ইরানের সঙ্গে পরমাণু চুক্তি
29 August 2015, Saturday
অবশ্যই তা সহজসাধ্য হয়নি। ওবামার যুক্তরাষ্ট্র দৃঢ়পদ ও আন্তরিক ছিল বলেই রিপাবলিকান প্রভাবান্বিত কংগ্রেস ও একগুঁয়ে ইসরায়েলকে পাশ কাটিয়ে প্রায় দুই বছরের নিবিড় কূটনীতি ও প্রচণ্ড দরকষাকষির ফলে ১৩ জুলাইয়ের মধ্যরাতে উভয় পক্ষ কোনোমতে চুক্তিটি স্বাক্ষরে মতৈক্যে পৌঁছায়; যদিও তখন পর্যন্ত বিশেষ করে জিসিসির মার্কিন মিত্র দেশগুলোর বিভিন্ন মহল থেকে চুক্তি বানচাল করার একাধিক প্রক্রিয়া সক্রিয় ছিল। এবং তা সক্রিয় ছিল পাশ্চাত্য মৈত্রীর একাধিক দেশ থেকে বিচিত্র সব কারণে। অবশ্য ওই কারণগুলোর কেন্দ্রে ছিল ইসরায়েল, যার অস্তিত্ব ইরান কখনো স্বীকার করতে চায়নি- বিশেষ করে ইরানে আহমাদিনেজাদের প্রেসিডেন্সির সময়।
চুক্তি স্বাক্ষরিত হওয়ার বেশ আগেই পারমাণবিক ইস্যুগুলোর প্রায় ১০০ পৃষ্ঠার বিবরণীতে ইরানের পারমাণবিক লিপ্সা এমনভাবে দুমড়ে-মুচড়ে ইরানকে বশে আনা হয়েছিল যে ওই বিষয়ে টুঁ শব্দ করারও এখতিয়ার ছিল না দেশটির। তা ছাড়া দেশটিকে নিয়ে ছিল অনেক সংশয়। ইরান এরই মধ্যে প্রচলিত অস্ত্রে যথেষ্ট সজ্জিতই শুধু নয়, সেসব তৈরিতে ও বন্ধু দেশগুলোতে সরবরাহ করতেও সক্ষম। বিশেষ করে দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র তৈরিতে ইরান এর মধ্যেই অনেক অগ্রসর।
প্রচলিত অস্ত্র নির্মাণে ইরানের পারদর্শিতা, বিশেষ করে দেশটির নির্মিত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র মজুদে অস্বস্তিতে থাকা জাতিসংঘ ইরানের প্রচলিত অস্ত্রসজ্জায়ই কিছু সীমাবদ্ধতা আরোপ করতে চাইলে চুক্তির কাছাকাছি পৌঁছেও উত্তেজনার সৃষ্টি হয় এবং সে সীমাবদ্ধতা আরোপ না করতে জেদ ধরে তেহরান। এতে সমগ্র চুক্তিটি ভেঙে পড়ার উপক্রম হয়। এই প্রশ্নে কেরি শক্ত অবস্থান নেন। কেননা ২০১৪ সালের শুরুতে ইসরায়েলিরা ভূমধ্যসাগরে একটি ইরানি ট্যাংকারের গতি রোধ করে, যা ইরানে তৈরি রকেট, মর্টার ও লাখ লাখ বুলেটে ভরপুর ছিল। বলাবাহুল্য, এগুলোকে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে ব্যবহারের জন্য গাজা উপত্যকায় পাঠানো হচ্ছিল। সিরিয়ার স্বৈরশাসক বাশার আল আসাদের সাহায্যার্থেও ইরানের অস্ত্র প্রেরণের প্রমাণ আছে। সিরিয়ার গৃহযুদ্ধে এ পর্যন্ত দুই লক্ষাধিক লোকের মৃত্যু হয়েছে এবং বহুলাংশে তা 'আইসিস' জঙ্গি তৎপরতাকেও উসকে দিয়েছে।
মার্কিন মিত্র সৌদি আরব-সংলগ্ন ইয়েমেনে সেখানকার মার্কিন সমর্থিত সরকারের বিরোধী হুথি বিদ্রোহীদের জন্য রসদ-সরঞ্জাম সরবরাহ করছে ইরান এবং দেশটি দীর্ঘদিনের মার্কিন মিত্র সৌদি আরবের সঙ্গেও এই একই ইস্যুতে প্রত্যক্ষ যুদ্ধে জড়িয়ে পড়েছে। তা ছাড়া চুক্তিটিকে যত দূর সম্ভব ইরানের অনুকূলে আনতে শীর্ষ রুশ কূটনীতিকদের তৎপরতা ইউরোপের মার্কিন মিত্রদের সন্দিগ্ধ করে তুলেছে বিধায় তারা নিশ্চিত করে ছেড়েছে যে আগামী ১০ থেকে ১৫ বছরের জন্য ইরানে সব ধরনের পারমাণবিক জ্বালানি উৎপাদন নিষিদ্ধ থাকবে।
চুক্তির লাভক্ষতির হিসাবকে এক পাশে রেখে ওবামা এটিকে একটি কৌশলগত (স্ট্র্যাটেজিক) লেনদেনের (Tradeoff) মাধ্যম রূপে বিবেচনা করেছিলেন। তিনি জানতেন যে চুক্তিতে কে কী পেল তা নিক্তি দিয়ে মাপা যাবে না। তবে অনস্বীকার্য যে বিশ্বের ভরকেন্দ্রে থাকা একটি অস্বস্তিকর উত্তেজনা তিনি কমাতে সক্ষম হয়েছেন। এ কথাও তো ঠিক, মানবসমাজের সব সংকটের নিরঙ্কুশ সমাধান নেই। ইরানের পরমাণু চুক্তিটিকে ঘিরে নতুন চালিকাশক্তি সৃষ্টি করবে, যা ইতিবাচক হলেও হতে পারে। তবে এই পর্যায়ে মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতার বিন্যাসে একটি পরিবর্তন দরকার ছিল। দরকার ছিল কূটনীতির গুণগত পরিবর্তনের। মার্কিন আনুকূল্যে ও সৌদি নেতৃত্বে যে আঞ্চলিক শক্তির বিকাশ উপসাগরীয় অঞ্চলে জিসিসির ব্যানারে দুই যুগের অধিক সময় ধরে অব্যাহত ছিল, তাতে শুধু কাঠামোগত নয়, উদ্দেশ্যগত পরিবর্তনের চাহিদা যুক্তরাষ্ট্র ও সংস্থাটি উভয়ের পক্ষ থেকে অনুভূত হয়ে আসছিল। কেননা মার্কিনিদের ইরাকে একটি অসমাপ্ত বিজয় অবশ্যই নুরি আল মালিকি থেকে হায়দার আল আবাদির প্রধানমন্ত্রিত্বকালে যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের জন্য কোনো সুফল বয়ে আনেনি।
সে জন্যই কি যুক্তরাষ্ট্র ও তার ইউরোপীয় মিত্রদের মনোবল চাঙ্গা করতে ইরানকে আঞ্চলিক নেতৃত্বের আসনে বসানো? তবে ইরানকে নিয়ে মার্কিনিদের এই এক্সপেরিমেন্ট অভিনব কিছু নয়। ইরানের প্রাক-বিপ্লব সময়ে যখন ইরানের শাহের আমলে মার্কিন আনুকূল্যে উপসাগরের পুলিশম্যান হিসেবে ইরানকে দাঁড় করানো ছিল শুধু সময়ের ব্যাপার। ইরান ইসরায়েলের একেবারে প্রথম দিককার স্বীকৃতি দানকারী দেশ। এখনকার চুক্তি অনুযায়ী পারমাণবিক ইস্যুতে কঠিন পরিস্থিতিতে নিপতিত হলেও সে সময়ে কিন্তু ইরানের পারমাণবিক শক্তি যুক্তরাষ্ট্রেরই আনুকূল্য উপভোগ করেছিল। এতটাই যে তার শুধু ১৯৭৯ সালের ইসলামী বিপ্লবের ঝোড়ো ঝাপ্টায়ই গতি পরিবর্তন হয়েছিল।
প্রেসিডেন্ট ওবামা দ্বিতীয় মেয়াদে নির্বাচিত হওয়ার পর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন যে তিনি যুক্তরাষ্ট্রকে মধ্যপ্রাচ্য থেকে সাময়িকভাবে গুটিয়ে নেবেন এবং ইসরায়েল কর্তৃক প্ররোচিত না হয়ে ইরানের সঙ্গে শান্তিপূর্ণ উপায়ে কূটনীতির মাধ্যমেই সেতুবন্ধে সচেষ্ট হবেন। অনেক সন্দেহ, উসকানি ও প্রতিবন্ধকতার মুখেও তিনি তাঁর কথা রেখেছেন। তিনি সফলভাবেই তাঁর জাতীয় নিরাপত্তা স্ট্র্যাটেজিকে একটি পুনরুজ্জীবিত আন্তর্জাতিক পরমাণু চুক্তির ওপর দাঁড় করাতে পেরেছেন। তিনি তাঁর প্রতিশ্রুত কূটনীতিকেও কাজে লাগিয়েছেন। এখন দেখার বিষয় শুধু এর কার্যকারিতা।
ইরানের পরমাণু চুক্তি যদি কূটনীতির বিজয়, আন্তর্জাতিক ব্যবস্থার কার্যকরিতা ও শুভবুদ্ধির সাফল্য বিবেচিত হয়, ইরানের পরমাণু চুক্তি বৈশ্বিক রাজনীতির একটি বিশেষ অর্জন। এত বিশাল অর্জনের জন্য কিছু না কিছু মূল্য তো দিতেই হয়। কূটনীতির ফাঁকফোকর গলিয়ে ইরান যদি পবিত্র শহর কোমের অদূরে ফার্দো পর্বতমালায় বিকল্প কোনো আণবিক স্থাপনা গড়ে তুলে থাকে এবং সেই বুশ আমল থেকে প্রচুর অনুসন্ধানের পরও সেই কল্পিত স্থাপনা সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়া সম্ভব না হয়ে থাকে, তাহলে তো সেটাকে প্রচেষ্টার সীমাবদ্ধতা বলে স্বীকার করতেই হবে, অন্তত বর্তমানের জন্য।
লেখক : সাবেক মহাপরিচালক, বিআইআইএসএস
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন