হীরকরাজা, হবুচন্দ্র ও নিরাভরণ রাজা
16 May 2018, Wednesday
সম্রাট বাবর, হুমায়ুন, আকবর, জাহাঙ্গীর, শাহজাহান প্রমুখ ঐতিহাসিক চরিত্রের চেয়েও এ দেশে বেশি ছড়িয়ে আছে কাল্পনিক চরিত্র হীরক রাজা, হবু চন্দ্র রাজা কিংবা ন্যাংটা রাজার নাম। আগে এই তিন চ্যাম্পিয়নের নাম আলাদাভাবে স্মরণ করা হতো। এখন মনে হচ্ছে এই তিনের সমন্বয়ে এক ‘ভয়ঙ্কর’ রাজা হাজির হয়েছেন এই মুল্লুকে।
বিচারপতি মুহাম্মদ হাবিবুর রহমান এই আজব রাজার নাম দিয়েছিলেন বাজিকর। প্রখ্যাত সাংবাদিক এবং সাবেক আওয়ামী লীগ দলীয় এমপি এ বি এম মূসা ডেকেছিলেন ‘চোরের রাজা’। তবে রূপের রানীরা এখনো কোনো কিছু না ডাকলেও এক কথার রাজা নিজেদের কাউয়া রাজ ঘোষণা করেছিলেন।
ড. কামাল হোসেনের কথামতো, ‘সংবিধান অনুযায়ী দেশের মালিক জনগণ। সেই জনগণই আজ বড় অসহায়। হাজার হাজার কোটি টাকা দুর্নীতি ও পাচার হয়ে যাচ্ছে; কিন্তু জনগণ কিছু করতে পারছে না। সবাই এত কথা বলছে, কোনো কিছুই তাদের গায়ে লাগছে না।’
গণতন্ত্রহীনতা এই ড্যামকেয়ার ভাবের মূল কারণ। ২০০১ সালে ক্ষমতা ছাড়ার আগে এক টাকার বিনিময়ে গণভবন একটি পরিবারের মালিকানায় ছেড়ে দেয়া হয়েছিল। এটা নিয়ে তুমুল সমালোচনা শুরু হলে কিছু দিনের মধ্যেই তা প্রত্যাহার করে নেয়া হয়। একই দল তখন জনগণের কথা গায়ে মাখত। কারণ তখনো এ দেশে গণতন্ত্র চালু ছিল। পাঁচ বছর ক্ষমতায় থাকলেও তখনো গণতন্ত্রকে পুরো ভক্ষণ করতে পারা যায়নি। এতদিনে সেই গণতন্ত্র ভক্ষণ কর্মটি সেরে ফেলা হয়েছে।
কাজেই হীরক রাজা, হবু চন্দ্র রাজা এবং ন্যাংটা রাজার অনুকরণে এক আজব রাজত্ব কায়েম হয়েছে।
আওয়ামী লীগের মতো জনসম্পৃক্ত ও পোড় খাওয়া রাজনৈতিক দলের ভূমিকা দলটির প্রতি অনুরক্ত অনেক বিবেকবান মানুষকে মর্মাহত করেছে। বাকশাল সৃষ্টির সময় মরহুম তাজউদ্দীন আহমদের মতো প্রজ্ঞাবান মানুষ আওয়ামী লীগে উপস্থিত ছিলেন। সেদিন তিনি সতর্ক করে বলেছিলেন, ‘মুজিব ভাই। আপনি শুধু নিজের মরণই টেনে আনছেন না। আমাদেরকেও সাথে নিয়ে মরবেন।’
আজকে তাজউদ্দীন আহমদের মতো দূরদর্শী কোনো নেতা আওয়ামী লীগে অবশিষ্ট নেই। কামাল হোসেনরা বিতাড়িত হয়েছেন, মাহমুদুর রহমান মান্নারা গলা ধাক্কা খেয়েছেন। তার পরেও কিছুটা দরদ নিয়ে ড. কামাল সতর্ক করে দেন, ‘ওরা যতই ভাব করুক যে, কিছুই গায়ে লাগছে না। তাদের শুভাকাক্সক্ষী হিসেবে বলব, ভাগ্য ভালো থাকলে সময় থাকতে দেশত্যাগ করুন। না হলে, এর পরিণতি ভয়াবহ হবে যা অতীতে বহুবার আমরা দেখেছি।’
জানি না, সুহৃদদের এসব সতর্ক বাণী প্রবেশ করার জন্য কানে কোনো ছিদ্র অবশিষ্ট আছে কি না।
২.
জামায়াত-বিএনপি নেতারা ধাক্কাধাক্কি করে বহুতলবিশিষ্ট বিল্ডিং রানা প্লাজা ফেলে দিয়েছিল। এ কথা বলে এক গবুচন্দ্র জাতিকে ‘টাসকি’ খাইয়েছিলেন। মনে হয়েছিল, সেই আপদ জাতির ঘাড় থেকে সরে গেছে; কিন্তু না, সেই আপদ আরো ঘনীভূত হয়ে ফারমার্স ব্যাংক নাম ধারণ করে জাতির রক্ত শুষে নিয়েছে। তার ভাতিজা এবং স্বাধীনতাযুদ্ধের মহান গবেষকও সেই ব্যাংকটির পরিচালক হয়েছিলেন। তদুপরি, একজন ছাত্র নেতাও পরিচালক হয়েছিলেন। এই প্রাইভেট ব্যাংকটি অক্কা পাওয়ার উপক্রম হলে পাবলিক ফান্ড থেকে এক হাজার কোটি টাকা দেয়া হয়েছে। জলবায়ু ফান্ডের টাকাও ব্যাংকটিতে গচ্ছিত রাখা হয়েছিল, তাও নলিশাহের খেদমতে গিয়েছে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে।
এতে অবশ্য বিবেকের দংশনের কিছু নেই। এই উপমহাদেশে প্রথম যে ব্যাংকটি দেউলিয়া হয়েছিল জানা গেছে তার মালিক ছিলেন কবিগুরু রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের পিতামহ প্রিন্স দ্বারকানাথ। লুণ্ঠন কর্মকে জাস্টিফাই করার জন্য এক গবুচন্দ্র বুক ফুলিয়ে বলেছেন, ক্ষমতায় থাকলে সম্পদ তো একটু বাড়বেই।
এসব দেখে অসহায় জনগণ মন খুলে কাঁদতেও পারছে না। কারণ ৫৭ ধারা প্রয়োগ করে এ দেশে কান্না বন্ধ করার মতো দশা সৃষ্টি করা হয়েছেÑ কাঁদতে কেহ পারবে নাকো যতই মরুক শোকে।’ হবুচন্দ্রের এই আইনটি বাস্তবায়নের জন্য আবার হীরক রাজার তন্তর মন্তর কৌশল ব্যবহার করা হচ্ছে।
এই তন্তর মন্তর শুধু দেশের ভেতরেই নয়- বাইরে নিয়েও শেখানো হয়। ভারত সরকারের আয়োজনে বাংলাদেশের গণমাধ্যম মালিক প্রতিনিধিদের একটি প্রভাবশালী দল এক সপ্তাহের সফরে নয়া দিল্লিতে গিয়েছিলেন।
এই ডিজিটাল তন্তর মন্তরেও পুরো কাজ হচ্ছে না দেখে বসুরা অ্যানালগ গাড্ডা নিয়ে নেমে পড়েছেন। ২০০৬ সালে লগিবৈঠা দিয়ে মানুষ মেরে সেই লাশের ওপর নৃত্য করেছিলেন চেতনার এই ভয়ঙ্কর সিপাহি। তিনি আসিফ নজরুলকে সরাসরি ‘গাড্ডা’ মারার হুমকি দিয়েছেন। একটা বিষয় প্রণিধানযোগ্য। আজ যখন এই ব্যক্তি জনগণের মাথায় কাঁঠাল ভাঙছেন তখন তিনি বিশেষ চেতনায় উজ্জীবিত রাজনৈতিক ক্যাডার; কিন্তু যখন বাতাসের দিক পরিবর্তিত হবে এবং একই ধরনের রাজনৈতিক প্রতিহিংসার মুখামুখি হবেন তখন তিনি রাতারাতি ‘সংখ্যালঘু’ হয়ে পড়বেন। একই রাজনৈতিক ট্র্যাডিশন তখন ‘সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতন’ হিসেবে চিহ্নিত হবে। অর্থাৎ মার দেয়ার সময় থাকেন ‘লীগার’ কিন্তু খাওয়ার বেলায় হয়ে পড়েন ‘সংখ্যালঘু’। এটাই এ দেশে তাদের টেকনিক্যাল সুবিধা। এই জটিলতার কারণেই এ দেশের বুদ্ধিজীবী সমাজ এ ব্যাপারে মুখ খুলে ‘সাম্প্রদায়িক’ হিসেবে চিহ্নিত হতে চান না। বসুরা এখন প্রকাশ্যে হুমকি দিলেও কিছু হয় না।
হীরক রাজার এই দেশে কারো কারো জন্য সাত খুন মাফ। অথচ শফিক রেহমানের মতো ব্যক্তির বিরুদ্ধে বায়বীয় হত্যার হুমকির অভিযোগ এনে দেশ ছাড়া করা হয়েছে।
এগুলো নিয়ে কথা বলার কেউ নেই। জনগণের হয়ে যারা কথা বলবেন Ñ তারা সেই তন্তর মন্তর শিখতে ও শেখানোতে ব্যস্ত।
৩.
হীরক রাজা এবং হবুচন্দ্র রাজার পরে আসে ন্যাংটা রাজার কথা। এই অংশটিই মূলত এই গল্পের চৌম্বক অংশ।
রাজ্যময় প্রচার চালানো হয়, কাউয়া রাজের জন্য একটি মহামূল্যবান ড্রেস বানানো হবে। এই ডিজিটাল ড্রেস কেউ কোনো দিন চোখে দেখেনি। বিশ্বের নামীদামি ডিজাইনার আর আইটি বিশেষজ্ঞকে এই ড্রেস বানানোর দায়িত্ব দেয়া হলো। তজ্জন্য টাকার কোনো সমস্যা নেই। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভও উদোম করে রাখা হয়েছে। উদোম রাজার রাজত্বে মানি বা টাকা এত বেশি অনাবৃত হয়ে পড়েছে যে, তা অন্যতম প্রধান রফতানিযোগ্য পণ্য হয়ে গেছে। গত দশ বছরে এই রাজ্য থেকে সাড়ে ছয় লাখ কোটি টাকা পাচার হয়েছে। এসব পিনাট নিয়ে কেউ মাথা ঘামায় না। সবাই ব্যস্ত ডিজিটাল ড্রেসটি কখন দেখবে সেটা জানতে। এই ড্রেসটি বানানোর পর এক শুভ দিনে রাজাকে তা পরিয়ে দেয়া হয়। মোদ্দা কথা হলো, কাউয়া রাজকে উদোম বানিয়ে চার পাশে সবাই পোশাকের প্রশংসায় পঞ্চমুখ হয়ে পড়েছে। রাজার মনেও বিশ্বাস জন্মে গেছে, তিনি অত্যন্ত চমৎকার একটি পোশাক পরিধান করেছেন।
সেই কনফিডেন্স নিয়ে রাজা রাজপথের মাঝখান দিয়ে হাঁটছেন। যারা এই পোশাকের প্রশংসা করে তাদের দিকেই মুক্তা হীরা জহরত ছুড়ে মারেন। এদের হাতেই রাজকোষের চাবিটিও ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এই অবস্থায় এই ডিজিটাল পোশাকের খুঁত ধরার মতো কোনো মানুষ এই রাজ্যে নেই। পত্রপত্রিকা এবং টিভি চ্যানেল যারা একই ছন্দে কথা বলেন, তাদের কোনো সমস্যা নেই। সমস্যা হয় তাদের যারা হীরক রাজার দেশের মাস্টার মশাইয়ের মতো গদ্যের ভাষায় কথা বলেন। এই ভাষায় কথা বলার দরুণ একটি দৈনিক পত্রিকা এবং গুটি কয়েক টিভি চ্যানেলের মালিককে রাজ্য থেকে বিদায় করে দেয়া হয়েছে। তাদের অপরাধ, রাজা যে আসলে নিরাবরণ হয়ে পড়েছেন- সেই কথাটি তারাই জনগণকে জানিয়ে দিয়েছিলেন।
শুধু দেশের জনগণ ও দেশীয় মিডিয়াই নয়- দেশের বাইরে থেকেও এই পোশাকের উচ্চ প্রশংসার সুবন্দোবস্ত করা হয়েছে।
এরা রাজার এই ডিজিটাল পোশাককে কখনো বিশ্বে দ্বিতীয়, কখনো তৃতীয় সুন্দরতম বলে ঘোষণা দিয়েছে। এমন প্রশংসা শুনে রাজা তো আকাশে উঠে যান।
এদের দেয়া খেতাব নিয়ে গবুচন্দ্র পরিষদ রাজাকে সত্যি সত্যি অভিনন্দন জানায়। জবাবে এর সব কৃতিত্ব রাজা মশাই দেশের জনগণকে উৎসর্গ করে দেন। এই বদান্যতায় চতুর্দিকে ধন্য ধন্য পড়ে যায়।
কিন্তু রাজার গায়ে যেমন পোশাকের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া যায়নি। তেমনি স্ট্যাটিসটিক্স ইন্টারন্যাশনাল, পিপলস অ্যান্ড পলিটিকস, গ্লোবাল ইন্টেলিজেন্স নেটওয়ার্ক, টেলিভিশন চ্যানেল দ্য ন্যাশনালকে কোথায়ও খুঁজে পাওয়া যায় না। ডিজিটাল ডুবুরি নামিয়েও তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। এ কথা সব জায়গা থেকে জানিয়ে দিলেও গবুচন্দ্রদের উল্লাসে একটুও ভাটা পড়েনি।
সবাই যখন রাজার উচ্চ প্রশংসায় পঞ্চমুখ, তখন একটি সংস্থা জানিয়ে দেয় যে রাজার গায়ে কোনো পোশাকই নেই। এটা শুনে গবুচন্দ্র মন্ত্রীরা তেলে বেগুনে জ্বলে ওঠে।
অজ্ঞাত অখ্যাত সংস্থার কাল্পনিক তুলনা নিয়ে গবুচন্দ্ররা জনগণের কানের পর্দা ফাটিয়ে ফেলে আর বিশেষ সংস্থার মূল্যায়নকে ঘৃণাভরে প্রত্যাখ্যান করেন!
উৎসঃ নয়াদিগন্ত
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন