আলোচনায় মধ্যবর্তী নির্বাচন
04 August 2015, Tuesday
পূর্বাপর নির্ধারণ করতে পারা না গেলেও দেশের রাজনৈতিক পরিসরে কোনো একটি বিষয়কে ঘিরে কখনও কখনও একটি গুঞ্জনের সৃষ্টি হতে পারে। সেটাকে একেবারে ভিত্তিহীনও বলা যাবে না। ৫ জানুয়ারির বহুল আলোচিত ও সমালোচিত নির্বাচনের পর নিয়মতান্ত্রিক রাজনীতি থেকে ছিটকে পড়া বিএনপির পক্ষ থেকেই একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন করে ৫ জানুয়ারির নির্বাচনকে কলংকমুক্ত করার দাবি উঠেছিল। কিন্তু ওই সময়কার ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ এমন দাবিকে হেসে উড়িয়ে দিয়েছিল এবং যেভাবেই দলটি ক্ষমতায় এসে থাকুক না কেন, সেটাকে পাকাপোক্ত করতেই উদগ্রীব ছিল।
কিছুটা বিস্ময়কর মনে হলেও এমন মধ্যবর্তী নির্বাচনের প্রয়োজনীয়তা এখন আওয়ামী লীগের ভেতরেই কেউ কেউ অনুভব করছেন। অবশ্য এর একাধিক কারণও থাকতে পারে। একটি দল বা ব্যক্তি যতই ক্ষমতালিপ্সু হোক না কেন, সত্যিকারের কোন রাজনীতিক তা ছলচাতুরীর মাধ্যমে পেতে চাইবে না। আওয়ামী লীগের এখনও অনেক হেভিওয়েট জনপ্রিয় নেতা আছেন, যারা অগ্নিপরীক্ষাসম নির্বাচনেও উৎরে যাবেন। সেই মানের আওয়ামী নেতারা একটি একতরফা প্রশ্নবিদ্ধ নির্বাচন, যেখানে ১৫২টি আসনে কোনো প্রতিদ্বন্দ্বীই ছিল না, তেমন নির্বাচনে জয়লাভ নিয়ে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন না বা কৃতিত্ব দেখেন না। তারা লড়াই করেই ক্ষমতার আসনে বসতে চান।
তাছাড়া ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হঠাৎ করেই যায়নি। ওই নির্বাচনে বিএনপি যদি অংশগ্রহণ করতও তাহলেও বৈধ পথেই জেতার মতো অনেক পদক্ষেপই ক্ষমতায় থাকা আওয়ামী লীগ নিয়েছিল। এখন তো ক্ষমতাসীন দলের অবস্থা আরও অনেক বেশি অনুকূল। নবম সংসদের সরকারের ঊষালগ্ন থেকেই প্রশাসন দলীয়করণের যে প্রক্রিয়া শুরু হয়েছিল, তা এখন প্রাতিষ্ঠানিক ভিত্তি লাভ করেছে। ‘গিভ অ্যান্ড টেক’-এর ভিত্তিতে গড়ে উঠেছে একটা লেনদেনের সম্পর্ক, যাকে অব্যর্থই বিবেচনা করতে হয়। প্রশাসন, যেমন- আইনশৃংখলা বাহিনী, নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন যদি ক্ষমতাসীন দল ও তাদের ক্ষমতায় প্রত্যাবর্তনের পক্ষে কাজ করে, তাহলে সরকারও তাদের স্বার্থের পক্ষে কাজ করবে। অবস্থাটি এখন এমন এক পর্যায়ে এসে পৌঁছেছে যে, পুলিশ, র্যাব, দুদকের কোনো প্রতিনিধি যখন কথা বলেন, তখন মনে হয় যেন তারা ক্ষমতাভোগী রাজনীতিকের মতোই কথা বলছেন।
আমি বর্তমান সরকারের উন্নয়ন বা অগ্রগতির কোনো সমালোচক নই। এসব ক্ষেত্রে তারা তো ভালোই করছে- যদিও দুর্নীতি, বৈষম্য, আঞ্চলিকতা তাদের উন্নয়নের কাজে কিছুটা কলংক লেপন করছে। তাছাড়া ভারত-বাংলাদেশ সম্পর্কের খুঁটিনাটিকে সবাই এক দৃষ্টিতে দেখছে না, বা এই সম্পর্কের লাভ-ক্ষতি নিয়েও মতভেদ থাকতে পারে- যা সব সরকারের সময়ই কম-বেশি থেকেছে। কিন্তু অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে অব্যাহত গুমোট ভাব অবশ্যই কারও কাম্য নয়।
এ উপলব্ধি থেকে সরকারের অভ্যন্তর থেকেই যদি একটা তাগিদ এসে থাকে, সেটা অবশ্যই সুখবর। অনেক তো হল, ক্ষমতাসীনদের এমন অপ্রিয় কাজে এ পর্যায়ে দম ফুরোনোর কথা। দেখুন না কেমন লাগে একটি সুস্থ রাজনীতির ধারায় অবগাহন করতে। দু-দলই আকণ্ঠ ক্ষমতার স্বাদ গ্রহণ করেছে। কিন্তু তা ছিল তিক্ত বিস্বাদ। উভয়েই পারস্পরিক দোষারোপে ক্ষত-বিক্ষত হয়েছে। তাই আমি আশ্চর্য হবো না, সরকার যদি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে একটি আগাম নির্বাচনের কথা ভাবে এবং কলংকমুক্ত হতে চায়, বিশেষ করে বৈধভাবে কোনো কারচুপি না করেই যদি জয়ের সম্ভাবনা শতকরা প্রায় একশ’ ভাগ থাকে। অনেকেই মনে করেন, সরকার তার সাম্প্রতিক মেয়াদে যেভাবে বিদ্যুৎসহ জনদুর্ভোগের সমস্যাগুলো দূর করেছে, তাতে অতীতের আওয়ামী লীগের বিরুদ্ধে কিছু কিছু নালিশ থাকলেও জনরোষ নেই। দেশ এখন নিু-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত হয়েছে। দেশে উদ্বৃত্ত খাদ্য উৎপাদন হওয়ায় মানুষ খেয়ে-পরে মোটামুটি ভালোই আছে।
তাই যদি হয়, তাহলে এক নির্যাতিত, বাকরুদ্ধ, জেল-জুলুমে বিপর্যস্ত বিএনপি কোন আশায় এমন একটি মধ্যবর্তী নির্বাচনে অংশ নিতে যাবে? দলটি তো এখন রাজনীতি থেকে প্রায় নির্বাসিত। তারা না আছে রাজনীতিতে, না আন্দোলনে। বিএনপির সহিংস আন্দোলন থামাতে গিয়ে সরকার ‘আউট অব দ্য ওয়ে’ সিটি কর্পোরেশন নির্বাচনের তফসিল ঘোষণা করে বিএনপিকে দ্বিধা-দ্বন্দ্বে ফেলে আন্দোলন প্রশমিত করেছিল। বিএনপিও বুঝে না বুঝে সে নির্বাচনে অংশ নিয়ে তিক্ত অভিজ্ঞতা অর্জন করেছিল। সরকার কিন্তু নির্বাচনী রাজনীতির অনেকটা ব্রোকার হিসেবে প্রশ্নমুক্ত থাকেনি।
সেজন্য ঘুরেফিরে আবার সেই একই সংকট, একই প্রশ্ন, একই আলোচনা- একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন। কিন্তু এখানে একটি প্রশ্ন থেকেই যায়। সেটি হচ্ছে, একটি মধ্যবর্তী নির্বাচন হলে সেই নির্বাচনকে পরিচালনা করবে ক্ষমতাসীন সরকার নাকি তত্ত্বাবধায়ক সরকার? কিন্তু অবস্থাদৃষ্টে প্রতীয়মান, আমাদের রাজনৈতক সরকারগুলো এখনও এতটা নৈতিক মান অর্জন করেনি, যার বলে তারা একটি স্বচ্ছ নির্বাচন জাতিকে উপহার দিতে পারবে। এই উপমহাদেশের অনেক মহৎ অর্জনই তো দীর্ঘ পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফল। ভারত বা শ্রীলংকা অনেক কিছুই অর্জন করেছে। তবে অপেক্ষাকৃত প্রশ্নমুক্ত একটি নির্বাচনের জন্য এদেশে এখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারই ভরসা।
এম আবদুল হাফিজ : নিরাপত্তা বিশ্লেষক, কলাম লেখক
পাঠক মন্তব্য
সকল মন্তব্য দেখার জন্য ক্লিক করুন