মরহুম বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান আওয়ামী ঘরানার সুশীল-সজ্জন ব্যক্তি হিসেবে পরিচিত ছিলেন। জীবনের শেষ মুহূর্তেও নিজের আদর্শিক অবস্থান থেকে সরে দাঁড়াননি। পছন্দের সরকারের কাছে কোনো টিভি চ্যানেল বা অন্য কিছু চেয়ে হতাশ হয়েছিলেন- এমন কথা কিন্তু তার সম্পর্কে শোনা যায়নি। ২০১০ সালের অক্টোবর মাসে ঢাকায় ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি অনুষ্ঠানে দেশের তখনকার পরিস্থিতি তুলে ধরতে গিয়ে তিনি বলে গেছেন, ‘দেশ এখন বাজিকরদের হাতে। ভর্তিবাজি, নিয়োগবাজি, টেন্ডারবাজি, দলবাজি ও মতলববাজির রকমফের দেখে মানুষ দিশেহারা।’
এ কথাটি শুনে সৈয়দ আশরাফুল ইসলামসহ অনেকেই তার প্রতি অত্যন্ত গোস্বা করেছিলেন। ক্ষুব্ধ আবদুল গাফফার চৌধুরী তখন তার স্বভাবসুলভ ভঙ্গিমায় সিরিজ লেখা শুরু করে দেন। ফলে যে মহৎ উদ্দেশ্যে এ কথাটি বলা হলো, সেই উদ্দেশ্যটি সাধিত হয়নি। মরহুম এ বিচারপতির কথাটিকে যদি আওয়ামী লীগ এবং তার নেতৃত্ব একটু আমলে নিত, তবে তাদের নিজেদের অনেক উপকার হতো আর দেশটিও একটি মহাবিপর্যয় থেকে রক্ষা পেত।
জনগণ কিন্তু বোকা নয়, দেশের হর্তাকর্তারা নিজেকে যত চালাক মনে করেই কাজগুলো করুন না কেন, জনগণ সেটি ধরে ফেলে। এ মেসেজটিই বিচারপতি হাবিবুর রহমান যথাযথ জায়গায় পৌঁছাতে চেয়েছিলেন। তার প্রথম উদ্দেশ্যটি সফল না হলেও জনগণের মনের অব্যক্ত বেদনা প্রকাশ করার একটা যুতসই শব্দ তিনি জাতিকে স্মরণ করিয়ে দিয়ে গেছেন। এ শব্দটি উচ্চারণের মাধ্যমে মনের ক্ষোভ অনেকটা লাঘব হয়। ক্ষমতাসীন নেতৃত্ব জনগণকে বোকা ঠাহর করে যখনই নিজেদের চালাকি দেখাতে যায়- তখনই বিচারপতি হাবিবুর রহমানের এ কথাটি স্মরণ করে এক ধরনের প্রশান্তি অনুভব করা সম্ভব হয়।
প্রধানমন্ত্রী দিন কয়েক আগে আত্মবিশ্বাসের সাথে ঘোষণা দিয়েছেন, ‘ভোট চুরি করে ক্ষমতায় আসার নিয়ত আমার নেই।’ এটা ঠিক, ২০১৪ সালের জানুয়ারি মাসে ভোট চুরি বা ডাকাতির কোনোটির দরকার পড়েনি। তখন ১৫৩টি সিটে বিনা ভোটেই নির্বাচিত হয়ে গিয়েছিলেন সরকারের প্রার্থীরা। নির্বাচনব্যবস্থাকে তখন কার্যত হত্যা করা হয়। কাজেই চুরি বা ডাকাতির প্রয়োজন পড়েনি।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান মারা গেছেন ২০১৪ সালের ১১ জানুয়ারি। অর্থাৎ সেই নির্বাচনের ছয় দিন পরই মারা গিয়েছিলেন। কাজেই এরশাদ এবং রওশনকে নিয়ে গণতন্ত্রের নামে পুরো সার্কাস বা বাজি তিনি দেখে যেতে পারেননি। তবে বাজিকরদের সম্পর্কে তার প্রেডিকশন অক্ষরে অক্ষরে মিলে গেছে। যত দিন যাচ্ছে তত বড় বাজি জাতিকে দেখতে হচ্ছে।
দেশের নির্বাচন, প্রশাসন ও বিচারব্যবস্থাকে এই বাজিকররা কোন জায়গায় নিয়ে ঠেকিয়েছেন; তার অনেক কিছুই বিচারপতি হাবিবুর রহমানের মতো প্রজ্ঞাবান ব্যক্তি উপলব্ধি করলেও তা দেখে যেতে পারেননি। মাঠের অবস্থা যত সঙ্গিন হয়ে ওঠে, বাজিকরদের গলাবাজি তত বেশি শ্রুতিগোচর হয়।
দেশের মানুষ এক দিকে গলাবাজি শুনছে, অন্য দিকে দেখছে নির্বাচনে ব্যালট ডাকাতি, কারচুপি, জাল ভোট প্রদান, ভোটকেন্দ্র দখল, বিরোধী পক্ষের ভোটার ও এজেন্টদের ভয়ভীতি দেখিয়ে ভোটকেন্দ্র থেকে বের করে দেয়া, বিরোধী দলের প্রার্থী ও সমর্থকদের ওপর পুলিশ এবং সরকারদলীয় ক্যাডার বাহিনীর হামলা।
বর্তমান ক্ষমতাসীনদের একটা বিশেষ গুণ রয়েছে। কোনো কথাই তারা পেটের ভেতরে বেশি দিন ধরে রাখতে পারেন না। হয় নেত্রী নিজে কিংবা দল বা জোটের অন্য কেউ বলে দেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে সরকারের বিভিন্ন বাহিনীর সম্পৃক্ততার বিষয়ে আওয়ামী লীগের তৎকালীন জেনারেল সেক্রেটারি আবদুল জলিল বলে গেছেন। এরশাদও তখনকার ভেতরের খবর বাইরে প্রকাশ করে দিয়েছেন। শেখ হাসিনা নিজেও কথা প্রসঙ্গে সেই গোমর ফাঁক করে দিয়েছেন। ২০০৮ সালের নির্বাচনে ‘উদ্দীন’দের সহায়তায় কী ঘটেছিল, সেটাও পরবর্তীকালে নিজের মুখ দিয়েই বলে দিয়েছেন। সেই স্বীকারোক্তি ইউটিউবে পাওয়া যাবে। তখন আরেকটু কলকাঠি নাড়া দিলেই বিএনপির বদলে এরশাদের জাতীয় পার্টিকে বিরোধী দলে বসানো যেত।
নেত্রীর কথা, ‘বিশ্বাস করুন একটু ইচ্ছে করলেই আমি এরশাদকে বিরোধীদলীয় নেতা বানাতে পারতাম, বিশ্বাস করুন, এটা পারতাম।’ অর্থাৎ উদ্দীনরা সামনে থাকলেও তখনো (বিএনপিকে কয়টি সিট দেয়া হবে এটির) মূল নিয়ন্ত্রণটি তার হাতেই ছিল।
তারা আসলেই কী পারেন, তার একটু নমুনা সিলেটের মেয়র নির্বাচনে দেখিয়ে দিয়েছেন। সারা দিন বিএনপির প্রার্থী আরিফুল হক ও স্থানীয় বিএনপিকে নাচিয়েছেন। সঙ্গত কারণেই আরিফুল দিনভর অভিযোগ করে গেছেন প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থীর কেন্দ্র দখলের, সিল মারার, এজেন্ট বের করে দেয়ার এবং ভোটের নামে প্রহসনের। তিনি এমন কথাও বলেছেন, আগের রাতেই নৌকা প্রতীকে সিল মারা হয়েছে; অথচ রাতের বেলায় ভোট গণনার সময় দেখা গেল তিনিই এগিয়ে যাচ্ছেন।
ভেতরের পুরো মেকানিজমের কিছু যেন অনেকে বুঝতে পারছেন না। খুলনা, গাজীপুর, রাজশাহী ও বরিশালে বিএনপির হাতে মুলা ধরিয়ে দিলেও আরিফের হাতে কেন লজেন্স, তা মালুম করতে একটু কষ্ট হতে পারে। যা হোক, দিনের টেনশন ভুলে গিয়ে রাতের বেলায় দুই আঙুল ফাঁক করে তিনিও দেখালেন বিজয় চিহ্ন।
পেছনের নটরাজের খেলা ধরতে ব্যর্থ হলে কিংবা আপাতত না বোঝার ভান করা চলবে না। রাজশাহী এবং বরিশালের মতোই একই অনিয়মের অভিযোগ ছিল সিলেটেও। জনগণ বলাবলি করছে, ব্যালট বাক্সে যে সিলই পড়–ক কিংবা যে সিলই মারা হোক না কেন- ফলাফল ঘোষণা হবে ওপরের ইচ্ছা ও দরকার অনুযায়ী। দেশটি যে আসলেই বাজিকরদের হাতে পড়ে গেছে এবং বিচারপতি হাবিবুর রহমান যে মিথ্যা বলে যাননি- এই নির্বাচন তা আরেকবার প্রমাণ করল।
নির্বাচনের আগে আগে সজীব ওয়াজেদ জয় একটি সার্ভের ফলাফল ঘোষণা করলেন। চলুন, সেই সার্ভে এবং সজীব ওয়াজেদ জয়ের পুরো পোস্টটির ওপর নজর বুলাই।
‘আসন্ন বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট সিটি করপোরেশন নির্বাচন নিয়ে পুরো জুলাই মাস ধরে স্বতন্ত্র গবেষণা প্রতিষ্ঠান রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট সেন্টারের (আরডিসি) মাধ্যমে আমরা তিনটি জনমত জরিপ করিয়েছি। জরিপগুলোর ফলাফলগুলো তুলে ধরছি-
বরিশাল : সেরনিয়াবাত সাদিক আব্দুল্লাহ (আওয়ামী লীগ) : ৪৪.০%, মুজিবুর রহমান সরওয়ার (বিএনপি) : ১৩.১%, অন্যান্য প্রার্থী : ০.৮%, সিদ্ধান্তহীন : ২৩.৫%, উত্তর দেননি : ১৫.৯%। বরিশাল সিটি করপোরেশনের এক হাজার ২৪১ জন নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে এ জরিপটি চালানো হয়।
রাজশাহী : খায়রুজ্জামান লিটন (আওয়ামী লীগ) : ৫৮.০%, মোসাদ্দেক হোসেন বুলবুল (বিএনপি) : ১৬.৪%, অন্যান্য প্রার্থী : ০.৯%, সিদ্ধান্তহীন : ১২.৩% এবং উত্তর দেননি : ৯.৬%। রাজশাহী সিটি করপোরেশনের এক হাজার ২৯৪ জন নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে এ জরিপটি চালানো হয়।
সিলেট : বদর উদ্দিন আহমেদ কামরান (আওয়ামী লীগ) : ৩৩.০%, আরিফুল হক চৌধুরী (বিএনপি) : ২৮.১%, অন্যান্য প্রার্থী : ১.৩%, সিদ্ধান্তহীন : ২৩.০%, উত্তর দেননি : ১২.৬%। সিলেট সিটি করপোরেশনের এক হাজার ১৯৬ জন নিবন্ধিত ভোটারের মধ্যে এ জরিপটি চালানো হয়।
সিটি করপোরেশনের ভোটার তালিকার নারী ও পুরুষ ভোটারের অনুপাত এবং বরিশাল, রাজশাহী ও সিলেট শহরের ২০১১ সালের শুমারির বয়স সম্পর্কিত তথ্যের বিন্যাস অনুযায়ী এই জরিপের ফলাফল উপস্থাপন করা হয়েছে। নির্বাচন কমিশনের ভোটার তালিকা থেকে ঠিকানা নিয়ে জরিপের জন্য নমুনা বাছাই করা হয়। এর মধ্য থেকে যারা নিজেদের সিটি করপোরেশনের ভোটার বলে নিশ্চিত করেন, তাদেরকেই জরিপে অন্তর্ভুক্ত করা হয়। এ জরিপে ভুলের মাত্রা (গধৎমরহ ড়ভ ঊৎৎড়ৎ) ধরা হয়েছে +/- ২.৫। পাঁচ বছর ধরে আরডিসির মাধ্যমে আমরা জরিপ পরিচালনা করছি। তাদের জরিপের পদ্ধতি ও ফলাফল বরাবরই আমার সঠিক মনে হয়েছে। আমাদের মনে রাখতে হবে, যেহেতু জরিপগুলো এক মাস ধরে করা হয়েছে এবং এর মধ্যে নির্বাচনী প্রচারণা জোরেশোরে চলেছে, তাই জরিপ ও নির্বাচনের ফলাফলে কিছুটা তফাত হতে পারে। কিন্তু আমি আত্মবিশ্বাসী যে, বরিশাল ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ বিশাল ব্যবধানে জয়ের পথে। যদিও সিলেটে আমরা কিছুটা এগিয়ে আছি, এ মুহূর্তে আসলে কাউকেই বিজয়ী হিসেবে দেখার সুযোগ নেই।’
জয় আরো বলেছেন, ‘বিএনপি অনেক ধরনের অভিযোগ করতে থাকে। কিন্তু আসল কথা হচ্ছে, তাদের কোনো জনপ্রিয়তাই নেই। অন্য দিকে, আওয়ামী লীগের জনসমর্থন দিন দিন বাড়ছে। নির্বাচনী লড়াইয়ে বিএনপি এখন আওয়ামী লীগের জন্য কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই নয়। আমি আমাদের দলীয় নেতাকর্মী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্য ও নির্বাচনের দায়িত্বে থাকা কর্মকর্তাদের প্রতি আহ্বান জানাব- তারা যেন সজাগ থাকেন। কারণ, আমাদের আশঙ্কা বিএনপি ভোটকেন্দ্র দখল করে জাল ভোট দিয়ে সেই দায় আমাদের ওপর চাপানোর চেষ্টা চালাবে। আপনারা সবাই বিএনপি নেতাদের এরূপ ষড়যন্ত্রের ফোনালাপ সম্প্রতি শুনেছিলেন গাজীপুর নির্বাচনের সময়। বিএনপির প্রার্থীরা যতই ভোটারদের কাছে যান, ততই তারা বুঝতে পারেন, তাদের দল বাংলাদেশের মানুষদের থেকে কতটা দূরে সরে গেছে। তাই আওয়ামী লীগকে বিতর্কিত করে নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ করাই তাদের একমাত্র কৌশল।’
নির্বাচন নিয়ে বিএনপি-জামায়াতের ‘ষড়যন্ত্র’ কী কী পদ্ধতিতে হতে পারে- সেসব আগেভাগেই জানিয়ে দিলেন। নির্বাচনের দিন অনলাইনে একটি দৈনিক শিরোনাম করল, নৌকা নৌকা স্লোগান দিয়ে কেন্দ্র দখল, ধানের শীষে ভোট পড়ল। সেই লিংকটি সাথে সাথে আবার সজীব ওয়াজেদ জয় তার পেইজে তুলে ধরলেন। পুরো মেকানিজমটি যেন ধীরে ধীরে স্পষ্ট হচ্ছে!
আলোচ্য সার্ভেটি চিত্তাকর্ষক। বরিশাল ও রাজশাহীতে আওয়ামী লীগ এবং বিএনপি প্রার্থীর মধ্যে বিশাল পার্থক্য দেখানো হলেও সিলেটে সেই পার্থক্য ছিল খুব কাছাকাছি। এ সার্ভেতে যেভাবে দেখানো হয়েছে, তেমনি কাছাকাছি ভোটের ব্যবধানেই আরিফুল জিতেছেন।
ক্লাস টুয়ের ছেলেটিও বিষয়টি মালুম করে ফেলেছে।
এতে স্পষ্ট হয়, কাকে কত ভোটে জয় দেখানো হবে তা আগে থেকে পুঙ্খানুপুঙ্খ ঠিক করে রাখা হয়েছিল।
বাজিকরেরা নির্বাচনে বিএনপিকে তেমনভাবে টাসকি খাইয়েছে।
উল্লিখিত লজেন্সটি বিএনপি স্থানীয়ভাবে স্বাদ আস্বাদন করলেই ভালো করবে। তবে মেয়র কতক্ষণ এই লজেন্সটির স্বাদ আস্বাদন করতে পারবেন- তার কোনো ঠিক-ঠিকানা নেই। মেয়াদকালীন সময়ে তিনি কতক্ষণ জেলের বাইরে থাকবেন, সেটিও গবেষণার বিষয়। কেন্দ্রীয় কোনো নেতা কিংবা বিএনপিপন্থী কোনো বুদ্ধিজীবী যদি লজেন্সটির স্বাদ আস্বাদন শুরু করেন বা এটি নিয়ে জোটের দূরত্ব বৃদ্ধি করেন, বাজিকরদের রোডম্যাপটিই এগিয়ে নেয়া হবে। এই সরকারের অধীনেই যারা আগামী সাধারণ নির্বাচনে অংশগ্রহণ করার জন্য উদগ্রীব হয়ে পড়েছেন, আরেকবার সাধলেই যারা থালা নিয়ে বসে পড়ার জন্য উতলা, তাদের জন্যও কিছু শিক্ষণীয় রয়েছে।
সামনে পথ একটাই, বিচারপতি হাবিবুর রহমান উচ্চারিত বাজিকরদের হাত থেকে জাতিকে উদ্ধার করা। ছেলেধরাও কার্যসিদ্ধির জন্য শিকারের হাতে লজেন্স ধরিয়ে দেয়। অবুঝ শিশু বুঝতে পারে না মিষ্টি লজেন্স তার জীবনে কতটুকু কষ্ট নিয়ে আসবে। বাজিকরদের হাত থেকে ২০-৩০টি লজেন্স গ্রহণ করলে ওসব অবুঝ শিশুর মতো জাতিও কষ্টে নিপতিত হবে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন