ফান্দে পড়িয়া গণতন্ত্র কান্দে রে ...
29 August 2018, Wednesday
বহুল আলোচিত নৌমন্ত্রী, শাজাহান খানের অতি প্রিয় গানের কলি দু’টি হলো, ফান্দে পড়িয়া বগা কান্দেরে এবং ‘ধরা পইড়া গেছ তুমি রঙিলা জালে।’ বিরোধী দল বিএনপি এবং তার নেত্রীর অবস্থা একটু বেকায়দায় দেখলেই তিনি তার ভুবনমোহিনী হাসিটি দিয়ে এই গান দু’টি গেয়ে উঠতেন। প্রথম প্রথম বিএনপি নেত্রী এবং বিএনপি এই রঙিলা জালে আটকা পড়লেও এখন ধীরে ধীরে পুরো দেশই একধরনের রঙিলা জালে আটকা পড়ে গেছে।
এই মন্ত্রী প্রবর একবার টকশোতে গিয়ে সাবেক এক মন্ত্রীর চোখ তুলে ফেলার হুমকি দিয়েছিলেন। খুব সম্ভবত চোখ হারানোর ভয়ে সেই সাবেক মন্ত্রীকে আর কোনো টকশোতে দেখা যায়নি। তখন বিষয়টি নিয়ে অনেক বিরূপ সমালোচনার মুখে পড়েন দাপুটে মন্ত্রী।
এর পর থেকে টকশোতে গিয়ে তিনি হাসিমুখেই সব বিরোধিতা মোকাবেলার চেষ্টা করে থাকেন। সব সময় মুখে হাসি ধরে রাখার চেষ্টা করেন। বিশেষ করে মিডিয়ার সাথে কথা বলার সময় এ কাজটি তিনি করে থাকেন। আর এটি করতে গিয়েই নিজের বর্ণিত রঙিলা জালে ধরা খেয়েছেন। সম্প্রতি রাজধানীর ফুটপাথে বাস তুলে দিয়ে দুই ছাত্রছাত্রীকে হত্যা করা হয়। এটা নিয়ে সাংবাদিকেরা মন্ত্রীকে প্রশ্ন করলে তিনি ইন্ডিয়ার মিডিয়ার সংযমের উদাহরণ টেনে আনেন। তিনি হাসিমুখে কঠিন জবাব দিতে গিয়েই এ বিড়ম্বনার সৃষ্টি করেছেন। নেহাত একটি হাসি কেন পুরো জাতির এমন ক্ষোভের কারণ হলো বিষয়টি ভেবে দেখা দরকার।
মন্ত্রী আবুল হোসেন কিংবা লতিফ সিদ্দিকীকে যত সহজে পদত্যাগ করানো হয়েছিল, তার বেলায় চাপ অনেক বেশি সৃষ্টি হলেও তা সম্ভব হয়নি। বর্তমান সরকার যে শক্তির ওপর ভর করে টিকে রয়েছে তার অন্যতম কাণ্ডারি হলেন তিনি। তার পদত্যাগ তাই সরকারের প্রেস্টিজ ইস্যু।
২.
কমনওয়েলথের মহাসচিব বাংলাদেশ সফরে এসে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সাথে সৌজন্য সাক্ষাৎ করতে গেলে তিনি জানান, দেশে গণতন্ত্রকে সুসংহত করা হচ্ছে। সাধারণত বিদেশী মেহমান এলে দেশের উন্নয়নের জোয়ারের কথা প্রথমেই জানানো হয়। এবার তার কিছুটা ব্যত্যয় ঘটিয়ে শুধু গণতন্ত্র সুসংহত করার কথা কেন জানালেন, সেটাও খানিকটা চিন্তার বিষয়।
হোস্টের মুখে এ কথা শোনে কুটুমের মনে কী ভাবের উদয় হয়েছিল তা জানা যায়নি। তবে তিন কুড়ি বয়সের এই বিলাতি ললনা মোনালিসার মতো রহস্যময় হাসির মাধ্যমে কিছুটা বুঝিয়ে থাকতে পারেন।
প্যাট্রিসিয়া স্কটল্যান্ড শেখ হাসিনার সাথে সাক্ষাৎ করেন ৯ আগস্ট। আগের দিন বিশ্বখ্যাত গার্ডিয়ান ড. শহিদুল আলমের ওপর একটি সম্পাদকীয় প্রকাশ করেছে। The Guardian view on Shahidul Alam : Bangladesh should let him go. এটা খুবই স্বাভাবিক যে, এই বিলাতি মহিলা বাংলাদেশ সম্পর্কে তরতাজা খবরগুলো খুবই আগ্রহ ভরে পড়েছেন। দেশের গণতন্ত্র সুসংহত হয়েছে না অন্য কিছু হয়েছে তা বোঝার মতো বিচক্ষণতা আশা করা যায়, এই ইংরেজ ব্যারিস্টার ও রাজনীতিকের রয়েছে। মেধার জোরে কালো গাত্রবর্ণকে অতিক্রম করেই তাকে এই পজিশনে উন্নীত হতে হয়েছে।
আওয়ামী লীগের নতুন ঘরানার কিছু বুদ্ধিজীবী ও পরামর্শকের বদৌলতে নতুন প্রজন্ম কোন দিকে মোড় নিয়েছে, তার কিছু আলামত দেখা গেছে দু’টি ছাত্র আন্দোলনের মধ্য দিয়ে। ক্রিকেটের উন্মাদনা দিয়েও তখন তাদের মনোযোগ ডাইভার্ট করা যায়নি।
সরকার বলতে চাচ্ছে, শহিদুল আলম সরকারের বিরুদ্ধে ছাত্রছাত্রীদের উসকানি দিয়েছেন। ১১ জন নোবেল লরিয়েটসহ ২৩ জন বিশ্বখ্যাত ব্যক্তি শহিদুল আলম ও গ্রেফতারকৃত ছাত্রছাত্রীদের অনতিবিলম্বে মুক্তিদানের আবেদন জানিয়েছেন। কোনটি উসকানি আর কোনটি গণজোয়ার এটি বুঝতে অক্ষম নাবালকদের কাছে এগুলোও হয়তো উসকানি বলে মনে হবে।
সরকারের বিরুদ্ধে ‘উসকানি ‘ দেয়া মহাপাপ। সরকারের অনেকগুলো যন্তরমন্তর ঘর থেকে এই বাণীগুলো প্রচার করা হচ্ছে। তা থেকে বিশ্বাস জন্মে যে, বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের মতো সুবোধ দল পৃথিবীতে আর দ্বিতীয়টি ছিল না। সেই পাকিস্তান আমল থেকে আওয়ামী লীগ বিরোধী দলের আন্দোলন করেছে; কিন্তু কখনোই সরকারের বিরুদ্ধে কোনোরূপ উসকানি দেয়নি। চেয়ার দিয়ে স্পিকার শাহেদ আলীকে অক্কা পাইয়ে পাকিস্তানের প্রথম সামরিক শাসনের উসকানির সাথে তাদের কোনো সম্পর্ক নেই।
বিরোধী দল হিসেবে এই সুবোধ-শান্ত আওয়ামী লীগ কোনো দিন রাস্তায় ভাঙচুর করেনি। অফিসগামী লোকদের দিগম্বর করেনি। একটি মাত্র দাবির জন্য ৩০০ দিনের বেশি হরতাল তারা করেনি। যাত্রীবাহী বাসে আগুন তারা দেয়নি। বিভিন্ন আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য কোনো দিন কোনো অতিরঞ্জিত কথা বলেনি। এগুলো সব গুজব, এগুলো সব মিথ্যা প্রচারণা।
বিরোধী দল হিসেবে আওয়ামী লীগের এই ইতিহাস কিংবদন্তি হয়ে আছে। বিরোধী দল হিসেবে তাদের সংযম আমরা দেখেছি দিনাজপুরের ইয়াসমিনের ঘটনায়। সেই সংযম দেখা গেছে এশিয়া এনার্জির বিরুদ্ধে আন্দোলনের সময়, কানসাটে বিদ্যুতের দাবিতে নাগরিক আন্দোলনের মুহূর্তে।
শুধু আওয়ামী লীগ কেন- সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের ব্যানারে যে সংগঠনটি রয়েছে তার কলাকুশলীরা ব্যক্তিগতভাবে গত ৫০ বছর ধরে অনেক অনেক সংযম দেখিয়েছেন। সরকারের বিরুদ্ধে উসকানি হবে বিবেচনায় এই প্রিয় মুখগুলো কোনো দিন রাস্তায় নামেননি। শহিদুল আলমের উচিত ছিল এসব প্রকৃত জ্ঞানী-গুণীর পদাঙ্ক অনুসরণ করা।
শহিদুল আলম যখন কাদের মোল্লার ফাঁসি চেয়ে সেøাগান দিয়েছিলেন, তখন তিনি সবুর খানের বংশধর ছিলেন না। আজ ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ আন্দোলনে সমর্থন দেয়ায় সেই পরিচয়টি বড় হয়ে উঠেছে। ‘রাজাকারের বাচ্চা’রা যেমন কোটা সংস্কার আন্দোলন করে, তেমনি এ দেশে বুঝি সবুর খানের বংশধরেরাই শুধু নিরাপদ সড়ক চায়। এ বিষয়গুলোও সবুর খানের রক্ত নিয়ে যারা চেতনার অংশীদার হতে চান, তাদেরকে স্মরণে রাখতে হবে।
আওয়ামী লীগের নেতা-নেত্রীরা তাদের কর্মীবাহিনীকে ঘূণাক্ষরেও লগিবৈঠা নিয়ে ঢাকায় আসতে বলেননি। বরং সব সময় বলেছেন, বেলি ফুলের মালা হাতে নিয়ে আসতে। এক লাশের বদলে ১০ লাশের কথা কখনোই বলা হয়নি। বরং এক গালে থাপ্পড় খেলে অন্য গাল এগিয়ে দিতে বলা হয়েছিল।
ক্ষমতায় এসে তারা আরো গণতান্ত্রিক হয়ে পড়েছেন। বিরোধী দলগুলোকে ফুলের মালা পরিয়ে কিংবা ওবায়দুল কাদেররা চুম্বন দিয়ে গণতন্ত্রকে সুসংহত করে ফেলেছেন।
এ দিকে নিরাকার আল্লাহকে খুশি করার জন্য তারা দুনিয়াবি সনদের যে স্বীকৃতি দিয়েছেন তাতে ‘দুনিয়ার ভগবানেরা’ও অখুশি হননি। বরং সাগরেদদের বুদ্ধির চমক দেখে উৎফুল্ল হয়ে পড়েছেন। একদা যারা টক তেঁতুল হুজুর ছিলেন, তারাও আজ খুব মিষ্টি মিষ্টি কথা বলা শুরু করে দিয়েছেন। মাশাআল্লাহ, তেঁতুল তত্ত্বের প্রবক্তা নারীরাও মরিচের গুঁড়া হাতে নিয়ে প্রতিপক্ষকে মোকাবেলার জন্য প্রস্তুত। একেই বলে ‘কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলা।’
৩.
আমাদের প্রধানমন্ত্রী সর্বদা ইতিহাস বিকৃতিকারীদের প্রতি কঠোর মনোভাব পোষণ করে থাকেন। তিনি জানিয়েছেন, বঙ্গবন্ধু হত্যায় খালেদা জিয়াও জড়িত। অনুমিত হচ্ছে, এখন দেশের সমস্ত ‘আওয়ামী মগজ এবং বিশ্বাস’ সে দিকেই ঘুরে যাবে। এ দেশে কোন প্রক্রিয়ায় ইতিহাসের জন্ম হয়, তার একটি নমুনা সামনে হাজির হয়েছে বলে প্রতীয়মান হচ্ছে।
মূলত ৭ মার্চের ভাষণ থেকে সর্বশেষ কথাটি উধাওয়ের হাত ধরেই সঠিক ইতিহাস লেখার ধারা শুরু হয়েছে। বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান, বিবিসির আতাউস সামাদসহ অনেক জ্ঞানী গুণীজন এ কথাটি লিখে গেছেন। সর্বশেষ এয়ার ভাইস মার্শাল (অব:) এ কে খন্দকার এ কথাটি লিখে মৌচাকে ঢিল ছুড়ে মেরেছেন বলে মনে হয়েছে। নিয়াজির আত্মসমর্পণ দলিলে স্বাক্ষরের সময় এ মাটির একমাত্র সন্তান হিসেবে উপস্থিত থাকলেও তিনিও ‘রাজাকার’ খেতাব পেয়ে গেছেন।
‘বঙ্গবন্ধুর খুনি’ হিসেবে খালেদা জিয়াকে অন্তর্ভুক্ত করার মধ্য দিয়ে ইতিহাস রচনার নতুন যুগের সূচনা হয়েছে বলে মনে করা হচ্ছে। সরকার বিএনপির কাউকে ডেকে আনতে বললে তল্পীবাহকেরা বেঁধে আনে। প্রধানমন্ত্রীর এই ঘোষণার পর একটুও দেরি না করে পরের দিনই ট্যাংক ড্যান্সার হিসেবে পরিচিত নেতা বলেছেন, তারেক রহমানও বঙ্গবন্ধুর খুনিদের উত্তরাধিকার বহন করছে।
তারপর তারেক তনয়া জাইমা রহমানকেও একই মামলায় অভিযুক্ত করা হলেও অবাক হওয়ার কিছু থাকবে না। তখন জাইমা যদি বলেন, ‘মহারাজ! সেই সময় আমার বাবার জন্ম হলেও আমার জন্মই হয়নি’ এই যুক্তিও টিকবে না। কারণ ’৭১-এর পরে জন্ম নিয়েও কেউ কেউ স্বাধীনতা যুদ্ধকালীন অপরাধের মামলায় সাক্ষ্য দিয়েছেন। সেই সাক্ষ্য গ্রহণও করা হয়েছে। কাজেই কারো রক্তে অপরাধীর ডিএনএর অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া গেলেই যথেষ্ট। অপরাধ সংঘটনের সময়ে ও স্থানে শারীরিক উপস্থিতি ‘জরুরি নয়’।
মরহুম প্রেসিডেন্ট জিল্লুর রহমান বলেছিলেন, আমার নেত্রী ভুল বলতে পারেন না। কাজেই আশা করা যাচ্ছে, অনুগত বুদ্ধিজীবীরা অচিরেই সেই সময়কার একটি অডিও প্রমাণ হাজির করে ফেলবেন। অন্য দিকে প্রবাসী কলামিস্ট তার স্বচক্ষে দেখা কোনো ঘটনা বিবৃত করে ফেলবেন। হয়তো বলা হবে, নির্মম হত্যাকাণ্ডটি সংঘটিত হওয়ার পরপরই ফারুক-রশীদদের জন্য ১৫ আগস্টে সকালের নাশতা নিয়ে অপেক্ষায় ছিলেন বেগম জিয়া!
কোনো কোনো কলামিস্ট অবশ্য কোনো ঘটনা স্বচক্ষে না দেখে কিংবা বিশ্বস্ত কারো কাছ থেকে টেলিফোনে না জেনে কোনো ঘটনা বিবৃত করেন না। জিয়া ও মুজিব পরিবারের অনেক ঘটনার চাক্ষুষ সাক্ষী তিনি। প্রতিটি ঐতিহাসিক ঘটনার দৃশ্যে তিনি স্বশরীরে হাজির হয়ে যেতে পারেন। স্বয়ং বঙ্গবন্ধু তাকে পাশে বসিয়ে রবীন্দ্রনাথের কবিতা কলেজের বাংলা প্রফেসরদের মতো একের পর এক আবৃত্তি করে যেতেন। বঙ্গবন্ধুর নাতি-নাতনীরা আজ যে একের পর এক বিদেশী বিয়ে করে যাচ্ছেন, সেই সুখস্বপ্ন কি বঙ্গবন্ধু অনেক আগেই দেখে গিয়েছিলেন? রবি ঠাকুরের সেসব কবিতা আবৃত্তির মাধ্যমে নিজের ভবিষ্যৎ রক্তকে আন্তর্জাতিক আবহে বিলীন হওয়ার ইঙ্গিত তিনি রেখে গিয়েছিলেন- এমন কথাও হয়তো শুনতে হবে।
অন্য দিকে স্কুলজীবনে একটি অপরাধে জিয়াউর রহমান তার বড় সন্তান তারেক রহমানকে বেল্ট দিয়ে পিটিয়েছিলেন, সেটিও নিজের চোখে দেখেছিলেন এই দেশবরেণ্য কলামিস্ট। কাজেই ১৫ আগস্ট সকালে খুনিদের প্রাতঃরাশ খাইয়েছিলেন বেগম জিয়া, সেটিও দেখবেন না তা কী করে হয়? সে দিন তার সাথে ছিলেন হয়তো প্রয়াত কয়েকজন। এসব স্পর্শকাতর ঘটনায় মৃতদের নাম উল্লেখ করলেও জীবিতদের নিরাপত্তার স্বার্থেই কখনো তাদের নাম উল্লেখ করা হয় না। সেই ঘটনাকে আরেকটু বিশ্বাসযোগ্য বানানোর জন্য দরকার পড়বে বিএনপির স্থায়ী কমিটির জনৈক সদস্য।
এবিএম মূসার শেষ জীবনে একটি কথিত বিচ্যুতি ঘটেছিল। তখন জামায়াত-বিএনপির অনেকের সাথে তার সখ্য সৃষ্টি হয়েছিল। মূসা সে সময় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সেই সদস্যের কাছে এই ঘটনা বর্ণনা করে গিয়েছিলেন। বিএনপি নেতৃত্বের স্বৈরাচারী মনোভাবের কারণে এই কথাগুলো তিনি ‘প্রকাশ্যে বলার সাহস পাননি’ বলে গোপনে জানিয়েছিলেন।
এভাবেই চেতনার আলোকে নতুন আরেকটি ইতিহাস লেখা হয়ে যেতে পারে। আপনি যদি মুক্তিযুদ্ধের সপক্ষ শক্তি হিসেবে নিজেকে দাবি করেন তবে এ কথার ওপর বাই ডিফল্ট আস্থা রাখতে হবে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন