তাপসী ও যুধিষ্ঠিরদের দেশে
07 August 2018, Tuesday
জাতির দুর্ভাগ্যই বলতে হবে। প্রধানমন্ত্রীর কৃচ্ছ্রতা সাধনের পরেও তার অফিসের বার্ষিক বাজেট তিন হাজার কোটি টাকা ছুঁয়েছে। দুর্মুখেরা বলেন, তার আগের জনের মেয়াদকালে এই খরচ ছিল ৭০ কোটি টাকা। ২০১৭-২০১৮ অর্থবছরে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে বাড়তি খরচ তিন হাজার ২০০ কোটি টাকা হয়েছে বলে খবর প্রচারিত হয়েছে।
গত নয় বছরে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা এই দেশ থেকেই পাচার হয়ে গেছে, ব্যাংকের খেলাপি ঋণ ছাড়িয়েছে এক লাখ কোটি টাকা, শেয়ারবাজার থেকে লোপাট হয়েছে আশি হাজার থেকে এক লাখ কোটি টাকা, কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে নব্বই মিলিয়ন ডলার উধাও হয়ে গেছে, বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টের সোনা ‘তামা’ হয়ে গেছে, কয়লা খনির দেড় লাখ টন কয়লা উধাও, এর জন্য আজ পর্যন্ত ক’জন মানুষকেও পাকড়াও করা হয়েছে।
তার পরেও তাপসী রাবেয়া স্টাইলে কথা বলা বন্ধ হয়নি।
যে ছাত্রনেতা সোনালী ব্যাংক বা জনতা ব্যাংক খালি করেছেন, এরা যখন টকশোতে এসে কথা বলেন, তখন একেকজনকে যুধিষ্ঠির বলে মনে হয়। কয়লা চুরির জন্য ১২ বছর আগে ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া বিএনপি-জামায়াতকেই দায়ী করেছেন যুধিষ্ঠির লীগের প্রচার সম্পাদক। বাংলাদেশ ব্যাংকের ভল্টে রক্ষিত সোনার ধাতু কিভাবে বদলে গেল, তার একটা চমৎকার ব্যাখ্যা দিয়েছেন কেন্দ্রীয় ব্যাংকটির জিএম আওলাদ হোসেন। তিনি জানিয়েছেন, তারা চার কোটি টাকা খরচ করে যে মেশিন কিনেছেন সেই মেশিনটির রঙ হেডেড হয়ে পড়েছে। সেই মেশিন সোনাকেও সোনা বলে, আবার পিতলকেও সোনা বলে। অর্থাৎ সোনার মেশিন সোনা চিনতে পারে না।
যুধিষ্ঠির লীগের হাছান এবং হোসেনরা দেশের মানুষের মাথাটি ‘আওলাইয়া’ দিয়েছেন। এ দুইজনের আত্মপক্ষ সমর্থনের কোশেশ ভদ্রলোকের কথা মনে পড়ে যায়।
সেই ভদ্রলোক স্ত্রীর কাছে হাতেনাতে ধরা পড়ে যান। স্ত্রী যে এত তাড়াতাড়ি বাসায় ফিরে আসবেন, তা ঠাহর করতে পারেনি। স্ত্রীর চিৎকারে হুঁশ ফেরে, ছি ছি ছি শেষমেশ কি না এ কাণ্ড?
হাতেনাতে ধরা খেয়ে স্বামী প্রবর যুক্তি দেখায়, দেখো প্রিয়তমা, এই হতচ্ছাড়া মেয়েটি তোমার পুরনো শাড়ি পরে থাকায় আমি এই ভুল করে ফেলেছি।
তখন স্ত্রী আর্তচিৎকার করে বলে, থামাও তোমার এই বোগাস। ওই হারামজাদি আমার পুরনো শাড়ি নয়, তোমার মায়ের পুরনো শাড়ি পরে আছে!
ধরা খেলে সাহেব ও মিয়াদের মাথা এমন করেই আউলিয়ে যায়। এরা কখনো পরনের শাড়ির ওপর দোষ চাপায়, কখনো সোনা চেনা মেশিনের ওপর কিংবা কখনো বারো বছর আগে ক্ষমতা ছেড়ে যাওয়া বিরোধী দলের ওপর।
২.
‘বাবা কেন চাকর’, ‘স্বামী কেন আসামি’ ইত্যাদি শিরোনামে বেশ কয়েকটি সিনেমা হয়েছিল। এ দেশের রঙ্গমঞ্চে আরো দু’টি সিনেমা মঞ্চস্থ হয়ে গেছে। এর একটি ‘প্রেমিক কেন বাপ’, অন্যটি ‘বিচারপতি কেন ফেরারি’।
কয়েক বছর আগে নারায়ণগঞ্জের এক নেতা তার ঊর্ধ্বতন নেতাকে ফোনে বলেছিলেন, ‘ভাই, আফনে আমার বাপ লাগেন। আফনে আমারে বাঁচান।’ অনেকটা এই ধারায়।
বাপ ডাকার দ্বিতীয় যে সংবাদটি জাতির মর্মমূলে প্রবেশ করেছে- তা আরো ক্লাইমেক্সপূর্ণ। সেটি নিয়েই এ দেশের রাজনীতির মঞ্চে তৈরি হয়েছে ‘প্রেমিক কেন বাপ’ নামের সিনেমাটি।
এই সিনেমার নায়িকা একটি ছাত্র সংগঠনের জেলা কমিটির সহসভাপতি। নায়ক সেই জেলার জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান। নায়িকার বয়স ২৫, নায়কের ৭০। এই গল্পের নায়ক এক ধরনের বাদশাহী জীবন উপভোগ করেন। রাজা বাদশাহদের হেরেমখানার স্বাদ থেকেও এদের অনেকে বঞ্চিত হন না।
অসম বয়সী এই দুই প্রেমিক-প্রেমিকার ভিডিওটি সঙ্গত কারণেই ভাইরাল হয়ে পড়েছে। তাদের মধ্যকার ধ্বস্তাধ্বস্তি টেকনোলজির কল্যাণে দেশবাসী অনেকটা চর্মচোখে দেখেছে। নায়ক কর্তৃক প্রত্যাখ্যাত হয়ে নায়িকার আত্মহত্যার প্রচেষ্টা এবং সেখান থেকে হাসপাতালে ভর্তি। সবকিছুর পুঙ্খানুপুঙ্খ দৃশ্য ক্যামেরায় বন্দী করা হয়েছে। তারপর হাসপাতালের শয্যা থেকে নিজেদের যাপিত জীবনকাহিনীর করুণ রসের বর্ণনা- সবগুলোর ভিডিও রেকর্ড বা আমলনামা ইউটিউবে সংরক্ষিত রয়েছে।
ভিডিওর প্রথম দৃশ্যে দেখা গেল নায়িকা তার প্রেমিকের পথরোধ করে দাঁড়িয়েছেন। নায়ক ধাক্কা মেরে নায়িকাকে দিয়েছেন সরিয়ে। নায়িকা নাছোড় বান্দার মতো পেছনে পেছনে ছুটছেন। কয়েকজন সুঠামদেহী পুরুষ নায়কের সহায়তায় এগিয়ে এসেছেন। প্রেমিকাকে পাশ কাটিয়ে পতœীকে সাথে করে নায়ক নিজের গাড়িতে গিয়ে উঠে বসেছেন। প্রেমিকাও পেছন পেছন গাড়ি পর্যন্ত এগিয়ে এসেছেন। সেই গাড়িতে ওঠার জন্য কিছুক্ষণ ধ্বস্তাধ্বস্তি। তবে নায়কের পাশবিক শক্তির কাছে নায়িকার নান্দনিক শক্তি হার মানে। নায়িকাকে ধাক্কা দিয়ে বের করে দরজা বন্ধ করে দেয়া হয় এবং গাড়িটি চলতে শুরু করে। চরম হতাশায় নায়িকা নিজের কপালে থাপ্পড় মারতে থাকেন। এরপর আত্মহত্যা করার জন্য ছাদে ওঠেন। অন্যরা তাকে থামালেন। রাগে, ক্ষোভে বেদনায় জ্ঞান হারান নায়িকা। কয়েকজন ধরাধরি করে তাকে নিচে নিয়ে এসে হাসপাতালে ভর্তি করিয়ে দেন।
তারপর সেই নায়িকা হাসপাতালের বেডে শুয়ে নিজের বক্তব্য রাখেন। তিনি জানান, কিভাবে দাদা-নানার বয়সী এই নায়ক তাকে ভালোবাসে। গত তিন বছর তাকে নাকি উনি ব্যবহার করেছেন। ফুল ফ্লেজেড পতœী বানানোর প্রতিশ্রুতি থাকলেও নায়ক এখন বেঁকে বসেছেন। মূলত সেটা নিয়েই ক্লাইমেক্স।
অন্য এক খবরে প্রকাশ, আদালত পরস্পরের সম্মতি সাপেক্ষে এই কিছিমের প্রেমকে বৈধ বলে ঘোষণা দিয়েছেন। এটার সমালোচনা করলে শুধু ঝুঁকিই সৃষ্টি হবে না- প্রগতিশীল মানুষের খাতা থেকেও নামটি কাটা পড়বে। মানব-মানবীর এই সম্পর্কে সামাজিক অনুমোদনের যে শর্ত আমাদের সমাজে প্রচলিত ছিল- সেই শর্তটি উঠিয়ে দিলে লাভ শুধু এই জমানার শাহ আলমদেরই। আর এভাবে কপাল চাপড়াতে হবে নাদিয়াদের। সুলতানা কামাল চক্রবর্তী এবং খুশি কবিররা কোর্টের এসব রায় বা পর্যবেক্ষণে উল্লসিত হলেও কখনই নাদিয়াদের পক্ষে দাঁড়াবেন না। সেরকম দাঁড়ানোর ভরসা থাকলে নাদিয়াকে অবিশ্বস্ত প্রেমিক শাহ আলমকে বাপ ডাকতে হতো না।
এই সিনেমার শেষ দৃশ্যটি সত্যিই অভিনব। বলতে পারেন এটি মিলনাত্মক সিনেমা। শেষ দৃশ্যে চমৎকারভাবে নায়ক নায়িকা মিলে গেছেন। আগের দৃশ্যে যা দেখানো হয়েছে তার সবই জামায়াত-বিএনপির চক্রান্ত’ বলে নায়ক-নায়িকা দু’জনই বিবৃতি দিয়েছেন। প্রথম দৃশ্যগুলোতে যিনি প্রেমিক ছিলেন শেষ দৃশ্যে এসে তিনিই বাপ হয়ে পড়লেন!
এটা কিভাবে সম্ভব? জবাব মনে হয় একটাই, বিএনপি-জামায়াত তাদের প্রতিপক্ষের অন্তরে ঢুকে ‘ওয়াছ-ওয়াছা’ দেয়ার শক্তি আয়ত্ত করে ফেলেছে।
৩.
মাহমুদুর রহমানের ওপর কোর্ট প্রাঙ্গণের হামলা নিয়েও একই পরিস্থিতি। প্রধানমন্ত্রী এবং তার পরিবারের সদস্যদের ব্যাপারে অবমাননাকর মন্তব্যের জন্য কুষ্টিয়া জেলা ছাত্রলীগের সভাপতি ‘আমার দেশ সম্পাদক’ মাহমুদুর রহমানের বিরুদ্ধে একটি মানহানির মামলা করে ছিলেন। এখানেও মানের হানি হয়েছে একজনের, কিন্তু করেছেন অন্যজন। সেই মামলায় হাজিরা দিতে মাহমুদ কুষ্টিয়া আদালতে উপস্থিত হন। আদালত তার জামিন মঞ্জুর করেছেন। কিন্তু ছাত্রলীগ আদালতের রায়ে সন্তুষ্ট না হয়ে তাকে কোর্ট চত্বরে আটকে ফেলে।
মাহমুদুর রহমান ও তার সঙ্গীরা ফেইসবুকের মাধ্যমে এই খবর দেশবাসীকে অবহিত করেন। এদিকে ঢাকা থেকে বিএনপির মহাসচিব স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীকেও এ ঘটনা জানান এবং মাহমুদুর রহমানকে রেসকিউ করার জন্য তার সহযোগিতা কামনা করেন। কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে নিরাপদে বের হওয়ার জন্য মাহমুদুর রহমান ও তার আইনজীবীরা আবারো আদালতের শরণাপন্ন হয়েছিলেন। আদালত পুলিশকে ডেকে মাহমুদের নিরাপত্তা দেয়ার নির্দেশ দেন। তারপর পুলিশের আশ্বাস পেয়েই তিনি কোর্ট থেকে বের হয়েছিলেন। কিন্তু আদালত প্রাঙ্গণেই ‘জয় বাংলা’ স্লোগান দিয়ে তার ওপর হামলে পড়ে তাকে রক্তাক্ত করা হলো। এই আক্রমণের পর চিহ্নিত কয়েকজন ছাত্রলীগকে সাব্বাশ জানিয়ে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট দেন এবং তাদের সন্তুষ্টি প্রকাশ করেন।
এটা নিয়ে দেশের ভেতর এবং বাইরে থেকে তুমুল সমালোচনা শুরু হলে কুষ্টিয়ার ছাত্রলীগ ঝালকাঠির নাদিয়ার মতোই পল্টি মারে। এই আক্রমণের দায় সেই নাদিয়ার ভঙ্গিতেই বিএনপি-জামায়াতের ওপর চাপিয়ে দেয়া হয়। দেশবাসী হতবাক ও হতভম্ব হয়ে এদের পানে তাকিয়ে থাকে।
বর্তমান ক্ষমতাসীনরা শুধু রাষ্ট্রের বিভিন্ন অর্গানকেই ব্যর্থ ও নন-ফাংশনিং করেননি। সমাজব্যবস্থাটিকেও ব্যর্থ বা নন-ফাংশনিং বানিয়ে ফেলা হয়েছে। মানব সমাজের পারস্পরিক যোগাযোগের ভাষা ও ভাবও সঙ্কটে পড়ে গেছে।
দেশবাসী তাদের পাঁচ বা ছয়টি ইন্দ্রিয় ব্যবহারের মাধ্যমে কী দেখছেন, কী শুনছেন বা কী উপলব্ধি করছেন- সেটি বড় কথা নয়, বড় কথা হলো বর্তমান জমানার তাপসী এবং যুধিষ্ঠিররা কী দাবি করছেন, তাদের সেটাই বিশ্বাস করতে হবে। বিশ্বাস না করলে কিলিয়ে কাঁঠাল বানিয়ে দেয়া হবে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন