নব্বই দশক পর্যন্ত সারা বিশ্ব থেকে মেরিটাইম স্টুডেন্টরা ইউকের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে পেশাগত সনদ অর্জনের জন্য যেতেন। মেরিটাইম মোড়লদের মধ্যে ‘বড় মোড়ল’ ছিল গ্রেট ব্রিটেন। গ্লোবালাইজেশনের ধাক্কায় এই প্রবণতা এখন অনেকটাই কমেছে। কিন্তু এ দেশের মেরিটাইম সনদ নিয়ে যে ছিনিমিনি বা ফেনীর পরিভাষায় ‘চুদুরবুদুর’ শুরু হয়েছে, তাতে সেই মোড়লি সিস্টেমই অনেক ভালো ছিল বলে মনে হচ্ছে। এটা আজকের লেখার মূল বিষয় নয়। অন্য সময় এটা নিয়ে আলোচনা করব। মোড়লদের দেশের অন্য একটি ঘটনা নিয়ে আজকের লেখা। খরচ কমানোর উদ্দেশ্যে বন্ধুরা মিলে গ্রুপে গ্রুপে যেতাম। সময়টি ছিল নব্বই দশকের শুরুর দিক। ঘটনাটি ঘটেছে নেভিগেটর বন্ধুদের গ্রুপে। গ্রুপের একজন হঠাৎ ধার্মিক হয়ে যায়। হালাল উপায়ে জবাই করা ছাড়া কোনো প্রাণীর গোশত সে খাবে না। তার এই ধার্মিকতা গ্রুপের অন্যদের ওপর আর্থিক চাপ সৃষ্টি করে। তখন ব্রিটেনে এখনকার মতো এত ‘হালাল’ দোকান ছিল না। অনেক কষ্ট করে অনেক দূর থেকে হালাল গোশত আনতে হতো।
বাসায় একদিন পার্টির আয়োজন করা হয়। কয়েকজন স্থানীয় ছাত্রকেও দাওয়াত দেয়া হয়েছে। ফলে পানীয়ের ব্যবস্থাও যথারীতি রাখা হলো। পার্টির মুড যখন তুঙ্গে, তখন নব্য ধার্মিক বন্ধুটি একটি বিয়ারের ক্যান খুলে সোজা গলায় ঢেলে দেয়।
এই ‘নয়নাভিরাম’ দৃশ্য দেখে আগে থেকেই কিঞ্চিত কাতর বন্ধুরা এবার সত্যি সত্যিই পাথর বনে যায়। তার জন্য হালাল চিকেন সংগ্রহের উদ্দেশ্যে যারা কয়েক মাইল হেঁটেছে- তারাই এখন তার বিয়ার পানের ‘চমৎকার’ দৃশ্য উপভোগ করছে।
আমাদের এই কয় বন্ধুর সে দিনের সেই মনোকষ্ট ভর করেছে আজ সমগ্র জাতির ওপর। মানবজমিনের একটি রিপোর্ট সবাই কাতর চোখে দেখেছে। প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক সম্পর্কবিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী গত ২ থেকে ৫ মে পর্যন্ত পাকিস্তান সফর করেছেন। একটি সূত্রের দাবি- গত কয়েক বছরে একাধিকবার ড. রিজভী পাকিস্তান সফর করেছেন। কিন্তু কখনোই তা প্রচার পায়নি। করাচির খ্যাতিমান প্রতিষ্ঠান হাবিব বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি তিনি। এ ব্যাপারে মন্তব্য নিষ্প্রয়োজন। মন থেকে একটি কথাই বেরিয়ে আসে- ‘কৃষ্ণের বেলায় লীলাখেলা, অন্যের বেলায় পাপ।’
যারা কথায় কথায় দেশবাসীকে ‘পাকিস্তান জুজু’র ভয় দেখান, প্রতিপক্ষকে উঠতে বসতে সে দেশে ঠেলে দেন, ‘পেয়ারে পাকিস্তান’ বলে মজাক করেন; তাদেরই এক মহাক্ষমতাধর ব্যক্তি দুই দিন পরপর পাকিস্তানে যান।
এই লীলাখেলাকে জাস্টিফাই করার জন্য স্মরণ করিয়ে দেয়া হচ্ছে, ‘সবার সাথেই বন্ধুত্ব- কারো সাথে শত্রুতা নয়।’ জামায়াত-বিএনপির এই পর্যায়ের কোনো নেতা যদি পাকিস্তানের কোনো বিশ্ববিদ্যালয়ের ট্রাস্টি হতেন, এ রকম ঘন ঘন সেখানে যেতেন; তবে এতক্ষণে নিরপেক্ষ সুশীলরা এ দেশে রোজ কিয়ামত শুরু করে দিতেন।
শুধু তাই নয়- এই জুজুর ভয় দেখিয়ে তারা সিঙ্গেল ইউনিটের এই জাতিকে স্পষ্টতই দুই ভাগে ভাগ করে ফেলেছেন এবং আমাদের দেশকে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে অনেক বছর পিছিয়ে দিয়েছে এটা। এ দেশে ‘পাকিস্তান’ নামক শব্দটি মোটামুটি একটি নাপাকি শব্দ, ম্লেচ্ছদের শব্দে পরিণত হয়েছে। এই নাপাকির সংস্রব থেকে দূরে থাকার নিমিত্তে এ দেশের সাহিত্য, সংস্কৃতি, সিনেমা, নাটক ৫০ বছর ধরে কাজ করে যাচ্ছে। এ অবস্থায় এই মহোদয় কেন ঘন ঘন পাকিস্তানে গেলেন তা চিন্তার বিষয় বৈকি।
মেরিন একাডেমিতে জুনিয়র লাইফের একটি করুণ রসের কাহিনী মনে পড়ে যায়। আমাদের প্রায়ই অ্যাটেনশন বা সোজা হয়ে থাকতে হতো। এমন সোজা যে, দুই হাত ও শরীরের মধ্যে সামান্য গ্যাপ বা ফাঁক সিনিয়ররা বরদাশত করতেন না। একটু গ্যাপ থাকলেই সিনিয়ররা সেখানে হাত ঢুকিয়ে চিৎকার করে উঠতেন, ব্লাডি হেল! হোয়াই গ্যাপ (ফাঁক কেন)? এই আতঙ্কে আমরা মনে হয়, লক টাইট দিয়ে হাত আর শরীরকে সংযুক্ত রাখতাম। কিন্তু মুশকিল হলো, সিনিয়ররা ইচ্ছে করলেই এই লক টাইট ছুটিয়ে চিচিং ফাঁক করে ফেলতেন।
একদিন জনৈক সিনিয়র আমাদের এক বন্ধুর হাতের ভেতর হাত ঢুকিয়ে চিৎকার শুরু করলেন, হোয়াই গ্যাপ? বন্ধুটি এত শক্তভাবে গ্যাপ বন্ধ করতে চাইলো যে, সিনিয়র মহোদয়ের হাত সামনে-পেছনে আর নড়াতে পারছেন না। তবুও চিৎকার করে যাচ্ছেন, হোয়াই গ্যাপ? কয়েক মিনিট ধস্তাধস্তি করে অবশেষে নিজের হাত বের করতে সক্ষম হন সেই সিনিয়র। এরপরও জুনিয়রকে লাউজি হ্যাগার্ড গালি দিতে কসুর করেন না। এ দেশে পাকিস্তানকে নিয়েও একই পরিস্থিতির উদ্ভব হয়েছে।
এখন ওবায়দুল কাদের যখন কথা বলেন, তখন মনে হয় সেই সিনিয়ররা জুনিয়রদের সাথে মশকারা করছেন। এখানে ‘চেতনাপন্থী’রা সেজেছেন সিনিয়র। অসহায় জুনিয়র হয়েছে এই চেতনার বিরোধীরা। আর এ গ্যাপটি হলো পাকিস্তানের সাথে সম্পর্ক।
জামায়াত-বিএনপির লোকজন পারতপক্ষে এই গ্যাপ রাখেন না। তারপরও বুদ্ধিজীবী সার্কেলের জাফর ইকবাল, শাহরিয়ার কবির, মুনতাসির মামুন কিংবা রাজনীতির জগৎ থেকে মতিয়া চৌধুরী বা ইনুরা জাতির বুকে কম্পন ধরিয়ে চিৎকার মারেন, হোয়াই গ্যাপ? বাস্তবে গ্যাপ (পাকিস্তানের প্রতি দরদ) না থাকলেও এদের হস্ত প্রক্ষেপণে এই গ্যাপ হয়ে যায়।
বেগম খালেদা জিয়া পাকিস্তানকে নিয়ে উচ্ছ্বাসভরে কিছু বলেছেন, তা কেউ বলতে পারবে না। পাকিস্তানের কোনো অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করেছেন, পাকিস্তানের কোনো প্রেসিডেন্টকে নিজ হাতে রান্না করে খাইয়েছেন- এমন কোনো ঘটনার কথা কেউ বলতে পারবে না। ক্ষমতায় থাকতে পাকিস্তানের সাথে কোনোরূপ চুক্তি বা উল্লেখযোগ্য সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর করেছেন, তাও বলতে পারবে না। তাদের জাতীয় পতাকার রঙের কোনো শাড়ি পরেছেন- এ ধরনের ছবি প্রতিপক্ষের কয়েকটি থাকলেও তার একটিও নেই। আমরা নিশ্চিত, এ ধরনের আলোকচিত্র খালেদা জিয়ার একটি থাকলে তাদের মোরাল ব্রিগেড মুখে আঙুল ঢুকিয়ে হাজার বার বমি করতেন। শুধু তাই নয়, ওপরের প্রতিটি বাক্যে বেগম জিয়ার প্রতিপক্ষের রেকর্ডে চরম হতাশাজনক ‘হ্যাঁ’-বোধক বর্ণনা রয়েছে। তারপরও নিজেদের ঘরের পাপ ঢাকতে কথায় কথায় নেতানেত্রীরা তাকে পাকিস্তান পাঠিয়ে দেন। তবে নিজেদের নেত্রীকে ঘুণাক্ষরেও দিল্লিতে পাঠানোর চিন্তা করেন না।
২.
পাকিস্তানের প্রতি প্রেম এবং বিদ্বেষের একটি বিশেষ প্যাটার্ন রয়েছে। ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের ভয়াবহতার পেছনে মূল কালপ্রিট ভুট্টো। সেই ভুট্টোকে যুদ্ধের তিন বছরের মাথায় এ দেশে এনে লালগালিচা সংবর্ধনা দেয়া হয় এবং মহাকালপ্রিট ভুট্টোকে এমন ভঙিতে জড়িয়ে ধরা হয়েছিল, তা দেখে অন্তরাত্মা কেঁপে ওঠে। অথচ সেই সময়টি ছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উপযুক্ত সময়। কারণ, যুদ্ধের দাগগুলো এবং অপরাধীদের চেহারা ও কর্মকাণ্ড সবার মনে দগদগে অবস্থায় ছিল। তখন বিচার হলে সাক্ষীদের সেফহোমে রেখে টিউটরিংয়ের প্রয়োজন পড়ত না এবং পুরো বিচারপ্রক্রিয়াটিকে প্রশ্নবিদ্ধ করারও প্রয়োজন পড়ত না।
অতীতের দিকে দৃষ্টি মেললে পুরো রোডম্যাপটি স্পষ্ট হয়ে পড়ে। সবার পেছনে ছিলেন একজন নটরাজ। ২১ আগস্টের গ্রেনেড হামলা থেকে শুরু করে বেশ কয়েকটি জঙ্গি হামলার বেনিফিশিয়ারির চেহারাটিও স্পষ্ট হয়ে পড়ে। এগুলো ছিল কার্যত ‘এক-এগারো’র প্রস্তুতি পর্ব। সেই ‘এক-এগারো’র রোডম্যাপ মতোই ২০০৮ সালের নির্বাচন সম্পন্ন হয়েছে।
এই নির্বাচনের ফলাফল কী হবে, তা বিএনপি নেত্রীসহ অনেকেই আগে থেকে টের পেয়েছিলেন। বেগম খালেদা জিয়া জামায়াতের সেক্রেটারি জেনারেলকে তার আশঙ্কার কথা স্পষ্টভাবেই জানিয়েছিলেন। বিএনপিকে ৪৮টি এবং জামায়াতকে দু’টি আসন দেয়া হবে, বেগম জিয়া এ কথাটিও বলে দিয়েছিলেন। কিন্তু আওয়ামী লীগ দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে সংবিধান পাল্টে ফেলবে- জামায়াতের এই আতঙ্ক বিএনপিকেও সেই নির্বাচনের দিকে টেনে নেয়। তখন বিএনপি নেত্রীর ভাবনামতো, সেই নির্বাচন বয়কট করলে আজকের ইতিহাস ভিন্ন রূপ হতে পারত। একজন নগণ্য বিশ্লেষক হিসেবে তখন শফিক রেহমানের ‘মৌচাকে ঢিল’ বেগম জিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করে কলাম লিখেছিলাম। সেই লেখাটি সোনার বাংলাদেশ নামক ওয়েবসাইটে প্রকাশিত হলে জামায়াত সমর্থকদের পক্ষ থেকে বিরূপ সমালোচনা শুনতে হয়।
পুরো রোডম্যাপটি আওয়ামী লীগের কাছে স্পষ্ট ছিল। কাজেই আওয়ামী লীগ নির্বাচনী ইশতেহারে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের অঙ্গীকারটি যুক্ত করে দেয়। উদ্দিনদের বিশেষ আনুকূল্য ও সহযোগিতায় নির্বাচনে দুই-তৃতীয়াংশ আসন নিয়ে জয়ী হয়। সেই ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মাধ্যমে ক্ষমতা এবং জনগণের ম্যান্ডেট নামক একটি মহা অস্ত্র- দুটোই আওয়ামী লীগের হাতে এসে পড়ে। এটি দিয়েই জামায়াতকে কাবু করা হয়।
এখানে কিছু কৌতূহলোদ্দীপক বিষয় রয়েছে। প্রথমে যুদ্ধাপরাধের বিচারের কথা বলা হলেও পরে এটাকে মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ বলা হয়। এ সংশোধনটির জন্য কিন্তু জনগণের আরেকটি ম্যান্ডেটের জন্য অপেক্ষা করা হয়নি।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের কথা এলে প্রথমেই পাকিস্তান সেনাবাহিনীর চিহ্নিত ১৯৫ জন যুদ্ধাপরাধীর বিচারের প্রশ্নটি এসে পড়ে। কারণ, মূল কমান্ডের বিচার না করে তাদের অক্সিলিয়ারি ফোর্সের বিচার অর্থহীন হয়ে যায়। পুরো বিষয়টি জনগণ ও তাদের কথিত ম্যান্ডেটের নামে স্পষ্ট চাতুর্য ছাড়া কিছু নয়। এই প্রশ্নটি একদিন উঠবে।
এই বিচার নিয়ে দেশের ভেতরের সুশীলসমাজ তেমন প্রশ্ন না তুললেও আন্তর্জাতিক পরিসরের মানবাধিকারবিষয়ক বিভিন্ন সংস্থা প্রশ্ন তুলেছে। এই কোর্টের ‘আন্তর্জাতিক’ বিশ্লেষণ নিয়েও আপত্তি উত্থাপন করা হয়েছে। সরকার এসব সমালোচনার কোনো কিছুকেই গায়ে মাখেনি।
২০১০ সালে যে বিচারটি শুরু হয়েছে, তা ’৭২, ’৭৩ ও ’৭৪ সালে না করার কোনো কারণই ছিল না। কারণ, তখন স্বাধীনতার সপক্ষ শক্তিই ক্ষমতায় অধিষ্ঠিত ছিল। বিশেষ করে ১৯৭২-১৯৭৫ সাল, ১৯৮২-১৯৯০, ১৯৯৬-২০০১ তো ছিল এই বিচারের জন্য স্বর্ণযুগ। এমনকি ১৯৭৫ থেকে ১৯৮২ সাল পর্যন্তও ‘স্বাধীনতার বিরোধী’ রূপে পরিচিত কোনো দল ক্ষমতায় ছিল না।
অর্থাৎ ঘটনা সংঘটিত হওয়ার দীর্ঘ ৩৯ বছর পর, এই মামলার কার্যক্রম শুরু করা, অর্থাৎ এত বিলম্বে ঘটার পেছনে কোনো যুক্তিসঙ্গত কারণ নেই। এ মামলার ক্ষেত্রে কোনো সময়েই কোনো প্রতিবন্ধকতা ছিল না। কাজেই ঘটনা সংঘটিত হওয়ার প্রায় চার দশক পর বিচার শুরু করায় পুরো বিচারপ্রক্রিয়াটি নিয়ে প্রশ্ন তোলার অবকাশ সৃষ্টি হয়েছে। এই বিচার জনগণের মনে নতুন প্রশ্নের সৃষ্টি করেছে।
কার্যত এটাই প্রতীয়মান হয়েছে যে, বিচারের প্রসিকিউশন টিম সাক্ষীদের তৈরি করেছে, তাদের সেফ হোমে রেখে টিউটরিং করেছে বা জেরায় কী কী বলতে হবে তা শিখিয়েছে। আদালতে গিয়ে এদের অনেকেই গুবলেট পাকিয়ে ফেলেছেন। সুখরঞ্জন বালির মতো কেউ কেউ উল্টো সাক্ষী দিতে চেয়েছেন। আইসিটি এ বিষয়টির গভীরে যাওয়া দূরের কথা, তা করার প্রয়োজনীয়তাও উপলব্ধি করেনি। ন্যায়বিচারের স্বার্থে অ্যাপিলেট ডিভিশনের এ বিষয়ে গভীরে যাওয়া উচিত ছিল, যা তারাও করতে সক্ষম হননি।
স্কাইপ কেলেঙ্কারির মাধ্যমে এই ট্রাইব্যুনালের কিছু দিক উন্মোচিত হয়েছিল। এখন আরো উন্মোচিত করে দিয়েছেন এই ট্রাইব্যুনালের সবচেয়ে ভোকাল প্রসিকিউটর ব্যারিস্টার তুরিন আফরোজ। এই মুখরা আইনজীবী একজন অভিযুক্তের কাছ থেকে ‘কিছু’ পাওয়ার আশায় এই ট্রাইব্যুনাল সম্পর্কে আরো অনেক কিছু জানিয়ে দিয়েছেন বলে অভিযোগ আনা হয়েছে। বোরখার একটি বিকল্প ব্যবহারও তিনি তার ভক্তসমাজকে শিখিয়ে দিয়েছেন। দেরি না করে প্রসিকিউশন টিম থেকে তাকে বহিষ্কার করা হয়েছে। তিনি অবশ্য মনে করেন, সরকার তাকে ব্যবহার করে এখন ছুড়ে ফেলেছে।
৩.
ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের বেলায় ‘রুট কজ অ্যানালাইসিস’ বলে একটা পরিভাষা আছে। কোনো সমস্যা সমাধান করতে হলে নির্মোহভাবে এটি করতে হবে। রুট কজ অ্যানালাইসিস ঠিকভাবে করতে না পারলে কারেক্টিভ অ্যাকশনও ঠিকমতো হবে না। ফলে একই সমস্যা বারবার ঘুরেফিরে আসবে। মানবসমাজও ইঞ্জিনিয়ারিং বিদ্যার এ নিয়মটি মেনে চলে। আপনি যতই এটা ওটা করেন না কেন- আসল জায়গায় হাত না পড়লে কাজ হবে না।
আজকে সমাজে যে অস্থিরতা বা আইনের শাসনের দুরবস্থা, তাও আমাদের এই রুট কজ অ্যানালাইসিসে ব্যর্থতা থেকেই উদ্ভূত। এসব বিষয় বুঝতে অক্ষমরা দেশ ও জাতির রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক কর্ণধার সেজে বসে আছেন।
রাজনৈতিক প্রতিহিংসা চরিতার্থ করতে যখন আদালতকে ব্যবহারের পরিকল্পনা শুরু হয়- তখন সে মতলবটিকে যতই সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক ক্যাপসুল দিয়ে ঢেকে ফেলা হোক না কেন, এর ‘সিকোয়েন্সিয়াল কনসিকোয়েন্স’ থেকে রক্ষা মেলে না।
র্যাবের মতো এলিট ফোর্স কিংবা আইসিটির প্রসিকিউশন টিমকে যখন বিরোধী দলকে সাইজ করার জন্য ব্যবহার করা হয়, তখন এদের ভেতর থেকে সাত খুনের আসামি কিংবা বেআইনি কাজ করা আইনজীবীদের সৃষ্টি ঠেকানো যায় না। এই অস্থিরতা তখন সমগ্র সমাজে ছড়িয়ে পড়ে। দুর্নীতি ও অপশাসন প্রাতিষ্ঠানিক রূপ ধারণ করে। কথায় বলে, নিজের বউকে বসের মনোরঞ্জনে ব্যবহার করলে সেই পতিপ্রাণা স্ত্রী নিজের প্রাইভেট শখ-আহ্লাদ একটু-আধটু মেটাতেই পারে।
যাদের দিয়ে কুকাজ করানো হবে, তারা কখনোই সুশাসন বা আইনের শাসন প্রতিষ্ঠায় সহায়ক শক্তি হতে পারে না। যে সমাজে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক কোটা সংস্কারের জন্য আন্দোলন করায় ছাত্রের গায়ে বমি করতে চান, সেই সমাজে এক রাজনৈতিক টাউট মনোবাঞ্ছা পূর্ণ না হলে তো মাদরাসাপ্রধানের মাথায় মল ঢালবেই। সামাজিক অবস্থান ও চেহারায় পার্থক্য থাকলেও মানসিক গঠনে এরা একই। রুট কজ অ্যানালাইসিসে পারস্পরিক এই সম্পর্কগুলো আমাদের উপলব্ধিতে থাকতে হবে।
১৯৯৬ সালের রাজনৈতিক মিত্রদের যখন আওয়ামী লীগ ২০১০-এর পর ‘যুদ্ধাপরাধী’ মামলায় ফাঁসি দিতে থাকে, তখন তাদের ২০০১-এর সঙ্গী বিএনপি অনেকটা ‘ইয়া নাফসি, ইয়া নাফসি’ জপ করাকেই বুদ্ধিমানের কাজ বলে গণ্য করেছে। বিশ্বের নামীদামি সংস্থাগুলো এই বিচারের স্বচ্ছতা নিয়ে প্রশ্ন তুললেও সে কথাগুলো ধার করেও বিএনপি উচ্চারণ করতে সাহস পায়নি। এ দিকে, আমাদের একাডেমির জুনিয়রের মতো বিএনপি যত অ্যাটেনশন হয়েছে- সরকার ততই ‘হোয়াই গ্যাপ’ বলে রাজনৈতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক আক্রমণ চালিয়েছে।
সব ভয়ভীতি কাটিয়ে এবং নৈতিক স্বচ্ছতার স্বার্থে তখন যদি সম্মিলিত শক্তিতে উচিত কথাগুলো বলার সাহস করা হতো, তবে পরবর্তীকালে দেশের প্রধান বিচারপতিকে পালিয়ে বিদেশে যেতে হতো না; বিএনপির দ্বিতীয় প্রধান নেতা তারেক রহমানকে একটি বিচারে খালাস দেয়া বিচারককে দেশ ছাড়তে হতো না এবং সর্বোপরি দেশের তিন-তিনবারের প্রধানমন্ত্রীকে বিচারের নামে এমন অবস্থার মুখোমুখি হতে হতো না।
এখন আমরা দ্বিতীয় ধাপ অতিক্রম করছি। এই ধাপে আমরা নীরব থাকলে আরো ভয়াবহ তৃতীয় ধাপটি খুব দ্রুত আমাদের পানে ধেয়ে আসবে। সরকার ‘এক কৃষক ও চার চোরের কাহিনী’ ধরেই অগ্রসর হয়েছে এবং সফলভাবে তা বিরোধী রাজনৈতিক শক্তির ওপর প্রয়োগ করেছে।
২০ দলীয় জোট নেতৃত্ব যদি আওয়ামী লীগের রোডম্যাপ এখনো পড়তে পারেন এবং তদনুযায়ী সামনের পরিকল্পনা সাজান; তবে সরকারের পায়ের মাটি সরতে বেশি দিন লাগার কথা নয়। যারা মনে করেছিলেন, এই সরকারের সাথে দাঁড়িয়াবান্ধা খেলে ক্ষমতায় আরোহণ করা সম্ভব, খুলনার নির্বাচন তাদেরও চোখ খুলে দিয়েছে। বর্তমান কিসিমের দাঁড়িয়াবান্ধা নয়- অন্য খেলার প্রস্তুতি নিতে হবে। যারা বুড়ো ও টায়ার্ড হয়ে পড়েছেন, তারা সসম্মানে অবসরে যান। নতুন খেলোয়াড়দের খেলতে দিন।
মালয়েশিয়ার জনগণ পারলে আমরা পারব না কেন? আনোয়ার ইব্রাহিম পারলে খালেদা জিয়া বা তারেক রহমানের জন্য তা কঠিন হবে কেন? বিশেষ করে নাজিব রাজাকের মতো করাপ্ট লোকজন যখন ক্ষমতায়। তারা হাওয়া ভবনের কথা বলে বলে সারা দেশটিকেই খাওয়া ভবন বানিয়ে ফেলেছে।
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন