেশের জনগণের মনে উত্থিত হলেও কোনো ব্যাখ্যা কারো কাছ থেকে পাওয়া যাচ্ছে না।
মহামান্য বিচারপতি, আপনার এই অখণ্ড অবসরে বসে ভাবুন- দুই নেত্রীর বিরুদ্ধে করা এই মামলাগুলোর কোনটির মেরিট কেমন ছিল। বেগম খালেদা জিয়া না অন্য কারো বিরুদ্ধে উত্থাপিত অভিযোগগুলো বেশি মুশকিল কিছিমের ছিল। তার নিজের কাজিন এবং তার দলের বর্তমান জেনারেল সেক্রেটারি যে স্বীকারোক্তি করে এসেছিলেন, তাও ইন্টারনেটে ছড়িয়ে আছে।
রায় ঘোষণার আগেই ওবায়দুল কাদেররা বলে দিতে পারেন, কোন রায়ের পর কারা কান্না শুরু করবে। এসব অগ্রিম ঘোষণার মাধ্যমে বিচারকরাও কর্তাব্যক্তিদের মনের খায়েশ জেনে যান। এর বিপরীতে রায় গেলে ফলাফল খুব সুখকর হয় না। তারেক রহমানকে একটি মামলা থেকে বেকসুর খালাস দিয়ে বিচারককে দেশ ছাড়তে হয়েছে। নিজের রায়ের কথিত অপরাধে দেশ ছাড়তে বাধ্য হওয়া আপনি দ্বিতীয় বিচারক। সেদিন আপনার পজিশন থেকে শক্ত অবস্থান নিলে পরে আপনাকে একই পরিণতি বরণ করতে হতো না।
ভালোভাবেই অবগত রয়েছেন, এ রায়টি হবে ২১ আগস্টে সংঘটিত তখনকার বিরোধীদলীয় নেত্রীর রাজনৈতিক সমাবেশের ওপর ভয়াবহ গ্রেনেড হামলাকে কেন্দ্র করে। এর রায় কী হবে, তা আমাদের একজন মন্ত্রী আগেভাগেই ইঙ্গিত দিয়ে রেখেছেন।
বিচারাধীন মামলা নিয়ে কথা না বলার নিয়মটুকু সরকারের কর্তাব্যক্তিরা অনেক আগেই লঙ্ঘন করে বসে আছেন। সেই ভয়াবহ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই তারা সমস্বরে এর সম্ভাব্য আক্রমণকারীর নাম বলে আসছেন। এই মামলায় বেশ কয়েকবার ইনভেস্টিগেশন অফিসার পরিবর্তন করা হলো। মামলার প্রথম দিকের চার্জশিটে তারেক রহমানের নাম না থাকলেও পরবর্তী পর্যায়ে পছন্দের অফিসারদের দিয়ে সেই নামও অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রিমান্ড নামক কৌশলটি এ ক্ষেত্রে কিভাবে ব্যবহৃত হয় তা বুঝতে খুব বেশি বেগ পেতে হয় না। যন্তরমন্তর ঘর থেকে মুফতি হান্নানের কাছ থেকে তারেক রহমানের নাম বের করা হয়েছে। এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ মামলার আসামি ও সাক্ষী হিসেবে হান্নানকে বাঁচিয়ে রাখা জরুরি হলেও তা করা হয়নি।
২১ আগস্টের মামলা নিয়ে বিএনপি নেতারা কিছু প্রশ্ন উত্থাপন করেছেন। মানুষের মন থেকে সন্দেহ দূর করতে এবং ন্যায়বিচারের স্বার্থেই প্রশ্নগুলোর জবাব দেয়া প্রয়োজন। ওই সমাবেশ হওয়ার কথা ছিল মুক্তাঙ্গনে। সে অনুযায়ী তখনকার সরকারের পক্ষ থেকে সমাবেশ স্থলে সব নিরাপত্তামূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়েছিল। কিন্তু সমাবেশ শুরুর অল্প কিছুক্ষণ আগে সেই সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করে আওয়ামী লীগের পার্টি অফিসের সামনে নিয়ে আসা হয়। কেন ওই সমাবেশের স্থান পরিবর্তন করা হলো, সেটাও একটা বড় প্রশ্ন হয়েই থেকে যাবে। ঘটনা সংঘটিত হওয়ার পর থেকেই এফবিআইকে আনা হয়েছিল ইনভেস্টিগেশন করার নিমিত্তে। কিন্তু আওয়ামী লীগ নেতৃত্ব তাতে সহযোগিতা করতে অস্বীকার করেন। এ ঘটনা থেকে রাজনৈতিক ফায়দা নিতে আওয়ামী লীগ যতটুকু আগ্রহ দেখিয়েছে, মূল পরিকল্পনাকারীকে শনাক্ত করতে এবং জনমনে সৃষ্ট প্রশ্নের জবাব দিতে ঠিক ততটুকুই অনাগ্রহ দেখিয়ে আসছে বলেই জনগণ মনে করে।
প্রিয় সিনহা বাবু, রাজনীতিতে পারস্পরিক বিদ্বেষ একটা জাতিকে কী ভয়ঙ্কর পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিতে পারে, ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা তার বড় প্রমাণ। এই বিদ্বেষ থেকে কারা লাভবান হচ্ছে, সে বিষয়টি তলিয়ে দেখা দরকার। এ ধরনের অশুভ পরিকল্পনা পণ্ড করে দিতে কিংবা আইন-আদালতের রাজনৈতিক ব্যবহার বন্ধ করতে আপনাকে হুইসেল ব্লোয়ার হিসেবে গণ্য করা হবে কি না, জানি না। আপনার উদ্দেশ্য নিয়ে নানা মহল থেকে প্রশ্ন উত্থাপিত হয়েছে। আপনার বইটি প্রকাশের পর সরকার পক্ষ সর্বোচ্চ প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছে। রাষ্ট্রের প্রধান আইনজীবী বলেছেন, আপনার সহকর্মীরা কেন একই বেঞ্চে বসতে অস্বীকার করেছিলেন সেসব কারণ যদি এখন সামনে নিয়ে আসা হয়, তা হলে আরো ‘দুর্গন্ধ’ ছড়াবে। আপনার বইটি বর্তমান সরকারের দুর্গন্ধ কেমন ছড়াচ্ছে, সে সম্পর্কে না জানার ভান করছেন ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগের টিকিটে এমপি হওয়ার খায়েশ পোষণকারী সরকারের সেই কর্মকর্তা।
সুপ্রিয় সিনহা বাবু, আগেই বলেছি, দেশ ও সমাজকে আজকের অবস্থায় পৌঁছাতে আপনার ভূমিকাও কম ছিল না। লঞ্চিং বিচারব্যবস্থার যে ধারা আপনার সময় শুরু হয়েছিল, তারই মর্মান্তিক শিকার হয়ে নিজেও বেরিয়ে এসেছেন। আপনার পূর্বসূরিসহ গুটিকয়েক ব্যক্তি এ দেশের বিচারব্যবস্থার যে অপূরণীয় ক্ষতি করে গেলেন তা পূরণ হওয়ার নয়। মামলার সাক্ষীদের সেফ হোমে রেখে কোচিং দেয়ার নমুনা বর্তমান সভ্যতার পুরো বিচারব্যবস্থাকে উপহাস করছে।
আদালতের গেট থেকে দিনদুপুরে একটি মামলার সাক্ষীকে উধাও করে ফেলা হয়েছে। সেই সাক্ষীকে পরে পাওয়া যায় পার্শ্ববর্তী দেশের জেলখানায়। ’৭১ সালের পর জন্ম নিয়েও কেউ কেউ সেই ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী হয়ে দাঁড়ায় কিভাবে?
আইনের শাসনের বিরুদ্ধে আপনাদের উক্তি ‘ ট্রুথ ইজ নো ডিফেন্স’ দেশে আইনের শাসন, মানবাধিকার ও গণতন্ত্রের স্বপ্নভঙ্গ ঘটিয়েছে। যে দেশকে আমরা কথায় কথায় গালি দেই, অপছন্দের মানুষকে কথায় কথায় সে দেশে পাঠিয়ে দেই, তাকিয়ে দেখুন, তারা কেমন করে তাদের বিচার বিভাগকে শক্তিশালী করে ফেলেছে। সেই নিন্দিত দেশটির প্রধান বিচারপতি দেশের খোধ প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রায় দিয়ে বরখাস্ত করেছেন। আবার একই ব্যক্তি বিরোধী দলে গিয়ে জেলখানায় আটক থাকা অবস্থায় বেকসুর খালাস পেয়েছেন। একটি দেশের বিচারব্যবস্থা স্বাধীন ও রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত না হলে এসব সম্ভব হয় না।
সে তুলনায় আমরা এত চেতনা ধারণ করেও কোথায় তলিয়ে যাচ্ছি তা ভাবতেও কষ্ট লাগে।
ন্যায়বিচার সম্পর্কে একটি মূল্যবান নির্দেশ হলো, অভিযুক্ত নির্দোষ প্রমাণিত হলে তাকে খালাস দেয়ার মানসিকতা বা ইচ্ছা যদি আপনার না থাকে, তবে খোদার দোহাই, সেই বিচার করবেন না। মনের ক্ষোভ মেটানোর জন্য দরকার হলে অন্য কোনো পন্থা ব্যবহার করুন। তাতে অন্ততপক্ষে পুরো বিচারব্যবস্থা কলুষিত হওয়ার হাত থেকে রক্ষা পাবে। ন্যায়বিচারের এই অমোঘ নির্দেশ মানতে আপনারা শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছিলেন। সেই ব্যর্থতার তালিকাই এখন শুধু লম্বা হচ্ছে। জানি না, সে দংশন আজ কতটুকু অনুভব করছেন।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন